রামায়ণের উত্তরকান্ডে ইলার কথা জানতে পারা যায়। যদিও রামায়ণের ঘটনার সঙ্গে পুরাণে বর্ণিত ইলার কাহিনীর মধ্যে নানা ভিন্নতা রয়েছে। রামায়ণ অনুসারে বাহ্লিকদেশে ইল নামে এক ধর্মশীল রাজা ছিলেন, যিনি প্রজাপতি কর্দমের পুত্র। আবার পুরাণের অন্য এক অংশে বলা হয়েছে ইল হলেন বৈবস্বত মনুর প্রথম সন্তান। তিনি ছিলেন এক মহাপরাক্রমশালী রাজা। বৈবস্বত মনুর কোনো সন্তান ছিল না, তাই তিনি মহর্ষি বশিষ্ঠকে পুরোহিত করে এক বিরাট যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রীর ইচ্ছে ছিল অন্য। যজ্ঞের সময় মনু পত্নী কন্যাসন্তান কামনা করেন। যজ্ঞের ফলে মনুর কন্যাসন্তান হয় এবং মনু ক্ষুন্ন হয়ে মহর্ষি বশিষ্টের কাছে যান। বশিষ্ঠ জানান যেহেতু তাঁরা স্বামী ও স্ত্রী আলাদা আলাদা সন্তান চেয়েছেন তাই যজ্ঞে বিপর্যয় ঘটেছে, যদি মনু বিষ্ণুর স্তব করেন তবে সব ঠিক হয়ে যাবে।
বশিষ্ঠমুনির কথানুযায়ী মনু বিষ্ণুর স্তব করেন ও তাঁর আশির্বাদে কন্যাটি পুত্র সন্তানে পরিবর্তিত হয়। পুত্র সন্তানটির নাম হয় সুদ্যুম্ন যিনি ইল নামেই পরিচিত। ইলই পরবর্তী সময়ে ইলা নামে এক নারীতে রূপান্তরিত হন, এবারের পুরাণের নারী তাঁকে নিয়েই।
জন্ম বৃত্তান্ত ছাড়া ইলের জীবনের পরবর্তী কাহিনী রামায়ণ ও পুরাণে প্রায় একই। একবার রাজা ইল মৃগয়া করতে গিয়ে উমাবনে প্রবেশ করেছিলেন। মৎস্য পুরাণে বলা আছে উমাবনে কোনো পুরুষের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। এই বনে শিব ও পার্বতী ক্রীড়া করতেন। একবার রতি ক্রিয়ার মত্ত থাকাকালীন পার্বতীকে কয়েকজন ঋষি বিনা বস্ত্রে দেখে ফেলেছিলেন। পার্বতী প্রচন্ড লজ্জা পেয়েছিলেন এবং তা দেখে স্বয়ং মহাদেব নিয়ম করেছিলেন যে কোনো পুরুষ যদি এই বনে প্রবেশ করেন তবে তখনই নারীতে পরিণত হবেন, সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিভ্রষ্ট হবেন, বাদ পড়বে না পশু, পাখি গাছগাছালিও ৷
আবার বাল্মিকী রামায়ণে আছে ইল যে বনে প্রবেশ করেছিলেন সেখানে কার্তিকের জন্ম হয়েছিল। ইল যখন সেখানে গেলেন মহাদেব স্ত্রীরূপ ধারণ করে পার্বতীর সঙ্গে ক্রীড়া করছিলেন। তাঁর প্রভাবে সেখানকার সমস্ত পুরুষ-পদবাচ্য জীবজন্তু ও বৃক্ষ স্ত্রীর রূপ পেয়েছিল।
রাজা ইল না জেনেই ওই বনে প্রবেশ করায় সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীরূপ পান এবং তাঁর সঙ্গী ঘোড়াটিও ঘোটকি রূপ পায়। ইল নিজের এই রূপ দেখে মনের দুঃখে শিবের কাছে গিয়ে প্রার্থনা করলেন কিন্তু শিব এই রূপ পরিবর্তন ছাড়া আর অন্য যেকোনো বর দিতে প্রস্তুত হলেন। ইল তখন পার্বতীর কাছে গিয়ে অনুনয় বিনয় করে অনুরোধ করলে পার্বতী জানান যে তিনি শুধু বরের অর্ধেক অংশই দান করতে পারবেন। ইল তাতেই খুশি হলেন, বললেন তাঁকে যেন একমাস করে পুরুষ ও আরেকমাস নারী এইভাবে থাকার বর দেওয়া হয়। পার্বতী এতে রাজী হলেন এবং এইসঙ্গে এই বরও দিলেন যে যখন ইল পুরুষ থেকে নারী হবেন তখন তাঁর পূর্বের স্মৃতি মনে থাকবে না, আবার পুরুষ হওয়ার পর তাঁর নারীরূপের কোনো ঘটনা মনে থাকবে না।
এরপর থেকে একমাস রাজা ইল হিসেবে রাজত্ব সামলানোর পরের মাসে এক পরমাসুন্দরী নারীতে রূপান্তরিত হতেন তিনি, তখন তাঁর নাম হত ইলা। নারীরূপে অরণ্যে ঘুরে বেরানোর সময় ত্রিলোকসুন্দরী ইলা মহর্ষি সোম পুত্র বুধকে দেখতে পেয়ে মুগ্ধ হলেন। ইলাকে দেখে বুধও মোহগ্রস্থ হলেন এবং তাঁর সহচরীদের জিজ্ঞেস করলেন ইলার পরিচয়। সহচরীদের কথায় বুধ জানতে পারলেন ইলা এদের অধিশ্বরী এবং এঁর কোনো পতি নেই। এই শুনে বুধ আবর্তনীবিদ্যার সাহায্যে ইল ও ইলার সমস্ত কাহিনী জানতে পারলেন এবং ইলার পাণি প্রার্থনা করলেন আর তাঁর সহচরীদের বললেন ওই সামনের পর্বতের পাশে কিম্পুরুষী হয়ে ফলমূল খেয়ে জীবন নির্বাহ করতে। সহচরীরা তাতেই সন্মত হলে ইলাও বুধের রূপে মুগ্ধ হয়ে তখনই বুধের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলেন। এরপর থেকে ইলা ও বুধ একসঙ্গে সুখে বিহার করতে লাগলেন।
ইতিমধ্যে একমাস কাল অতিক্রান্ত হলে ইলা আবার পুরুষরূপ পেলেন এবং তাঁর সঙ্গে বুধকে দেখে অবাক হলেন। বুধ মহারাজ ইলকে জানালেন যে প্রচন্ড শিলাবৃষ্টিতে তাঁর সমস্ত ভৃত্যদের মৃত্যু হয়েছে, ইল স্বয়ং আশ্রয় নিয়েছিলেন বুধের কাছে। এই কথা শুনে ইল নিজের রাজ্য ও পত্নী-পরিজনদের কাছে ফিরে যেতে চাইলেন, কারণ তিনি না ফিরলে তাঁর পুত্র শশবিন্দু রাজ্য অধিগ্রহণ করে নেবে। কিন্তু বুধ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে ওখানেই থেকে যেতে বললেন এবং সম্বৎসর কাল এখানে থাকলে বুধ নিজেই তাঁর হিতসাধন করবেন।
ইল বুধের কথা রাজী হলে একমাস পুরুষ ও একমাস নারী হয়ে কাল কাটাতে লাগলেন। নবম মাসে ইলা এক পুত্র সন্তান প্রসব করলেন, যার নাম হল পুরূরবা। সম্বৎসর কাল পার হলে বুধ ঋষি দুর্বাসা, সংবর্ত, চ্যবন, অরিষ্টনেমি ও প্রমোদনকে ডেকে ইলের সব ঘটনা জানালেন এবং ইলের যাতে ভালো হয় তার উপায় বলে দিতে বললেন। ইলের পিতা কর্দমও সেখানে উপস্থিত ছিলেন, অশ্বমেধ যজ্ঞের বিধান দিলেন। এর কিছুকাল পর বুধ স্বর্গে গেলে কিম্পুরুষ হওয়ার লজ্জায় ইলও সিংহাসন ত্যাগ করলেন, তাঁর জায়গায় রাজা হলেন ইক্ষ্বাকু, সূর্যবংশের মূল ধারার বাহক।
অশ্বমেধ যজ্ঞশেষে মহাদেব খুশি হয়ে ইলকে পুরুষত্ব দান করেছিলেন। ইল তখন জৈষ্ঠ্যপুত্র শশবিন্দুকে বাহ্লীকদেশের রাজা করে প্রতিষ্ঠান নামে এক পুরী স্থাপন করে পুরূরবাকে তার দায়িত্ব দিলেন। এই পুরূরবাই হলেন কুরুবংশের আদিপুরুষ ও ইক্ষ্বাকুকুলের মহাপরাক্রমশালী রাজা যার উত্তরসূরীদের কাহিনীই হল সুবিশাল মহাভারত। পুরাণের নারীদের মধ্যে তাই নারীরূপী মহারাজ ইল, অর্থ্যাৎ ইলা চরিত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইলা যেখানে বুধের সঙ্গে সংসার করেছিলেন আর পুরূরবার জন্ম হয়েছিল ইলার নামানুসারে সেই স্থানের নাম হয় ইলাবৃতবর্ষ।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team