৩১।।
ফাঁসিদেওয়া থানার ওসি বিধান দারোগা বেশ ভোজনরসিক।
ঘোষপুকুরের ধাবায় এলে বিধান তপাদার একটু বেশিই খান। দিশি মুরগির গরগরে কষা আর রসুনের চোকার মতো পাতলা রুমালি রুটি। মদ, মেয়েছেলে আর ঘুষের পরই রুটি-মাংসের এই কম্বো ডিশ এস আই বিধানবাবুর উইশলিস্টে থাকে। খাওয়ানোর লোকের অভাব নেই। এলাকার দু’নম্বরি মদ বিক্রেতা থেকে সুপারির চোরাচালানকারী, জগতে সেবা করার লোকের অভাব নেই। তবে এখন শোনা থানার চার্জে নাকি আস্তে আস্তে ইনস্পেক্টরদের নিয়ে আসা হবে। এস আই-রা পুরো থানার দায়িত্ব নাকি আর পাবে না।
সে যাই হোক, ওসব কু-ভাবনার কথা এই সময়ে ভাবতে চায় না বিধান। ওসির রেলাই আলাদা। থানা কমপাউন্ডের মধ্যেই একটা ছোট্ট বাড়ি দারোগাবাবুর জন্য বরাদ্দ। ছিরিছাঁদ নেই বটে, পায়খানার ছাদ থেকে বর্ষায় জল চুঁইয়ে পড়ে কিন্তু শখ করে ওই সরকারি বাড়িটিকেই ‘বাংলো’ বলতে খুব ভাল লাগে বিধান দারোগার। বিধাননগরের আনারস থেকে বিলাইতি মাল... সন্ধেবেলা বাংলোয় সবই চলে আসে। এ-জীবনে বেঁচে থাকার সুখটাই আলাদা। ভাল জমি রেকর্ডে অদলবদল হলে তো গণ্ডার মারা পড়ে সেদিন। টাকার বান্ডিলের একটা আলাদা গন্ধ আছে, ফুলশয্যার বিছানার মতো। এই যেমন এখন, সামনে হাতজোড় করে বসে আছে হরিদাস সাহা। এদানে ছোঁড়া বি এল আর ও অফিসে দালালি করে বেশ কামাচ্ছে। ওর বাইকে চেপেই আজ এখানে এসেছে বিধান দারোগা। নিজের জিপে এলে সঙ্গে কনস্টেবল আর আর টি সেটের ঘ্যানঘ্যানানি। শান্তিতে একটু মাল খাওয়া যায় না।
হরিদাস তেলতেলে মুখে গ্লাসে মদ ঢেলে দিচ্ছে,
‘আরও একখান ঠ্যাং বলি বড়বাবু?’
‘বল। বলে দে। কচি মুরগি আর কচি ঠ্যাং-এর কি বিকল্প আছে রে, হরিদাস?’
‘হেঁ, হেঁ। খাওন রসিক মানুষকে খাইয়েও সুখ। বিকালে একটা আর সি পাঠাই, বড়বাবু?’
‘মোটা দাঁও নাকি রে, হরিদাস?’
‘একলপ্তে অনেকটা আদিবাসী জমি, স্যর।‘
‘আইনকানুন সব বাঁচিয়ে করেছিস তো?’
‘এক্কেবারে। জোসেফ খালকোর রাস্তার ধারের তিনবিঘা জমির বদলে ভেতরে তিনবিঘা চাষের জমি। সঙ্গে দুই লাখ টাকা। তিনটা সাদা শুয়ার। কি এমন খারাপ ডিল, ক’ন স্যর?’
‘কিচ্ছু খারাপ না। এক কোটির ওপরে খেলা। শোন একদিন ব্যবস্থা কর।‘
‘চিন্তা করবেন না, বড়বাবু। সরেস মাল হাতে আছে। একেরে কলেজ গার্ল, ফ্রেশ।‘
অসম্ভব প্রশান্ত মুখে রুমালি রুটি, মাংস আর কলেজ গার্লের কথা ভেবে চোখ বন্ধ হয়ে আসে বিধান দারোগার।
পৃথিবীর কোনও সুখই চিরস্থায়ী নয়।
নেশাটা জমে এসেছে এমন সময় থানার জিপ আসে ধাবার সামনে। হাবিলদার ভোলা ছুটতে ছুটতে আসে ভেতরের কেবিনে,
‘অনেক কষ্টে আপনার খোঁজ পাইসি বড়বাবু। মোবাইলও ধরে না, এমন জায়গায় আছেন এখন।‘
‘কেন, কি ব্যাপার? রুটি মাংস চলবে?’
‘আর রুটি মাংস। ওদিকে নীরেন নন্দীর বাড়ির সামনে হুলাট ব্যাপার স্যর। চলেন তাড়াতাড়ি।‘
নীরেন নন্দী পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। এই এলাকার বাঘ আর গরু একসঙ্গে জল খায় নীরেনের কথায়। ওর নাম শুনেই নেশা ফেটে যায় বিধান দারোগার। কচি মুরগির দুটো ঠ্যাং এখনও প্লেটে। ওদিকে না তাকিয়েই বেল্ট ওপরে তুলতে তুলতে ছুটতে শুরু করে বিধান দারোগা,
‘কেসটা কি, ভোলা?’
‘কেস গুরুচরন, বড়বাবু। একঘন্টা ধরে নীরেন নন্দীর বাড়ি আর অফিসের সামনে টোটাল হুলাট। হাজারখানেক আদিবাসী তির-ধনুক আর মাদল নিয়ে ক্যাচাল করতেসে। এস ডি পি ও সাহেব আপনাকে ফোনে পায় নাই। নিজেই শিলিগুড়ি থেকে রওনা দিসেন। এতক্ষণে থানায় মনে হয়।‘
ঘামতে ঘামতে রুটি, মাংস আর মদ ভুলে ফাঁসিদেওয়া থানার মাহিন্দ্রা উইলিস জিপে ওঠেন বিধান দারোগা,
‘শালার বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ এসব কী! আজ স্যাটা ভেঙে দেবো সবক’টার।‘
দাত্তা সাহেব নীরেন নন্দীর বাড়ির সামনে এলেন যখন, ততক্ষণে থানার সেকেন্ড অফিসার মিশ্রাজির গাড়ি ঘিরে নৃত্য করছে আদিবাসী মেয়েরা। পুলিশের জিপ ভাঙেনি, কাউকে অ্যাসল্ট করেনি কিন্তু এত লোকের সামনে ফোর্সকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখাটাও একধরণের ক্যালকুলেটেড অ্যাসল্ট। ওদিকে নীরেন নন্দীর বাড়ির একটু দূরে দাউদাউ আগুন জ্বলছে। ড্রাইভার প্রশান্ত জানায়,
‘পোয়ালের পুঞ্জিতে আগুন দিসে স্যর। বাড়িতে কিছু করে নাই।‘
বাড়িতে আগুন দেয়নি বটে তবে কয়েকশো আদিবাসী যুবক বাড়ির ভেতরে। নীরেন সহ বাড়ির সকলকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে তালাবন্ধ করে রেখেছে। কয়েকজন একমনে খুঁজে চলেছে নীরেনের সেগুন কাঠের আলমারিগুলো। গয়নাগাটি, টাকা পয়সা কোনোদিকে কারও নজর নেই। সকলেই নিজের এবং বাপ ঠাকুর্দার জমির দলিল খুঁজে বেড়াচ্ছে।
আর টি সেটে দার্জিলিং-এ এস পি সাহেবকে ধরে সৌরভ,
‘স্যর সিচুয়েশন ইজ রিয়েলি গ্রেভ হিয়ার। নীরেন নন্দীর বাড়ি র্যানস্যাক হচ্ছে। অল আর লোকাল ট্রাইবালস্। শুড আই ইউজ ফোর্স?’
‘ওয়েট ফর ফিউ মিনিটস। ট্রাইবালদের এগেইন্সটে ফোর্স অ্যাপ্লাই করার আগে রাইটার্স থেকে অ্যাপ্রুভাল নিতে হবে। উড ইউ হ্যান্ডল দ্য সিচুয়েশন উইথআউট অ্যাপ্লায়িং ফোর্স? গিভ আ ট্রাই।‘
‘রজার স্যর।‘
দ্রিমি দ্রিমি মাদলের আওয়াজ আর প্রায় উৎসবের মতো আবহ থেকে নীরেন নন্দী এবং ওর পরিবারের লোকজনকে বাইরে নিয়ে আসার পর সৌরভ বুঝতে পারে এইচ ডি গোটা প্ল্যানটাই নিখুঁত একজিকিউট করেছে। বাকিরা শুধু আওয়াজ তোলার জন্যই ভেতরে ঢুকেছে, দুই থেকে তিনজন লোক, যারা জমির কাগজ দেখে চিনতে পারবে তারাই মূলত আলমারি ভেঙে উদ্ধার করেছে পুরনো দলিল, প্রাচীন কবলা। নীরেন নন্দীদের পুলিশের গাড়িতে নিয়ে শিলিগুড়ির দিকে রওনা দেন দাত্তাসাহেব। গাড়িগুলো মাটিগাড়া ক্রস করার সময় আর টি সেটে মেসেজ আসে, বিধানের উদ্ভ্রান্ত গলা,
‘স্যর, বি এল আর ও অফিস থেকে কাগজ লুঠ হচ্ছে। কয়েক হাজার লোক। ঘেরাও হয়ে আছি এখন। অ্যাডিশনাল ফোর্স ডিপ্লয় করুন স্যর।‘
‘দেখছি, তা তোমার রুটি মাংস খেতে ঠিক কতটা সময় লাগে, বিধান?’
মোবাইলে ডাবগ্রাম আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন থেকে ফোর্স রিকুইজিশন দিয়েই বাগডোগরা বি এল আর ও অফিসের দিকে নিজের গাড়ি ঘোরায় সৌরভ।
কলকাতা থেকে কুচবিহার খবর এখন একটাই।
স্নিগ্ধসুন্দরের অর্ধনগ্ন মৃতদেহ আর নিজের তোলা নিজেরই পর্ন ভিডিও। যে সব আকাদেমি থেকে স্নিগ্ধ পুরস্কার পেয়েছিল, সব ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে এখন। এবারে বিশ্ব কবিতা উৎসবের কনভেনর ছিল স্নিগ্ধ। সেই উৎসব পিছিয়ে গেছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সাম্মানিক ডি লিট রদ করে দিয়েছে সে দেশের সরকার। যে তরুণ কবিরা স্নিগ্ধর চিয়ারলিডার ছিল, ফেসবুকেই তারাই সবার আগে স্নিগ্ধসুন্দরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। অনেক মেয়ে একটার পর একটা পোস্ট দিয়ে স্নিগ্ধর যৌনাচারের পুঙ্খানুপুঙ্খ লিখে চলেছে। ‘মি টু’-র সাম্প্রতিকতম ট্রেন্ডে কবি স্নিগ্ধসুন্দর মরেও বেঁচে আছেন প্রবলভাবে।
অনেকদিন বাদে ভগবান দাস বেহালাবাদক হাঁটতে বেরিয়েছে। সেই সক্কালবেলা গোশালা মোড় থেকে হাঁটতে হাঁটতে বাগজানে আমিন মিয়াঁর বাড়িতে যায় ভগবান। অনেকদিন বাদে শরীলের কলকব্জাগুলা খানিক ঢিলা হয়। আহ্, হাঁটনের চেয়ে বড় সুখ আর কিছুতে পায় না ভগবান। এখন চারদিকের সর্ষে খেতে ফুল ধরেছে। সরিষার খেত বরাবর মৌমাছিদের ওড়াওড়ি। হাঁটতে হাঁটতে জগতের এইসব লীলাখেলা দেখে বড়ই আমোদ জাগে মনে। ভগবানের ভগবান পৃথিবীটা বানাইছে বটে! কী তার নিয়ম, কী তার সূক্ষ্ম ছলাকলা। না হাঁটলে জগতের কত কিছুই যে অদেখা থাকত, ঠাকুরের লীলা বুঝনের জন্য জীবনে হাঁটা চাই। এই এখন যেমন হাঁটতে হাঁটতেই নাকে আসে সরিষা ফুলের তিতামিঠা একটা গন্ধ। লালপুল পার হয়ে বাঁ দিকে কান্নিক নেয় ভগবান। আমিন মিয়াঁর সাধের বাড়ি দেখা যায়। সেই হাড়ভাঙা গাছের বেড়া, পোষা মুরগি আর বকফুলের গাছে ফুটে থাকা সাদা সাদা পালক।
ভগবানকে দেখেই বেতের ইজিচেয়ার থেকে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরে আমিন মিয়াঁ,
‘আরে সাগাই, এতদিন বাদে! আজকাল বড় হোটেল খুলছ তুমি। মিয়াঁর কথা মনে পড়ে না একদম?’
‘ক’ন কি মিয়াঁ, বেবাক সময় তো আপনাদের কথাই ভাবি। এই তারকদা, ইলাদি, সুমনদা আর ওই গানের দলের ছেলেমেয়েগুলা এমন বন্ধনে জড়ায় দিসে...’
‘জানি ভগবান, সব জানি। তুই সৎ মানুষ, তোর হাতের রান্না আর ধাবার খবর এখন দিকে দিকে। বুড়া বয়েসেও চোখে জল আসে তোর উন্নতিতে।‘
‘কত্তা, পয়সা দিয়ে এখন কি আর করি বলেন তো। যখন দরকার ছিল তখন হাতে কিছু ছিল না, এখন দরকার নাই হাতেপাতে পয়সাই পয়সা। তবে অনেক কয়টা মানুষ আমার ওখানে খাইটে নিজের সংসার চালায়। আমার নিজের যদি বলেন, মাথার ওপর এতদিনে একটা পার্মানেন ছাদ হইসে। তবে বেহালা বাজানো বলেন বা ধরেন গিয়া হাঁটন, কোনোটারই সময় পাই না আর তেমন।‘
‘আরে ভগবান, তোর হাতের রান্নাতেও সুর আছে। জগতে কোথায় সুর নাই বলত তুই? এক সুরের মাঠ থেকে অন্য সুরের মাঠে তুই ফিট কইর্যা গেছস। চল্, খাইতে বস।‘
মিয়াঁর বাড়িতে খাওনের একটা আলাদা মজা আছে। বাড়াবাড়ি নাই তবে সাজায় খাইতে দেয়। কাঁসার বাটিতে নানান পদ, কালানুনিয়া চালের ভাত, থালার এক কোণে লাফা শাকের প্যালকা। জীবনে এই একটা লোককে নিজের রক্তের আত্মীয় বলে মনে হয় বেহালাবাদকের,
‘মিয়াঁ, শুনছেন?’
‘বুক ধড়ফড় করে ভগবান, বুক ধড়ফড় করে। নিজের রক্ত তো। তবে কাজটা জব্বর করসে বটে জন্নত। তোর কথা শোনে, একটু সাবধানে থাকতে বলিস।‘
‘মিয়াঁ, সুভাষদার প্ল্যান নিখুঁত থাকে সবসময়। আর জন্নত তো আমাদের কাঁচা হিরা।‘
পড়ন্ত আলোয় আমিন মিয়াঁর কপালে বয়সের দাগগুলো কেঁপে ওঠে,
‘চাইরদিকে একটা বদল টের পাই রে ভগবান। এই হাওয়া বাতাস, শীতের হিম, দখিনা বাতাস... সবকিছুতেই একটা অদলবদলের সুর। বয়স হইলে একটা অঙ্গ বিকল হয়। আরেকটা সজাগ হয়। চোখ আর কান জবাব দিতেছে এখন। গন্ধ টের পাই খুব। চাইরদিকে একটা উথালপাথাল গন্ধ।‘
‘চিন্তা কইরেন না মিয়াঁ, মানুষই বদল আনে। এক সময় পাশের লোকটাও জানে না আমরা একই নৌকায় হাল বাইতেছি। হাওয়া শন শন করে বয় মিয়াঁ। ধুলাবালি উড়নের সময় শুরু হইয়া গেছে।‘
ওঠার আগে মিয়াঁর ঠাণ্ডা হাতটা ছুঁয়ে বিদায় নেয় ভগবান। এখন অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। দোমোহানি মোড়ে এসে আকালু বর্মনের দোকানের সামনে দাঁড়ায় ভগবান। দোকান বলতে হাটের সামনে, রাস্তার পাশে ফুটপাথে প্লাস্টিক বিছিয়ে আকালুর মাছের ব্যবসা। নিজেই তিস্তায় মাছ ধরে সারাদিন। বিকেলে সেই মাছ দোমোহানি হাটের সামনেটায় বিক্রি করে। ভগবানকে দেখে কান এঁটো করা হাসি হাসে আকালু,
‘ভগবানদা, নিজেই আজকে? লোক পাঠান নাই কালকে। আবার হাঁটনের শখ চাগাড় দিসে নাকি?’
হাসে ভগবান,
‘ম্যালাই মাছ ধরছিস আজ।‘
‘হ্যাঁ, দাদা আইজ কপাল চকচকা। রাইচ্যাং আর বইরালির অভাব নাই আজ। বসেন চা খান।‘
আকালুর থেকে মাছ নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে ভগবান।
তিস্তা ব্রিজের পাশে টোল গেটের পাশের কাঞ্চন গাছটার নীচে ‘ভার্জিন মোহিতো’র দলটা আড্ডা দিচ্ছে নিজের নিজের স্কুটি আর বাইকের ওপর বসে। দূর থেকে ভগবানকে দেখেই সমস্বরে আওয়াজ ওঠে। বাপ রে বাপ চিল্লাইতে পারে বটে এরা। মহুয়া নিজের স্ট্যান্ড করা স্কুটিতে বসতে বলে ভগবানকে,
‘কাকা, পালাচ্ছিলে কেন?’
‘আর বলিস না বেটি, হাতের মাছগুলার কথা ভাবি শুধু। বেশি দেরি হইলে মাছে পচন লাগব।‘
‘বুঝ দিও না কাকা আমি জানি আকালুদা তোমার মাছ কেটেকুটে হলুদ মাখিয়েই দিয়েছে। বসো, একটা জয়েন্ট নাও। অনেক খবর আছে।’
‘তোদের ওই জয়েন ময়েন মানে গাঁজা তো? ও আর পারি না রে, ব্রহ্মতালু ফাইট্যা যায়। সিগারেট দে বরং। পেছনে ফিলটার দেওয়া সিগারেটে টান দিতে বেবাক মজা।’
‘ফালতু কথা বোলো না কাকা, তোমার এখন অনেক পয়সা’, জোজো ফুট কাটে।
‘পয়সা তো তোদের জন্যই। নে, কী খবর দিবি বললি?’
‘তোমার ডি এম-এর বউয়ের তো এবার বিশ্ব কবিতা উৎসবে যাওয়া বাতিল হয়ে গেল। এত খাতিরদারি সব বেকার’, জয়েন্টে আরো একটা টান দেয় জন্নত, ‘স্নিগ্ধর কারনামা নিয়ে অপাপবিদ্ধা সিংহ রায় বিরাট পোস্ট দিয়েছে ফেসবুকে। অথচ একসময়ে স্নিগ্ধসুন্দরের পোস্টার গার্ল ছিল। স্নিগ্ধর সুপারিশেই মাদুরাই কবিতা উৎসবে একমাত্র বাঙালি কবি।’
এই জন্নতকে নিয়ে বড় ভয় ভগবানের। দু’দিন আগেই ঠান্ডা মাথায় খুন করার পরও মেয়েটার হাবভাবে কোনও বত্যয় নেই। নিঃশ্বাসের ওঠাপড়ায় কোনও হেলদোল নেই। একে দেখলেই রাধারানির কথা মনে আসে ভগবানের।
খানিক বাদে ভগবানের ধাবার দিকে আবার হাঁটা দেয় বেহালাবাদক।
বাতাসে সরিষা ফুলের তিতামিঠা গন্ধ।
৩২।।
সাদার স্ট্রিট্রের পাট শেষ এখন। ঘুপচি ঘর থেকে বেরিয়ে বিল মিটিয়ে বাইরে আসেন ট্রিপল আর।
নীচে বাটা সুভাষের পাউডার ব্লু রঙের গাড়ি। ভ্যালেরি ডোমিনিক গাড়িতে উঠে আসার খানিকক্ষণ বাদেই নিজেকে রাধারানি রায়-এর বেশে নিয়ে ফেললেন হালকা রঙের শাড়ি এবং সামান্য প্রসাধনের দৌলতে। কলকাতা থেকে অনেক দূরে সিকিমের কার্তোক মনাস্টারির পাশে ‘দ্য হরাইজন’ আপাতত কিছুদিনের ঠিকানা হতে চলেছে ট্রিপল আর-এর। ইচ্ছে করেই প্লেন কিংবা বাসে যেতে চাননি রাধারানি এই পথটা। বাতাসি এপিসোডের পর থেকেই খুব হালচাল শুরু হবে। ওই সময়টুকু একটু অজ্ঞাতেই থাকতে চান উনি,
‘সুভাষ, আমরা কি টানা যাবো, নাকি মাঝে হল্ট করব কোথাও?’
‘টানা এতটা পথ যাওয়া ঠিক হবে না, ম্যাডাম। মাঝে মালদায় একটা স্টপওভার নিয়ে নেওয়া ভাল।’
‘বেশ, তাই হোক তবে। ওদিকের খবর কি?’
‘নীরেন নন্দীর বাড়ি থেকে অনেক কাগজ পাওয়া গেছে। তারপর বি এল আর ও অফিস থেকেও সোনার খনি। সব কাগজই সুপ্রভাত উকিলের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ফটোকপি করে। অরিজিনাল কাগজগুলো মিছিল করে এস ডি ও অফিসে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।’
‘কোনও অ্যারেস্ট?’
‘এত আদিবাসী মহিলা-পুরুষের ইনভলবমেন্ট আছে ম্যাডাম, মাস অ্যারেস্ট হয়নি। তবে মুখরক্ষার জন্য কয়েকজনকে রেডি করাই ছিল আমাদের। ওরা নিজেরাই ধরা দিয়েছে। নব্বুইদিন বাদেই বেল পাবে। এতবড় ঘটনার পর কয়েকজনকে ধরতেই হত পুলিশকে। সেদিক থেকে দেখলে প্রশাসনের মুখরক্ষা হয়েছে আর আমাদের কাজ হাসিল।’
‘ঠিক, তবে ভয়টা দেখাতেই হবে নইলে জমি উদ্ধার করা মুশকিল। সুপ্রভাতবাবু জান কবুল লড়বেন, জানি আমি কিন্তু সিভিল কোর্টে মামলার ফয়সলা হতে যুগের পর যুগ কেটে যাবে। ভয়টা ভীষণ জরুরি।’
‘হ্যাঁ, ম্যাডাম। কাল পরশু থেকে ‘ফুটবলার’রা প্র্যাকটিসে নামবে।’
‘নামুক কিন্তু রক্তপাত না হয় যাতে, সেটা খেয়াল রেখো। এতটা জনসমর্থন বিফলে যাবে তাহলে। প্রশাসনও সুযোগ পেয়ে যাবে। রুলিং পার্টির মেশিনারি তো জানোই, তেল খাওয়া যন্ত্রের মতো। লোকাল জোনাল সব গর্ত থেকে বেরিয়ে আসবে আবার।’
‘ম্যাডাম, ভেতরে ভেতরে মাটি ধ্বসে গেছে অনেকটাই। কোড গ্রিন-কে মানুষ অনুভব করছে এখন।’
‘এই বদলের ইশারা এবং সংকেতকে ঝড়ে পরিণত করে ফেলতে হবে, সুভাষ। লোহা গরম আছে এখন।’
খাপরাইল মোড় থেকে খুব দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে বাগডোগরা বি এল আর ও অফিসে পৌঁছয় সৌরভ। আর টি সেটে খবর আসে ডাবগ্রাম পুলিশ ব্যাটালিয়ন থেকে কমব্যাট ফোর্স রওয়ানা দিয়েছে। বি এল আর ও অফিসের সামনে লোকে লোকারণ্য। ঠিক নীরেন নন্দীর বাড়ির সামনেটায় যেমন ছিল। লোকাল থানার দুটো জীপের পাশে মাদল আর জংলি ফুল নিয়ে নাচছে আদিবাসী ছেলেমেয়েরা। ভেতরে কাগজ লুঠ হচ্ছে। ওসি বিধান তপাদার ‘স্যটা ভেঙে’ দেওয়ার বাসনা নিয়ে এখানে এলেও এখন ঘেরাও হয়ে আছে ভেতরে। খবর আসে ওসিকে দু’প্লেট মুরগির মাংস আর হাঁড়িয়া খাওয়ানো হচ্ছে এখন। বি এল আর ও ছেলেটি নতুন। এক এক করে কাগজ নিয়ে বেরিয়ে আসছে জমি-বুঝদার কয়েকজন লোক। এরা কাগজ দেখেই জমির চাল চরিত্র বুঝতে পারে। ডাবগ্রাম থেকে ফোর্স আসার আগেই জমির কাগজ সহ লোকজন সৌরভের সামনে আসে। তার আগেই সব কাগজ জেরক্স হয়ে গেছে নিখুঁত সময়জ্ঞানে। মব থেকে কয়েকজন আদিবাসী তরুণ এসে দাঁড়ায় এস ডি পি ও সাহেবের গাড়ির সামনে,
‘সাহাব, আমরা কোনও কিছুই লুঠ করব না। একটা কাগজের টুকরোও না।’
‘এ তো লুঠই। লুঠ ছাড়া আর কি বলা যায় একে?’
‘সমস্ত ঘাপলা কাগজ আমরা শিলিগুড়ির এস ডি ও অফিসে জমা দেবো সাহাব।’
সৌরভ বোঝে এখন ফোর্স অ্যাপ্লাই করলে রিটালিয়েশন হবে। এস পি সাহেবকে ব্রিফ করে গোটা ঘটনাটা। এস পি-ও বোঝেন পুলিশের গুলিতে ট্রাইবালদের মৃত্যু হলে সেটা হারাকিরি হবে। আগুন জ্বলে উঠবে চতুর্দিকে। সৌরভকে নির্দেশ দেন,
‘অ্যাপ্লাই মিনিমাম অর নো ফোর্স বাট এনসিওর দ্যাট দ্য পেপারস আর সিকিওর্ড।’
‘রাইট স্যর।’
তারপর ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক বরাবর এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের জন্ম হয়। কয়েক হাজার মানুষের মিছিল উৎসব পালন করতে করতে এগিয়ে চলল শিলিগুড়ির দিকে। সামনে পিঠে বাচ্চা বেঁধে আদিবাসী মেয়েরা, মাঝে এবং মিছিলের লেজের দিকে নৃত্যরত যুবক এবং বয়স্ক মানুষের দল। কারো হাতে তির-ধনুক, কারো হাতে ঢোল। মিছিলকে প্রায় এসকর্ট করে নিয়ে চলেছে বিরাট পুলিশ ফোর্স। দুদিকের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে বাগডোগরা থেকে শিলিগুড়ি কোর্ট অবধি বারো-তেরো কিলোমিটার রাস্তাকে প্রায় গ্রিন জোন বানিয়ে ফেলা হয়েছে। মিছিলের মাথায় সাংবাদিকের দল। মোবাইল এবং টি ভির ক্যামেরা হাতে। ফোনে এস ডি ও মিস্টার শ্রীবাস্তব-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে সৌরভ। দার্জিলিং থেকে এর মধ্যেই ডি এম সাহেবের ফোন এসেছে এস ডি ও-র কাছে,
‘এস ডি পি ও সাহেব, প্লিজ এনসিওর দ্যাট দ্য পেপারস রিমেইন ইন্ট্যাক্ট। আউ হ্যাভ বিন ডাইরেক্টেড বাই দ্য হাইয়েস্ট অথরিটি টু রিসিভ দ্য ডেপুটেশন। শুধু জমির কাগজ যাতে লুঠ না হয়।’
‘দ্যাট আই এনসিওর ইউ।’
মিছিলের পাশে পাশে একটি পালসার বাইকের পেছনে বসে নিজের মোবাইল ক্যামেরায় ছবি তুলছে প্রশান্ত ধর। ভি ডি ও এবং স্টিল ফটো। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় চাঁদমুনি বাগানের পাশে তির-ধনুক সহ এই আদিবাসী মানুষের ছবি এক একটি অসাধারণ সিল্যুট। আরাত্রিকা দিদিমণির দিল্লি ব্যুরো চিফের ভাষায় ‘সুপার্ব ভিস্যুয়াল।‘ সন্ধের মুখে মিছিল এসে পৌঁছয় কোর্ট মোড়ে। এস ডি ও অফিসে সাংবাদিকদের সামনে সমস্ত জমির কাগজ জমা পড়ে শ্রীবাস্তব সাহেবের হাতে। শ্রীবাস্তব প্রশাসনের তরফ থেকে কথা দেন সব বিতর্কিত ট্রাইবাল জমির মূল অবধি গিয়ে হাতবদলের ইতিহাস খতিয়ে দেখা হবে। ততক্ষণে আজ সারাদিনের খবর ভেসে আসছে টিভি এবং মোবাইলে স্ক্রিনে। ‘খবরিলাল’ পোর্টালের ম্যানেজিং এডিটরের মোবাইলে ফোন আসছে, এমনকী ন্যাশনাল মিডিয়া হাউস থেকেও।
শিলিগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ি যাওয়ার এন বি এস টি সি-র শেষ বাসে একদম পেছনের সিটে মংরা মাতাল। কোলের ওপর রাখা একটি স্লিং ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর লুঠ করা জমির কাগজপত্রের জেরক্স।
এইসব কাগজ মধুকুঞ্জে যাবে খানিক বাদেই।
মধুপুর শহরের বেস্টম বেস্ট উকিল সুপ্রভাত ব্যানার্জির চেম্বারে।
রুদ্রপলাশ একটি প্রতীক মাত্র। আসলে বসন্ত এসে গেছে। এই জনপদের মানুষের মনে দোতারার সুর বেজে উঠেছে, বেজে উঠেছে মাদলের দ্রিমি দ্রিমি। রুদ্রপলাশ একটি সংকেত মাত্র। আসলে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মানুষের হৃদয় জেগে ওঠে। ভয় পেতে পেতে ভয়ের বোধটাই উড়ে যায় যখন, পাশের মানুষটিও কাঁধে হাত রাখে। একার লড়াই কোন মন্ত্রবলে হয়ে ওঠে সমবেত সামগান! ম্যাজিক বটে। এই রুদ্রপলাশ গাছ একটি অমোঘ মন্ত্রের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সৌরভের সামনে। চেম্বারের জানালা থেকে বাঁদিকে তাকালেই রুদ্রপলাশ, ডাইনে মহানন্দা নদীর ওপর জ্বলতে থাকা মার্কারি ভেপার। এই আলো এবং পলাশ থেকে অনেকটা দূরে,বাতারিয়া নদীর পাশে, প্রথম বসন্তেও আগুনকে ঘিরে বসে আছে কয়েকজন কালো মানুষ। পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা বাতারিয়া নদীর জল পাথরে আছড়ে পড়ছে নিজস্ব নিয়মে। রাতের আকাশে বুদ্বুদের মতো মিশে যাচ্ছে আগুনের ফুলকি।
‘দ্য হরাইজন’ পৃথিবী থেকে বেশ খানিকটা বিপ্রতীপে।
মোবাইল নেটওয়ার্কের বাইরে, শোরগোলের বাইরে এ এক অন্য দুনিয়া। কুয়াশা এবং মনাস্টারি থেকে ভেসে আসা লামা বালকের মন্ত্রোচ্চারণে এখানে ভোর হয়। রাধারানির ভোরের দুনিয়ায় মিশে থাকে সবুজ চা আর দশ কিলোমিটারের সাইক্লিং। আজ অবশ্য সকালটা খানিক আলাদা। আজ রাতে কমলা রঙের আকাশে নতুন গাথামালা লেখা হবে। ম্যারাথন দৌড়ের শেষ ল্যাপ। কপালের ঘাম মুছে নিয়ে নিজের মনেই হেসে ওঠেন ট্রিপল আর। হয়ত বিরাট একটা দৌড়ের এটাই স্টার্টিং ব্লক। একটা আওয়াজে ছিটকে বেরিয়ে আসবে কালো কালো কিছু মানুষ।
এ দৌড় শুরু হয়ে গেছে। কখন থামবে, কোথায় থামবে কেউ জানে না। এমনকী রাধারানি নিজেও জানেন না।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team