বাংলায় শীত এবার পরিবর্ধিত। অন্তত হপ্তা দুয়েক বেশি থেকে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছে প্রকৃতিদেবীর কাছ থেকে। তা না হলে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পৌঁছেও খোদ কলকাতায় রোদ এত মনোরম! আর কিছু না হলেও জয়নগরের মোয়া দোকানির চওড়া হাসিই প্রমাণ করে দেয় শীতের বিলম্বিত যাত্রা। এমনটা শেষ কবে পেয়েছেন মহানগরবাসী? ওদিকে উত্তর বাংলায় বহুদিন বাদে প্রাচীন প্রবাদ মেনে মাঘের শীতে জঙ্গলের বাঘ কাঁপছে, কাঁপতে কাঁপতে নেমে আসছে মানুষের উঠোনে। অসময়ের ছিচকাঁদুনে বৃষ্টি, উত্তুরে কনকনে হাওয়া, ফিকে ফিকে রোদ্দুর, পাহাড়ে তুষারপাতের ভাইরাল ছবি ইত্যাদি এবার উত্তরের চল্লিশোর্ধ নাগরিকদের বাল্যস্মৃতি ফিরিয়ে দিয়েছে। কুয়াশায় ঘেরা প্রাতঃভ্রমণে হাড়ে হাড়ে ঠকাঠক শব্দ তুলে বরিষ্ঠ নাগরিক মাঙ্কিটুপির ফাঁক দিয়ে প্রতিবেশীকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন, আইস এজ তবে কি ঘনিয়ে আসছে ব্রাদার? এই কারণেই কি পাহাড়ি ভালুকেরা দলে দলে নেমে আসছে সমতলে? তবে কি বলছ তুষার মানবের দেখা পাবো অচিরেই? কম্পিত কন্ঠে উত্তর মিলছে, সাহারা মরুভূমিতে বরফ পড়লে হিমালয়ের পাড়াতুতো তরাই-ডুয়ার্স আর কী দোষ করল ভাই?
এইসব শীতার্ত আবগারি আবহাওয়ার দিনরাত্রিগুলিতে মদহোসি ও সরকারি রাজস্ব হু হু বাড়লেও তরুণ সমাজের দুঃখ কিন্তু ঘোচে নি। দুর্বল ভাইরাসের দাপাদাপি পিকনিক মরসুমের দফারফা এবং তাদের ভরপুর আনন্দের সত্যনাশ করে ছেড়েছে। আসলে ভাইরাস নয়, মনখারাপের এক আজব রোগ ছোঁয়াচে হয়ে ঘরে ঘরে ঢুকে গিয়েছে। প্রতিটা ঘর বাসস্থান আজ ভাইরাসের ডেন, যে ভাইরাস মানুষের সুস্বাদু ভেজা কুরে কুরে খায়। গলির মোড়ে চা-আড্ডায়, ফ্লেক্স-বাঁধানো চাউমিন স্টলে, মাছ-বাজারের আলো-আঁধারিতে কিংবা শপিং মলের খাঁ খাঁ একাকিত্বে— সর্বত্র জমে আছে চাপ চাপ বিষণ্ণতা! অথচ কেন জানি না পথে ঘাটে মানুষের কেবল সেই ঘরেই ফিরে যাওয়ার ব্যস্ততা—যেন এই বুঝি বা যুদ্ধকালীন সাইরেন বেজে উঠবে, এই বুঝি ঘোষণা হবে ব্ল্যাক আউট! গত দু বছরের অর্জিত অভ্যেস ভুলেই বা যাই কী করে! শীতের ফ্যাকাশে আলোয় মাস্কে ঢাকা এইসব ক্লিষ্ট মুখগুলি দেখে কি মায়া বা বিভ্রম জাগে না স্বয়ং বিধাতার? কোন সে দানব শক্তি তবে নিয়ন্ত্রণ করছে আজ মানব স্নায়ুতন্ত্রকে?
তবু মন্দের মাঝে ভাল খবর, ইস্কুল কলেজ খুলতে শুরু করেছে। মানে শিগগিরই মোড়ের মাথায় ফের মিলবে লাল-নীল কচি মুখের মিছিল, মানে মিড ডে মিলের ঝোলের তীব্র গন্ধ, মানে রোজকার ট্রাফিক গুবলেট হতে যাচ্ছে আবার! সরস্বতী পুজোয় কলেজ ক্যাম্পাস থেকে ভেসে এসেছে ডিজে-র অহংকারী ঝংকার বিটস— নাচো আরো নাচো, বাঁচো ভালো বাঁচো। অক্ষম পন্ডিতেরা বলেন, শিক্ষা নাকি মাতুলালয়ে গিয়া আর গুরুগৃহে ফেরে নাই, বড় বড় ইমারতে রাজত্ব করিতেছে ডিগ্রির দোকানিরা! স্বাস্থ্য নাকি পাহাড়িয়া ধ্বসের ন্যায় ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, আর আম্ফান ঝড়ে উড়িয়া গিয়াছে ন্যায়-নীতি-মান! মহারাজা হেসে কন, যাক যা গেছে তা যাক, তাই বলে কি নাচব না? ভালো করে খেয়ে পিয়ে বাঁচব না? আরে আমি তো আছি! আমি থাকলেই তোমরা থাকবে। যারা নিজেদের পন্ডিত মনে করে আর আমায় মনে করে অযোগ্য অর্বাচীন, তারাই আসলে বড় মূর্খ। তা না হলে আজ আমি আছি কী করে? আর আমি আছি বলেই তোমাদের শেষ দেখে এবং দেখিয়ে ছাড়বো, হা হা হা। মহারানিও তাই শুনে দুপাক ঘুরে নেন, হাসতে থাকেন, হি হি হি।
জ্যোতিষীরা বলছেন, মন খারাপের দিনগুলি শেষ হয়ে আসছে, খুব বেশি বাকি নেই। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, বুম এলো বলে। রাজনীতিবিদরা বলছেন, সব ডামাডোল কেটে গিয়ে বড়সড় কিছু এইবার ঘটতে চলেছে। যে যাই বলুক, প্রিয় পাঠক আপনি কান পেতে থাকুন! ভরন্ত দুপুরে বা পড়ন্ত বিকেলে কাছে বা দূরে কোথাও কোকিলের কুহু কুহু যদি শোনা যায়, তবে ফুল ফুটুক বা না ফুটুক, কাঁথা কম্বল উঠুক বা না উঠুক, আজ বসন্ত এসে গেছে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team