মানুষ কি আর বৃক্ষের মতো চিরটাকাল একই অবস্থানে স্থির থাকে? বৃক্ষ তো সে নয় যে আকাশপানে ডানা মানে ওই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে বৃষ্টির জলে বেহদ ভিজবে; অর্কদেবের সঙ্গে সরাসরি বন্ধুত্ব করে পাতায় পাতায় রান্নাটুকু সারবে, মাটির গভীরে শিকড় ডুবিয়ে জলপান করবে বা মাটি আঁকড়ে শক্তপোক্ত দাঁড়িয়েই থাকবে আজীবন, যদ্দিন বাঁচে। মানুষ চলবে ফিরবে, নাচবে গাইবে এইই স্বাভাবিক। মানব শিশু যেদিন প্রথম টলে টলে একপা দুপা হাঁটে সেদিন তাঁর নিকটজনদের আনন্দ আর ধরেনা। হাঁ বাছা আমার নিজ পায়ে দাঁড়াবে, চলবে ফিরবে। তা মানুষের চলাফেরা কি আর একপা, দু’পা রইল! সে যে ক্রমে জল-স্থল-অন্তরীক্ষ সর্বত্রগামী হল! কখনও রুটি-রুজির টান তো কখনও উৎসব আনন্দে যোগদান তো কখনও চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয় কখনওবা নতুন দেশ দেখা বা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে মানুষ চলছে, ফিরছে, ছুটছে। ‘পায়ের তলায় সরষে’ ‘পায়ে চাকা বাঁধা’ এমন সব বাক্যি কি আর এমনিই মুখে মুখে ঘুরছে! কোন সে যুগান্তরে, সাড়ে তিন হাজার খ্রীস্টপূর্বাব্দে সিন্ধুসভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজে প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে খেলনা মাটির চাকা পাওয়া যায় কী করে?
এত কথার কারণ এইই গমনাগমন বিষয়ক দুচারটি অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করার বাসনা আমচরিতের এই পর্বে। তা সেবারে হিমালয় ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়া, সুস্বাস্থ্যবান ‘ভ্রমণ’নামক গ্রন্থটি একমাত্র গাইড। তালিকায় লখনৌ, আলমোরা, কৌশানি, নৈনীতাল, রাণীক্ষেত তারপর হরিদ্বার হয়ে ফেরা। পুজোর মধ্যে যাত্রা। আমরা দুজন, সঙ্গে বয়স্কা মা ও বছর তিনেকের শিশু। নিউজলপাইগুড়ি থেকে ট্রেন ধরে বিস্তর পথ পেরিয়ে মোটামুটি নিরাপদেই গোমতী নদ তীরবর্তী নবাবদের শহর লখনৌ পৌঁছালাম অষ্টমীর দিন। এ শহরে দুদিনের বিরতি। কর্তামশাইয়ের বড়দি সপুত্রকন্যা এ শহরেই বসবাস করেন বহু বছর। তিনি রেলকর্মী, টি টি পোস্টে বহাল। নিতান্ত অল্পবয়সেই স্বামীকে হারিয়েছেন। আমাদের জন্যে মাতৃসমা বড়দির ছোটপুত্রটি স্টেশনে অপেক্ষায় ছিল। তারই সঙ্গে টাঙ্গায় চেপে তাদের বাড়িতে।
একে পুজো তায় সপরিবারে মামা এসেছে। বেশ আনন্দের বাতাবরণ তৈরি মুহূর্তেই। খবরাখবর, উপহার দেওয়া নেওয়া, জোরদার আড্ডা। মুহূর্তেই পথের ক্লান্তি উধাও। স্নান সেরে, তৈরি হয়ে সবাই মিলে কাছেই বেঙ্গলি ক্লাবের দুর্গাপূজার অঞ্জলি দিতে চললাম। সারাদিন হাসি-মজায় কাটল। পরদিন লখনৌর কয়েকটা দ্রষ্টব্যস্থল, মার্কেট ঘুরে বেড়ানো হল ভাগ্নে-ভাগ্নিদের সঙ্গে, সদলবলে হৈচৈ করে।
কাঠগোদামের ট্রেন রাতে; বড়দিই টিকিট কাটিয়ে রেখেছিলেন, ভাইয়ের হাতে দিয়ে বলেন ‘ভালো করে রাখ, স্লিপার ক্লাসের টিকিট। এই ট্রেনটা প্রায় ফাঁকাই থাকে, অসুবিধা হবেনা। ‘রাতের খাওয়া সেরে যথাসময়ে স্টেশনে এসে সিট নম্বর মিলিয়ে ট্রেনে চেপে বসলুম। মোটে ভিড় নেই, ফাঁকা ফাঁকাই। ভাগ্নেরাই ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে গাছিয়ে বসিয়ে দিয়ে গেল। ট্রেন ছাড়ার আগের মুহূর্তে জনা পাঁচেকের একটি দল হাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে উঠে এলেন আর ট্রেনও ছাড়ল। এরপর শুরু তাদের পারস্পরিক দোষারোপের পালা; কার জন্যে দেরি, ট্রেনটা মিস করলে কি হত ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাষায় মালুম তাঁরা বাঙালি। উচ্চকন্ঠী এক মহিলা দলের অন্যদের তুলোধোনা করতে লাগলেন। আমরা ঘটনার গতিপ্রকৃতি অবলোকন করি বসে বসে। ছেলে কোলের ওপর মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। হায়! তখন কি আর জানি ঘটনার পরবর্তী অভিমুখ কোন দিকে?
ওনাদের দলের এক ভদ্রলোক টিকিট নাম্বার মিলিয়ে মিলিয়ে আমাদের কাছে এসে বিরতি দিলেন এবং ভাল করে দেখে নিয়ে জানালেন এই যে পরম নিশ্চিন্তে বসে থাকা আমাদের এই দুটো আর শোবার উদ্যোগ নিতে থাকা মায়ের সিটটাও নাকি ওনাদেরই। তাজ্জব ব্যাপার! তা কী করে হয়! রেলের লোকই টিকিট কেটে দিয়েছে। কর্তামশাই তড়িঘড়ি ‘সাত রাজার ধন এক মানিক’ টিকিট বের করেন, সিট নাম্বার তো আমাদের ঠিকই আছে, সিটগুলো আমাদেরই। উচ্চকন্ঠী মহিলাটি হুমড়ি খেয়ে পড়েন আর একই টিকিট দুবার বিক্রি করে জালিয়াতির অপরাধে রেল কোম্পানিকে বিস্তর গালাগাল দিতে শুরু করেন শেষে ‘আমার শরীর খুব খারাপ করছে’ বলতে বলতে সিটের ওপর খানিক নেতিয়েই পড়েন। ভদ্রলোকটি আমাদের টিকিট হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখতে থাকেন।
আমরাও চিন্তায় পড়ে যাই, কোনটি আসল কোনটি নকল টিটি না এলে বুঝি কী করে! হায় যাত্রারম্ভে এ কি গেড়ো! তবে আমরা আত্মবিশ্বাসী, কারণ বড়দি। তিনি রেল কোম্পানির লোক, যাকে দিয়েই টিকিট কাটান জালি টিকিট কাটবে না নিশ্চিত। কিন্তু এনারা কাকে দিয়ে কাটিয়েছেন, সে তো ঈশ্বর মালুম। ভদ্রলোক বারবার ওঠেন বসেন, সিট নাম্বার মেলান। রাত গভীর হয়। ট্রেন দ্রুত ছোটে, ভোররাতে কাঠগোদাম পৌঁছবে। কালো কোট পরা একজন, কী যেন বলতে বলতে এধার থেকে ওধারে চলে গেলেন। টিকিট চেক করার নাম নেই। আমাদের সহযাত্রী ভদ্রলোক তখনও গভীর মনযোগে নিজেদের টিকিট পরখ করে চলেছেন। হঠাৎ কী মনে করে আবার আমাদের টিকিট চেয়ে নিয়ে কীসব দেখে টেখে ওনার মুখখানি উজ্জ্বল হয়, উনি সোল্লাসে বলেন ‘এই দেখুন কান্ডটা, আপনাদের সিট নাম্বার ঠিক থাকলেও ডেট তো একমাস আগের। এ হল গে অক্টোবরের ২০ আর আপনাদের টিকিট তো সেপ্টেম্বরের ২০-র। পুরনো টিকিটে যাত্রা করা বেআইনি। বুঝলেন। তালে সিটগুলো এবার ছাড়েন। মেলা ফাঁকা সিট পড়ে আছে ওখানে গিয়ে শুয়ে পড়েন। টিটি আসলে সেটেল করে নেন।’
‘এ তো অবিশ্বাস্য কান্ড! হাতে নিয়ে দেখা গেল সত্যি আমাদের টিকিটে জ্বলজ্বল করছে একমাস আগের ডেট। বড়দির যেমন ভুল আমাদেরও তো। আমরা তখন টিকিট হাতে পেয়েই খুশি, চেক করিনি। উচ্চকন্ঠীনী কেমন তেড়েফুঁড়ে উঠলেন। ‘যান ওদিকে, আসুক টিটি দেবে নামিয়ে মাঝরাত্তিরে কোথায়, তখন বুঝবে মজা। অন্যের সিটে আরাম করে বসে আছে তখন থেকে। এইবার জেলের ভাত খাবে সব।’ আশ্চর্য মহিলা তো! ওনার এত রাগ কীসের!
ঘুমন্ত বাচ্চা, ব্যাগট্যাগ সমেত আমরা ওপাশেই ফাঁকা সিটে গিয়ে বসি। মনে কী যে অস্বস্তি আর ভয়! সত্যি এই মুহূর্তে আমরা তো বিনাটিকিটে রেল সফর করছি। তায় একমাসের পুরনো টিকিটে, এক্কেবারে ফ্রড কেস। হায় হায়! এমনও হয়! তারা বিছানা পত্তর পেতে কম্বল মুড়ে দিব্যি টানটান শুয়ে পড়েন। ভদ্রলোক একবার এসে বলেন, ‘অত চিন্তা করবেন না, টিটি আসুক একটা উপায় হবে। পেনাল্টি দিতে হবে হয়তো। এখন শুয়ে থাকেন, আর কী করবেন।’ ভয়ানক দুশ্চিন্তায় প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে! আমার মা স্তব্ধ হয়ে জানালার কিনার ঘেঁষে বসে। শত অনুরোধেও তিনি শুলেন না। কোনও কথার উত্তরও দিলেন না। রাত গভীর হচ্ছে, প্রচন্ড গতিতে ছুটছে ট্রেন, মাঝেমাঝেই কেমন ঘোড়ার মতো লাফিয়ে উঠছে যেন! ছেলেকে শুইয়ে দুহাতে চেপে ধরে ঠায় বসে আছি আমিও। প্রতি মুহূর্তে অপেক্ষা করছি সেই চরম মুহূর্তের, কল্পনায় দেখতেও পাচ্ছি টিটি, পুলিশ সবাই মিলে এই ঘোর অন্ধকারে কোন সে অজানা অচেনা পাহাড়ি স্টেশনে নামিয়ে দিচ্ছে আর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে আমাদের লাগেজ। নয়তো কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে জেলে!
নার্ভও একসময় ক্লান্ত হয়। ছেলের বাবা ওপরের বাংকে শুয়ে পড়ে, খানিক বাদে তার নাসিকা গর্জনের আওয়াজ ওঠে! পুরুষমানুষের টেনসন খানিক কমই হয় বুঝি! আধো ঘুম আধো জাগরণে সে দুঃস্বপ্নের রাত্রিও ভোর হয়। সারারাত অমন টেনশনে রেখে টিটি বা পুলিশ কেউই আসেনা! দীর্ঘ সফর শেষে, ভোরে কাঠগোদামে থামে ট্রেনটি। বিষণ্ণ বদনে ট্রেন থেকে অবতরণ করি, ব্যাগপত্তর সহ বাইরেও চলে আসি। না কোনও টিটি পথ আগলে দাঁড়ায়, না কোনও পুলিশের টিকি দেখা যায়। পরবর্তী নির্ধারিত ভ্রমণসূচিতে ঘোরাঘুরি প্রায় নির্বিঘ্নেই সারা হল। হরিদ্বার থেকে ফেরার টিকিটে অবশ্য আর কোনও ভুল ছিল না। এ কান্ড প্রায় বছর পঁচিশ আগের। তখন এমন অনলাইন বুকিং সুবিধে ছিল না মোটে; ঘরে বসে মোবাইল টিপে টিকিট কাটার এমন উপাদেয় পদ্ধতির কথা কারও স্বপ্নেও ছিল না। তবে হ্যাঁ দালালরাজ কিন্তু ছিল। রেলভ্রমণে প্রাপ্ত মিঠেকড়া অভিজ্ঞতা সবারই কমবেশি আছে নিশ্চিত। দুনিয়াসুদ্ধ সহযাত্রীরা সব্বাই সেই উচ্চকন্ঠীর মতো মুনি দুর্বাশা এমনটাও নয়।
জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশনটি আমাদের বাড়ি থেকে দু’পা। সেবারে দার্জিলিং মেল; স্লিপার ক্লাস, গন্তব্য কলকাতা। লোয়ার, মিডল দুটো আমাদের। ওপাশের সিটে জোড়াসনে হাসমুখ এক মধ্যবয়সিনী, কলকল করে কথা বলছেন। তাঁকে ঘিরে দিলখুশ আরও জনা দশেক নারীপুরুষ। প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজন মিলে দলবেঁধে সব বেড়াতে যাচ্ছেন। কলকাতা হয়ে জগন্নাথধাম, পুরী তাদের গন্তব্য। ট্রেন ছাড়তেই ছোটবড় কৌটোয় ঠাসা লালরঙের খাবারের ঝুড়ি, ফ্লাক্স বেরুলো। হাতে হাতে কাগজের কাপ গেল, প্রায় অপরিচিত আমাদের হাতেও কফি ভর্তি কাপ তুলে দিলেন, ’খেয়ে দেখুন, আমার মেয়ে তমার হাতের।‘ নিউ জলপাগুড়ি আসতে আসতে মেয়ের হাতের কেক, বাদাম কারিপাতা আরও নানা মশলা দিয়ে চিড়েভাজা। সত্যিই মুখে লেগে থাকার মতো। সদ্যপরিচিত মহিলার এপ্রকার আতিথ্যপ্রদানে আমরা প্রায় আত্মহারা। সবাই তাঁর গুণবতী কন্যাটির ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগলাম এবং প্রতিটি সংবাদ মোবাইল মারফৎ মেয়ের কাছে সরবরাহ করলেন তিনি। স্পিকার লাউডে রেখে মেয়ের কথা শুনছি, ‘সবাইকে দেবে কিন্তু মা। তোমরা সবাই খাবে, কেমন হয়েছে বলবে কিন্তু।’ জানলাম মেয়ে নার্সিং স্টুডেন্ট। যাইহোক যাত্রাপথটুকু বেশ হাসি মজায় আত্মীয়তার আবহে পরিপূর্ণ হয়ে রইল। মনেমনে বললুম, আহা! প্রিয় জলপাইগুড়ি। এ শহরে এখনও এমন মানুষ বাস করে!
আরেকবার জলপাইগুড়ি টাউন স্টেশন থেকে সকালে ‘হলদিবাড়ি সুপার ফাস্ট’ ট্রেনে যাচ্ছি শান্তিনিকেতন। সঙ্গে ব্যাগ, ছোট ট্রলি, বিস্কিট, গোটা দুই আপেল, জলের বোতল ব্যাস। মালদায় স্টেশন থেকে লাঞ্চ করা যাবেখন। নইলে বোলপুর পৌঁছে স্টেশনের ক্যান্টিন থেকে কিছু একটা হলেই হল। নিজের জন্যে লাঞ্চ প্রস্তুত করার সময় কই। ঘরদোর মোটামুটি প্রকারে গুছিয়ে, সহায়িকার হাতে খানিক ঘরকন্নার দায় চাপিয়ে, বাড়ির অন্যান্য সভ্যদের যথাসম্ভব কর্তব্যকর্ম বুঝিয়ে নিজে যে যথাসময়ে ট্রেনটা ধরতে পেরেছি এইই ঢের।
আমার উল্টো দিকের সিটে ভারি গম্ভীর চেহারার এক দম্পতি। মাঝবয়সী গিন্নি যৎপরোনাস্তি পরিপাটি। কী সুন্দর চুলের ক্লিপ, কপালের টিপ, পায়ের চটি আর ওড়নার রঙ ম্যাচ করেছে। ভদ্রলোক মনযোগের সঙ্গে কাগজ পড়তে শুরু করলেন, মহিলাটি ওপরের হ্যাঙ্গারে খান তিনেক ব্যাগ ঝোলালেন। কোলের পাশে একটা বড় আকারের পেটফোলা ব্যাগ রেখে গুছিয়ে বসেন। তারপর মোবাইল খুলে নানাস্থানে যাত্রারম্ভের সংবাদ জানিয়ে জানালাপথে বাইরে চেয়ে রইলেন। উত্তরবাংলা অপরূপা, সত্যি চেয়ে চেয়ে মুগ্ধ হবার মতই তো। ‘ব্যাগের চেনগুলো বন্ধ করুন।’ মহিলাটি বলেন আমায়। ‘তাইতো।’ আলাপ শুরু হয়, কোথায় যাচ্ছি? একা কেন? শান্তিনিকেতনে কে আছে আপনার? ‘কেন রবীন্দ্রনাথ আছেন।’ খানিকক্ষণ মুখের দিকে চেয়ে কী যেন বোঝার চেষ্টা করেন। বলেন, ‘উনি তো মারা গেছেন সেই কবে। ওখানে চাকরি করেন আপনি? আচ্ছা।’ ‘রবীন্দ্রনাথ কি আর আমাদের মতো, মরে যাবেন?’ না, একথা আর উচ্চারণ করিনা।
এরপর উনি জানালেন কলকাতায় কামালগাজির কাছে ফ্ল্যাট মেয়ের। পাশেই নিজেদেরও একটা ফ্ল্যাট আছে। একটাই মেয়ে, ছোট বাচ্চাটি সে সামলাতে পারে না। তাই নাতির জন্যে মা বাবাকেও কলকাতায় যাওয়া আসার মধ্যেই থাকতে হয়। জলপাইগুড়ির বসত ভিটে প্রায় তালাবন্ধই থাকে। কথা বলতে বলতেই উনি বড় দুটি কাপে ফ্লাক্স থেকে চা ঢালেন, কৌটো থেকে বিস্কিট বের করেন, দুজনে খান। কাপদুটো ধুয়ে আনেন জলের বোতল নিয়ে গিয়ে। ছোট্ট টাওয়েল দিয়ে কাপ দুটো সযত্নে মোছেন। ভাজা মশলার কৌটো বের করে স্বামীকে দেন নিজে খান। ঠিকঠাক সময়ান্তরে স্বামীকে ওষুধ বের করে দেন। শুকনো ফল খান আবার বিরতি দিয়ে প্লেট, ছুড়ি বের করে আপেল, পেয়ারা কেটে দুজনে খান সবশেষে ছুড়ি প্লেট ধুয়ে মুছে ব্যাগে ভরেন। সত্যিই কত্ত কী বয়ে এনেছেন গুছিয়ে গাছিয়ে নিজেও কেমন সুন্দর করে সেজে এসেছেন! উনি বলেন ‘আমরা বাইরের কিচ্ছু মুখে দিইনা। ওনার পেটের সমস্যা, প্রেসার ওঠানামা করে। আরও হাজার রকম আছে। প্রচুর ডাক্তার টেস্ট সব চলছে। কিন্তু একসময় ফুটবলে কত নাম ছিল ওনার, জলপাইগুড়ির পুরনো লোকেরা জানে।’
রুগ্ন চেহারার ভদ্রলোকটির মুখে ম্লান হাসি ফোটে এতক্ষণে। তা এহেন সুশৃঙ্খল আর ভারি পরিপাটি মানুষদের সামনে বসে হকারদের থেকে কিছু আর নিইনা। ‘ঝালমুড়ি, চা, কফি আরও সব এটা সেটা না খেলে রেলযাত্রার মজাটা কোথায়? সে ভাবখানা চাপা দিয়ে খিদেভাবটা নিয়ে চুপ করে বসে থাকি। ট্রেনটা সামান্য লেট করে মালদা স্টেশনে ঢোকে। মিনিট বিশেকের বিরতি। এখানেই লাঞ্চ সারা যাবে। হকারদের হাঁকডাকে সরগরম চারধার। ভদ্রমহিলা কাগজের প্লেট গোটা তিনেক টিফিন বাটি, চামচ বের করে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বলি,’আপনি একটু ব্যাগগুলোর দিকে নজর রাখবেন। আমি একটু নিচে যাই। কিছু নিয়ে আসি।‘ চট করে আমার হাতটা ধরে ফেলেন তিনি ‘না না তা হবেনা। আমার এখানে অনেক খাবার আছে। আমাদের সঙ্গে খাবেন। সারারাস্তা কিছুই তো খেলেন না। এক জায়গার লোক আমরা, দুপুরে ভাগাভাগি করে খাই। বলতে গেলে চারজনের খাবার আছে সঙ্গে।’
কন্ঠস্বরে কী এক দাবি ছিল, খেলাম ওনাদের সঙ্গে বসে। স্যালাডও কেটে এনেছেন! হুহু করে ট্রেন ছুটছে, আর কত সে গল্প। ভদ্রলোক বহু পুরনো দিনের গল্প বলতে ভালবাসেন। তিস্তার বোরলি মাছের গল্প, এ জেলার ফুটবলের গল্প, কিংসাহেবের ঘাট, ইউরোপিয়ান ক্লাবের গল্প। ‘৬৮র প্রলয়ংকরী বন্যার গল্প। জলপাইগুড়িতে নেতাজি এসেছিলেন আরও সব বিখ্যাত নেতারা এসেছিলেন কী বিরাট জনসমাগম হয়েছিল; সে সব উজ্জ্বল সময়ের গল্প। দেশভাগের আগে কত গুরুত্ব ছিল জলপাইগুড়ি স্টেশনের, সে গল্প। এ জেলার টি, টিম্বার আর টোবাকো কত শক্ত করেছে দেশের অর্থনীতির ভিত সে গল্প। নুরমঞ্জিল বা নবাববাড়ি, বাকালি হাউস, জলপাইগুড়ির কাছেই সেই পাঙ্গা এয়ারপোর্ট, রাজবাড়ি, শেষ রাজা প্রসন্নদেব রায়কত, জলপাইগুড়ির নাট্যচর্চা, উচ্চাঙ্গ সংগীতের চর্চা এমনই সব গল্প নিয়ে আমরা বুঁদ হয়ে যাই। দেখতে দেখতে অপরাহ্ন, বোলপুর এসে গেল। ঝোলাঝুলি সমেত নেমে পড়ি তাঁদের বিদায় জানিয়ে। এখানে মিনিট দুয়েকের স্টপেজ, ট্রেন ছেড়ে দিল। ওনাদের জন্যে নাকি বড় প্রিয় ওই ভারি ঘরোয়া শহরটির জন্যে মনটা হঠাৎ কেমন করে ওঠে!
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team