আগেও লিখেছি আজ কেন্দ্রীয় সরকার ঢক্কানিনাদে বলছেন তারা ভারতবর্ষের প্রায় ৩৫ কোটি পিছিয়ে পড়া দেশবাসীকে আর্থিক সাক্ষরতা (Financial Literacy) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিটি পরিবারে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছেন। “নো ফ্রিল অ্যাকাউন্ট বা জিরো ব্যালান্স অ্যাকাউন্ট অর্থাৎ কোনওরকম প্রাথমিক ডিপোজিট ছাড়াই ব্যাঙ্কে খাতা খোলার ধুম পড়ে গিয়েছিল, প্রকল্পের নাম “প্রধানমন্ত্রী জনধন যোজনা” (PMJDY)। এখানে আংশিক কে-ওয়াই-সি (know your customer) বা কে-ওয়াই-সি ছাড়াই ব্যাঙ্কে খাতা খোলার সুযোগ তৈরি হলো।
আমরা গ্রামীণ ব্যাঙ্ক কর্মীরাও গত শতাব্দির সপ্তম দশকে পাঁচ টাকা ডিপোজিট নিয়ে সারা ভারতবর্ষে কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে তাদের বুঝিয়ে সেভিংস খাতা খুলিয়েছিলাম। একজন অ্যাকাউন্টধারী বা পঞ্চায়েত সদস্যের পরিচয়কারী হিসেবে সই হলেই চলত। আমার ধারনা সেটাও ছিল আর্থিক সাক্ষরতার একটা বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। চিটফান্ডের যখন রমরমা চলছে তখন কিছু ব্যাঙ্ক কর্মচারী ওই দুষ্টচক্রে গ্রাহকদের নাম না লেখানোর জন্য বুঝিয়েছেন। সে সময় সরকার বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক শক্ত হাতে চিট ফান্ড দমনে এগিয়ে আসেনি।
আবার বিচ্ছিন্ন ভাবে কিছু ব্যাঙ্ক কর্মী অবসরের সময়ে প্রাপ্ত সারা জীবনের সঞ্চিত টাকা অতি লোভে চিট ফান্ডে রেখে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। অন্যদিকে কিছু অতি চালাক(?) রিটায়ার্ড কর্মী, চিট ফান্ডের এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। বেশ ভাল টাকা সংগ্রহ করার পর চিট ফান্ডে লাল বাতি জ্বললে পরিচিতদের কাছ থেকে সংগৃহিত টাকা মার যায়। চাকরি জীবনে যারা চূড়ান্ত সততা বজায় রেখেছিলেন তাদের এমন হঠকারিতা পরিতাপের। যদিও এমন উদাহরন অতি নগন্য।
“প্রধানমন্ত্রী জনধন যোজনা” প্রকল্পে আর্থিক সাক্ষরতার সঙ্গে গ্রাহককে সরাসরি অর্থ ট্রানসফার (ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার-DBT), অতিক্ষুদ্র বীমা (ইনসিওরেন্স), ৫০০০ টাকা পর্যন্ত ওভার ড্রাফট, রুপে ডেবিট কার্ড (বিশেষ ATM) এবং অটল পেনসন যোজনা (APY) এরকম নানা স্কীম এক ছাতার তলে এনেছিল।
একজন অ্যাকাউন্টধারী বছরে ১২ টাকা প্রিমিয়াম দিলে এবং তার বয়স ১৮ থেকে ৭০ এর মধ্যে হলে একটি দুর্ঘটনা বীমা করে দেয় ব্যাঙ্ক। অ্যাকাউন্টধারীর দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে অথবা স্থায়ী অক্ষমতা হলে তার নমিনি বীমা কোম্পানি থেকে এককালীন দুই লক্ষ টাকা পেয়ে থাকে। প্রকল্পটির নাম প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বীমা যোজনা ( P.M,S.B.Y.), পলিসি প্রতি বছর রিনিউ করা যায়।
আবার ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়স্ক গ্রাহক প্রধানমন্ত্রী জীবন জ্যোতি বীমা যোজনা (PMJJBY) প্রকল্পে প্রতি বছর ৩৩০ টাকা প্রিমিয়াম দিয়ে বীমার সুবিধা গ্রহন করতে পারেন। বীমাকারীর মৃত্যু হলে নমিনি এককালীন ২ লক্ষ টাকা পাবেন। PMSBY প্রকল্পে শুধুমাত্র দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে বা অঙ্গহানি হলেই নমিনি বীমাকৃত অর্থ পাবেন অন্যদিকে PMJJBY প্রকল্পে যে কোন ভাবে মৃত্যু হলেই নমিনি ২ লক্ষ টাকা পাবেন। একজন গ্রাহকের যদি দুটি প্রকল্পের জন্য বীমা থাকে তবে নমিনি দুটি প্রকল্প থেকেই (২+২)=৪ লক্ষ টাকার বীমারাশি পেতে পারেন। বীমার প্রকল্প দুটি তাৎপর্যপূর্ণ।
অটল পেনসন যোজনায় ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সি গ্রাহক যখন উপার্জন করার ক্ষমতা হারাবেন তখন যেন তার একটা নির্দ্দিষ্ট আয় থাকে, এমন একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এই পেনসন প্রকল্প। অন্যভাবে বলি অসংগঠিত ক্ষেত্রে যারা কর্মরত তাদের ভবিষ্যতের সুরক্ষা “অটল পেনসন যোজনা” (APY)। প্রতিমাসে একটা নির্দ্দিষ্ট পরিমান টাকা পেনসন তহবিলে জমা করলে গ্রাহকের বয়স যখন ৬০ বছর হবে তখন থেকে আমৃত্যু প্রতিমাসে তিনি পেনসন পেতে থাকবেন।
প্রায়শই একটা কথা শোনা যায় “ব্যাঙ্ক জিরো ব্যালেন্সে খাতা খুলতে চায় না এবং বীমার ব্যাপারটা গ্রাহকদের বলেন না”। যদিও অটল পেনসন যোজনায় গ্রাহক বৃদ্ধিতে ব্যাঙ্কের নজর আছে, কারন APY-এর লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয় সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। ইদানিং কালে স্বনির্ভর দলের মহিলা সদস্যরা ব্যাঙ্কে PMSBY ও PMJJBY প্রকল্প দুটির ব্যাপারে খোঁজ করছেন এবং বীমার সুবিধা নিচ্ছেন। এখনও বলব প্রকল্প দুটির প্রগাঢ় প্রচার দরকার।
এখন পাবলিক সেক্টার ব্যাঙ্কগুলো সত্যিকারের ‘মাস’ (mass) ব্যাঙ্কিং করে থাকে। মধ্যবিত্ত মানুষের ব্যাঙ্কে মাসে দু-একবার যেতেই হয়। কাজেই তাদের ব্যাঙ্কিং অপারেশনের খুটিনাটি জানার আগ্রহ বেড়েছে। এই বীমার ক্লেম পাওয়ার পদ্ধতিও খুব সোজা।
এর আগেও আমি বলেছি এই ব্যাঙ্কের আদিলগ্নে কোর্ট কেসের জন্য নিয়োগ প্রক্রিয়া ব্যহত হয়েছিল। যে কারনে ১৯৭৭ এর মার্চ থেকে প্রায় আড়াই বছর ব্যাঙ্কের শাখার বিস্তার হয়নি। ১৯৭৯ এর আগষ্ট থেকে ব্যাঙ্কে নিয়োগ শুরু হল, নতুন নতুন শাখার উদ্বোধন হল, ধীরে ধীরে ব্যবসা বাড়তে থাকল। ১৯৮০ সনে হেড অফিসে একদিন দেখা গেল ব্যাঙ্কের মোট ব্যবসা এককোটি টাকা পার করেছে। আহা সে কী আনন্দ! উদযাপন করতে রসগোল্লা খাওয়া হয়েছিল। ৩১.০৩.২০২১-এ সেই ব্যাঙ্কের ব্যবসা প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা ছুঁতে চলেছে। ডিপোজিট ৩৫১৮.৯১ কোটি টাকা, ঋণ ২৩৭৮.৩৭ কোটি টাকা। নন পারফর্মিং অ্যাসেট (NPA) ২৩৩.৯৯ কোটি টাকা।
হালকা করে NPA-এ ব্যাপারটা বলে না দিলে কিছু পাঠকের প্রতি অবিচার হবে। ব্যাঙ্ক যে ঋণ দেয় তার কিস্তি (সুদ+আসল) যদি নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না আসে তবে ব্যাঙ্কের সেই সম্পদ বা ঋণকে NPA বলা হয়, ওই ঋণের সুদ ব্যাঙ্কের খাতায় জমা হয় না। টার্ম লোন বা মেয়াদি ঋণের কিস্তি ৯০ দিন পার হলে, ক্যাশ ক্রেডিট বা ওভার ড্রাফটে যে লিমিট থাকে সেই সীমা অতিক্রম করে ৯০ দিন পার হলে, কৃষি ঋণের টাকা দুটি “শস্য ঋতু” বাকি থাকলে তাকে NPA বলা হয়ে থাকে। গ্রাহক হিসেবে এটুকু জানাটা জরুরি।
এটা বোঝা দরকার উত্তরবঙ্গ ক্ষেত্রীয় গ্রামীন ব্যাঙ্কের স্বাস্থ্য আর একটু ভাল হতো যদি NPA–এর পরিমান হ্রাস করা সম্ভব হতো। সমস্ত রকম প্রভিশন (ভবিষ্যতে ব্যয় হবে এমন কোনও খাতে অর্থের সংস্থান করে রাখাকে প্রভিশন করা বলা হয়) এমন কি পেনসনের জন্য ৫৭ কোটি টাকার সংস্থান করার পর নেট প্রফিট হয়েছে ২.০০ কোটি টাকা। যেখানে অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক ক্রমাগত লোকসান করে চলেছে সেখানে একটা গ্রামীন ব্যাঙ্ক গত প্রায় দশ বছর এক নাগাড়ে লাভ করে যাওয়াটাও বড় সাফল্য তো বটেই।
পিছিয়ে পড়া উত্তরবঙ্গের উত্তরপ্রান্তের পাঁচটি জেলা যথা কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং ও কালিম্পং ব্যাঙ্কটির ঘোষিত ( notified) কর্মক্ষেত্র। এই জেলাগুলোতে ব্যাঙ্কটির ১৪২ টি শাখা কাজ করছে নানা প্রতিবন্ধকতা সামলে। কোচবিহার ছাড়া উত্তরের আর চারটি জেলার অর্থনীতি একসময় চায়ের উপর নির্ভরশীল ছিল। সমতলে দুটো অর্থকরী ফসল ছিল পাট ও তামাক। বাজারজনিত কারনে তামাকের চাষ এখন নামমাত্র কিছু এলাকায় হয়। পাটের বাজার কৃষকের অনুকুলে ছিলই না।
এখন এই এলাকায় প্রায় দু ডজন চা বাগান হয় বন্ধ নয় ধুঁকছে। স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরেও এই এলাকায় উল্লেখযোগ্য কোন শিল্প গড়ে ওঠেনি। পাহাড়ে লাগাতার আন্দোলনে পর্যটন শিল্পে আঁধার। কোভিডেও সবচেয়ে ক্ষতি হয়েছে পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত মানুযগুলোর। এত প্রতিকুলতার মধ্যে ব্যাঙ্ক চালানো কত কঠিন সেটা ব্যাঙ্ক কর্মীরাই বোঝেন কিন্তু ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের প্রথম সারির করোনা যোদ্ধার স্বীকৃতিটুকুও নেই। সেখানে কিঞ্চিৎ লাভের মহিমাও অনেকটাই ওজনদার।
আমি যখন রিটায়ার করি তখন ব্রাঞ্চের সংখ্যা ছিল ১৩৪ সেটা বেড়ে হয়েছে ১৪২টি। আগে মোট কর্মচারী ছিল ৭৩৯ জন, ব্যবসা বেড়েছে কয়েকগুন কিন্তু কর্মচারীর সংখ্যা কমে হয়েছে ৪৫৫ জন (অফিসার ২৬০ জন ক্লার্ক ১২১ জন, সাব স্টাফ ১৬ জন এবং পার্ট টাইম সাফাই কর্মী ৫৮ জন)। এখন জন প্রতি ব্যবসা ১২.৯৬ কোটি টাকা এবং শাখা প্রতি ব্যবসা ৪১.৫৩ কোটি টাকা। যদিও ব্যাঙ্কের পুরো অপারেশনটাই বর্তমানে কম্পুটার নির্ভর তবুও অচিরেই লোকবল না বাড়লে সম্পূর্ণ ধাঁচাটাই ভেঙ্গে পড়তে পারে।
ম্যান পাওয়ার বাজেটের একটা থিওরি বাতলে দিয়েছিল নাবার্ড। ১৯৮৪-৮৫ থেকেই ইউনিয়নগুলোর দাবিপত্রে ক্রমাগত কর্মী নিয়োগের ব্যাপারে চাপ রাখছিল। সেবার ইউনিয়ন বলেছিল তারা ব্যাঙ্কের বোর্ডের সঙ্গে দেখা করে কর্মী সংখ্যার ব্যাপারে কথা বলবে। একদিন দুপুরে তদানিন্তন চেয়ারম্যান শ্রী অমল ব্যানার্জী আমাকে ও দেবাশীষকে ডেকে বললেন “ম্যান পাওয়ার বাজেট অনেকদিন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের সেন্ট্রাল অফিসের অ্যাপ্রুভালের জন্য পাঠানো হয়নি। কালকেই সেটা পাঠাতে হবে বলে জোনাল অফিস জানিয়েছে। আপনারা কাল সকালেই ওটা রেডি করে আনবেন”।
বিশাল বপুর স্টেটমেন্ট বানাতে হবে, তাতে প্রতিটা ব্রাঞ্চের নানারকম তথ্য থাকবে এবং তার উপর ভিত্তি করে ম্যান পাওয়ার বাজেট তৈরি করতে হবে। অফিসে অনেক খোঁজ করে অর্দ্ধেক ব্রাঞ্চের স্টেটমেন্ট পাওয়া গিয়েছিল তাছাড়া আরও কিছু কাগজপত্র জোগাড় করে আমরা দেবাশীষের বাড়িতে আস্তানা গাড়লাম। ওর ফ্যামিলি বাইরে ছিল, আমিও সে সময় কোচবিহারে একাই থাকি। মনে আছে দেবাশীষ ইলিশ মাছ কিনে এনেছিল (রান্নাও করেছিল)।
বড় বড় অ্যামালগামেশন সিট পেতে ব্রাঞ্চ ধরে ধরে ইনপুট প্রয়োগ হলো। মাঝে একবার গরম ভাত আর সরষে ইলিশ খেয়ে নিয়েছিলাম। প্রচুর সিগারেট পুড়েছিল সারা রাত। রাত সাড়ে চারটায় আমাদের ম্যান পাওয়ার বাজেট শেষ হয়েছিল। দুজনে যখন শুতে গিয়েছিলাম তখন কাকের ডাক জানান দিচ্ছিল নতুণ সকালের কথা। সেদিন সকালে দেরিতে অফিসে গিয়েছিলাম।
অমল ব্যানার্জী সাহেব প্রায় দু-ঘন্টা ধরে বাজেট স্কান করেছিলেন। উনি বলেছিলেন “আমি দু-এক দিনের মধ্যেই মুম্বাই সেন্ট্রাল অফিসে সমস্ত কাগজ নিয়ে যাব। আশা করি ভাল কিছু আদায় করে আনতে পারব। আর আমাদের বাজেটও যুক্তিপূর্ণ”। আমরা ভেবেছিলাম সামনেই এন.আই.টি.-র রায় ঘোষনা হতে পারে, হয়ত তখন নতুন করে ম্যান পাওয়ার বাজেটের অনুমোদন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের সেন্ট্রাল অফিস দেবে না।
ব্যানার্জী সাহেবের সেন্ট্রাল অফিসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সোর্স ছিল। প্রায় হাতে করে তিনি অনুমোদন করিয়ে এনেছিলেন। ব্যাঙ্কিং সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের কলকাতা অফিসে তদ্বির করেছিলেন তাড়াতাড়ি যাতে পরীক্ষার পর্ব মিটিয়ে নিয়োগ শেষ করা যায়। ১৯৯০ সনে BSRB আমাদের ব্যাঙ্কের জন্য প্রসেস শেষ করেছিল আশ্চর্যজনক দ্রুততায়। নিয়োগপত্রও তাড়তাড়ি পাঠানো হয়েছিল। ওই ব্যাচে বেশ কিছু ক্রিম ছেলেমেয়ে ব্যাঙ্কে ঢুকে পড়ল। শম্পা, বহ্নিলেখা, সিদ্ধার্থ, বুক্কু, বিশ্বনাথ, বাবলু, শেখর বলের মত উজ্জ্বল একঝাঁক তরুণকে আমরা পাশে পেয়েছিলাম। যাদের নাম বলিনি তারাও একান্তই অনুজ, কর্মক্ষত্রে অল্পদিনের মধ্যে তারা ছাপ ফেলেছিল।
ওদিকে বেশ কিছু ছেলে ক্লারিকাল থেকে প্রমোশন প্রসেস শেষ করে ফিল্ড সুপারভাইজার পদে যোগদানের অপেক্ষায়। ইতিমধ্যে NIT–র রায় ঘোষিত হলো। নতুন একটা অপযুক্তি খাড়া করা হলো “NIT–র রায় ঘোষনা হবার পর ওই পদে প্রমোশন কী ভাবে হতে পারে? কারন NIT–র রায় কার্য্যকরী হলে ওই পদটির না থাকার সম্ভাবনাই বেশি”। কাজল শেখর রায় ও আরো দু-তিন জন দিল্লীতে অর্থ দপ্তরের আধিকারিকের সঙ্গে সাক্ষাত করে জেনেছিল “ওই যুক্তিতে প্রমোশন আটকে রাখা যায় না”। ব্যানার্জী সাহেব বললেন “NIT –র রায় ঘোষনার পর কোনও ব্যাঙ্ক কি এমন প্রমোশন দিয়েছে? কাগজ দেখাতে হবে”। কাজল আবার ছুটল অসমের নলবাড়িতে বাবুল বোরার কাছে, ওখানে কর্তৃপক্ষ প্রমোশন দিয়েছে। তখন অসম অশান্তির আগুনে জ্বলছে। সে রাতে আশ্রয় না পেয়ে ওকে রঙ্গিয়ায় যেতে হয়েছিল।
পরদিন কাজল ফিরে এল সার্কুলারের কপি নিয়ে। ১লা এপ্রিল ১৯৯১ থেকে কার্যকরী করে ২৯ জন ফিল্ড সুপারভাইজার পদে প্রমোশন পেয়েছিল। আমরা অশোক চৌধুরীর গুটি চালাচালি নজর করেছিলাম। কারন আন্দোলনের রিমোট ওর হাতেই ছিল। অনেক পরে অশোক একদিন বলেছিল “প্রচুর লড়াই করে ২৯ জনের প্রমোশন আদায় করলাম। ফল কী হলো? পাঁচ জন বাদে সবাই অন্য ইউনিয়নে চলে গেল, পোস্টিং–এর লোভে”।
আমার ব্যাঙ্ক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল ১৯৮৭ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত। সেই সময় দার্জিলিঙের পরিস্থিতি ছিল অগ্নিগর্ভ। বেশ কিছু ব্যাঙ্কে আগুন লাগানো এবং লুটপাট করা হয়েছিল। চেয়ারম্যান অনেকদিন ধরেই ছুটিতে, কবে আসবেন “নদেবা ন জানন্তি”। এক ভদ্রলোক জেনারেল ম্যানেজার নাস্তানাবুদ হয়ে ছুটিতে। সহকর্মী শ্রী শ্যামল ভট্টাচার্য NIT–র কাজের জন্য অফিসে একান্তই অনিয়মিত, অন্য সহকর্মী দূর্গেশ MJT–র গুরু দায়িত্ব নিয়ে হিমসিম। সিনিয়র বলতে দেবাশীষ পার্সোনেল ও চেয়ারম্যানের দপ্তরের দায়িত্বে। আমাদের টিম অপারেশন, ক্রেডিট, ডেভেলপমেন্ট ও এরিয়া ম্যানেজার কোচবিহারের কাজ সামলাচ্ছিল। শ্রী অনিল বিশ্বাস দক্ষতার সঙ্গে ডেভেলপমেন্ট এবং অসীম দাস স্টেশনারি বিভাগ চালাত। রিফাইনান্স দেখাশোনা করত দিবাকর। আরও অনেকে প্রচুর লড়াই করে হেড অফিস চালু রেখেছিল। আমাদের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা ছিল সীমিত কিন্তু বারবার লক্ষণরেখা পার করতে হয়েছিল সমষ্টির স্বার্থে। অনেক সময় বড় কাজের চাপ এসে পড়লে স্বপন ভট্টাচার্য, সুশীল রায় ও তাপস গুহরায়কে টেনে আনতাম।
আমরা লাগাতার যোগাযোগ রেখেছিলাম সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের সেন্ট্রাল অফিসের সঙ্গে। নাবার্ড, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রশাসনিক সঙ্কটের কথা জানত। সেন্ট্রাল অফিস থেকে একটা অনভিপ্রেত পত্রাঘাত হলো। তারা বলেছিল সেন্ট্রাল অফিসে আমাদের ব্যাঙ্কের কোন অফিসার চিঠি লিখবে না, শুধুমাত্র সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের ডেপুটেড অফিসাররাই ওদের চিঠি লিখতে পারবে। সবগুলো ইউনিয়ন গর্জে উঠেছিল। এরমধ্যে কৃষ্ণমূর্তি সাহেব (RM,CBI) শিলিগুড়িতে সালিশিতে ডাকলেন। হঠাৎ দেখি পলাতক জিএম সাহেব শিলিগুড়ির ওই অফিসে সালিশির দিন হাজির।
প্রথমে কৃষ্ণমূর্তি সাহেব সাংঘাতিক আক্রমন শানিয়েছিলেন। উনার বক্তব্য ছিল আমাদের অত্যাচারে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের দুই প্রশাসক পালিয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে নাকি ‘এফআইআর’ করা উচিত ছিল। কৃষ্ণমূর্তি দুঁদে অফিসার, পরে উনি একটি কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের সিএমডি হয়েছিলেন। হঠাৎ করে আমাদের জিএম বলে বসলেন “ওরা ঠিকমত অফিসে আসে না। সারাদিন ইউনিয়নের মিটিং করে। আমাকে হুমকি দেয়”। এবার আমরা ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান ও জিএম-এর দোষগুলো জোরাল কন্ঠে তুলে ধরলাম। ব্যাঙ্ক পোড়ানো হচ্ছে আমরা কাগজপত্র উদ্ধারের চেষ্টা করছি। বিপদ মাথায় নিয়ে স্টাফরা পাহাড়ে গিয়েছে। ঠিক সেই সময় উনারা না বলে পালিয়ে গেলেন”। কৃষ্ণমূর্তি সাহেব সমস্যা বুঝেছিলেন বললেন “এটা তোমাদের ব্যাঙ্ক, তোমাদের রক্ষা করতে হবে”। আরও বলেছিলেন “ আমি আজকেই সেন্ট্রাল অফিসে তোমাদের সমস্যার কথা বলব”।
(ক্রমশ)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team