(আগের অংশ ফেব্রুয়ারি ২২ সংখ্যায় প্রকাশিত হবার পর)
বিস্তর অভিযোগ উঠেছে হেরিটেজ তালিকা নিয়ে। কার পরামর্শে অথবা কাকে খুশি করতে এ ধরনের একটি অবাস্তব বিকৃত হেরিটেজ তালিকা প্রস্তুত করা হলো এবং কীসের ভিত্তিতে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন কলকাতাতে বসেই তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করলো তা নিয়ে শুধু প্রশ্ন তোলা নয়, গোটা বিষয়টি এখন জেলার অসংখ্য শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের হাসি ঠাট্টার বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
গত ৫ জুলাই ২০১৯ তারিখে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তি (No.79/N-1/WBHC/2008-09) জারি করে নবদ্বীপ আর কোচবিহারের বেশ কিছু স্থান ও স্থাপত্যকে হেরিটেজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বৈষ্ণব ধর্মের প্রবক্তা যুগ পুরুষ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এবং তাঁর সহধর্মিনী বিষ্ণুপ্রিয়ার পুণ্য জন্মভূমি নবদ্বীপে বল্লাল ঢিপি, ইস্কন মন্দির, মণিপুর রাজবাড়ি, বামনপুকুর বড় মসজিদ, নবদ্বীপ পুরভবন, ১১টি ঘাট সহ ৮৬টি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন স্থাপত্য এই তালিকায় স্থান পেয়েছে। আর কোচবিহার শহরের ১৫৫টি স্থাপত্যকে এই তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে। নবদ্বীপের কথা আমার বিশেষ কিছু জানা নেই। তবে কোচবিহার শহরের যে ১৫৫টি স্থাপত্যকে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের পক্ষ থেকে হেরিটেজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে বেশ কিছু স্থাপত্যের ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যগত গুরুত্ব নিয়ে ইতিমধ্যেই নানা প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। হেরিটেজ তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য কোনও স্থাপত্য মোটামুটি একশ বছরের প্রাচীন হওয়া প্রয়োজন। ব্যতিক্রমে, চিত্তাকর্ষক নির্মাণশৈলী অথবা কোনও প্রখ্যাত মনীষীর জন্ম ভিটেবাড়ি, তাঁর পদধূলি ধন্য স্থান বা উপাসনা স্থলকেও অনেক সময় হেরিটেজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু এ সবের তোয়াক্কা না করে, ক্ষেত্র সমীক্ষা বা সরেজমিন পর্যবেক্ষণ ছাড়াই শুধুমাত্র স্থানীয় হেরিটেজ কমিটির অবিবেচনা প্রসূত সুপারিশের ভিত্তিতে এই শহরের এমন কিছু ইমারত বা স্থানকে হেরিটেজ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যা শহরবাসীর কাছে ইতিমধ্যেই হাসিঠাট্টার খোরাকে পরিণত হয়েছে। আবার এমন অনেক প্রাচীন জলাশয়, স্থান বা স্থাপত্যকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে অধুনা যার কোনও অস্তিত্ব নেই, কিছু বিলুপ্তপ্রায় অথবা বেদখল হয়ে গেছে। সেগুলোকে কি আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
কোচবিহারের যে কোনও ইতিহাস সচেতন মানুষ অবলীলায় বলে দিতে পারেন এই শহরের প্রাচীন এবং ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থাপত্য কোনগুলো। অথচ সেই তালিকায় কেমন করে পঁচিশ বছর আগে সাগরদিঘীর উত্তর-পশ্চিম কোণে নির্মিত ভারত সঞ্চার নিগমের দফতর (এক্সচেঞ্জ) অথবা নীলকুঠির অসম রোডে মাত্র ত্রিশ বছর আগে নির্মিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুত্ বন্টন বিভাগের বাংলো-আবাসন স্থান পেল তা নিয়ে স্থানীয় জনমনে বিস্ময় দেখা দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়। মাত্র চল্লিশ বছর আগে নির্মিত জেলা জজ আদালত ভবন, বিগত শতাব্দীর পাঁচের দশকে নির্মিত রামকৃষ্ণ মঠ, বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠও সেই তালিকায় স্থান পেয়েছে। অথচ ২০ নম্বর ওয়ার্ডের ঐতিহ্যমণ্ডিত ও প্রাচীন ব্রহ্মচারী কালীবাড়িটির কথা বেমালুম ভুলে গেছে হেরিটেজ কমিশন! আরো অবাক করে দিয়ে ঐ তালিকায় উঠে এসেছে কোনও এক অজানা সেনবাড়ি বা সাহাবাড়ির নাম! শহরের নয় নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত পুলিশ সুপারের বাংলো থেকে শুরু করে অতিরিক্ত জেলাশাসক এমনকি পূর্ত দপ্তরের নির্বাহী অধিকারিকের সরকারি বাংলোটি পর্যন্ত হেরিটেজ তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইতিহাস তো দূরের কথা, কোচবিহারের ভারত ভুক্তির পর নির্মিত এই সব বাংলো গুলো প্রাচীনত্বের নিরিখে তো নয়ই, নির্মাণশৈলীতেও কোন বিশেষত্বের ছাপ বহন করে না। একইভাবে নীলকুঠির বিভাগীয় বন দফতর আর সেদিন নির্মিত বনশ্রী আবাসনকেও হেরিটেজ তকমা প্রদান করা হয়েছে। এমন উদাহরণ আরো অনেক আছে। প্রশ্ন হল, মাত্র তিন চার দশক আগে নির্মিত এই স্থাপত্য(!) দেখতেই কি দেশী বিদেশী পর্যটকরা হেরিটেজ সিটি কোচবিহারে ছুটে আসবেন?
যাদের সুপারিশে পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন এই তালিকা প্রস্তুত করেছে, শুনেছি সেই স্থানীয় হেরিটেজ কমিটিতে বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধি, কিছু সরকারি আমলা এবং এই শহরের কয়েকজন ইতিহাসবিদ, পুরাতত্ত্ব ও প্রত্ন বিশেষেজ্ঞ ও কিছু বিশিষ্ট নাগরিক স্থান পেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনে কোচবিহার তো দূরঅস্ত, গোটা উত্তরবঙ্গ থেকে একজন প্রতিনিধিরও ঠাঁই হয় নি! তাই পরের মুখে ঝাল খাওয়া ছাড়া তাদের আর উপায়ই বা কী! তবে আগামী প্রজন্মের কাছে এই শহরের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার স্বার্থে অবিলম্বে ভুলে ভরা বিকৃত এই হেরিটেজ তালিকার সংশোধন প্রয়োজন। বিকৃত এই হেরিটেজ তালিকা সংশোধনের দাবিতে কোচবিহারের জেলাশাসককে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়ে, এমনকী রাজ্য হেরিটেজ কমিশনে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়েও কোনও উত্তর পাওয়া যায় নি। জানি না তাঁরা কার পরামর্শে এমনটা করছেন। শেষ পর্যন্ত হয়তো মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণ হাসপাতালের নাম ফিরিয়ে দেওয়ার মত রাজ্যের মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীকেই আবার এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হবে।
খড়গপুর আইআইটি-র কিছু নগর স্থপতিকে শহরের হেরিটেজ রক্ষার রূপরেখা রচনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে বলে শুনেছি। জেলার মহাফেজ খানা বা উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারে এই শহরের পুরোনো যে সব ছবি মানচিত্র সংরক্ষিত আছে সেগুলো তারা যদি একটু যাচাই করে নিতেন তবে মন্দ হতো না। ইগো সরিয়ে রেখে কথা বলতে পারেন এই শহরের আদি বাসিন্দা বয়স্ক মানুষজনের সাথে, যাদের স্মৃতি থেকে এখনো প্রাচীন এই রাজার শহরটি হারিয়ে যায় নি। আমার মনে হয় রাজনগরের হেরিটেজ বজায় রেখে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে আসতে, সিঙ্গাপুর বা প্যারিস যেতে হবে না, কোচবিহার থেকে মাত্র সত্তর কিলোমিটার উত্তরে ভুটানের ফুণ্টশোলিং বলে যে শহরটি আছে দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থপতিদের সেটা একটু ঘুরে আসতে অনুরোধ করছি। এই শহরের ভবিষ্যত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে, যথাযথ ক্ষেত্রৎসমীক্ষা আর জনমত যাচাই করে কোচবিহার শহরকে হেরিটেজ ঘোষণার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় সমস্যা বাড়বে বই কমবে না।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team