রামায়ণের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র শান্তা। কৃত্তিবাসী রামায়ণে শান্তাকে রাজা দশরথ ও কৌশল্যার প্রথম সন্তান হিসেবে দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে বাল্মিকী রামায়ণে একথা কোথাও বলা নেই যে শান্তা রাজা দশরথের কন্যা, সম্পর্কে রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্নের বোন।
কৃত্তিবাসী রামায়ণ ধরে এগোলে অঙ্গরাজ লোমপাদ ও বর্ষিণীর কোনো সন্তান না থাকায় বন্ধু দশরথ তাঁর কন্যাকে অঙ্গরাজের কাছে দত্তক দেন। অঙ্গরাজ যেমন দশরথের বন্ধু ছিলেন তেমনই রাজমহিষী কৌশল্যার বোন ছিলেন অঙ্গরাজপত্নী বর্ষিণী। বাল্মিকীর রামায়ণে আবার সরাসরি শান্তাকে লোমপাদ ও বর্ষিণীর কন্যারূপেই বর্ণনা করা হয়েছে। সুতরাং শান্তার জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন বিতর্ক রয়েই গিয়েছে।
পরবর্তীকালে শান্তা ঋষি বিভান্ডক ও অপ্সরা ঊর্বশীর পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ঋষ্যশৃঙ্গের মাথায় দুটো ছোট শিং ছিল। মাতা স্বর্গে চলে যাওয়ার পর তিনি তাঁর পিতার স্নেহ ও যত্নেই পালিত হন এবং কোনোদিন নারীসঙ্গ লাভ করেননি।
অঙ্গরাজ্য একবার ভয়ঙ্কর খরার কবলে পড়ে। অনাবৃষ্টির ফলে দূরদূরান্তে সবুজের দেখাও মিলত না কোথাও। প্রজারা অনাহারে মরতে বসে। সেসময় গুজব ওঠে অঙ্গরাজ লোমপাদ কন্যা শান্তাকে ঋতুমতি হলেও বিবাহ দেননি, সেই পাপে রাজ্যের এই হাল। একথা জেনে শান্তা খুব কষ্ট পান। তিনি পিতাকে কথা দেন রাজ্যের মঙ্গলের জন্য তিনি সবরকম ত্যাগ করতে প্রস্তুত। লোমপাদ তখন মন্ত্রীদের কথা শুনে কন্যাকে ঋষ্যশৃঙ্গকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন এবং জানান তাঁর মাথায় ছোট দুটি শিং আছে। পিতার অনুরোধে ঋষ্যশৃঙ্গকে না দেখেই বিবাহ করতে রাজি হন শান্তা। কারণ রাজা লোমপাদের মতো শান্তাও বুঝতে পারেন যে বিভান্ডকপুত্রই এই রাজ্যের ত্রাণ করবেন, এমনই তাঁর ক্ষমতা। ঋষ্যশৃঙ্গ এতদিন অগ্নি পরিচর্যা ও পিতার সেবায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করেছিলেন। তাছাড়া তাঁর পিতার থেকে তাঁকে আনাও খুব কঠিন কাজ ছিল।
রাজা লোমপাদ মন্ত্রী অমর্ত্যদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করলেন যে কোনো বারাঙ্গনাই পারে ঋষ্যশৃঙ্গকে ওই তপোবন থেকে বের করে আনতে। জীবনে নারীসঙ্গ লাভ না করা ঋষ্যশৃঙ্গ বারাঙ্গনাদের প্ররোচনায় তপোবন থেকে বের হন, এবং লোমপাদের অঙ্গরাজ্যে এসে উপস্থিত হন। রাজ্যে প্রবেশমাত্র প্রবল ধারাবর্ষণে চারিদিক শস্যশ্যামলা হল। শান্তাও পিতার আদেশে হাসিমুখে ঋষ্যশৃঙ্গকে বিবাহ করলেন।
পুরাণে শান্তার শুধু এতটুকু গুরুত্বই ছিল না। রামায়ণ রচনার নেপথ্যেও শান্তা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। রাজা দশরথ ছিলেন পুত্রহীন। বহু তপস্যা, যজ্ঞ করার পরও কৌশল্যা, কৈকেয়ী বা সুমিত্রার গর্ভে সন্তান আসছিল না। তখন দশরথের মন্ত্রী সুমন্ত্র রাজাকে ঋষ্যশৃঙ্গের কথা জানান। প্রবল ক্ষমতাশালী এই ঋষি যদি অযোধ্যায় আসেন তবেই পুত্রলাভ সম্ভব।
রাজা দশরথ এই কথা শুনে ঋষি বশিষ্ঠকে সব কথা জানালেন এবং তাঁর অনুমতি নিয়ে বন্ধু লোমপাদকে বললেন যে পুত্রকামনায় তিনি যে যজ্ঞ করছেন তাতে যদি লোমপাদ কন্যা শান্তা ও জামাতা ঋষ্যশৃঙ্গ অযোধ্যায় আসেন তবে তিনি খুব খুশি হবেন। লোমপাদ রাজী তো হলেনই এবং সেই সঙ্গে কন্যা ও জামাতাকে অনুরোধ করলেন অযোধ্যায় যাওয়ার জন্য। মহাসমারোহে অযোধ্যায় শান্তা ও ঋষ্যশৃঙ্গকে স্বাগত জানানো হল। ঋষ্যশৃঙ্গকে পেয়ে অযোধ্যাবাসী যেমন খুশি হলেন, রাজার অন্তঃপুরবাসিনীরাও খুবই খুশি হলেন বিশালাক্ষী শান্তাকে পেয়ে। এরপর মহাসমারোহে অশ্বমেধ যজ্ঞের সমস্ত নিয়ম পালিত হলে নির্দিষ্ট নিয়ম ও সময়ে রাজা দশরথের চারটি সন্তান হল, যারা রাম, লক্ষ্মণ, ভরত ও শত্রুঘ্ন নামে পরিচিত।
খুব সাধারণ নারী হলেও পুরাণে তাই শান্তাকে একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। রূপে কিম্বা গুণে তিনি এমন কোনো অসামান্যা ছিলেন না। কিন্তু রাজ্য রক্ষার্থে শুধুমাত্র পিতার সম্মানের জন্য তিনি শিং-বিশিষ্ট এমন একজনকে স্বামী হিসেবে মন থেকেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন যাঁকে তিনি কখনো চোখেও দেখেননি, তাঁর নামও শোনেননি। তাই তাঁর এই ত্যাগ পুরাণের পাতায় আজও জ্বলজ্বল করে, অন্যান্য মহিয়সী নারীদের কাছে তাঁর দ্যুতি এতটুকু ম্লান হয় না।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team