এবার আমরা সামসিং ফাঁড়ির মেজর হোম-স্টেতে। ইংরাজি ক্যালেন্ডারের শেষ তিন দিন তিন রাত থেকে পয়লা জানুয়ারি বাড়িমুখো। প্রতি বছরের মত এ বছরও ন্যাফ (হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ক্যাম্প) এর পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল ‘নেচার স্টাডি ক্যাম্প’ এর। আমাদের দুই ছেলে মেয়ে ডিসেম্বরের ২৫ তারিখে রওনা হয়েছিল দলের সঙ্গে। এবার ওরা তাঁবু ফেলেছিল সামসিং-এ। আশপাশটা ঘন সবুজ জঙ্গলে ভর্তি।
আমরা বাপ-মা ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ক্যাম্প ফায়ারের আমন্ত্রণ রক্ষা করে রাতে থাকতে চলে গেলাম সামসিং ফাঁড়ির মেজর হোম-স্টেতে। বছরের ২৫ ডিসেম্বর থেকে ২৯ ডিসেম্বর এই পাঁচটা দিন আমরা ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে না থাকাটা যেমন মিস করি তেমনি আবার স্বামী-স্ত্রী একান্ত হওয়ার সুযোগটাও হাতছাড়া করি না।
সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ জলপাইগুড়ি থেকে রওনা দিয়ে হোম-স্টেতে পৌঁছলাম দুপুরবেলা লাঞ্চের ঠিক আগ দিয়ে। হোম-স্টেতে লাঞ্চ না করে চলে গেলাম ক্যাম্পে। ওখানেই খাওয়ার নিমন্ত্রণ সেদিন।
আমরা এখানে আসবার কয়েকদিন আগে থেকেই খবরাখবর শুনছিলাম নেওড়া ভ্যালির জঙ্গল থেকে হিমালয়ান ভালুক নাকি নেমে আসছে পাহাড়ের পাদদেশে এবং সমতলে। জলপাইগুড়িতেও ভালুক চলে এসেছিল। ফলে ফরেস্ট পেরোনোর সময় মনে মনে ভালুক দেখার উন্মাদনাও উঁকি দিচ্ছিল বারবার। সামসিং ফাঁড়ির যেখানে আমরা থাকতে এসেছি তার থেকে দশ কিলোমিটার উঁচুতে চুইখিম অরণ্য। আমাদের হোম-স্টেতে গাড়ি রেখে অন্য গাড়ি ভাড়া নিয়ে একদল ট্যুরিস্ট আগের দিনই গেছে চুইখিম বেড়াতে। সুন্তালিখোলাও খুব কাছেই। ওখানে যাওয়ার জন্যেও গাড়ি পাওয়া যায় এখান থেকে।
মেটেলি থেকে যে রাস্তাটা উঠে গেছে সামসিং-এ, সেটা এক কথায় অপূর্ব। দু’পাশে চা বাগিচার গালিচা, গাছে গাছে পাহাড়ি ময়নার ঝাঁক। এ সময়টায় গাছগুলো সব ছেঁটে দেওয়া হয়েছে, চলছে জল সেচের কাজ। ফাঁড়িতে যাওয়ার পথটিও খুবই সুন্দর। এক্কেবারে গা ছমছমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে।
সে রাত্তিরটা কাটল সুন্দর। সকাল থেকেই বৃষ্টি বৃষ্টি আবহাওয়া ছিল। ক্যাম্পে বিকেলবেলা বেশ জোরে জোরে বৃষ্টি নেমে গিয়েছিল। সেই সঙ্গে ছিল ঝোরো হাওয়া। একটু থামল কী থামল না সন্ধে থেকে আবার বৃষ্টি সাথে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। অগত্যা আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে ‘বৃদ্ধ সন্ন্যাসী’র ভরপুর সঙ্গ লাভে উদ্যত হলাম।
পরদিন চালসা থেকে ছেলে-মেয়েকে ফেরত নিয়ে আবার চলে এলাম হোম-স্টেতে। পাভেল-ঝিলাম হুজুগ তুলল, ফলে বাড়ি না ফিরে আবার চললাম ওখানেই। পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা। হোম-স্টেটি এত পরিষ্কার আর ঝকঝকে যেন মনে হচ্ছিল এক্কেবারে নতুন। কিন্তু জানলাম তার বয়স আট বছর পেরিয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা-কর্মী আর তাঁর স্ত্রী মিলে চালান এটি। ভদ্রলোকের রুচিবোধের প্রশংসা না করে উপায় নেই। বৌদির রান্নার হাতও ভারি সুন্দর। গরম গরম সুস্বাদু রান্না।
পরদিন ভোরবেলা থেকে বাপ-বেটা দু’জনেই নানান রকম পাখির গন্ধ পেয়ে গেছে। ফলে ক্যামেরা হাতে বাবা আর সঙ্গে অ্যাসিস্টেন্ট ছেলে। পাখি স্পট করছে আর ক্যামেরা-বন্দী করছে দু’জনে।
সকাল তখন এগারোটা হবে। পাহাড়ের আরও ওপরের দিক থেকে ফোনে খবর এল- কোনও ট্যুরিস্ট যেন ওপরের দিকে না আসে। কারণ, দুটো ভালুক দিনের বেলা জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়ে নিচের দিকে নেমে এসেছে। ঝোপঝাড়ে দেখা গেছে তাদের। ফলে খুব সাবধান। আমরা যদিও হোম-স্টের বারান্দাতেই আছি তবুও কেমন যেন রোমাঞ্চ হল শরীরে মনে। একবার দেখা পাওয়ার ইচ্ছেও যে হয়নি তাও নয়। শোনা গেল গত রাতে কাছেই ওপরের দিকে কোনও এক বাড়িতে মুরগীর ওপর হামলা করেছিল ভালুক। আজ বেশ খানিকটা নিচে নেমে এসেছে। সারাদিনই এইসব খবরাখবরে বেশ শিহরণ জাগছিল মনে।
সন্ধেবেলা ঘটল এক কান্ড। ঝিলাম সকাল থেকেই দেখাচ্ছে, ঠিক কাঁধের কাছটাতে একটা কালো বিন্দু, সেখানে আবার খুব জ্বালা আর ব্যথা। ঐ কালো বিন্দুতে হাত ছোঁয়াতে দিচ্ছে না। সারাদিন যাহোক খুব একটা পাত্তা না দিয়ে সন্ধের সময় একটু জ্বরজ্বর লাগাতে ওর বাবা বলে উঠল, “দেখি তো তোর কাঁধের কাছটা, কী হয়েছে দেখি তো একবার”। হ্যাঁ, ঠিক তাই। যা মনে হয়েছিল তাই। বেশ একটু বড় হয়েছে স্পটটা। ওর বাবা বলল, “এটা তো পোকা লেগে আছে! রক্ত খাচ্ছে”! আমার তো গা শির শির করে উঠল। অতনু স্যানিটাইজার স্প্রে করল আর আমি নখ দিয়ে চিমটি কেটে হাতে তুলে এনে দেখালাম, পোকাই তো! এতক্ষণ ধরে রক্ত খাচ্ছিল! রাতে ঝিলামকে একটা প্যারাসিটামল দেওয়া হল। জ্বরজ্বর ভাব কমে গেল খানিক বাদে। ব্যাথা, জ্বালাও আর নেই।
পরদিন আসবার জন্যে ব্যাগ গোছগাছ করে, স্নান সেরে সবাই রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে গিয়ে বসেছি। বিরু এখানকার আর একজন ভাইয়া, যার কথা এতক্ষণ বলাই হয়নি। আমাদের দেখভাল, ফরমাইশি নানান কাজ সবটাই বিরু সামাল দেয়। খুবই অমায়িক ব্যবহার। খুব ভাল ছেলে। বিরুর ডাকেই আমরা নাস্তা নিতে পৌঁছলাম ডাইনিং-এ। হঠাৎ পাভেল বলে উঠল, “মা, দেখত, আমার কাঁধের কাছে কুটকুট করছে আর জ্বালাও করছে! কী হল দেখত একবার! জামা সরিয়ে দেখি আবার এক পোকা। একই জিনিস যা কাল ঝিলামের কাঁধে ছিল। এক চিমটে দিয়ে সরিয়ে দিলাম পোকা। চুলকোতে লাগল খানিক্ষণ। তারপর সব ঠিক। পরে জানলাম এঁটুলি পোকা বলে ওগুলোকে। এসব জায়গায় বড়ই সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু আমাদের তো আর এরকম অভিজ্ঞতা ছিল না, ফলে ঘাবড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল। জানলাম, খুব নাকি ঝামেলায় ফেলে এরা।
সব মিলিয়ে দারুণ কাটল তিনটে দিন। এত সুন্দর একটা জায়গা! ইচ্ছে করছিল আরও দুটো দিন থেকে যাই।
সামসিং ফাঁড়ির মেজর হোম স্টে বুকিং 8900512711
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team