 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             শৌভিক রায়
                                            
                                                
                                                শৌভিক রায়
                                            
                                            
                                         
                                            এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। ঠিক প্রকাশ করা যাচ্ছে না! সামনে অনন্ত খাদ। পেছনে আকাশচুম্বী পাহাড়। দুজনেই মোহময়ী। কিন্তু তাদের হারিয়ে দিয়েছে বহু নিচের সেই অনির্বচনীয় দৃশ্য। ওই দূরে বয়ে দেখা যাচ্ছে তোর্ষাকে। খানিকটা পুবে জয়ন্তী। আর তার খানিকটা পাশে রায়ডাক। ভেবেছিলাম সংকোশকেও বোধহয় দেখতে পাবো। কিন্তু চোখ আটকে গেল ঘন সবুজে। বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে, এতটা ওপরে রয়েছি যেখান থেকে শুধু বক্সার ঘন অরণ্য নয়, দেখা যাচ্ছে জলদাপাড়া, চিলাপাতা সব! ওপর থেকে গাছগুলিকে বেঁটে দেখালেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তাদের প্রাচীনত্ব। ঘন নীল আকাশটা আবার হাতের খুব কাছাকাছি। সেখানে উড়ছে অদ্ভুত সুন্দর পাখিরা সব। তাদের ডাক খানিকটা কর্কশ হলেও, সৌন্দর্যে ধারেপাশে আসছে না কেউ। আর উড়ছে রংবাহারি প্রজাপতির দল। শুধু তাদের দেখেই কাটিয়ে দেওয়া যায় সারাটা দিন। তবে মেঘ বৃষ্টি আর আলোর খেলা দিনের সবসময়ে। এই মুহূর্তে ঢেকে যাচ্ছে সব তো পরমুহূর্তেই ঝলমলে রোদে হেসে উঠছে চারদিক। এখানকার গুটিকয়েক বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে সেই হাসির কেমন যেন অদ্ভুত মিল। এই সব মিলেই প্রবল হাওয়ায় গায়ে শীত জড়িয়ে বুঁদ হয়ে আছি লেপচাখার সৌন্দর্যে।

ছবি - বক্সা ফোর্ট
বক্সা ফোর্ট থেকে আরও কিমি চারেক ওপরে উঠলে পাহাড়ি ছোট্ট হ্যামলেট লেপচাখা। আর অন্যদিকে, সান্তালাবাড়ি পার হয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে এগোতে বাঁ হাতে এক পথ চলে গেছে চুনাভাটির দিকে। ভয়ঙ্কর নির্জন সেই পথে অনেকটা হেঁটে দেখে এসেছি সেই গ্রামটিও। ভুট্টা, আর মকাই ক্ষেতের সেই গ্রামে পাখিরা কথা বলে। দোকানপাট নেই বললেই চলে। সামান্য কয়েকটি বাড়ি। চলে পশুপালন। পায়ে হাঁটা পথে ভারসাম্য ঠিক রাখাই মুশকিল কিছু কিছু জায়গায়। পাহাড়, জঙ্গল আর নির্জনতা মিলিয়ে এই দিকটাও অসামান্য। আসলে এটি বক্সা ফোর্টে যাওয়ার সমান্তরাল অন্য একটি পথ। একটি জায়গা থেকে ডান হাতে বেঁকে যেতে হয় ফোর্টের দিকে। এই পথেও রয়েছে নদী আর ঝর্ণা। বর্ষায় সেগুলি যে কী সুন্দর হয়, সেটা বেরসিকও বুঝবে। তবে এই পথে ফোর্টে যাই নি। চুনাভাটি থেকে ফিরে জিরো পয়েন্ট হয়ে পরিচিত পথেই এগিয়েছি ফোর্টের দিকে। ফোর্টে ঢুকে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে, সেখান থেকে ডুয়ার্স রানি লেপচাখায়।
ফোর্ট নিয়ে আর নতুন কথা কী বলব! ব্রিটিশ আমলে আন্দামানের সেলুলার জেলের পরেই দুর্গম ও দুর্ভেদ্য বক্সা ফোর্ট, ডুয়ার্স তো বটেই, উত্তরবঙ্গের গর্ব। হিংস্র শ্বাপদের গা ছমছমে বক্সা জঙ্গলের উত্তরে, সিনচুলা পাহাড়ে, ২৮৪৪ ফিট উচ্চতায়, কে বা কারা ফোর্টটি নির্মাণ করে সে বিষয়ে স্পষ্ট জানা যায় না। কারো মতে ফোর্টটি তিব্বতিদের তৈরী, কেউ কেউ মনে করেন কামরুপীরা ছিলেন এর নির্মাণের পেছনে। আবার ভুটিয়ারা এই ফোর্টের নির্মাতা এরকমটাও মনে করেন ঐতিহাসিকেরা। আরও ওপরে ৪৫০০ ফুট উচ্চতায় রয়েছে রোভার্স পয়েন্ট। মাত্র ১১ কিমি দূরে ভুটান। সিনচুলা গিরিপথ পেরোলেই অসামান্য রূপম উপত্যকা।

ছবি - লেপচাখা গ্রাম
বক্সা ফোর্ট কবে তৈরী সে নিয়ে বিতর্কের মাঝে কিছু তথ্য জরুরী। মনে করা হয়, ১৬৬১ সালে প্রাণভয়ে ভীত কোচবিহার-রাজ প্রাণনারায়ণ এই ফোর্টে এক বছর কাটিয়ে ছিলেন। ফোর্টটি তখন 'জং' নামে পরিচিত। পরবর্তীতে 'জং'-এর অধিকার নিয়ে লড়াই বেঁধে থাকতো ভুটান ও কোচবিহারের। প্রথম ইঙ্গ-ভুটান যুদ্ধে, ইংরেজ ক্যাপ্টেন জোনস ১৭৭৩ সালে বক্সা অধিকার করলেও, ১৮৬৫ সালে সিনচুলা চুক্তি অনুসারে ফোর্টটি পাকাপাকিভাবে ব্রিটিশদের দখলে আসে এবং 'জং` বা দুর্গের দখল নেয় তারা।
বক্সা ফোর্টের দখল নিয়ে ব্রিটিশরা কিছু সংস্কার করেছিল। ফোর্টটি পাথরের দেওয়ালে মুড়ে ফেলা হয়, টিনের ছাদ দেওয়া হয়। নির্মিত হয় অফিসারদের থাকবার ঘর, পোস্ট অফিস। জলের ব্যবস্থাও করা হয়। বক্সাকে দেওয়া হয় মহকুমার মর্যাদা। ১৮৭৩ সালে সেনা মোতায়েন-সহ তিনটি পিকেট বসানো হয় বক্সায় এবং পরের বছর বক্সাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় মহকুমার মর্যাদা। ১৯০১ সালে রাজাভাতখাওয়া থেকে জয়ন্তী পর্যন্ত মিটার গেজ রেলপথ চালু হলেও ফোর্টের দুর্গমতা কিন্তু একই থেকে যায়। ১৯১৪ থেকে ১৯২৪ অবধি মিলিটারি পুলিশের ছাউনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল ফোর্টটি। অবশেষে স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে ১৯৩০-এ জেলখানায় বদলে যায় ফোর্ট। দুর্গম এই ফোর্টে বন্দি হয়েও সেদিনের স্বাধীনতা-সংগ্রামীরা দমে যাননি। তবে এই ফোর্টে নেতাজি সুভাষকে বন্দি রাখা হয়েছিল বলে যে কথা শোনা যায় তা ঠিক নয়। স্বাধীনতা-সংগ্রামী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীকে অন্য বন্দীরা 'নেতাজি' সম্বোধন করতেন। সম্ভবত সেখান থেকেই নেতাজি সংক্রান্ত বিপত্তি। এই ফোর্ট থেকেই ১৯৩১ সালে বন্দিরা রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তিতে তাঁকে অভিনন্দনপত্র পাঠিয়েছিলেন। বিশ্বকবি প্রত্যুত্তরও দিয়েছিলেন। ফোর্টে প্রবেশের মুখে খোদাই করা দুটো পত্রই দেখা যায় আজও। স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের এখানে বন্দি হিসেবে রাখা হয়েছিল। সেই বন্দিদের মধ্যে ছিলেন পদাতিক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭০ অবধি তিব্বতি রিফিউজি ক্যাম্প ছিল ফোর্টে। ১৯৭১-৭২ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদেরও আশ্রয় দেওয়া হয় এখানে এবং শেষ অবধি ১৯৭৬-৭৭ সালে পরিত্যক্ত হয় ফোর্ট।

ছবি - ড্রুকপা শিশু
১৯৮০ সালে জাতীয় স্মারক ঘোষণা হলেও, আজ কিন্তু বড্ড অবহেলায় পড়ে রয়েছে আজকের বক্সা ফোর্ট। বক্সাকে নিয়ে প্রবন্ধ-উপন্যাস-গল্প-কবিতায় বহু লেখালিখি হলেও বর্তমান বক্সা ফোর্টের চারদিকে ধ্বংসস্তুপ কেবল! সান্ত্রাবাড়ি থেকে এখনও পাঁচ-ছয় কিমির উঁচু-নীচু পাহাড়ি হাঁটা পথে যেতে হয় ফোর্টে। অপূর্ব নৈসর্গিক পরিবেশে, ফোর্টের বিপরীতে দেখা মেলে নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার, ফরেস্ট রেস্ট হাউস, পোস্ট অফিস (অতীতের রেসিডেন্টস অফিস) ও কিছু বাড়িঘরের। কিন্তু ফোর্টের ভগ্নদশায় মন খারাপ হয়ে যায়। ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদের প্রতি এই অবহেলা সত্যি অকল্পনীয়। কে বিশ্বাস করবে যে, কয়েক দশক আগেও লোহার গেট, পাহারাদার, দেওয়াল, আংটাবেড়ি ইত্যাদি দেখা যেত এই দুর্গে। কাঁটাতারে ঘেরা থাকত এলাকা। কাকপক্ষীও ঢুকবার সাহস পেত না। বক্সা ফোর্ট নিয়ে আলোকপাতের অবকাশ আজও রয়ে গেছে। বারংবার দৃষ্টি আকর্ষণ সত্ত্বেও অজানা কারণে বক্সা ফোর্ট অবহেলিত। জানা নেই কবে ঘুচবে এই অন্ধকার, কবে যোগ্য মর্যাদা পাবে ইতিহাসের বক্সা ফোর্ট।
লেপচাখায় বসে বসে ভাবছিলাম ডেভিস আর গ্রিফিথের কথা। আজকের বক্সা দেখলেও কি তাঁরা একই কথা বলতেন? কেননা ১৭৮৪ সালে লেফটেন্যান্ট ডেভিস ও ১৮৩৮ সালে উইলিয়াম গ্রিফিথ বক্সার দূর্ভেদ্য জঙ্গল ও অপরূপ শোভায় মোহিত হয়ে উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন। গ্রিফিথ ১৮৩২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং ১৮৪২-৪৪ সালে কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনের সুপারিন্টেন্ড হিসেবে কাজ করেছিলেন। প্রকৃতি-প্রেমিক গ্রিফিথের বা ডেভিসের সেদিনের বিবরণ থেকে আজকের বক্সার কি বিরাট অমিল? আমি নিজে ১৯৮৪ সালে যখন প্রথম বক্সা ফোর্টে আসি তখন রাস্তা ছিল আলাদা। ১৯৯৩ সালের বিধ্বংসী বন্যায় সেই রাস্তার অস্তিত্ব বিলুপ্ত। ফোর্টেরও কিছু অবশিষ্ট ছিল সে সময়। আজকের এই দৈন্যদশা হয় নি তখনও পর্যন্ত। মনে আছে কয়েক মাস পরেই সান্দাকফু ট্রেক করতে যাব বলে, প্রস্তুতির জন্য ফোর্ট থেকে সান্তালাবাড়ি অবধি নদী বক্ষ ধরে নেমেছিলাম। সেদিনও এখানে অরণ্য যেমন গভীর ছিল, আজও ঠিক ততটাই। যোগাযোগ ব্যবস্থার খানিকটা উন্নতি হলেও, প্রয়োজনের তুলনায় সেটা কিছুই না। ড্রুকপা ও নেপালি অধ্যুষিত এই অঞ্চলের মানুষদের কষ্টের সীমা-পরিসীমা নেই বললেই চলে। জীবনধারণের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষগুলি আনতেও তাদের যে পরিশ্রম করতে হয়, তা আমাদের মতো শখের পর্যটকদের বোধগম্য হয় না কিছুতেই।

ছবি - লেপচাখা
ফোর্ট থেকে লেপচাখার দিকে, চড়াই-উৎরাই পথে, কিছু বাড়িঘর চোখে পড়েছে। বেশির ভাগ বাড়ির সামনে রয়েছে 'ক্ষেতি' আর তাতে যথারীতি চাষ হয়েছে ভুট্টা আর মকাই। দেখা গেল ইউ-এর চাষও। সেগুলি দিয়ে পরে তৈরী হবে পানীয়। বাড়িগুলিতে থাংকা ঝোলানো দেখে বোঝাই যায় তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। লেপচাখাতেও রয়েছে চোর্তেন। দেখা মেলে বৌদ্ধ মঠ বা মনাস্ট্রির। আধুনিক সভ্যতার হাত ধরে এখানেও তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি হোম স্টে। ডুয়ার্সের এই অঞ্চল আজও যেন অচেনা, রহস্যময়। লেপচাখা থেকে আর একটি পাহাড়ি পথে চলে যাওয়া যায় রায়মাটাঙে। তবে সেই পথ বড্ড নির্জন আর বিপদসংকুল। সময়ও লাগে আমাদের মতো অনভ্যস্তদের। গাইড ছাড়া যাওয়া উচিত নয় বলে, ঝুঁকি নেওয়া গেল না আর।
ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে এলো লেপচাখায়। কিন্তু পূর্ণিমার আলোয় মুহূর্তেই মুছে গেল সেই অন্ধকার। এক অদ্ভুত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো চারদিক। নিচের সবুজ অরণ্যের রূপ গেল পাল্টে। খাপ খোলা তরবারির মতো দেখতে হয়ে গেল তিন সেই নদী। এক অদ্ভুত নির্জনতায় কখনও কখনও ভেসে এল কোনও প্রাণীর ডাক। যে সৌন্দর্যের সাক্ষী হলাম এবার তা বর্ণনা আমার সাধ্যাতীত। শুধু মনে হচ্ছিল, আবহমানকাল থেকে এভাবেই যেন বসে আছি আমি আর আমার সামনে একে একে চলে যাচ্ছে বক্সার ইতিহাসের নানা অধ্যায়। সাক্ষী হচ্ছি কেবল সেসবের।

ছবি - লেপচাখার বার্ডস আই ভিউ
মরা চাঁদের আলোয় যখন হোম স্টে-এর ঘরে ঢুকলাম, তখন রাঙা হচ্ছে চারদিক। রেডি হলাম ঝটপট সূর্যোদয় দেখব বলে!
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
