প্রকৃতি এখানে অকৃপণ। চারদিকে এত কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে কাকে ছেড়ে কাকে দেখব তা মনস্থির করতে না করতেই বেলা গড়িয়ে যায়। শীত-দুপুর কখন যে টুপ করে গড়িয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে সেটা বোঝা ভার।
খানিক আগেই দেখে নিয়েছি অহেলা গ্রামের সুইমিং পুল। আর এখন ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম ডঃ ক্যাম্পবেলের কথা। ভাগ্যিস তিনি ১৮৪১ সালে কুশাং থেকে চিন দেশীয় চা গাছের বীজ আনিয়েছিলেন! তাঁর এই একটি পদক্ষেপ বদলে দিয়েছিল দার্জিলিঙের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন। কেননা, পরীক্ষামূলকভাবে পোঁতা সেই চা বীজ দার্জিলিঙের জলবায়ু ও মাটিতে দ্রুত বেড়ে ওঠায় ব্রিটিশরা বুঝেছিল যে, দার্জিলিং পাহাড় চা-চাষের উপযুক্ত। ১৮২৩ সালে মেজর রবার্ট ব্রুসের অসমের জঙ্গলে চা-গাছ আবিষ্কার এবং ১৮৩৯ সালে অসম চা কোম্পানির প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতে চা-শিল্পের প্রসার শুরু হওয়ার পর দার্জিলিঙে চা-গাছের বেড়ে ওঠা খুলে দিয়েছিল নতুন দিগন্ত। দ্রুত ব্রিটিশরা দার্জিলিঙে চা-চাষে উদ্যোগী হয়। এই ব্যাপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন মেজর গ্রামলিন। পৃথিবীবিখ্যাত দার্জিলিং চায়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। ১৮৫৬ সালে লেবং-এর ধোত্রে চা-বাগান দিয়ে শুরু হয়েছিল উত্তরবঙ্গের চা-অভিযান।
আসলে অহেলা ভিউ পয়েন্ট থেকে গরুবাথানের বিস্তীর্ন অঞ্চলে বা পাহাড়ে একের পর এক চা-বাগান দেখতে দেখতে এই কথাগুলি মনে পড়া যথেষ্টই প্রাসঙ্গিক। কেননা গরুবাথান বর্তমানে যে জেলার অধীনে সেই জেলাও ছিল আঠারো ডুয়ার্সের অন্যতম। ১৮৬৫ সালে সিনচুলা চুক্তির পর ব্রিটিশরা ডুয়ার্স অঞ্চলকে পূর্ব ও পশ্চিম ভাগে ভাগ করেছিল। সংকোষ নদীর পূর্ব প্রান্ত থেকে অসমের বিস্তীর্ন ডুয়ার্স অঞ্চল ছিল পূর্ব ডুয়ার্স নামে পরিচিত। পশ্চিম ডুয়ার্স বলতে বোঝাত সংকোষ নদীর পশ্চিম তীর থেকে তিস্তা নদীর পূর্বকে। পশ্চিম ডুয়ার্সের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছিল ডালিমকোট। এর সদর দপ্তর ছিল কালিম্পঙ। অর্থাৎ, অতীতে কালিম্পঙ ছিল ভুটানের অধীনে আর সেখান থেকে গিরিপথ বা দ্বার দিয়েই সমতলে নেমে আসতেন ভুটান বা লস্ট হরাইজনের দুর্দান্ত মানুষেরা। অতীতের সেই ডালিমকোট আজকের গরুবাথানের খুব কাছেই। সেখানকার ভগ্নপ্রায় ফোর্ট টুরিস্টদের হয়ত খুব কিছু আকর্ষণ করে না, কিন্তু সেখানে যে কত ইতিহাস লেখা আছে তার খবর এই প্রজন্মের কে আর রাখে!
ছবি - শাখাম পথে
আজকের কালিম্পঙ পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় চা-বাগানের ব্যাপক প্রসার দেখা গেলেও, দার্জিলিং পাহাড়ে চা-বাগান পত্তনের প্রথম একশ বছর পরেও কালিম্পঙে কিন্তু সেভাবে চা-বাগান গড়ে ওঠে নি। কালিম্পঙের চা-বাগানের ইতিহাস তার পর থেকে। এর কারণ অনুসন্ধানে প্রাবন্ধিক সৌমেন নাগ বলছেন, “কালিম্পঙ ছিল ভুটানের অধীন। এর জনবসতি ছিল মূলত লেপচা এবং ভুটিয়া। এরা সবাই ছিল মূলত কৃষিজীবী। তিস্তার এপারে চা-বাগিচা গড়ে ওঠার ফলে সেখানে কৃষিজমির অস্তিত্ব প্রায় ছিল না। দার্জিলিং তখন ইংরেজ শাসকদের বাসভূমি। তাদের সেনাবাহিনীর জন্য গোর্খাদের নিয়োগের প্রধান কেন্দ্র। সিকিম থেকে লেপচা শ্রমিকদের নিয়ে এসে দার্জিলিং শহর নির্মাণের আর প্রয়োজন ছিল না, এমনকি সেই সম্ভাবনাও ছিল না। কারণ সিকিমের জনসংখ্যা ছিল এমনিতেই কম। সেখান থেকে দার্জিলিং শৈলাবাস নির্মাণের জন্য লেপচা শ্রমিকদের নিয়ে আসায় সিকিমে শ্রমিক পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছিল। তাই সিকিমের শাসক লেপচাদের সিকিম ত্যাগ করার ওপর নানা বাধানিষেধ আরোপ করেছিলেন। পাহাড়ে খাদ্যের প্রয়োজনে দরকার কৃষিক্ষেত্র। তাই ইংরেজ সরকার কালিম্পঙকে কৃষিক্ষেত্ররূপে রাখতে চেয়েছিল।”
কিন্তু কালিম্পঙের জলবায়ু ও মাটিও চা-চাষের অনুকূল হওয়ায় বর্তমানে এই জেলাতেও প্রচুর চা-বাগান স্থাপিত হয়েছে। আর তাদের অনেকেই পেয়ে গেছে দার্জিলিং চায়ের লোগো। প্রশ্ন জাগতে পারে যে, দার্জিলিং চা ব্যাপারটি ঠিক কী! পাতার গুণমান, চায়ের সুগন্ধ, স্বাদ, উপকারিতা ইত্যাদি নানা কিছু বিচারে দার্জিলিং ও কালিম্পঙ পাহাড়ের কিছু কিছু চা-বাগানের চা সাধারণ চায়ের তুলনায় একেবারেই আলাদা। ১৯৮৩ সালে 'টি বোর্ড অফ ইন্ডিয়া'র প্রস্তুত করা লোগো একমাত্র তারাই ব্যবহার করতে পারে। এই মুহূর্তে মোট ৮৭টি চা-বাগান সেই মর্যাদার অধিকারী। তার মধ্যে কালিম্পঙ পাহাড়ের কিছু চা-বাগানও রয়েছে, যারা দার্জিলিং চা প্রস্তুত করছে।
ডুয়ার্সের এই অঞ্চলে আসলে সবার আগে পা রেখেছি বিখ্যাত সেই ডালিমকোট ফোর্টে। ভুটিয়া ভাষায় 'কোট' শব্দের অর্থ দুর্গ এবং তিব্বতি ভাষায় 'ডালিং' তীর্থস্থানকে বোঝায়। লেপচারা বলেন 'ডালিং' মানে পবিত্র ভূমি। গরুবাথান থেকে ১০ কিমি দূরত্বের এই ফোর্ট আজ হেরিটেজের মর্যাদা পেয়েছে। এই ফোর্টের স্থাপনা নিয়ে কিছু মিথ রয়েছে। মনে করা হয়, বহু বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে যখন গিয়াবো আচোক রাজা হন, তখন প্রয়োজন হয় একটি সুরক্ষিত স্থানের। কেননা তিনি যেখানে তাঁর দিদিমা মনোমায়া রাইয়ের কাছে বড় হয়েছেন সেই চাখুনডারা ততটা নিরাপদ ছিল না তাঁর পক্ষে। অবশেষে সেরকম একটি জায়গার দেখা পাওয়া যায়। আর সেটি ছিল ডালিম এলাকায়, পাহাড়ের এক ঢালে। এর চারদিকে রয়েছে খাত। ফলে জায়গাটি টেবলটপ আকৃতি নিয়েছে। এখানেই গিয়াবো আচোক ও তাঁর সঙ্গীরা গড়ে তোলেন ফোর্টটি। এই ফোর্টের গড়ন ও স্থাপত্য নিঃসন্দেহে অভিনব। এত উঁচুতে যে পাথর ব্যবহার করে ফোর্টটি তৈরি করা হয়েছিল, তা কীভাবে এল সেই ব্যাপার নিঃসন্দেহে গবেষণার বিষয় হতে পারে। ফোর্টের গড়ন, রাজা গিয়াবো আচোকের বীরত্ব, রহস্যমৃত্যু, তাঁর রানির আত্মহত্যা ইত্যাদি সব মিলে ফোর্টটিকে রহস্যময় করে তুলেছে। বক্সা ফোর্টের কথা মনে রেখেও বলতে হয় যে, এই ফোর্টটি সম্ভবত ডুয়ার্স অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন ফোর্ট এবং একে ঘিরে যে গল্প প্রচলিত তা এককথায় রীতিমতো আকর্ষণীয়। নেওরা ভ্যালি জাতীয় উদ্যান ফোর্টের খুব কাছেই। ডালিমখোলা পয়েন্টটিও জিরিয়ে নেওয়ার জন্য অনবদ্য।
ছবি - মিশন হিলস চা বাগানের ফ্যাক্টরি
ফোর্ট ফেরত চেল নদীর ধারে পিকনিক স্পটটি ভীষণ মনকাড়া। চারদিকের দৃশ্য চ্যালেঞ্জ করে যে কোনও পাহাড়ি প্যানোরামাকে। এসব শেষ করে অহেলা ভিউ পয়েন্টে এসে, ডঃ ক্যাম্পবেল আর গ্রামলিন আচ্ছন্ন করেছিলেন। আসলে পাহাড়ের মাথা থেকে চারদিকে চা-বাগান সহ এত সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল যে, না ভেবে উপায় ছিল না বোধহয়। যাহোক এবার চলা ফাগু পার করে মিশন হিলসের দিকে। এই ফাগু অবশ্য লোয়ার ফাগু। ডালিমকোটের পথেই পেয়েছি আপার ফাগুকে।
মিশন হিলস যেখানে শুরু সেটা রীতিমতো পাহাড়। যত ওপরে উঠছি নিচের দৃশ্য ততই সুন্দর হচ্ছে। এই চা-বাগানের প্রতি আমার নিজের একটু দুর্বলতা আছে। আসলে বাঙালিদের অধীনে আজকাল যে কয়েকটা চা-বাগান রয়েছে, মিশন হিলস তাদের মধ্যে একটি। মালবাজারের রায় এন্ড কোম্পানির এই চা-বাগানের চায়ের স্বাদ মালবাজারে তাদের নিজস্ব স্টলে বসেও নিয়েছি বেশ কয়েকবার। সর্বোপরি এই চা-বাগান পেয়েছে দার্জিলিং চায়ের মর্যাদা। চারুচন্দ্র সান্যাল, এস পি রায়, বি সি ঘোষের মতো প্রখ্যাত মানুষদের পরে বাঙালি চা-বাগান মালিক আজকাল যেখানে দেখাই যায় না প্রায়, সেখানে এই কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে যথেষ্ট গৌরবের।
মিশন হিলসের ফ্যাক্টরি আর চারপাশ দেখে এবার এগিয়ে চলা সামনে। পাকদন্ডী রাস্তা একসময় নেমে আসে নিচে। শুরু হয় জঙ্গল, পাহাড়, নদী মিলে এক অসাধারণ দৃশ্য। সেই দৃশ্যেই তন্ময় হয়ে গেলাম মুহূর্তে। কিন্তু ঘোর ভাঙল পরিচিত আওয়াজে। কান খাড়া করে আবার শুনলাম। হাতির ডাক। বোঝা যাচ্ছিল আশেপাশে রয়েছে গজরাজ। আর থাকবেই বা না কেন! শাখাম নামে পরিচিত এই জায়গাটি তো হাতিদের আঁতুরঘর।
ছবি - সৌরেনির অরণ্য ও পাহাড়
শাখামের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দুর্গম পথে সোজা চলে যাওয়া এবার সৌরেনি গ্রামে। ওখানকার হর্নবিল জলপ্রপাত রূপে ছাঙ্গের জলপ্রপাতকেও হার মানায়। সবসময় দেখা মেলে হিমালয়ের বিভিন্ন পাখিদের। সমাগম হয় হর্নবিলের সব প্রজাতির। সৌরেনি পৌঁছতে বেশ খানিকটা উঠতে হয় পাকদন্ডী পথে।
ফিরতি পথে মাল নদীর ওপর ব্রিজ পেরিয়ে ঘন জঙ্গলের প্রায় অন্ধকার রাস্তা দিয়ে এসে পৌঁছলাম সামসিংয়ের সুন্দর বস্তিতে। সত্যি বলতে এতক্ষণে মানুষজনের দেখা পেয়ে খানিকটা স্বস্তি হল। আদিম অরণ্যের শাখাম আসলে পৌঁছে দিয়েছিল এমন এক যুগে যেখানে ভুটান রাজা-যুদ্ধ-তন্ত্রমন্ত্র-বৌদ্ধ সন্ন্যাসী-রূপকথা ইত্যাদি সব মিলে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যেন!
এই ডুয়ার্স সত্যিই অনন্য। কেউ চেনে, আর কেউ চেনে না।
ছবি - নৃত্য গীতের গরুবাথান
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team