৩৩।
বাতাসির আস্তানা গুটিয়ে নেওয়ার সময় হয়ে এল এবার। এইচ ডি-র কাজ শেষ। এবারে আবার নিজের এলাকায় ফিরে যাবে হরিদাস সাহা। সেই আপার চ্যাংমারির লেবুবাগান, সেই নাংডালা বাগানের বস্তি, সেই নাগরাকাটা। বৃত্তের এতটা বাইরে এসে কাজ করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছিল হরিদাস। তবে সব কাজেরই একটা দাম আছে। এতদিন ভাবত জমিজমার অনেক কিছু বোঝে ও। কিন্তু হাতে কলমে দালালের ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে মালুম হয়েছে জমি, জমির পর্চা, তার মারপ্যাঁচ, রেকর্ডের ঘাপলা এক মহাসমুদ্র।
দারোগা বিধান তপাদার সাসপেন্ড হয়েছে দু-দিন আগে। দারোগার ‘বাংলো’ বাড়ি, দিশি মুর্গা, রয়্যাল চ্যালেঞ্জ, কচি ঠ্যাং... সবকিছুই লহমায় হাওয়া হয়ে গেছে। এতদ অঞ্চলের জমি ঘাপলায় বিধান তপাদারের ভূমিকা ছিল মারাত্মক। নীরেন নন্দীর সঙ্গে সাঁটঘাট করে কম আদিবাসী জমির সর্বনাশ করেনি লোকটা। লোকাল-জোনাল-এর নয়নের মণি হয়ে একই পোস্টিং-এ নয় বছর ধরে নিজের শেকড় পুঁতে দিয়েছিল এখানে। এসডিপিও দাত্তা সাহেবের ফোন এসেছিল এইচ ডি-র কাছে। বাতাসি ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ এসেছে ‘ট্রিপল আর’-এর থেকে। কিন্তু এই বাতারিয়া নদী, এখানকার মানুষজন, প্লাইউড কারখানা আর এই বিএলআরও অফিস, এতকিছুর ওপর মায়া পড়ে গেছে এইচ ডি-র। সাবিত্রীর সঙ্গে একই ছাদের নীচে, একই বিছানায় এতটা দিন একসঙ্গে কাটিয়ে আবার আগের মতো বেহিসেবি জীবনে ফিরে যেতেও সময় লাগবে খানিকটা। এইচ ডি-র জীবনে একটা ছন্দ চলে এসেছে।
শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ এমনটাই ভাবছিল ও। পাশের ছোট্ট রান্নাঘর থেকে ডাল সম্বর দেওয়ার তীব্র ঝাঁজ নাকে আসে। মুসুরির ডাল সাবিত্রীর হাতে খোলে ভাল। চিন্তার সূত্র কেটে যায় এক সময়ে, চোখ বন্ধ থাকলেও বুঝতে পারে ঘরে শুক্রা এল এখন,
‘হরি-দা, আমাকেও নিয়ে চল্। তোরা দুজনাই এখান থেকে চলে গেলে আমি একা থাকব কী করে?’
‘কিন্তু এমন পাকা কাজ তুই আর কোথায় পাবি, শুক্রা? সুভাষ-দার কারখানায় তোর কোনও অসুবিধে হবে না। থেকে যা এখানেই‘, হরি বোঝে সাবিত্রী আর হরিদাকে ছেড়ে এখানে মন টিকবে না শুক্রার, ‘অন্তত আর কিছুদিন এখানে থাক। নতুন কাজ খুঁজতেও তো খানিকটা সময় লাগবে।‘
‘কেন, কোড গ্রিন-এর কাজ?’
‘শোন শুক্রা, আপাতত আমাদের কাজ শেষ। বিএলআরও অফিসে ‘ফুটবলার’রা অ্যাকশনে নামার সুযোগই পায়নি। আগেই মানুষ যা করার করে দিয়ে দিয়েছে। সকলেই নিজের অজান্তে ‘কোড গ্রিন’-এর মেম্বার হয়ে গেছে এখন। লড়াইটা এখন আর আমাদের কয়েকজনের মধ্যে নেই।‘
‘অত কিছু বুঝি না। বন্দুকবাজগুলোকে কি তাহলে বসিয়ে খাওয়ালি অতদিন তুই আর সুভাষদা?’
‘সুভাষদা সবসময় দুইটা প্ল্যান রেডি রাখে রে। মানুষ নিজেরা না নামলে সেদিন ‘ফুটবলার’দের দিয়েই অনেক কাজ করাতে হত।‘
‘যাই বল্ হরিদা, একা একা এখানে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তুই আমার ব্যবস্থা কর।‘
শীত প্রায় মরে এসেছে এখন।
সকাল আটটাতেও জামবাড়ি মদের দোকানের সামনে কুয়াশার নামগন্ধ নেই। ঝকঝকে রোদ। চিকরাশি গাছের ছায়ায় পুরনো আরামকেদারায় বসে তারক ব্যানার্জি। গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে রৌদ্রের সরলরেখায় ঝিকিয়ে উঠছে তারকের হাতের আংটিগুলো। দূর থেকে বেশ কয়েকটা মোটরবাইকের আওয়াজ কানে আসে তারকের। আস্তে আস্তে তিনটে বাইকের ইঞ্জিন এসে থামে জামবাড়ি ভাটির সামনে। বাইক তিনটে থেকে ছয়টি প্রজাপতি নেমে আসে চিকরাশি গাছের ছায়ায়। অরিত্র এসে গলা জড়িয়ে ধরে তারকের,
‘তারকদা, খাইনি কিছু সকাল থেকে, সেই ভোরে রওনা দিয়েছি মধুপুর থেকে। ভুঁড়ির চাট দিয়ে পরোটা খাব এখন।‘
‘আরে বস্, বস্। সোমরার মা খানিক বাদে আসবে। ওই তো চাট বিক্রি করে এখানে।‘
‘বেশ ততক্ষণ না হয় খালিপেটে এইট্টিই খাই আমরা।‘
‘মারব এক থাপ্পর...’
‘আমরা এখন বড় হয়ে গেছি তারকদা। আর তোমার ওই এইট্টি আপ মদে তো জল মিশিয়ে কিছুই অবশিষ্ট রাখো না’, জন্নতের গলায় আবদারের সুর।
এখন আমি নিজেই দোকান দেখি রে মা। একফোঁটা জল খুঁজে পেলে তারক ব্যানার্জি হাতের সবক’টা আংটি খুলে জলে ফেলে দেবে, বুঝলি।‘
জন্নতের দিকে তাকালেই মকবুলের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে তারকের। ভগবান যে কতরকম চোরাকুঠুরি তৈরি করে রেখেছেন এই দুনিয়াদারি বরাবর।
ছেলেমেয়েগুলোকে ভাল বুঝতে পারে না তারক। এরা সত্য আর ন্যায়-এর জন্য করতে পারে না এমন কাজ নেই কোনও অথচ মুখের কোনো বিকার নেই। এই রোদে এইট্টির বোতল খুলে বসে পড়েছে সকলে। সঙ্গে সোমরার মায়ের হাতে বানানো খাসির ভুঁড়ির গরগরে চাট। জন্নতের দিকে তাকালে ভয় হয় তারকের। আমিনের রক্ত ওর শরীরে নেই কিন্তু সুর খেলা করে প্রবলভাবে। কী দারুন গাইতে পারে মেয়েটা! মুখ দেখে কে বলবে, ক’দিন আগে ঠান্ডামাথায় খুন করেছে একজনকে। কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ সাড়া পড়ে গিয়েছে সেই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অথচ মেয়ের মুখটা দ্যাখো, কিছুই হয়নি যেন। হাঁটতে হাঁটতে বাগানের কুলিলাইনের দিকে এগোয় তারক। পেছন পেছন জন্নতও আসে ধীর পায়ে,
‘কী ভাবছ, তারকদা?’
‘কাকা বল, জ্যাঠা বল। দাদা বলে ডাকিস কেন রে?’
‘আহা। কোড গ্রিন’-এর লোকেদের বয়স বাড়ে নাকি আবার। তুমি, আমি আমরাও যখন বুড়ো হব, তখনও সব্বাই এভারগ্রিন থেকে যাব।’
‘তোর ভয় করে না? কলকাতা থেকেও ওই খুনের তদন্ত করতে লোকজন আসছে। স্পেশাল টিম।’
‘আমি সবকিছুর জন্য তৈরি আছি তারকদা। তবে কোনো ক্লু ছেড়ে আসিনি। যা কিছু ছিল, একজন সাফসুতরো করে দিয়েছে।’
‘জানি আমি মিলনজী বলেছে আমাকে। দাত্তাসাহেব মানুষটা প্রখর বুদ্ধিমান।’
দাত্তাসাহেবের নাম শুনেই মুখে কি একঝলক অতিরিক্ত রঙের আভাস খেলা করে গেল! তারক ব্যানার্জির চোখ এড়ায় না। জন্নত নিজে বুঝতে পারে ও ব্লাশ করে ফেলেছে।
‘এরপর?’
‘এরপর আর কিছুই না তারকদা। মাসখানেক এখানে থাকতে হবে আমায়। হঠাৎ করে মধুপুর ছেড়ে গেলে সন্দেহ হবে। মাসখানেক বাদে সিকিম। ‘ট্রিপল আর’ ওখানেই ডেকে নিয়েছেন আমাকে। ওঁর সঙ্গে থাকতে হবে অনেকটা দিন। ‘দ্য হরাইজন’-ই আমার নেক্সট ঠিকানা।‘
‘রাধারানির মতো তোরও বোধহয় কোনও ঠিকানা হবে না রে জন্নত।‘
‘সব গ্রহ, তারকদা, গ্রহের ফের’, নিজের আংটিবিহীন আঙ্গুলগুলো মুঠি করে জন্নত।‘
দুজনেই হো হো করে হেসে ওঠে। এমনকী তারক ব্যানার্জির পোষা ময়ূরটাও কর্কশ কেকাধ্বনিতে মাতিয়ে দেয় জামবাড়ি বাগানের আকাশ বাতাস।
নিজের বিরাট চেম্বারের একটা দিক পুরোটাই কাচের।
মধ্য কলকাতার এই হাইরাইজের বারোতলায় ‘দ্য ডেইলি নিউ এজ’-এর ইস্টার্ন রিজিয়নের অফিস। চিফ রিপোর্টারের চেম্বারটাও চোখ ধাঁধানো। কাচের জানালা দিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সহ গোটা মধ্য কলকাতার প্যানোরামিক ভিউ। আরাত্রিকা এইমাত্র ‘কোড গ্রিন’ নিয়ে যে স্টোরিটা বেরুবে তার প্রথম কিস্তিটা শেষ করে উঠল। এই প্রথম ‘কোড গ্রিন’ শব্দবন্ধটা দিনের আলোর মুখ দেখবে। এগারো বছরের সাংবাদিক জীবনে কম ‘স্টোরি’ তো করেনি ও। কিন্তু এই প্রথম নিজেকে লুকিয়ে লিখতে হচ্ছে। গোটা কাহিনি ওর নখদর্পণে। নিজেও জড়িয়ে ছিল অনেকটা। ভাবতে ভাবতে ভাল লাগছে, এই মুভমেন্টের আঁচ পেয়েছে সকলেই কিন্তু সবটাই একটা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ঘটা সমূহ হিসেবে ভেবে নিয়েছে সবাই। এও যে একটা সংঘটিত আন্দোলন ছিল, সেটা প্রথমবারের জন্য আরাত্রিকাই লিখছে। অবশ্য লিখতে হচ্ছে কুশীলবদের নামধাম গোপন করে।
গোটা জীবনভর মনে থাকবে আপার চ্যাংমারির সেই লেবু আর কলা বাগানের কথা, সুরেশ তামাং-এর মুখ, এবং মোটা সুতির কাপড়ের ব্লাউজ পরা সেই মেয়েটিকে যার কাছে শহুরে এলিগ্যান্সও ম্লান হয়ে আসে লহমায়। আরাত্রিকার কাছে সাবিত্রী একটা অধ্যায়। পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে জেগে থেকে, গল্প করে কাটিয়েছে অনেক রাত।
ফোনে আওয়াজে আপার চ্যাংমারি থেকে বারোতলার অফিস চেম্বারে আবার ফিরে আসে আরাত্রিকা,
‘হাই, ম্যাডাম, হাউ ইজ লাইফ?’
‘লাইফ ইজ সো সো, বলবিন্দর। হোয়াট অ্যাবাউট ইউ, ফটোগ্রাফি কেমন চলছে?’
‘কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে মঙ্গলাজোড়ি যাচ্ছি। বার্ড ফটোগ্রাফি করতে। ওড়িশায়। হোপফুলি ফেরার সময় কলকাতায় একটা স্টপওভার হবে।’
‘ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম, মাই উড বি হাজব্যান্ড।’
আরাত্রিকা আর বলবিন্দরের দূর সম্পর্কের প্রেমে এভাবেই কথা হয় মাঝেমধ্যে।
এভাবেই এডিটরের তাগাদায় বারে বারে ফিরে আসে উত্তর জনপদের সেই সময়কার দিনগুলো, রাতগুলো। এভাবেই এডিটরের কথামত টাঙ্গি, তির এবং ধনুক হাতে হাতে নিয়ে ‘ভাল’ ভিস্যুয়াল আসবে, তক্ষকের ছবি আসবে, আসবে ইনডং নদীর কথা। পীযুষের গান, আমিন মিয়াঁর বাঁশি।
ভগবানের ধাবা এখন রমরম করে চলছে।
গরিবগুর্বো মানুষ থেকে ট্রাক ড্রাইভার। সন্ধের দিকে মধুপুর, শিলিগুড়ির বাবু-বিবিরা কেউ বাদ নেই। পরিশ্রমে কীই না হয়! কয়েকদিন আগে হরিদা শুক্রাকে নিয়ে এসেছে এখানে। ছেলেটা খাটতেও পারে বটে। জোয়ান ছেলে, খিদে বেশি। ভগবান নিজেই ওকে সব রান্না টেস্ট করানোর নাম করে খাইয়ে দেয়। এই কয়েকদিনেই শুক্রা বাজারঘাট করা থেকে ম্যানেজারি, সবকিছুতেই জমিয়ে নিয়েছে নিজেকে। এমন একটা লোকের জন্যই অপেক্ষা করে ছিল ভগবান। চারদিকে এত মানুষ কিন্তু আপনজনের বড় অভাব। ছেলেটার মা-বাপ নেই, ভগবানেরও কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই দুনিয়ায়। আর হ্যাঁ, এর হাতে ধাবার দায়িত্ব দিয়ে নিজের পুরনো অভ্যেস আবার ঝালিয়ে নিচ্ছে ভগবান। সে বেহালা বাজানোই বল কিংবা হাঁটনই বল।
আজই যেমন।
গোশালা মোড় থেকে হাঁটতে হাঁটতে বেলাকোবা চলে গিয়েছিল ভগবান। খানিক যাওয়ার পর দু-দিকে চ-বাগান। কত রকমের যে পাখি! বসন্ত আসবে আসবে করছে এখন। কোকিলগুলো পাগল হয়ে গেছে। নিমগাছের ডগায় লালচে রঙের কচি পাতা। এ এক আজব লীলা বটে ঠাকুরের। দশ দিক, ছয় ঋতু আর চার বেদ। ঋতু বদলের সময়টা খুব ছুঁয়ে যায় বেহালাবাদককে। এক এক ঋতুতে এক এক রকমের ফুল। আকাশেরই বা কত ঢং। আর জগতের এই পরিবর্তনগুলো না হাঁটলে ধরা যায় নাকি? শরীলের কলকব্জায় রোগ বিয়াদি এখনও থাবা বসায়নি, সেও তো ওই হাঁটনের জন্যই।
বেলাকোবার চমচমের নামযশ দুনিয়া জুড়ে। ইলাদির বাড়িতে প্রথম খেয়েছিল ভগবান। আহা, সোয়াদটা এখনো মুখে লেগে আছে। জিভ থেকে গলা, মাথা থেকে মন… বেলাকোবার চমচম ভগবানের এক আজব সৃষ্টি। সাধে কি আর লোকে উড়োজাহাজে করে এই চমচম নিয়ে যায় দূরদূরান্তে! আর সাইজ? এক একটা নৌকার মত দেখতে। একটা পেটের খিদেয় খায় ভগবান, পরেরটা চোখের খিদেয়। উঠে আসার সময় বেশ কিছু চমচম সঙ্গে বেঁধে নেয়। কয়েকটা ইলাদির বাড়িতে নিয়ে যাবে আর কয়েকটা শুক্রার জন্য।
ফেরার সময় রোদটা বড় মিঠা। একমনে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে ধাবার দিকে হাঁটা দেয় ভগবান। লেভেল ক্রসিং এর ঠিক আগে ঘ্যাঁচ করে একটা পুলিশের জিপ ব্রেক করে ওর পাশে। হঠাৎ করা হাঁটা থেমে যাওয়ায় হাতে ধরে থাকা চমচমগুলো নড়ে ওঠে প্যাকেটের ভেতরে। গাড়ি থেকে সাদা পোষাকে নেমে আসে সৌরভ দত্ত। সকলের মত ওঁকে ‘দাত্তাসাহেব’ বলেই ডাকে ভগবান। আহা, কী সুন্দরই না লাগছে দেখতে মানুষটাকে! তামা দিয়ে তৈরি দেবতা যেন। যেমন লম্বা তেমন শরিল। তাকিয়েই থাকে। শেষ বিকেলের লাল আলোয় বড় মায়াবি লাগে দাত্তাসাহেবের মুখটা। ভগবানকে গাড়ির সামনের সিটে বসিয়ে নিজেই আবার ড্রাইভিং সিটে ওঠে সৌরভ,
‘কী এমন অবাক হয়ে আমাকে দেখছিলে, মিস্টার ভায়োলিন?’
‘সাহেব, অমন রূপ দেখে ভেবলে গেছিলাম খানিকটা।‘
‘তুমি মানে ভগবান পুরুষদের বানানোর সময় অন্যমনস্ক ছিলেন। শোনা যায়, মেয়েদের তৈরি করতে উনি ছয়দিন সময় নিয়েছিলেন। সপ্তাহের শেষদিন বাঁচাকুচো মাটি দিয়ে ছেলেদের অবয়ব বানিয়েছিলেন। বুঝলে কিছু, মিস্টার ফরেস্ট গাম্প?’
‘অত বুঝনের কাম নাই সাহেব। বিয়া করেন একটা। আপনের তো ব্যারাকপুরে বদলি হয়ে গেসে।’
‘আহা, বদলি বলো না ভগবানদা, প্রমোশন বলো। অ্যাডিশনাল এসপি, ট্রেনিং।‘
‘মাঠে ময়দানে আপনে এত ভাল কাজ করলেন তবু আপনাকে ট্রেনিং-এ পাঠায় দিলো! সুপ্রভাতদা বলছিল ওটা নাকি গ্যারেজ পোস্ট।’
‘কত নতুন ছেলে আমার হাত দিয়ে ট্রেনিং পাবে, বল তো তুমি। তাছাড়া কেউ কিছু ধরতে না পারলেও সন্দেহ একটা থাকেই, ভগবানদা। পুলিশের অনেক ইন্দ্রিয়। আমার প্রত্যেকটা চলাফেরার ওপর এখন নজর আছে। ভালই হল, এখন কিছুদিন সাইডলাইনে থাকাটাই ভাল। এখানকার বাকি কাজ তোমরা সামলে নিতে পারবে।’
কথায় কথায় জিপ ভগবানের ধাবায় এসে থামে।
কোণের টেবিলে হালকা আলো আঁধারির মধ্যে জন্নতের অবয়ব টের পায় ভগবান। দাত্তাসাহেব জিপটা ধাবার পেছনে পার্ক করে জন্নতের সামনে এসে বসে। মরে আসা আলোর ভেতরেও জন্নতের মুখে একটা আভা দেখতে পায় ভগবান। বুড়োর চোখ ফাঁকি দেওন অত সোজা না। ধাবার পাশে একটা বিষণ্ণ মাদার গাছ সারা বছর মনখারাপ করে থাকে। এই সময় ওই গাছে আগুনরঙের ফুল ফোটে। আগুনের ভেতর থেকে একটি ফাজিল পাখি ডেকে ওঠে,
‘পিউ কাহা, পিউ কাহা…।’
৩৪।
চিকা বিশুর চেহারায় একটা চেকনাই এসেছে।
আগের সেই চোয়াড়ে ভাবটা আর নেই। ‘চিকা’ নামটাও আস্তে আস্তে উবে যাচ্ছে, সকলেই ও এখন শ্রী বিশ্বজিৎ পাল মহাশয়। করপোরেশনের মেয়র হওয়ার পর থেকেই রোজ জিমে যাচ্ছে। সে হাঁসফাঁস করা স্থূল ভাবটা আর নেই। নির্দল হয়ে জিতে আসার পর থেকে বাকি দলগুলো বেশ তোয়াজেই রেখেছে চিকা বিশুকে। মিঠাপাতা একশো বিশ জর্দা ছেড়েই দিয়েছে প্রায়। তবু জে ডব্ল্যু ম্যারিয়টের এই সুইটের ভেতরেও ঘাম হচ্ছে।
‘বিশ্বজিৎ বাবু, এমন ঘামছেন কেন আপনি?’
সাংবাদিক প্রশান্ত ধরের প্রশ্নে ভারি জহর কোট অবধি ঘেমে ওঠে চিকা বিশুর,
‘আর বলিস না ভাই। ফোন পাচ্ছি, ফোন। থ্রেট কল।‘
সাদা ধপধপে একটা তোয়ালে দিয়ে মেয়র সাহেবের ঘাড়ের পাশ থেকে ঘাম মুছিয়ে দেয় ওর পিএ। বুলেট পঞ্চু। চিকা মেয়র হওয়ার পর থেকেই বুলেট পিএ। উঠতি ঠিকাদার থেকে বার-মালিক সকলেই জানে মেয়রের কাছে পৌঁছুতে গেলে বুলেট পঞ্চুই ভরসা। এ হেন পঞ্চুর মুখেও আতঙ্কের ছোঁয়া,
‘কিছু একটা করুন, প্রশান্তদা।’
‘কেন, কী আবার হল? ভালই তো চলছিল সবকিছু। মেয়রের প্রশস্তি করে কত রিপোর্ট ছাপলাম বলো আমার পোর্টালে। চিকাদা-র রক্তদানের ছবিতে তো হাজার হাজার ভিউ।’
‘আরে, ভিউ-এর মার গাঁড়া গেছে। চম্পাসারির রাস্তায় তিনমাসের মধ্যেই ছাল বাকল উঠে গেছে।’
‘এরকম তো কতই হয়। আবার টেন্ডার, আবার রাস্তা, আবার ঠিকাদার। চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ। রাস্তা তৈরি করার চাইতে ভেঙে যাওয়াটাই তো মজার।’
‘এদিকে চিকাদা-র মজা যে বের করে দিচ্ছে ফোন করে করে। শুধু কি আর ফোন, আজ যা ঘটেছে তা তো কাউকেই বলিনি, আমরা দুজনেই সালটে নিয়েছি। দাদা শুধু তোমাকে বিশ্বাস করে তাই তোমার সঙ্গেই শেয়ার করতে চায় ঘটনাটা।’
‘দাদা, খুলে বল তো কী হয়েছে?’
ঘাম মুছতে মুছতে চিকা বিশুর কান্নাভেজা গলা,
‘বেশ কিছুদিন থেকেই আননোন নম্বর থেকে ফোন পাচ্ছিলাম। কর্পোরেশনের ভেতরে যা হয়, বোঝোই তো, একটু আধটু…। প্রতিটা কেস-এর ডিটেইলস তুলে ধরে ফোনে কী হুমকি আমাকে। বলে কিনা গরিবের পয়সা গরিবকে ফেরত দিয়ে দাও, নইলে বিপদ আছে। প্রথম প্রথম ফাইজলামি ভেবেছিলাম। কিন্তু কয়েকদিন আগে ফোনে বলে উড়িয়ে দেবো তোমাকে।’
‘কিছুই তো করেনি এখনও, এত ভয় পাওয়ার কী আছে?’
‘আরে সেটাই তো ব্যাপার। আজ চিকাদার চেম্বারে যে ভল্ট থাকে তার ভেতরে বোমা রাখা ছিল। টিফিন কৌটোর বাইরে টাইমার সহ বোমা।‘
‘ডায়েরি করেননি, দাদা?’
‘মাথা খারাপ? জান হাতে নিয়ে আমরা দুজনেই কাউকে কিছু না জানিয়ে ওটা মহানন্দায় ফেলে দিয়ে এলাম। যে সরকারি ভল্টের ভেতরে বোম রাখতে পারে সে সবকিছুই করতে পারে।‘
‘উপায়?’ এবারে প্রশান্ত ধরও ঘামতে শুরু করে। করপোরেশন থেকে একটা ভাল মাসোহারা বাঁধা আছে ‘খবরিলাল’ পোর্টালের জন্য।
‘সুভাষদাকে বলেছিলে ব্যাপারটা?’
‘সে আর বলিনি। বাটাদাকেই তো প্রথম ফোনটা করি।‘
‘তারপর?’
‘তার আর কোনও পর নেই প্রশান্ত। সুভাষদা পরিষ্কার বলে দিলো, হাত ময়লা করিস না। নীরেন নন্দী আর বিএলআরও অফিসের কথা তো জানিসই।’
‘বাপরে সে এক ঘটনা বটে’, প্রশান্ত আঁতকে উঠে বলে, ‘আমি তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলাম।‘
চিকা বিশুর মুখে কান্নার ছাপ, ‘উৎপাতের পয়সা নাকি চিৎপাতেই যাবে, বাটাদা বলল। আরও বল সব ছেড়েছুড়ে দান ধ্যান করে পাপস্খালন করার কথা। সময় নাকি পালটে যাচ্ছে।’
‘উঠি তাহলে, চিকাদা’, বাটা সুভাষের নাম শুনলে, এখনও, প্রশান্ত ধরের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যায়।
মিলন গোম্বু রিটায়ার করেছেন কয়েকদিন আগে।
আজ গাড়ি চালিয়ে ফিরে চলেছেন পাহাড়ে। রিটায়ারমেন্ট বেনিফিটের পুরো টাকাটাই ‘কোড গ্রিন’-এর বিভিন্ন বেনামি অ্যাকাউন্টে দিয়ে দিয়েছেন। বাড়ি একটা করেছিলেন বটে ছোটখাট। সেটাও সুমন ইয়োলমোর ‘দ্য হরাইজন’ কে দান করে দিয়েছেন। পাহাড়ের প্রতিটা বাঁক নিখুঁতভাবে কাটিয়ে উপরে উঠছিলেন যখন মনে পড়ে যাচ্ছিল নিজের ছোটবেলা। বাপ-মা নেই এমন একজনকে মানুষ করেছিলেন যে মানুষটি, তিনি আর নেই। কার্তোক মনাস্টারিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন উনিই। এমন দেবতা না থাকলে কোথায় ভেসে যেত এক অনাথ বালক। বৃদ্ধ লামার একটি উপদেশ সারাজীবন মনে রেখে দিয়েছেন মিলন, ‘মানুষের ভাল কোরো, যে পথেই হোক না কেন।’ সেই আপ্তবাক্য অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছেন এই রিটায়ার্ড ডিএসপি। এই যে ফিরে যাচ্ছেন এখন সেও তো ওইখানেই। ইচ্ছে ছিল, মনাস্টারিতেই কাটিয়ে দেবেন বাকি জীবন কিন্তু ট্রিপল আর চাইছেন ‘দ্য হরাইজন’-এর কাজকর্ম দেখভাল করতে। আসলে ‘কোড গ্রিন’ ওপরে ওপরে শেষ হয়ে গেলেও অবশিষ্ট কাজগুলোকে এখনও মনিটর করার দরকার আছে। পাবলিক কোনও মুভমেন্টকে তুঙ্গে নিয়ে গেলেও কোথাও একটা অদৃশ্য সুতোর টান থাকা দরকার। সে কাজে মিলন গোম্বুকে এখন আড়ালেরও আড়ালে ব্যবহার করতে চান রাধারানি।
মেল্লি চেকপোস্ট পেরিয়ে যে ছোট্ট ক্যাফেটা আছে সেখানে সুভাষ অপেক্ষা করছে। এটাই দুজনের রঁদেভু পয়েন্ট। মিলন গোম্বুর গাড়ি দেখেই বাইরে বেরিয়ে আসে বসন্ত্ সুব্বা। সেই নিখুত জ’লাইন, সেই টম ক্রুজের মত মুখের আদল,
‘সাহাব, সুভাষজী অনেকক্ষণ ধরে ইন্তেজার করছেন আপনার জন্য।‘
স্মিত হেসে ভেতরে ঢোকেন মিলন গোম্বু,
‘হাই সুভাষ, তুমিও কি আমার মত বিফোর টাইম মেইন্টেন করছ আজকাল?’
‘মিলনজী, সবটাই আপনার থেকে শেখা। আপনিই আমাদের সারথি।’
‘ম্যাডামকো ইয়াদ করো, সুভাষ। একরত্তি একটা মেয়ে কী অদ্ভুতভাবে চালিয়ে নিয়ে গেল গোটা অপারেশনটা!’
‘সে তো বটেই কিন্তু আপনি আমাদের কৃষ্ণ। এখন দুটো সাজেশন চাই আপনার।‘
‘গো অন, সুভাষ।‘
‘আপার চ্যাংমারির লেবু আর কলাবাগানের নীচে পুঁতে রাখা জিনিষপত্র কী করব? দুই, সব অ্যাকটিভ সেলগুলো কি ডিসল্ভ করে দেবো?’
‘সুভাষ, অস্ত্র যা আছে থাক। প্রায় বিনা ব্যবহারে আমরা অনেকটাই কাজ হাসিল করে ফেলেছি। তবে ভবিষ্যৎ কেউ জানে না। রুলিং পার্টির আড়াই দশকের পুরনো একটা ক্যাডার বেস আছে, ভুলেও যেও না। ওগুলো থাকুক। মনে করো কিছুই নেই। ঘুমিয়ে থাকুক ওরা। যেভাবে আছে এখন।’
‘আর অ্যাকটিভ লোকজন?’
‘আমাদের লোকেরা মার্কড নয়। থাকুক ভিড়ের মানুষ হয়ে। নো অ্যাসাইনমেন্ট। সাধারণ মানুষ নিজেই নিজেদের অ্যাসাইনমেন্ট বুঝে নিচ্ছে এখন। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কী করবে সুভাষ?’
‘বাপ ঠাকুর্দা অনেক রেখে গেছেন, মিলনজী। আমার ব্যবসাপাতি যা আছে, আপনাদের আশীর্বাদে ভালই চলে যাবে। কালো টাকা যা ছিল, ভাল কাজে খরচ হয়ে গেছে। এখন থেকে আবার কার র্যালি অর্গানাইজ করব। বাচ্চাদের অংক শেখাব।‘
এরপর দুটো গাড়ি দু-দিকে চলে গেল।
একটা পাহাড়ের বাঁক বরাবর অনেক ওপরে অন্যটা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে শিলিগুড়ি শহরের দিকে।
বাতারিয়া নদীর জল ওদের দু-জনকে ডাকছিল। খেতে দুলতে থাকা লাফা শাক বলছিল, যাস না তোরা। প্লাইউড ফ্যাক্টরির কাঁচা কাঠের গন্ধ বলে উঠেছিল, না গেলেই নয়? এই একটা মাত্র জীবনে অনেক কিছুই তো দেখল হরি। অনেক নারীর শরীরও মুখস্ত। পথঘাট, গলতা রাস্তা সবকিছুই হাতের তালুর মত চেনা। শুধু জমিন বাদ দিয়ে কোনওকিছুর মায়ায় জড়ায়নি এখনও। এই বাতাসী ছেড়ে যেতে মনখারাপ হচ্ছে বটে তবে এখানে নিজের জমিন নেই। আর নিজের জমির ওপর উপুর হয়ে শুয়ে ভাপ নিতে বড্ড ভাল লাগে এইচ ডি-র।
জমি তো শখে কেনে। এক পৃথিবী জমিন চাই ওর। মানুষ চাষ করবে, সব্জি ফলাবে, পেট চালাবে। এসব করবে বলেই হরি জমি কেনে। বীজ লাগানো থেকে ফল ধরা, এই দেখে দেখে একটা গোটা জীবন কাটাবে বলে না বাইরের জমি বেচে দিয়ে ভেতরের থেকে আরও ভেতরে জমির পর্চা খুঁজে বেড়ায় ও। একদিন সব জমি অন্যের নামে করে দিয়ে আকাশেও ঠিক মাটি খুঁজে নেবে এইচ ডি। লোকাল করেস্পন্ডেন্ট, ‘দ্য ডেইলি নিউ এজ’, সম্পাদক, ‘জলঢাকা নিউজ।’ আজকে হরি একা বাড়ি ফিরছে না। বাতাসির এই পড়ন্ত রোদ যেন সাবিত্রীর সাদা খোলের তাঁতের শাড়িতে রঙের রায়ট লাগিয়ে দিয়েছে। আকাশের রঙও বুঝি এমন সিঁদুর লেপটে দিতে পারে এই মেয়েটির সিঁথিতে?
হরির বাইক যখন নাগরাকাটায় বাড়ির সামনে এসে থামল তখন রাত্রি গাঢ় হয়ে আসছে। ভেতরের ঘর থেকে তক্তাপোষের ওপর শুয়ে থাকা তরুবালার ক্ষীণ আওয়াজ,
‘হরি, অ হরি। এলি রে বাপ?’
‘হরি, অ অ অ হরি…’
---------------------------------- সমাপ্ত ----------------------------------
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team