পৌরাণিক কাহিনী হিসাবে দেবর্ষি নারদকে নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। নারদের চরিত্রটিকে নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করেছেন অনেক কথাকারই। রঙিন মেজাজের এই চরিত্র একদিকে যেমন হাস্যকৌতুকের জন্ম দেয় তেমনি নারদের কার্যকলাপ থেকে অনেক শিক্ষাও মেলে।
পুরাণে নারদের বিয়ে ও পত্নী নিয়ে চর্চার শেষ নেই। তাছাড়া নারদের যে কাহিনীগুলো পুরাণে দেখা যায় তাতে দেবর্ষি নারদ না এ নারদ অন্য কেউ তা নিয়েও বিতর্ক আছে। পুরাকালে নারদ ও পর্বত নামে দুই ঋষি একবার অন্ন আর ঘৃত দিয়ে তৈরি আহার করার জন্য মর্তে নামেন। নারদ ও পর্বত ছিলেন ঘটনাচক্রে মামা ও ভাগ্নে। মর্তে নামার পর তারা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। দুজনে দুজনের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন যে কেউ কারো কাছে কোনো কথা গোপন করবেন না। যদি কেউ কথার খেলাপ করেন তবে সে পাপের ভাগী হবেন।
ঘুরতে ঘুরতে তারা রাজা সৃঞ্জয়ের রাজ্যে এসে উপস্থিত হন এবং সেখানেই জীবন কাটাতে শুরু করলেন। রাজা সৃঞ্জয়ের কন্যা সুকুমারী যেমন সুন্দরী তেমনই সুশীলা, গুণবতী। পিতার আদেশে কন্যা নারদ ও পর্বতের দেখাশোনা করতে লাগলেন। সুকুমারীর রূপলাবণ্যে ও সেবায় নারদ মুগ্ধ হলেন। কথামতো পর্বতকে তাঁর সেকথা জানানো উচিত ছিল কিন্তু নারদ লজ্জায় তা পারলেন না। কিন্তু মাতুলের হাবভাব দেখে পর্বত সব বুঝতে পারলেন এবং তাঁকে ডেকে তিরস্কার করলেন। নারদ ছিলেন তপস্বী ব্রাহ্মণ, তাঁর পক্ষে এইভাবে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা পাপের সামিল। তাই পর্বত রাগে নারদকে অভিশাপ দিলেন যে নারীকে দেখে নারদ প্রতিজ্ঞা ভুলেছেন তাঁকে বিয়ে করলেও ওই কন্যা নারদের আসল রূপ দেখতে পারবেন না, বানররূপী নারদকে দেখতে পাবে সকলে অর্থ্যাৎ নারদ সুকুমারীকে বিয়ে করলে তাঁর মুখ বানরের হয়ে যাবে।
পর্বতের কথা শুনে নারদ প্রচন্ড রেগে গেলেন এবং তিনি হিতাহিতশূন্য হয়ে পর্বতকে অভিশাপ দিলেন তপস্বী, সংযমী, ব্রহ্মচারী ও সত্যবাদী হয়েও পর্বত কোনওদিন আর স্বর্গে ফিরে যেতে পারবেন না, তাঁকে এই মর্তেই থেকে যেতে হবে। এইভাবে সুকুমারীর জন্য দুই অভিন্ন হৃদয় সম্পর্কের ইতি ঘটল।
এর কিছুকাল পর নারদের সঙ্গে সুকুমারীর বিবাহ সম্পন্ন হল। কিন্তু পর্বতের অভিশাপে সুকুমারী নারদের মুখের পরিবর্তে বানরকে দেখতে পেলেন। সকলে স্তম্ভিত হল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সুকুমারীর কোনো বিকার দেখা গেল না। তিনি বানরের মুখরূপী নারদকেই পতিরূপে সেবা করতে লাগলেন। কুৎসিত রূপের বানরের রূপে তিনি বিচলিত তো হলেনই না, বরং তাঁকে আরও বেশি করে যত্ন আত্তি করা শুরু করলেন। এই সময়ে অনেক রাজা মুনি ঋষি তাঁর মন পাওয়ার চেষ্টা করলে সুকুমারী সেদিকে দৃষ্টিও দিলেন না। নারদও সুকুমারীর এই নিষ্ঠা দেখে খুশি হলেন। নারদ ও সুকুমারী দাম্পত্য জীবন সুখের হয়ে উঠল।
এর বেশ কিছুদিন পর নারদের সঙ্গে পর্বতের দেখা হল। পর্বত তখন নারদের অভিশাপে স্বর্গে যেতে না পেরে দীন অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পর্বতের কষ্ট দেখে নারদের খারাপ লাগল। তাঁরা ঠিক করলেন পরস্পরকে দেওয়া অভিশাপ থেকে নিজেদের মুক্ত করবেন। সেই মতো নারদও তাঁর পূর্বরূপ ফিরে পেলেন।
নারদ নিজের চেহারা ফিরে পেয়ে খুব খুশি হলেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে নারদ পত্নী সুকুমারীর কাছে এসে উপস্থিত হলেন। সুকুমারী স্বভাবতই রূপবান নারদকে চিনতে পারলেন না। তিনি পরপুরুষ সন্দেহে সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন।
পর্বত তখন সুকুমারীর সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং সমস্ত ঘটনা জানালেন। সুকুমারী যে কতটা পতিব্রতা তা বোঝালেন। সুকুমারী তখন সলজ্জে নারদের কাছে নিজেকে সমর্পন করলেন।
সাবিত্রী সত্যবান, বেহুলা লখিন্দরের গল্পে আমরা পতিব্রতা নারীর দেখা পাই। সাবিত্রী, বেহুলার মতো রমনীর কথা শুনে আমরা উজ্জীবিত হই। কিন্তু পুরাণে এমন আরও কত নারীর কথা লেখা আছে তাঁদের কথা অজানাই থেকে যায়। সাবিত্রী, বেহুলাদের স্তোত্রে আমরা এতটাই মজে থাকি যে এইসব নারী হয়ে যায় গৌণ। সুকুমারী তেমনই এক নারী। বিবাহের ঠিক পরেই নিজের স্বামীকে বানররূপী দেখে তাঁর মনে কোনো বিকার তো হয়ই না, উলটে তাঁর চরণে আরও বেশি করে নিজেকে সঁপে দেওয়া এ বড় কম কথা নয়। সমস্ত কামনা থেকে নিজেকে সরিয়ে স্বামীসেবা করা এই রমনী এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
পতিব্রতা আরও অনেক নারীর সঙ্গে এক পঙক্তিতে উচ্চারিত হওয়ার মতো এক নাম নারদ পত্নী সুকুমারী।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team