জীবনের এতটা পথ হেঁটে এসে একটা জিনিস স্পষ্ট বুঝি, বেশিরভাগ মানুষ নিজেকে বড্ড বেশি বেশি বেশি ভালোবাসে। মুখে স্বীকার করে না বটে কিন্তু বাঁধনহারা আত্মাভিমানে টুক করে সামান্য টোকা লাগলেই অখুশি। প্রশংসা নামক আরক তার সবচেয়ে প্রিয় আর সমালোচনা এক্কেবারে না পসন্দ। সমালোচকটি বন্ধু হলেও মুহূর্তেই শত্রু! নিজের চিন্তা, চেতনা, বোধ-বুদ্ধির ওপর মনুষ্যসন্তানের অখন্ড বিশ্বাস! নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবার দুর্বলতা থেকে কম সংখ্যক মানুষই মুক্ত। নইলে ওই রোগাপটকা ছোটোখাটো চেহারা আর খিনখিনে কন্ঠস্বর সম্বল বীরেন ঠাকুরমশাই প্রতিটি যাত্রাপালায় নায়কের চরিত্রে অভিনয় করবেন কোন সাহসে? তাঁর স্বরচিত পালায় কাহিনীর সামঞ্জস্য প্রায়ই থাকে না, কেমন ঘোঁট পাকিয়ে ওঠে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধপ্রাঙ্গনে বা অশোককাননে বন্দিনী সীতার সামনে কারণে অকারণে নর্তকীর দল সলমা জড়ির চিকিমিকি ওড়না আর রঙিন ঘাঘরায় ঢেউ তুলে তুলে মঞ্চজুড়ে নৃত্য করে যায়, তখন আবহ সংগীত হিসেবে হয়ত বেজে ওঠে ‘শুকনো পাতার নুপুর পায়ে বাজিছে ঘুর্ণি বায়...’ অথবা সমকালীন ঝিনচ্যাক কোনও হিন্দী গানের সুর। মঞ্চের চারদিক ঘিরে বসে থাকা দর্শকাসন থেকে ভেসে আসে জোরদার হাততালি, আনন্দধ্বনি! পালাগানের ভুলত্রুটি অসংগতি নিয়ে ওনার তেমন নিন্দেমন্দ করেনি কেউ কস্মিনকালেও। বরং পালাগান লেখা ও অভিনয় সুবাদে ঠাকুরমশাই যথেষ্ট শ্রদ্ধা ভক্তি অর্জন করেছেন আজীবন। না জায়গাজমি না চাকরিবাকরি, উপার্জন বলতে পুরোহিতগিরি। গ্রামের এবাড়ি ওবাড়ির পুজো, বিয়ে, অন্নপ্রাশন বা বাৎসরিক সেই দুর্গাপূজা, কালীপূজা, লক্ষ্মীপূজা, সরস্বতী পূজা ইত্যদি আর যজমানদের ভক্তিমিশ্রিত উপহারের ওপর ভরসা করে অত বড় সংসার সঙ্গে যাত্রাদলটিকেও তিনি লালন করেছেন। বুকের পাটা ছিল বলতে হবে। আসলে গানবাজনার, যাত্রা-নাটকের নেশাও ঘোর নেশাই তো! মানুষের ভালবাসা আর প্রশংসাই ছিল ছোটখাটো চেহারার ঠাকুরমশাইয়ের জীবনের মূল চালিকা শক্তি। ‘কমলা অপেরা’ ছিল বীরেন ঠাকুরের প্রাণভোমরা।
একথা সত্য পারিবারিক যাত্রা দলটির মালিক বীরেন ঠাকুর মশাই স্বয়ং। দশাসই চেহারা ও পুরুষালী কণ্ঠস্বরের অধিকারিনী মোটামুটি সুশ্রী চেহারার স্ত্রীর নামে দলের নামও ‘কমলা অপেরা’। কিন্তু মানাক চাই না মানাক ঠাকুরমশাই নায়ক সাজবেনই! পালার নায়ক রাজা, রাজকুমার, দস্যু রত্নাকর, ধনুর্বান হস্তে রামচন্দ্র, কুরুক্ষেত্রে অর্জুন, মথুরায় শ্রীকৃষ্ণ, রাজা দুষ্মন্ত, দুর্বাশা মুনি, যেকোনও পালায় তিনিই নায়ক। সেখানে ওনার ছেলে, ভাই বা ভাইপোরা হলেই বেশি মানাতো কিন্তু এই ত্যাগটুকু আর আজীবনে করে উঠতে পারেননি ঠাকুরমশাই।
কাঠের ওপর রূপোলি রাংতা জড়ানো বিশাল তরবারি বা ধনুর্বান-- সবই অজ্ঞাত কারণে ওনার মাথায় মাথায় দীর্ঘ! দর্শকপ্রিয় একটি দৃশ্যে চটাপট মেলা হাততালি পেতেন তিনি। সেটি ছিল দুহাতে তরবারিটি মাথার ওপর বনবন ঘুরিয়ে যখন তিনি মহা তেজে যুদ্ধ ঘোষণা করতেন। ওই ঘুর্ণনের বেগে তিনিও মঞ্চের ওপর সাঁই সাঁই কয়েক পাক ঘুরে নিতেন। তো এসব দৃশ্যে মাঝেমধ্যে বিভ্রাটও হত। নায়কের হাত ছুটে তরবারি একেবারে দর্শকের ওপর নিক্ষিপ্ত হয়েছে বার কয়েক শুনেছি! বললে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না আমাদের গ্রামদেশের মানুষের কিছু কিছু ব্যাপারে ধৈর্য ছিল অসীম। কেননা সে হাত ফসকানো তরবারির আঘাতে দুএকজন অল্পবিস্তর আহত হলেও তেমন আন্দোলন কিছু হতো না। সবার ঐকান্তিক ইচ্ছে, পালা যেন কিছুতেই বন্ধ না হয়। আবার আলোকিত মঞ্চের ওপর দর্শককুলের মহতি আগ্রহের মধ্যমণি হয়েও রাজামশাই বৃহদাকারের ধনুকে তীর যোজনা করতে বারংবার ব্যর্থ হচ্ছেন দেখেও সেকালের দর্শকেরা মোটে গন্ডগোল পাকাতো না! ছিটেফোঁটা হাসির ঢেউ উঠতো এই পর্যন্ত। মোটকথা ‘কমলা অপেরা’ নিয়ে আমাদের গ্রামদেশের বেশিরভাগ মানুষ সন্তুষ্টই ছিল। পতি-পত্নীর চেহারার কন্ঠস্বরের ব্যাক্তিত্বের বিপুল বৈপরীত্য সমেত টানাটানির সংসারে তাঁরা যে একটা গোটা যাত্রাদল তৈরি করেছিলেন সেটা কম কথা নয়। তাঁর ছিল গোটা আটেক সন্তান এবং ঈশ্বরের আশির্বাদে প্রত্যেকেই সুদর্শন, লেখাপড়াতেও বেশ। আমার মনে হয় রাজার পরে রাজপুত্তুর যেমন রাজত্ব ও সিংহাসন লাভ করে ঠিক তেমনই ঠাকুরমশাইয়ের সুদর্শন পুত্রেরা একদিন পালাগানে নায়ক হবে, দল পরিচালনা করবে এমন আশায় তারাই অমন জাম্বো সাইজের তরবারি আর তীরধনুক বানিয়েছিল।
তাঁদের বাড়ির সামনে রাস্তার ওধারে বিরাট বটপাকুড় তলায় যাত্রার আসর জমে উঠত কালীপূজা বা লক্ষ্মীপূজা বা মনসাপূজার মেলা উপলক্ষ্যে। যাত্রা মরসুমের আগে প্রায়ই রাতের বেলা মাঠ পেরিয়ে ভেসে আসতো কমলা অপেরার রিহার্সালের ভ্যাম্পর ভ্যাম্পর কনসার্টের সুরলহরি, হা হা হা হাস্যধ্বনি, নানা সংলাপের টুকরো টাকরা। সেসব শব্দতরঙ্গে হৃদয় আকুল হত, ভাবতাম ইসস এই বাড়িটায় না জন্মে ঠাকুরমশাইয়ের মেয়ে হয়ে জন্মালে জীবন সার্থক হত। আমিও তো মঞ্চে উঠে ঘাঘরায় ঢেউ তুলে তুলে সুন্দর নাচতে পারতাম! কত আনন্দেই না হত। ওনার মেয়ে ক্ষমা আর ছেলে রতন আমাদের সঙ্গে পড়ত। যাত্রার মরসুমে প্রায়ই স্কুল কামাই যেত ক্ষমার, শুনতাম সে তাদের দলের সঙ্গে মাথাভাঙ্গায়, জামালদহে বা রানিরহাটে গেছে। স্কুলে তার কথাবার্তা ভাবভঙ্গী ছিল সবার থেকে আলাদা, চলনে বলনে বেশ রানি রানি ভাব। অবাক হয়ে তাকে দেখি! বন্ধুত্ব গড়ার চেষ্টাও চালাই, সে মোটে ফিরেও চায় না। সেবার স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান, সাজো সাজো রব। গান, কবিতা, নাচের প্র্যাকটিস চলছে। নতুন মাষ্টারমশাই ঘোষণা করলেন গানের প্রতিযোগিতা হবে। রবীন্দ্রসংগীত; প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তিনটে পুরস্কার। গানে তেমন উৎসাহ নেই আমার, নৃত্যপ্রদর্শনের ইচ্ছে। কিন্তু কবেই বা আমার কোনও ইচ্ছের মূল্য কেউ দিয়েছে? গাইতে অনিচ্ছুক আমাকে গানের প্রস্তুতিই নিতে হবে। যুক্তি? গানের শিক্ষক রেখে গান শেখানো হচ্ছে কেন যদি গানই না গাইতে চাও? মঞ্চে বসে গান গাও তবে তো সাহস হবে। সুতরাং লিপিকা মাসির কাছে নতুন গান শিখে বাড়িতে অভ্যাস চলেছে ‘নূপুর বেজে যায় রিনি রিনি/ আমারো মন কয় চিনি চিনি।’
যাই হোক নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠান শুরু হল, হেডমাষ্টারমশাই ভাষণ দিলেন, কবিতাও বললেন। কচিকাঁচারা ছড়া, কবিতা বলল, মাঝপথে ভুলেও গেল কেউ কেউ। মেঘের কোলে রোদ হেসেছে/বাদল গেছে টুটি গানের সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করল ক’জনা। ‘অমল ও দইওয়ালা’ নাটক হল। আর সেই রবীন্দ্রগানের প্রতিযোগিতা। সাকুল্যে গোটা পাঁচেক প্রতিযোগী, স্বাভাবিক কারণে ক্ষমাও আছে সেখানে। সবাই আগে থেকেই জানে, ক্ষমাই ফার্স্ট। বাড়ি থেকে আনা হারমোনিয়ম বাজিয়ে সে গায় ‘জীবন পুরের পথিক রে ভাই / কোনও দেশে সাকিন নাই / কোথাও আমার মনের খবর পেলাম না / আ আ আ’ সঙ্গে তেরেকেটে বোল তুলে তবলায় সঙ্গত করে তার ভাই রতন। কী একটা কারণে যেন তাকে একবার গান থামাতে বলেন নতুন মাষ্টারমশাই, ক্ষমা মোটেই তাঁর কথায় কান দেয় না। পুরোটা গেয়েই কাঠের হাই বেঞ্চ জোড়া দিয়ে তৈরি মঞ্চ থেকে নেমে আসে। অনুষ্ঠান শেষ হয় কিন্তু পুরস্কার ঘোষণা আর হয় না। মাষ্টারমশাইরা ক্ষমাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা তুমি এই গানটি কার কাছে শিখেছ? এটি তো অন্যরকম গান। তুমি ভালই গেয়েছ কিন্তু... কথা হল এটা তো অন্যরকম গান তাই...’।
অনেক পরে নাম ঘোষণা হলে দেখা গেল পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় ক্ষমা নেই! পরিস্থিতি ক্রমে ঘোরালো, তার দাদারা জ্ঞাতিগুষ্ঠি সমেত আসরে অবতীর্ণ, তর্কবিতর্ক। বোনকে বঞ্চিত করে অন্যদের কেন পুরস্কার দেওয়া হল? যাদের পুরস্কার দেওয়া হল তারা গানবাজনার কি জানে? মুখ চিনে পুরস্কার দেওয়া হল কেন ইত্যাদি ইত্যাদি। সে মহা ঝামেলা! মাষ্টারমশাই ক্ষমার বাড়ির লোকেদের বোঝান ‘ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আধুনিক গান গেয়েছে, এটা তো ছিল রবীন্দ্রসংগীতের প্রতিযোগিতা।’ কিন্তু তাঁরা সেকথা মানতে চান না। আমি সেবারে তৃতীয় পুরস্কার খাতা আর কলম পেয়েও আনন্দ পেলাম না। সত্যিই তো গানবাজনার কীই বা বুঝি। ক্ষমার দাদাদের রক্তচক্ষু দেখে তিন পুরস্কার প্রাপক সম্যক বোঝে অযোগ্য তিন বালিকা পুরস্কৃত হয়েছে! ভাবি ধুর নাচই ভালো ছিল। নাচের ব্যাপারে আমরা সবাই একাধারে কোরিওগ্রাফার ও নর্তক। আশেপাশে ত্রিসীমানায় তখন কোনও নাচের স্কুল, শিক্ষক কিচ্ছু নেই। কিন্তু তাতে কী? নিজের ইচ্ছেমতো সেজেগুজে হাত-পা ঘোরাও, মনের খুশিতে নৃত্য কর কেউ কিচ্ছু বলতে আসছে না। টেলিভিশন, ইউটিউব বা অনলাইনে নাচ, অভিনয়, আবৃত্তি শেখার ধারণা তখন অবাস্তব বা রূপকথার গল্প। নাচে যেটা সম্ভব গানে কি আর তাই হয়, সুর তাল লয়ের সঙ্গে বিধিবদ্ধ স্বরলিপির বাঁধ রয়েছে না? হৈচৈ গোলমালে গান গেয়ে প্রথম স্বীকৃতি লাভের আনন্দটাই মাটি। এই ঘটনায় ক্ষমার পরিবার স্কুলকে ক্ষমা করে না। তাঁরা মেয়েকে পার্শ্ববর্তী গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দেন। আর ক্ষমা তো বড়বেলাতেও কদাচিৎ সামনা সামনি পড়ে গেলে মুখ ঘুরিয়ে আকাশ দেখে! অপরাধ না করেও তার ক্ষমা আর এ জীবনে পাওয়া হয়নি। কারণ চল্লিশ পেরোতেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে সে পরপারের যাত্রী হয়েছে, সেও বহুদিন।
ইতিমধ্যে ধরলা নদী দিয়ে কত জল প্রবাহিত হল। রাস্তাঘাট, যানবাহনের সুবিধা হল, স্কুলটি মাধ্যমিক হল। ছাত্র ও শিক্ষক সংখ্যাও ক্রমবর্ধমান। বন্যাবিধ্বস্ত রেলপথটি সেজে উঠল। শুধু সেকালের সাপ্তাহিক হাট নয় প্রাত্যহিক বাজার বসল। ক্রমে জনবসতি নতুন নতুন পাড়ায় নামাঙ্কিত হয়ে বিস্তারিত হল। ছেলেরা প্রায় সবাই একে একে চাকরি পাওয়ায় ঠাকুরমশাইয়ের অবস্থা ফিরেছিল। যাত্রাদলটির ভার নিয়েছিল ওনার বড় আর মেজ ছেলে। ঠাকুরমশাই আর নায়কের রোলটোল পেতেন না, মন্ত্রী ইত্যাদিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হত তাঁকে।
চাকরিসূত্রে তখন বাইরে থাকি। একবার বাড়িতে এসে ক্ষমার সেই তবলাবাদক ভাই রতনের গল্প শুনে তাজ্জব! সে পাশটাশ করে তখন ভূমি ও রাজস্ব দপ্তরে চাকরি করছে। জেলা শহরে পোস্টিং। বাড়ি থেকেই যাতায়াত। সঙ্গে ব্যাচে টিউশন পড়ায়, মেলা ছাত্রছাত্রী। ছোটবেলায় এমনিতে সে খানিক লাজুক স্বভাবেরই ছিল জানতাম কিন্তু এখন নাকি নায়কোচিত বিবিধ গুণের আধার ও কিশোরী তরুণী যুবতীগণের কাঙ্ক্ষিত পুরুষ! বন্ধুদের কাছে শুনি রতনের একাধিক ছাত্রী স্যারের প্রতি গভীরভাবে অনুরক্ত এমনকি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেও বদ্ধপরিকর! ছাত্রীদের প্রেমের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রতন কতটা জোয়ারে ভেসেছিল তা সেই জানে কিন্তু বিবাহে সে মোটে রাজি নয়। অফিসের এক কলিগকে তার পছন্দ, সেখানেই বিবাহের বাসনার কথা জানিয়েছে বন্ধুদের। কিন্তু এদিকে অবস্থা ঘোরালো হয় ক্রমে, যখন দেখা গেল বাড়ি থেকে বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার পথেই সে আক্রান্ত হচ্ছে। একদিন নির্জন লিচুতলা দিয়ে যাবার সময় এক ছাত্রী পথ আটকায়, রতনকে অকপটে নিজের মনের অবস্থা জানিয়ে একটি সিঁদুর কৌটো হাতে দিয়ে পরিয়ে দিতে বলে নইলে সে ফলিডল খাবে। খুব বুদ্ধি করে সে পঞ্জিকা, পাকা দেখা ইত্যাদি প্রসঙ্গ তুলে তখনকার মতো আত্মরক্ষা করে। টিউশন দেওয়া বন্ধ করেও সমস্যা মেটে না। আবার একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে সন্ধে রাতে বাসস্ট্যান্ডে নেমে, এক কাপ চা খেয়ে সাঁ সাঁ সাইকেল চালিয়ে আসছে, অল্প গেলেই বাড়ি। কিন্তু বাঁশঝোপের আড়ালে দিদিকে সঙ্গে নিয়ে ওত পেতে এক ছাত্রী! ‘স্যার দাঁড়ান, কথা আছে। একটু দাঁড়ান।‘ বলতে বলতে তারা রাস্তায় উঠে আসে, স্পিড কমালেও বুদ্ধি করে সাইকেল থামায় না রতন। মেয়েটি একটি গাঁদা ফুলের মালা ছুঁড়ে দেয় স্যারের কন্ঠদেশ লক্ষ্য করে এবং ব্যর্থ হয়। মালাটি পথেই পড়ে থাকে। রতন স্পিড বাড়ায় কিন্তু মেয়ে দুটি দুপাশ থেকে তার হাত দুটো চেপে ধরে। জোরে প্যাডেলে চাপ দিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয় সে কিন্তু কাঁধের থেকে ফুলস্লিভ সার্টের হাতা ছিঁড়ে তা মেয়েদের হাতেই রয়ে যায়! মেয়েটি চেচায়, ‘স্যার আপনাকে আমি ছাড়বো না। এখন পালাচ্ছেন পালান। সবাইকে সব বলে দিব। দেখি কোথায় যান?’
এরপরে আর সাহসে কুলোয়নি রতন গ্রাম ছেড়ে চাকুরিস্থলের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া নিয়েছে। আর ঘর মুখো হয়নি জানি। অফিস কলিগটিকে বিয়ে করেছিল কিনা জানি না তবে তার বাবার তৈরি যাত্রাদলটির সঙ্গে যে সে যোগাযোগ রাখেনি তা জেনেছিলাম। আসলে পুরনো পথে হাঁটতে গিয়ে পুরনো সে দিনের কথা খুব মনে পড়ে। অনেকদিন পরে এক আত্মীয়বাড়ির অনুষ্ঠানে গিয়ে সেসব জায়গা আর চিনতে পারি না। ঠাকুরবাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে, ভাইয়েরা গ্রাম ছেড়ে শহরমুখো বহুদিন। ঠাকুরমশাই, তাঁর স্ত্রী এবং কমলা অপেরার আর চিহ্ণ নেই কোথাও। ক্ষমাও মারা গেছে বহুদিন। ওর আর দুই বোনের বিয়ে হয়েছে অন্য জেলায়। রাস্তার ধারের সেই বটপাকুড়ের গাছও নেই। যা কিছু আপনাদের শোনাচ্ছি আমচরিতের নানা পর্বে, সবই সত্যি ঘটনা। স্বাভাবিক কারণেই লেখায় উপস্থিত চরিত্রদের নাম ধাম খানিক পাল্টেছি। আজ সময়ের অনেকটা স্রোত পেরিয়ে পেছন তাকালে মনে হয় এই তো সেদিনের কথা, কখনও মনে হয় আজব দেশের আজব কিস্যা যেন! দু একটি অক্ষরের আঁচড়ে সেইসব মানুষের আর কতসব ঘটনার ছবি আঁকার চেষ্টা করছি আমচরিত কথার পর্ব থেকে পর্বান্তরে। স্মৃতিতর্পণ বই তো নয়।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team