আমাদের সঙ্গে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের লিড ব্যাঙ্ক অফিসারদের গভীর সখ্যতা ছিল। এর মূল কারন আমরাই দারিদ্র দূরীকরন প্রকল্পের বৃহৎ ঋণ দাতা এবং নিয়মিত ডি.সি.সি. থেকে এস.এল.বি.সি.-র রিপোর্ট রিটার্ন সময়মত পাঠিয়ে থাকি। অনেক সময় লিড ব্যাঙ্ক অফিসারের ঘরে বসে আমরা রিপোর্ট তৈরীর ব্যাপারে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে নানাভাবে সাহায্য করতাম। মনে পড়ছে কোচবিহারের ভবরঞ্জন ব্যানার্জীর কথা। এমনিতে জনপ্রিয় মানুষ কিন্তু ভীষন একগুঁয়ে। রিজিওনাল ম্যানেজারের সঙ্গে তার নিত্যদিন ঝামেলা।
আমি তখন কোচবিহার স্টেশন রোডে একটা ছোট বাসায় ভাড়া থাকতাম। শ্রীহরি ছিল আমার গার্জিয়ান। সে সময় সবারই কাজের খুব চাপ। মাঝে মাঝেই ভবদা ব্লকের বি.এল.বি.সি মিটিঙে প্রায় জোর করে নিয়ে যেতেন। কোনদিন হয়ত তিনি বাইরে থেকে রাতে ফিরে সোজা আমার বাসায়। রাস্তা থেকেই বাসার মালকিনকে হাঁক পেড়ে বলতেন “বৌদি আসলাম, একটু মুড়িমাখা আর চা-টা হবে তো”? আমি ওদের ঘরে ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা দেখতে যেতাম, তাছাড়া সাধারণত কোন সাহায্য নিতাম না। ভবদার হাঁকডাকে আমি লজ্জাই পেতাম। মাঝে মধ্যে ভবদা সিঙ্গারা চপ আনতেন। আড্ডা মারতে মারতে বেশী রাত হলে দুজনে আমার একার খাবার ভাগ করে বহুদিন খেয়েছি।
তখন প্রজেক্ট ডিরেক্টর ডি.আর.ডি.সি. ছিলেন কর সাহেব আর ডিএম ছিলেন বি.এল.মিনা আই.এ.এস.। দুজনেই আমাদের কাছের লোক। একবার কর সাহেব কোন কারনে একটু কটু মন্তব্য করেছিলেন ভবদাকে। আর যায় কোথায়, ভবদা সোজা ডিএম কে নালিশ। ডিএম একদিন তার চেম্বারে ওদের দুজন এবং আমাকে ডেকে বসিয়ে মিটমাট করার চেষ্টা করলেন। উনার সেদিন তুফানগঞ্জ এসডিও অফিস ভিজিট করার কথা। বেরিয়ে যাবার সময় আমার উদ্দেশে বললেন “তোমাকে আজকেই মিটমাট করতে হবে, না হলে লাকড়ি দিয়ে দুজনের মাথা ফাটিয়ে দেবে”। আমি উপায় না দেখে একবার ভবদার পা ধরি একবার কর সাহেবের পা ধরি।
ওরা দুজনেই ভাল মানুষ জানতাম মিটমাট হবেই। ডিএম-এর চেম্বারের বাইরে যে কর্মীটি থাকতেন তার বাড়ি যাওয়া আটকে গিয়েছিল। অবশেষে দুজন হাত মেলালেন। কোচবিহার হোটেলের পাশে একটা বড় মিষ্টির দোকানে সেদিন ভবদার ঘাড় ভেঙ্গে প্রচুর মিষ্টি খাওয়া হয়েছিল। ব্যাপারটা অমল ব্যানার্জী তদানিন্তন চেয়ারম্যান সাহেব জানতেন। উনি বেশ মজা পেয়েছিলেন।
কোচবিহারে একজন এ.ডি.এম ছিলেন তরুণ এবং প্রাণশক্তিতে ভরপুর। চ্যাংড়াবান্দা থেকে ডিআইসি-র একটি প্রকল্পের আবেদনকারী একজন অভিযোগ করেছিল ”ব্যাঙ্ক তাকে ঋণ না দিয়ে ঘোরাচ্ছে”। এ.ডি.এম সাহেব ভবদাকে তদন্ত করে রিপোর্ট দিতে বলেছিলেন। ভবদা চ্যাংড়াবান্দা গিয়ে ব্যাঙ্ক ও বেনিফিসিয়ারী দুজনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। স্থানীয়ভাবে খৌঁজখবর করেছিলেন এবং ব্যাঙ্কের পক্ষেই রিপোর্ট দিয়ছিলেন। ঠিক তার কিছুদিন আগেই আমি কোচবিহার থেকে জলপাইগুড়ি বদলি হয়েছিলাম।
পরে একদিন ভবদা এ.ডি.এম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। দু-একটা কথার পর এ.ডি.এম নাকি অকারনে ভবদাকে বলেছিলেন “গেট লস্ট”। ভবদা কড়া প্রতিবাদ করলেন, বললেন “আমি সরকারী কাজে আপনার কাছে এসেছি আমাকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারেন না”। এ.ডি.এম. সাহেব সিকিউরিটিকে ডেকে ভবদাকে আটকে রাখতে বললেন। ব্যাস, খবর ঝড়ের গতিতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল।
ব্যাঙ্কের লোকজন বিশেষত গ্রামীন ব্যাঙ্কের কর্মীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। এস. এল.বি.সি –তে তখন ডঃ মানব সেন, কনভেনর তিনিও রাজ্য সরকারের কাছে প্রতিবাদ পাঠালেন। ব্যাঙ্ক কাজকর্ম প্রায় বন্ধ হওয়ার মুখে। সে সময় ডিএম মীনা সাহেব অমল ব্যানার্জীকে অনুরোধ করেছিলেন আমাকে কোচবিহারে কিছু দিনের জন্য আনতে। অবশেষে এ.ডি.এম সাহেব বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় কুড়ি বছর পর মীনা সাহেব জলপাইগুড়িতে কমিশনার হয়ে এসেছিলেন। দেখা হয়েছিল, পুরনো দিনের অনেক কথা তার স্মরনে আছে হৃদয়ের উষ্ণতাও ম্লান হয়নি।
সে সময় দুজন জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক থেকে ডেপুটেড। প্রণব কুমার ঘোষাল ছিলেন জিএম অ্যাডমিন এবং এস.এল,দাগা ছিলেন জিএম অডিট এন্ড ভিজিলেন্স। তখন ইউনিয়নের দাপটে ওরা ম্রিয়মান ও সদা তটস্থ। আমাদের কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল ওদের। অনেকে বলে আমি নাকি দাগা সাহেবকে নিয়ে প্যারোডি করেছিলাম “এক থা সাহাব দাগা, ছুটি লেকে ভাগা”। ওটা আমাদের জুনিয়ারদের অবদান। ওরা দুজনেই খুব নরম মনের লোক। ঘোষালদা যেন কলম খুলেই বসে থাকতেন আমাদের তৈরী কাগজ দেখালেই সই করে দিতেন।
একদিন অফিসের কাজে খুব সকালে শিলিগুড়ি গিয়েছিলাম। ফিরে আসতেই খবর পেলাম সেদিন নাকি অফিসে কান্তিময় দত্ত ইউনিয়নের হয়ে বদলির ইসুতে ঘোষালদাকে খুব চাপ দিয়েছিল। চেয়ারম্যান সাহেবও ছুটিতে বাইরে। এক নাগাড়ে অমন ভয়ানক চাপ সহ্য করতে করতে পারলেন না। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন ঘোষালদা। রক্তচাপ বেড়ে গিয়েছিল। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। ঘোষালদা এআইবিইএ ইউনিয়নের সমর্থক ছিলেন। সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ও গ্রামীন ব্যাঙ্কের যারা এআইবিইএ-এর সমর্থক সবাই হাসপাতালে হাজির। আমি শিলিগুড়ি থেকে ফিরেই হাসপাতালে। সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের রিজিওনাল অফিসে গ্রামীন উন্নয়ন দপ্তরে একজন অফিসার ছিল কান্তিদের ইউনিয়নের কাছের লোক। আমাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব ভাল ছিল। হাসপাতালেই একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলেছিল “ওরা কাজটা ঠিক করেনি। তোমরা দেখো যেন থানা পুলিশ না হয়”। কয়েকদিন পর কান্তি আমাকে একান্তে বলেছিল “ আমি উনাকে টাচও করিনি। জিএম স্যার অজ্ঞানের অ্যাক্টিং করেছিল”। সত্যি মিথ্যা ঈশ্বর জানেন।
ঘোযালদা তাড়াতাড়ি ছাড়া পেয়েছিল। এমনিতেই ঘোষালদার ভাড়াবাড়ি ছিল আমাদের একটা আড্ডাখানা। উনি মদন মোহন মন্দিরের কাছে ডক্টরস লেনে একটা বাড়িতে থাকতেন। উনার বাড়িতে ভালমন্দ কিছু খাবার তৈরী হলেই আমাদের ডাক পড়ত। ভাস্কর, দেবাশীষ ও আমি বর্ষায় উনার বাড়িতে খিচুড়ি খেয়েছি অনেকদিন। বৌদি নানা দেবদেবীর পূজা করতেন আর আমরা প্রসাদ সেবন করতাম।
১৯৯০ সনে আমাদের বেতন কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের কর্মচারীর সঙ্গে সমান করা হবে তার ঘোষনা ট্রাইবুনাল করেছিল। সরকার সার্কুলার করেছিল বছর পেরিয়ে যাবার পর। ইতিমধ্যে রাজ্য সরকার ১৯৯০ সনে নতুন বেতন কাঠামো “রোপা ১৯৯০“ চালু করেছিল। চেয়ারম্যান সাহেব অমল ব্যানার্জী ছুটিতে ছিলেন, আমরা ‘পে রিভিশন’-এর সার্কুলার তৈরী করে ঘোষালদাকে দিয়ে সই করে সব ব্রাঞ্চে পাঠিয়ে দিলাম। ঘোষালদা শুধু দেখেছিলেন সার্কুলারে দেবাশীষ, ভাস্কর আর পিএনসি-র সই আছে কিনা। আমরা জানতাম বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া ওই সার্কুলার জারি করা যায় না। অমল ব্যানার্জী ছুটি থেকে ফিরে দারুণ অসন্তোষ ব্যক্ত করেছিলেন। আমরা জানতাম ব্যানার্জী সাহেব অবশেষে আমাদের রক্ষাই করবেন। ঘোষালদার সঙ্গে পরেও বহুদিন যোগাযোগ ছিল। মাঝে মাঝে বাড়িতে ফোন করতেন, সবার খোঁজ করতেন। অমন ভাল মানুষটা অকালে পরপারে চলে গিয়েছিলেন।
অন্য একদিন অমল ব্যানার্জী সাহেব ও আমি ব্রাঞ্চ ভিজিটে গিয়েছিলাম। বিকেলে কোচবিহারে ফিরে শুনি কোচবিহার ব্রাঞ্চে গোল্ড লোনের ব্যাপারে একটা ঝামেলা তৈরী হয়েছে। দিবাকর চক্রবর্তী ম্যানেজার ও গোপাল বন্ধু ভট্টাচার্য অফিসার অফিসে আটকে পড়েছেন। ব্যানার্জী সাহেবকে বলেছিলাম “আপনি বাড়ি থাকুন। আমরা সামলাতে না পারলে আপনাকে ডাকব”। তখন অফিস ছুটি হয়ে গেছে তাও বেশ কয়েকজন বাইরের মানুষ উপস্থিত। অভিযোগকারী জানালেন “আমরা ঋণ শোধ করে গয়না ফেরত নিতে এসেছিলাম। কাগজ পত্রে সই করে, আমরা গয়নার প্যাকেট ফেরত নিই। খুলে দেখি ওগুলো আমাদের গয়না নয়”।
আমরা বললাম “আপনাদের উপস্থিতিতে গয়নার পিউরিটি দেখা হয় এবং ওজন করেছিলেন একজন স্বর্ণশিল্পী যাকে বলা হয় টেষ্টার কাম অ্যাসেসর (TCA)। তারপর ওই TCA প্যাকেটটি গালা দিয়ে সিল করে। আপনার ও আমাদের উভয়পক্ষের সিল করার পূর্ণ অধিকার ছিল। খোলার কথা TCA, ব্যাঙ্ক ও ঋণ গ্রহিতার সামনে। TCA –কে পাওয়া যাচ্ছে না সেটাও আপনাকে বলা হয়েছে। তবুও আপনারা সই করে বলেছেন প্যাকেটটি আপনার এবং সিল ঠিক আছে। প্যাকেট নিজের হাতে খুলে বলছেন ওগুলো আপনাদের গয়না নয়?” সে সময়ের কোচবিহারের কংগ্রেস নেতা শ্যামল চৌধুরী এসেছিলেন। উনি আমাদের যুক্তি গ্রহন করে বলেছিলেন “এটাতো পুলিশকে জানানো দরকার”। এমন যুক্তিবাদি নেতা এখন কোথায়?
পুলিশ এসেছিল শুধুমাত্র। একটা নতুন প্যাকেটে গয়নেগুলো ভরা হলো। ওরা লিখে দিয়েছিল স্বেচ্ছায় ও নিজ দায়িত্বে তারা গয়নাগুলো ব্যাঙ্কের সেফ কাস্টডিতে রেখে গেল। রাতেই দিবাকরকে নিয়ে থানায় গিয়েছিলাম। ছেলেটি আমাকে ভরসা করত কিন্তু সেদিন ও খুব নার্ভাস হয়ে পড়েছিল। গোপাল কিন্তু ছিল একেবারেই নিরুত্তাপ। ওসির সঙ্গে কথা বলে ঘটনাটি জানিয়ে একটা এফআইআর থানায় জমা করা হয়েছিল। রাতে চেয়ারম্যান সাহেবকে বিশদে জানানো হয়েছিল। উনি পরদিন সকালে এসপি-র সঙ্গে দেখা করতে বলেছিলেন।
সকালেই এসপি-র সঙ্গে দেখা করেছিলাম। উনি বললেন “আমি ১১ টায় আপনাদের ব্রাঞ্চে যাব। আপনি ব্রাঞ্চ অফিসিয়ালদের সবাইকে থাকতে বলবেন আর আপনিও থাকবেন”। এসে দেখি ওসি ও অন্য একজন পুলিশ অফিসার কাগজপত্র দেখছিলেন। মাঝে মাঝে দু-একটা অনভিপ্রেত মন্তব্য করছিলেন। এসপি এসে প্রথমে গোল্ড লোনের নিয়মকানুন বুঝে নিয়েছিলেন। তারপর আগের দিন ঘটে যাওয়া ঘটনাটি বিস্তারিত শুনলেন। ঋণগ্রহিতাকে ডাকা হয়েছিল, এসপি সাহেব উনাকে বললেন “আপনার কাজেও অনেক ভুল আছে। মনে হচ্ছে আপনি ব্যাঙ্কের অফিসার অ্যারেষ্ট হোক সেটা চাইছেন। নিজের দোষটাও দেখুন “। ওরা গয়না ও কাগজপত্র সিজ করে সেগুলো ব্যাঙ্কের হেফাজতেই রাখতে দিয়েছিল। TCA আর কোচবিহারে আর কোনদিন ফিরে আসেনি। যতদূর মনে আছে দিবাকরকে অগ্রিম জামিন নিতে হয়েছিল।
পুলিশ কোর্টে আইপিসির বিভিন্ন ধারায় চার্জসীট দিয়েছিল। কেস চলেছিল প্রায় দশ বছর। আমি কেসটিতে সরকার পক্ষের মূল সাক্ষী। মাননীয় বিচারক মিঃ জানার কোর্টে টানা সাক্ষী হয়েছিল। বিচারক আমার বক্তব্য শুনে কোর্টেই বললেন “যা বলছেন সব ঠিক তো? নইলে কিন্তু বিপদে পড়বেন”। যাইহোক দিবাকর ও গোপাল উভয়েই বেকসুর খালাস পেয়েছিল। যে দীর্ঘ সময় কেস চলেছিল ততদিন দিবাকর কিন্তু চরম অশান্তির মধ্যেই কাটিয়েছে। দিবাকর এখন সুখে অবসর জীবন যাপন করছে।
মনোজ চক্রবর্তী যখন খড়িবাড়ী শাখার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সে সময় একটি ছেলে ছিল ক্যাশিয়ার। কাজ কর্মে তৎপর ছিল এবং দ্রুততার সঙ্গে কাজ করত। নানা কায়দায় সে ফ্রড করে চলছিল। কিন্তু ব্যাঙ্কে যেভাবে কাজ হয় ফ্রড করল ধরা পড়তেই হবে। ব্রাঞ্চে একবার আগুন লেগে কাগজপত্রের কিছু ক্ষতি হয়েছিল। তদন্ত করতে গিয়ে “কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়ল”। ক্যাশিয়ার ছেলেটি সাসপেন্ড হয়েছিল। ব্যাঙ্ক সিবিআই-কে তদন্ত ভার দিয়েছিল। মনোজ বদলি হয়ে এরিয়া অফিস জলপাইগুড়িতে পোস্টিং পেয়েছিল। সিবিআই মাঝে মাঝেই মনোজকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করেছিল।
একদিন বিকেলে আমার মাধ্যমে মনোজকে পরদিন ওদের শিলিগুড়ি অফিসে ডেকে পাঠাল। ওইদিন আবার আমার কোচবিহারে মিটিং ছিল। মিটিঙের মধ্যেই জলপাইগুড়ি থেকে ফোনে জানাল মনোজকে সিবিআই গ্রেপ্তার করেছে। আমি রজত দাসকে বলেছিলাম মনোজের স্ত্রী ও শিশু দুই কন্যাকে আমার আনন্দ পাড়ার বাড়িতে পৌঁছে দিতে। না হলে মা আর দুই কন্যা অসহায় বোধ করবে। এসব কেসে জামিন সাধারণত তৎক্ষণাৎ দেয়া হয় না। মনোজের পরিবার আমাদের আত্মীয় মনে করত। মনোজ এমনিতে আমার কাছের মানুষ আর পরিশ্রমী কর্মী তার প্রতি এমন কঠোর আচরন পছন্দ করিনি। যাকে ডাকলেই পাওয়া যাবে তাকে গ্রেপ্তারের মধ্যে কোনও কৃতিত্ব আছে কি? জামিনের জন্য একটা শংসাপত্র দিতে গিয়ে আমি নানা বিশেষণ প্রয়োগ করেছিলাম। সিবিআই এর আগরওয়াল সাহেব ফোনে বলেছিলেন “তা হলে কি আমরা ভুল লোককে গ্রেপ্তার করেছি?”। আমার যতদূর মনে আছে আমি বলেছিলাম “ঠিক তাই”।
মনোজের কেসটি কুড়ি বছর ধরে কোর্টে চলছে তো চলছেই। ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারীতে ওর বিরুদ্ধে আপাত গ্রাহ্য কোন অপরাধ প্রমাণ হয়নি। ব্যাঙ্ক সাসপেনসন তুলে নিয়েছিল কিন্তু কোর্টের দরজায় তার দীর্ঘ দিন চক্কর কাটা চলেছিল। মনোজের সততা সম্বন্ধে কারও কোন সন্দেহ ছিল বলে জানি না।
আর এক ম্যানেজারবাবুর কথা হঠাৎ করে মনে এলো। ছেলেটি যথেষ্ট ডিগ্রীধারী কিন্তু প্রকৃত শিক্ষার অভাব ছিল। প্রচন্ড বদমেজাজী, এ নিয়ে টুকটাক অভিযোগ লেগেই থাকত। বিয়ের পর থেকেই, পান থেকে চুন খসলেই নাকি স্ত্রীর উপর হম্বিতম্বি করত। মাঝে মধ্যে স্ত্রীর গায়ে নাকি হাতও ওঠাত। একদিন রাতে কথা কাটাকাটি শুরু হয়েছি কি হয়নি প্রচন্ড মার শুরু করেছিল ছেলেটি। রক্তপাতও নাকি হয়েছিল। তরুণী মেয়েটি রাতেই হাসপাতালে দেখিয়ে সোজা থানায় অভিযোগ জমা করেছিল।
ম্যানেজারবাবু গ্রেপ্তার হয়েছিল। ওর বাবা ছিল নির্ভেজাল ভাল মানুষ। যতদূর মনে পড়ে ওর তিনিও নাস্তানাবুদ হয়েছিলেন। নানা কায়দা করে তার সাসপেনসন বাঁচানো হয়েছিল। ফৌজদারী কেস হয়েছিল মহামান্য বিচারক বলেছিলেন “আসামী তার স্ত্রীর দিকে চোখ বড় করে তাকাতেও পারবে না”। সময়ের অমোঘ নিয়মে ওরা মিলিত হয়েছিল। পরে তাদের পরিবারে সন্তান এসেছিল, তারও বিয়ে হয়েছে।
আর একজন সহকর্মীর বাড়ি ছিল কোচবিহার জেলায়। সুদর্শন, ভদ্র ব্যবহার। জলপাইগুড়িতে বদলি হয়ে এসেছিল। বিয়ে হয়েছিল এক স্থানীয় মেয়ের সঙ্গে। একটা ভাড়া বাড়িতে থাকত। ওদের ফুটফুটে ছেলেটা প্রি-প্রাইমারী ক্লাসে পড়ছিল। শিশুটিকে পড়াতে বসে একদিন দুজনের ঠোকাঠুকি বড় আকার নিয়েছিল। ছেলেটি রাগবশত মেরেছিল স্ত্রীকে। আমরা কেউ মহিলার গায়ে হাত দেওয়া নিশ্চয় পছন্দ করিনা। মেয়েটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। শুনলাম পুলিশ কেস হবে। আমার সহকর্মীরা অনুরোধ করেছিল হাসপাতালে গিয়ে মেয়েটিকে বোঝাতে। কথা শুরু করতেই সে একেবারে ফোঁস করে উঠেছিল, বলেছিল “একটা অসভ্য লোকের পক্ষে কথা বলতে এসেছেন। আপনার সঙ্গে আমি কোনও কথা বলব না”।
অনেক চেষ্টায় ছেলেটি জামিন পেয়েছিল। মেয়েটি পুত্রসহ বাপের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিল। ওদের ঝামেলার মীমাংসা হয়নি। ছেলেটি বড় হচ্ছিল, বাবাকে সে পাশে পেল না। আমার সহকর্মীটি কোচবিহারে বদলি হয়ে গিয়েছিল। পুত্রের সঙ্গ লোভে ওর মাথায় হাত রাখতে চেয়ে সে কোচবিহার থেকে সকালে রওনা হয়ে এসে স্কুলের উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকত। কখনও স্কুলের সামনে, পথের এক প্রান্তে ওর মা অন্য প্রান্তে বাবা। মা ছেলের হাত ধরে গটগট করে চলে যেত। হতাশায় বিদ্ধ রিক্ত বাবা ফিরে যেত কোচবিহারে। মেয়েটিকে দূর থেকে শহরের পথে দেখেছি বহুবার, এগিয়ে গিয়ে কথা বলব সে সাহস ছিল না। ছেলেটি এখন সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ যুবক। বধূটি কেমন আছে জানি না। তবে আমার অবসরপ্রাপ্ত সহকর্মীটি শারীরিক বা মানসিক কোনও দিক দিয়ে ভাল নেই। একা, একেবারে একা একটা বাড়িতে থাকে আর ভাবে জীবনটা কী হতে পারত আর কী হলো।
(ক্রমশ)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team