খুদে হান্স-এর গল্প পড়েছেন? ক্লাস ফাইভের পাঠক্রমে ছিল একসময়, স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে, হান্স দেখে যে সমুদ্রকে ঘিরে রাখা পাথর নির্মিত দেওয়ালে ছোট একটা গর্ত হয়ে গেছে, এদিকে বৃষ্টি হচ্ছে মুষলধারে আর সমুদ্রও অশান্ত। কোনও কিছু না ভেবে মুষ্টিবদ্ধ নিজের হাত ছোট্ট হান্স সেই গর্তের মধ্যে আঁটোসাঁটো করে ঢুকিয়ে দেয়। কারণ সে জানে গর্তটা বাড়তে দিলে একসময় গোটা দেওয়ালটাই ভেঙ্গে পড়বে, জলের তোড়ে ভেসে যাবে তাদের গ্রাম। এদিকে বাড়িতে চিন্তার শেষ নেই, বাড়ি ফেরার সময় পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, হান্স বাড়ি ফেরেনি। ঝড় জলের রাত, কোথায় রয়ে গেল তাদের হান্স? খোঁজ করতে করতে একসময় তারা দেখল, তাদের হান্স ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে কাঁপছে কিন্তু প্রাণপণ প্রচেষ্টায় নিজের মুষ্টিবদ্ধ হাতটি দেওয়ালের গর্তে ঢুকিয়ে রেখেছে যাতে গর্তটা বাড়তে না পারে। ছোট্ট হান্সের সেই প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সাহস ও দায়িত্ববোধ দেখে গ্রামবাসী তাকে অনেক অনেক আদর ও ভালোবাসা দিয়েছিল সেদিন। হান্স ছিল ডাচ বা ওলন্দাজ, হল্যান্ড দেশীয়, যে দেশকে এখন আমরা নেদারল্যান্ড বলে জানি ।
মুর্শিদাবাদের কালিকাপুর অধুনা কাশিমবাজারে ডাচ সমাধির সামনে দাঁড়ালে আপনাদেরও মনে পড়বে সেই বাল্যকালের নায়ক হান্সের কথা। সম্মুখে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছে তারই দেশের ৪৭ জন ওলন্দাজ নরনারী যাঁরা একসময় এই কাশিমবাজারেই বসবাস করতে। ইতিহাস বলে, মুর্শিদাবাদ প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই কাশিমবাজার ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। ব্যবসা-বাণিজ্যে কাশিমবাজারের সুখ্যাতি তখন দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে দেশান্তরে। বাংলার বৃহৎ বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে তখন তার চূড়ান্ত রমরমা। শুধু ইংরেজ নয়, ফরাসি ও ডাচ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীও তখন তাদের কারখানা গড়েছে কাশিমবাজারে। ১৬৬৭ সালের পর থেকে এই ১৯০০ শতকের আগে পর্যন্তও বিভিন্ন নথিতে হুগলী নদী কাশিমবাজার নদী নামে উল্লিখিত রয়েছে, যার বন্দরে নোঙর করতো দেশ বিদেশের বাণিজ্যতরী। শুধু তাই নয়, হুগলী, পদ্মা ও জলঙ্গী নদীর মধ্যবর্তী ত্রিকোণ অংশটি কাশিমবাজার হিসেবেই গণ্য করা হয়েছে অতীতে।
কিন্তু এখন সে রামও নেই, রহিমও নেই। উনিশ শতকের শুরুর দিকেও কাশিমবাজার জনপদ ও কাশিমবাজার বন্দরের রমরমা বজায় ছিল। ১৮১১ সালেও সিল্ক, হোসিয়ারি ও আইভরি নির্মিত শিল্পকলার জন্য এ শহর সমুজ্জ্বল ছিল স্বমহিমায়। তারপর শেষ হয় সুদিনের গল্প। আবহাওয়ার মারাত্মক পরিবর্তন, ম্যালেরিয়ার প্রকোপ এবং সর্বোপরি শহর থেকে প্রায় তিন কিমি দূরে হুগলী নদীর খাত সৃষ্টি হওয়ায় কাশিমবাজার ধীরে ধীরে হারাতে থাকে তার কৌলিন্য। এখন সে জেলা মুর্শিদাবাদের ছোট একটা শহর যার লোকসংখ্যা সাকুল্যে ১০১৭৫, ২০০১ সালের জনগণনা অনুসারে। তবে পুরানো গৌরবের স্মৃতি এখনও রয়েছে শহরজুড়ে। যার একটি শিয়ালদহ-লালগোলা রেলপথের কাশিমবাজার স্টেশনের সন্নিকটে ডাচ সমাধি। ডাচ সমাধিক্ষেত্রের সবচেয়ে পুরানো কবরটি ১৭২১ সালের। ড্যানিয়েল ভ্যান দার ম্যুল সমাহিত রয়েছেন ওখানে। শেষটি ১৭৯২ সালে নির্মিত। অধিকাংশই পিরামিড আকৃতির। বেশ কিছু সমাধির খোদাই করা নাম এখনও পড়া সম্ভব। ১৬৬৬ সাল নাগাদ এই সমাধিক্ষেত্রের আশপাশেই ডাচেদের মালিকানায় বৃহৎ কারখানা ছিল বলে জানা যায়, যে কারখানায় প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ জন লোক কাজ করতো, পরিবার পরিজন নিয়ে এই শহরেই করতো বসবাস। তবে সে বসবাসের চিহ্ন সব মুছে গেছে, রয়ে গেছে অমোঘ মৃত্যুর নিশানা, আজও।
তাই ইতিহাসকে চাক্ষুস করতে হলে এখানে একটিবার আসা প্রয়োজন। ইতিহাস দর্শনের পাশাপাশি, মৃত্যু নামক ধ্রুবসত্যের অনুভবটিও উপলদ্ধি করা যাবে। নানান দোষের মধ্যেও মৌলভী সাহেবদের একটি কথার সত্যতা অজান্তেই আপনার মন মেনে নেবে, মানুষের বয়স আসলে বাড়ে না, বয়স ক্রমশ কমে, একটা একটা করে দিন যায়, আর এক পা, এক পা করে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় প্রাণ।
কীভাবে যাবেন ? শিয়ালদহ-লালগোলা রেল বিভাগের কাশিমবাজার রেলষ্টেশনে নামুন। ষ্টেশনের পাশেই ডাচ সমাধি। শহরে দু’টো রাজবাড়ি রয়েছে, দেখে নিতে পারেন।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team