 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                                                 শাশ্বতী চন্দ
                                            
                                                
                                                শাশ্বতী চন্দ
                                            
                                            
                                         
                                            
                                        ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছিল রুমি দ্রুত পায়ে। আলুথালু, চোখের কোল ভেজা। প্রীতিকে দেখে থমকে গেল একবার। তারপরেই আর্ত স্বরে বলে উঠল, ‘একবার খবর দিলে না মা? নয় দিন হয়ে গেল! কী করে পারলে? মা, মা গো! একেবারেই পর করে দিলে?’
প্রীতির বুকের ভিতর বাঁধ ভাঙে। অসহ জলস্রোতে যেন ডুবে যায় সপ্তডিঙা মধুকর। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় পৃথিবীর সমস্ত বানানো নিয়মের দেওয়ালে মাথা কুটে কাঁদতে। কিন্তু চাইলেই কি পারা যায়? প্রীতি তো শুধু রুমির মা নয়। ভট্টাচার্য বাড়ির বৌ। অজিতেশ ভট্টাচার্যের সদ্য বিধবা। তাই সব জলকল্লোল বুকের ভিতর বন্দী করে শুধু দুটো হাত দু দিকে ছড়িয়ে ডাকেন, আয়।
যেন উড়ে আসে রুমি। প্রীতিকে জড়িয়ে ধরে, শেষ দেখাটাও যদি দেখতে পেতাম আফশোস থাকত না। একটা ফোন যদি করতে!
কী করতি দেখে? রোগে ভুগে শরীরে আর কিছু ছিল না। কঙ্কালসার হয়ে গিয়েছিল। তার থেকে তোর মনের মধ্যে যে ছবিটা আছে তোর বাবার, হাসিখুশি, গোলগাল, সেটাকেই বাঁচিয়ে রাখ। সেটাই তোর আসল বাবা।
কাজের বাড়ি। লোকজন, আত্মীয়স্বজন চারদিকে। সবার নজর এড়িয়ে রুমিকে ঘরে টেনে নিতে চাইলেন প্রীতি। অপ্রিয় কথা উঠুক, রুমির অতীত নিয়ে নাড়াঘাঁটা হোক, চাইছিলেন না। কিন্তু দেওয়ালের যেমন কান আছে। বাতাসেরও চোখ আছে বোধহয়। তাই হাজির হলেন অর্চনা, ‘ঠিকই শুনেছি তাহলে, রুমি এসেছে। কার কাছে খবর পেলি? এ বংশের কেউ তো তোকে ডাকবে না। তুমি ডেকে এনেছ নাকি বৌদি মেয়েকে আহ্লাদ করে?’
‘মা ডাকলে আমি আরো আগেই আসতাম পিসিমনি। বাবাকে শেষ দেখাটা দেখতে পেতাম। তুমি কিন্তু একটুও বদলাওনি এই পনেরো বছরে। এখনও বিষ উগড়ে চলেছ! এই শোকের মধ্যেও! আমার বাবা, চলে গিয়েছেন। তিনি তোমারও দাদা ছিলেন। একমাত্র দাদা।’
‘ছোট মুখে বড়ো কথা বলিস না রুমি। তুই আমাকে সম্পর্ক শেখাবি? ভট্টাচার্য বাড়ির মেয়ে হয়ে মুসলমান ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সম্পর্ক নিয়ে ভেবেছিলি? খুব যে বাবা বাবা করছিস, সেই বাবার বুকে কতটা ঘা দিয়েছিলি, ভুলে গিয়েছিস? তোর এই কান্ডের জন্য ঘরে বাইরে মুখ দেখাতে পারিনি, এখনও পারি না তা জানিস? অত উঁচু গলায় কথা বলিস না। বুঝলি!’
কিছু বলার জন্য মুখ খুলেছিল রুমি। প্রীতি মুখে হাত চাপা দেন, ‘একটাও কথা বলবি না। ঘরে চল।’
রুমিকে টেনে নিজের ঘরে ঢোকান প্রীতি। পিছন থেকে অর্চনা বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে সোহাগ করছ করো। মনে রেখো ও কিন্তু জাত খুইয়েছে। পুজোর জিনিসে যদি ছোঁয়াছানি হয়, আমি কিন্তু কুরুখেত্তর করব।’
দরজায় খিল আটেন প্রীতি। ঘরের মাঝখানে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রুমি। আর দশটা বিবাহিতা মেয়ে বাপের বাড়ি এলে যে সমাদর পায়, তা যে সে পাবে না, জানাই ছিল। তবে এতটা নির্মম আক্রমণ হবে, এমন মায়াহীন দয়াহীন হবে আপনজনের ব্যবহার, ভাবেনি বোধহয়। বা কিছুই ভাবেনি বোধহয়। বাবা নেই, এই নিষ্ঠুর সত্যটা অন্য কিছু ভাবার ক্ষমতাই নষ্ট করে দিয়েছিল।
অস্ফুটে বলল রুমি, ‘না এলেই ভালো করতাম, মা? তোমাকে ঝামেলায় ফেললাম।’
রুমিকে বুকে টেনে নেন প্রীতি, ‘আয়, মা-মেয়েতে কাঁদি কিছুক্ষণ।  বুকের ভার কমিয়ে নে।’
‘জেঠিমা, ময়দা দাও। ঠাকুর চাইছে। লুচি হবে সকালে। আর আলু ফুলকপির তরকারি।’  ফুল্লরা এসে বলল।
অজিতেশের ভাইয়ের মেয়ে ফুল্লরা। ওর দাদা রাজু অজিতেশের পারলৌকিক কাজ করছে।  ফুল্লরা ছেলে, বর সহ এখানেই আছে আট দিন হল। সবাই দেখে শুনে কাজ উঠিয়ে দিচ্ছে বলে রক্ষা। ছোট মেয়ে পিয়ার বিয়ে কাছেই দিয়েছেন। এ পাড়া, ও পাড়া। তবু পিয়া এসে থাকতে পারেনি। আসা যাওয়া করে৷ শাশুড়ি যে শয্যাশায়ী। তবে জামাই সুদীপ করিতকর্মা। কালকের কাজ উতরে দেবে, ভরসা আছে প্রীতির।
ময়দা নিতে ভাঁড়ার ঘরে ঢুকেই চমকে উঠলেন প্রীতি।খোলা জানালা দিয়ে অপরিচ্ছন্ন রোদ্দুর এসে পড়েছে ঘরের মাঝখানে। সেই রোদ্দুরে পা ডুবিয়ে বসে আছে রুমি একটা হাতল ভাঙা চেয়ারে। কপালের ঝুরো চুলে, চোখের লালিমায় রাত জাগার চিহ্ন স্পষ্ট। সহজ হওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললেন প্রীতি, ‘এ ঘরে কেন? একেই উত্তরের ঘর। তার ওপর গাছপালার জন্য রোদ কম ঢোকে। হিম হয়ে আছে তো।’
বিষণ্ণ হাসে রুমি, ‘এ ঘরেই তো থাকতাম। ভুলে গিয়েছ?’
নিরিবিলি বলে এই ঘরটাই বেছে নিয়েছিল রুমি। অজিতেশের আপত্তি ছিল, ‘আমাদের ঘর থেকে এতটা দূরে!  একটা লম্বা বারান্দা মাঝখানে। রাত-বিরেতে ভয়টয় পেলে? বরং পাশের ঘরে থাকুক দুই বোন মিলে।’
রুমি জেদ ধরেই ছিল, ‘পিয়ার সঙ্গে ঘর শেয়ার?  ওরে বাবা! আমার সব জিনিস হান্ডুল পান্ডুল করে দেবে। ভয় পাব কেন? বারান্দা তো কী? গ্রীল দিয়ে ঘেরা। চোর ডাকাত তো আর আসবে না।’
কতদিন ঘুমের মধ্যে টের পেয়েছেন প্রীতি, অজিতেশ চুপিচুপি উঠে গিয়েছেন। রুমির ঘরের পর্দা তুলে দেখে এসেছেন। কখনো প্রীতির কাছে ধরা পড়ে গেলে অপ্রস্তুত মুখে হেসেছেন, ‘দেখতে গিয়েছিলাম ঘুমাল কিনা। যা রাত জেগে পড়ার স্বভাব মেয়েটার!’
চাপা কষ্ট লুকিয়ে বললেন প্রীতি, ‘সে যখন থাকতি তখন থাকতি। তাই বলে এখনও বসে থাকবি? চার পাশে যা ধুলো!’
‘ধুলো জমতে দিলে কেন মা?’
না শোনার ভান করে ময়দার কৌটা টানেন প্রীতি। রুমি আবার বলে, ‘আমার ঘরটাকে শেষ পর্যন্ত ভাঁড়ার ঘর বানিয়ে দিলে?’
‘তুই যাওয়ার পর খালিই পড়েছিল। জানিসই তো, সংসারে চৌষট্টিটা বাড়তি জিনিস থাকে। তারই কিছু ঢুকে গিয়েছে।’
ঘরের আনাচ কানাচে ঘুরে বেড়ায় চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস। রুমি থাকাকালীন এ ঘরের চেহারাই অন্য রকম ছিল। পড়ার টেবিলে বইখাতা টিপটপ সাজানো। বিছানার চাদর টানটান। কুলঙ্গিতে মাটির পুতুল। বড্ড গোছালো মেয়ে ছিল রুমি। টিউটরের সঙ্গে প্রেমের মতো ছেদো ব্যাপার ও পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে বিয়ের মতো অদূরদর্শী কাজ রুমি করতে পারে, তা মা হয়েও বুঝে উঠতে পারেননি প্রীতি।
 ময়দার কৌটা নিয়ে বেরোতে যাবেন। পিছন থেকে রুমি বলল, ‘ভারী? আমি পৌছে দেব?’ 
‘উহু। তোর পিসি দেখলে আবার কী না কী বলবে। শোন, তুই আমার ঘরে গিয়ে বস। আ্যটাচাড বাথরুমে স্নান করে নিস। সারা বাড়ি হটর হটর করে বেড়াস না।  কে কী বলে বসে! এই তো আর দু তিন দিন। নিয়মভঙ্গের পরের দিনই বাড়ি ফাঁকা হয়ে যাবে।"
রুমির মুখ ম্লান হয়ে গেল দেখে বুকে শেল বিঁধল। কিন্তু বলতেই তো হত। এক তো অর্চনাই নয়। আরো কতজন আছে। কে কতটা বিষ জিভের ডগায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে!
রান্নাঘরের সামনের চাতালে চেয়ার নিয়ে বসে আছে অর্চনা, ফুল্লরা, শেফালি, শুভশ্রী। কিছু একটা আলোচনা চলছিল। প্রীতিকে দেখে থেমে গেল। গ্রাহ্য না করে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। পিছন থেকে বললেন অর্চনা, ‘রুমি কি দাদার কাজ করবে নাকি? বলেছে কিছু?’
‘তেমন কিছু কথা হয়নি। আচ্ছা, জিজ্ঞেস করব।’
‘এই দ্যখো, জিজ্ঞেস করবে কেন আগ বাড়িয়ে? হয়ত ওর মনেই নেই। তোমার কথা শুনে মাথায় আসবে। তখন তো আরেক অশান্তি।’
‘অশান্তির কী আছে? মেয়ে বাবার কাজ করবে, বাবাকে জল দেবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
‘স্বাভাবিক!’ ভেংচে ওঠেন অর্চনা, ‘সে মেয়ে যে মসুলমানের বৌ এখন, সে খেয়াল আছে? মসুলমানের বৌয়ের জল বামুন নেবে? ধম্মে সইবে?’
 ঘুরে দাঁড়ান প্রীতি। চিরকাল মাথা নিচু করে সব মেনে নেওয়া প্রীতি, সমস্ত লোকাচার নীরবে পালন করা প্রীতি, ভট্টাচার্য বাড়ির বড়ো বৌ প্রীতি জীবনে প্রথম বার মাথা উঁচু করেন। বলেন, ‘রুমি আগে একজনের মেয়ে। কার বৌ সেটা পরের কথা। যদি জল দিতে চায়, আমি বারণ করব না।’
উল্টোদিকে হাঁটেন প্রীতি। আবার এসে ঢোকেন ভাঁড়ার ঘরে। দেখেন মেঝের ওপর উবু হয়ে বসে আছে রুমি। হাতে একটা বই। প্রীতিকে দেখে মায়াচ্ছন্ন চোখ তোলে, ‘সেই বাংলা অভিধান!  ইশ! কতগুলো পৃষ্ঠা পোকায় কেটে ফেলেছে। তখন খুব বই পড়ার নেশা ছিল। বঙ্কিম, দ্বিজেন্দ্রলাল, মাইকেল, কিচ্ছু ছাড়তাম না। কোনো শব্দে আটকে গেলে বাবার কাছে ছুটে আসতাম, মানে বলো। বাবা কখনো পারত। কখনো পারত না।। একদিন এই অভিধানটা কিনে এনে বলেছিল, এখন থেকে যে শব্দের মানে বুঝবি না এখানে দেখে নিবি। সব শব্দের মানে কি আমি জানি? কিন্তু মেয়ের কাছে অজ্ঞতা প্রকাশ করতে লজ্জা করে।’
হুহু করে কেঁদে ওঠে রুমি। টপ টপ করে ঝরে পড়ে অশ্রু। অভিধানের ওপর পড়ে।
দৃষ্টি বিভ্রম হয় প্রীতির। দেখে অভিধানের বাদামী পৃষ্ঠাগুলো যেন অবিকল অঞ্জলিবদ্ধ করপুট। শুষে নিচ্ছে জল অসীম আগ্রহে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
