এবার শীতকালে খুব জাড় পড়েছে। জাড় পড়লে আর কিছু না হোক খেজুরগাছে রসের বাণ আসে। নালি দিয়ে পোড়া ভাঁড় জিরেন রসে যেমন ভরে যায়, তেমনি ঝরা, তে-ঝরা রসেও ভাঁড় ভর্তি হয়ে যায়। ভর্তি হয়ে নিচে চুঁইয়ে পড়ে।
হামজা এবার একটাও রোজা রাখতে পারেনি। আজ ঈদের দিন। গতকাল ছিল রোজা গিয়ে চাঁদরাত। জামরুল গাছের উপরে চিকন চাঁদটা উঠলেও হামজার ঠোঁটের কোণায় হাঁসি ছিল না। প্রশান্তবাবুর দোকান থেকে শাড়ি আনতে হবে, ঈদের বাজার করতে হবে। খোদেজা, হামজার ন-বছরের মেয়ে, গতকাল থেকেই ওর আশে-পাশে ঘুর ঘুর করছিল। হামজা এমন ভাব দেখাচ্ছিল যেন ও কিছুই বুঝতে পারেনি। শিউলিকে গতকাল বলেছিল গাছ না-কাটতে। কাল ঈদের দিন, সকাল সকাল কে রস জাল দেবে, কে গুড় তৈরি করবে? তাছাড়া ঈদের দিনে সকালে কে পাটালি কিনতে আসবে!
হামজার কথা শুনে শিউলি বলেছিল, তোমার দিক থেকে ভাবলে ঠিকই ভাবছো। কিন্তু এটা ভেবে দ্যাখো ঈদের দিনের সকালে একটা ঝটকা বাজার বসে। যারা আগে থেকে কিনতে পারে না, টাকা জোগাড় করে উঠতে পারেনি, তারা ধার-দেনা করে আসে। বা ধর শেষ মুহূর্তে যারা মজুরির টাকা হাতে পেল, তারাই আসে।
হামজা শিউলির কথাগুলোকে খুব একটা অস্বীকার করতে পারেনি। কেননা ওর নিজেরই এখনো কিছু কেনা হয়নি বউ-বাচ্চাদের জন্য। তাছাড়া কাল রবিবার, হাটবার। হাটের একটা ভিড় থাকবেই। গেল হাটে সাথে মেয়ে খোদেজা গেছিল পাটালি বিক্রি করতে। সারা সপ্তাহের জমানো রস দিয়ে আটটার মতো পাটালি হয়েছিল, কেজি চারেক হবে। হামজার পাটালিতে খুব একটা চিনি মেশানো থাকে না। ভেজাল যে দেবে, তার উপায় নেই। চিনির দাম পঞ্চাশ টাকা কিলো। আর খেজুরগাছ যে ইজারা নেবে, তার টাকা কই। ব্যালক হবার সময় তিন ভায়ের মধ্যে ভিটেবাড়ি ভাগ করে হামজা তিনটে খেজুর গাছ পেয়েছিল। ভাইদের সাথে গুড়-চুক্তিতে গাছ নিলেও নটা গাছে আর কতটুকু রস হবে। হামজা নিয়ে যাবে না, কিন্তু খোদেজার একই বায়না, না, সে যাবেই। স্কুল বন্ধ আজ টানা দুবছর, মামার বাড়িও গেছিল ছ মাস আগে। এতদিন একা একা বাড়িতে থাকতে কারইবা ভালো লাগে। হামজা মেয়ের জেদ উপেক্ষা করতে পারেনি।
গুড় বিক্রি করে পঞ্চাশ গ্রাম খেজুর, আড়াইশো ছোলা, গাবা আপেল পাঁচশো আর হপ্তার চাল ডাল আনাজ বাজার করে দুশো টাকার মতো পড়ে ছিল। হামজা ভেবেছিল, পরের দিন জন খাটতে যাবে না। ওদিন রোজা রাখবে। রোজা রেখে জন খাটতে গেলে কাজে ফাঁকি পড়ে, বেশি খাটা যায় না। না-খেটে পয়সা নেওয়া হারাম। হামজা হারামের কামাই নিজেও খাবে না, বাল-বাচ্চাকেও খাওয়াবে না।
খোদেজার হাতে আপেলের প্লাসটিকটা দিয়ে বলেছিল, চল।
খোদেজা বলেছিল, আব্বা আমার ঈদের জামা জুতো কিনে দেবে না?
হামজা বলেছিল, হবে রে মা। ঈদের এখনো হপ্তা-খানেক বাকি।
হামজা জানে এরপর খোদেজা আর কোনো কথাই বলবে না। না-বলার কারণও হামজা জানে। মেয়েটা এক্কেবারে মায়ের ধাত পেয়েছে। হাজার কষ্ট পাবে কিন্তু মুখে কোনো রা নেই।
সেদিন রাতে খোদেজা ঘুমিয়ে গেলে হামজার কাছে এসেছিল খোদের মা। একটাই ঘর, খোলার ছাওনি, বেড়ার গাঁথনি দেওয়া। হামজাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ঈদ আসছে।
হামজা খোদেজার মাকে বাকি কথা শেষ না-করতে দিয়েই বলেছিল, এবার তোমাকে একটা মলমলের শাড়ি কিনে দেবো।
খোদেজার মা বলেছিল, ঘরের বাঁদিকের বেড়াটা পাল্টাতে হবে, ঘুন লেগে গেছে। সেবারে, বাঁদরের উৎপাতে আট দশটা খোলা ভেঙে গেছিল। ওগুলো পাল্টাতে হবে। ঈদের দিনে পাড়া পড়শি আসবে, এবার একটু লাচ্চা সেমাই ছাড়া মাংসের ঘুগনি আর পরোটা করব। খোদেজাও কত দিন ধরে খেতে চাইছে। শাড়ি পরে হবেখন।
সে হপ্তাতেও রোজা রাখতে পারেনি হামজা। বড়োভার জন খেটে ঘরামি দিয়ে ফুলকাটা বাঁশের বেড়া বুনিয়েছিল। চালের খোলা পাল্টে ছিল।
হামজার মনে ক্ষেদ নেই আল্লার প্রতি। ওকে জমি-জমা দেয়নি, হাতি ঘোড়া দেয়নি, কিন্তু খাটার মতো তাগড়াই শরীরটা দিয়েছে। খোদেজার মাকে দিয়েছে, খোদেজাকেও দিয়েছে, হামজা সব ঠিক করে নিতে পারবে।
শান্তি বস্ত্রালয় পেরোবার সময়, হামজা ঠিকই করে নিয়েছিল, আজ দেখে যাবে, দরদাম করে যাবে। পরের হাটে কাজ করার জমানো টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে যাবে। পাটালি বিক্রি করার সময় বড়োভার ফোন এসেছিল হামজার চায়না মোবাইলে, চার দিনের একটা ফুরোন কাজ আছে। হাজার দেড়েক পাওয়া যাবে। ও টাকাতে সে হাত দেবে না। বাকি দিনের কাজের টাকা দিয়ে সংসার খরচ চালাবে।
হামজা খোদেজাকে নিয়ে শান্তি বস্ত্রালয়ে ঢুকেছিল। খুব ভিড়। মানুষের হাতে এত টাকা! সবাই কত কত জামা কাপড় কিনছে।
প্রশান্তবাবু হামজাকে চেনে। বাজারের পাশেই বাড়ি। হামজা মাঝে মধ্যে ওনার টুকি-টাকি বাগান-কোপানো, নিড়ানোর কাজ করে দেয়। হামজাকে দেখে বলেছিল, কী রে হামজা, কী ব্যাপার। হামজা সব বললে, প্রশান্তবাবু বলেছিল, দ্যাখ, দেখে পছন্দ করে যা, পরের হাটে এসে টাকা দিয়ে নিয়ে যাস। আমি আলাদা করে রাখব।
হামজার মুখের হাসি খোদেজার খুশির থেকে অনেক বেড়ে গেছিল। খোদেজার ভোমরাকাটা লাল ফ্রক আর আসমানি রঙের মলমল শাড়ি মিলিয়ে সতেরশো হয়েছিল। প্রশান্তবাবু বলেছিল, তুই দেড় হাজারই দিস। হামজা একশো টাকা অ্যাডভান্স করে এসেছিল।
দশটায় ঈদের নামাজ। ঈদের ঝটকা বাজারের ভিড় কমছে। সবাই বাড়িমুখো হচ্ছে। কত কাজ - ঈদের সেমাই পায়েস রান্না আছে, নতুন লুঙ্গি সেলাই আছে, পাড়ার লোককে শাড়ি জামা দেখানোর আছে। সকালে প্রশান্তবাবুর দোকানে গিয়ে বড়োভার কাজ করে পাওয়া কড়কড়ে তিনটে গান্ধি নোট দিয়ে একশো টাকা ফেরৎ নিয়ে ফ্রক আর শাড়ি নিয়েছিল। কিন্তু ভোরবেলা উঠে রস ঝেড়ে, জাল দিয়ে গুড় তৈরি করে পেপসির বোতল ভর্তি করে দিয়েছিল খোদেজার মা। তা কেজি দেড়েক হবেই হবে। জিরেন রসের গুড়। তিনশোটাকার কমে কেজিতে নামবে না হামজা।
হামজা বক পাখির মতো বসে আছে। গাঁট থেকে চায়না মোবাইল বের করে দেখে আটটা বেজে গেছে। আর আধঘন্টার মধ্যে বিক্রি করতেই হবে। হাতে একশো টাকা আছে। ওদিয়ে সিমুই, লাচ্চা, লাচ্চার চিনি, গুড়ো দুধ, পাঁচশো মাংস, ঘুগনির বুট হবে না। তাছাড়া খোদেজার মা পই পই করে বলে দিয়েছে, চুল দাড়ি কাটতে।
মানুষের সাড়া না পেয়ে কালো পিঁপড়ে গুড়ের গন্ধে বোতলের চারিদিকে পিলপিল করছে। সাড়ে আটটা বেজেই গেছে। হাটের এদিকটা আরো পাতলা হয়ে গেছে। হামজার মতো দু চারজন হাটুরে বসে আছে। হামজা মনে মনে ভাবে, আর গো ধরে থাকব না। শ খানেক যা হয়, তাই সই। এবার উঠতে হবে। না হলে ঈদের বাজার আর ঈদের নামাজ ধরতে পারবে না। হামজা হাঁক দেয়, দেড় কেজি জিরেন গুড়, দেড়শো। নিয়ে যান - পাবে না, এমন সস্তা কোথাও পাবে না।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team