বছর সাতেক আগে একবার এক ভাড়া গাড়িতে চেপে যাচ্ছিলাম বাগডোগ্রা থেকে মাদারিহাট। চালক দলগাঁও-বীরপাড়ার অনুপ লামা ডুয়ার্সের হাল হকিকত জানাতে গিয়ে বলেছিল এই সমস্যার কথা। ভুটান বর্ডারে গড়ে ওঠা শিল্পতালুক থেকে ছড়াচ্ছে দূষণ, বাতাসে উড়ছে খনিজ গুঁড়ো, বিছানা টেবিল চেয়ার ঢেকে যাচ্ছে ধুলোয়। অনুপ বলছিল, এই খনিজ ধুলো এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে হা করলেই নাকি মুখে ঢুকে পড়ে, দাঁতে দাঁত ঠেকালে বালি কিচ কিচ করে। বর্ষাকালে এই দূষণের মাত্রা কিছুটা কম মনে হলেও বছরের বাকি শুকনো সময় অসহনীয় হয়ে ওঠে বলে অভিমত ছিল তার।
পরবর্তীকালে সেই এলাকার অন্যান্য পরিচিতদের কাছে একাধিকবার শুনেছিলাম এই গম্ভীর সমস্যার কথা, ডাক্তার বন্ধুরা জানিয়েছিলেন এই দূষণ থেকে সৃষ্ট সম্ভাব্য সব রোগের আশংকা। গত সাত বছরে আলিপুরদুয়ার জেলার এই প্রত্যন্ত আদি জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় আরও নানা সমস্যার সঙ্গে অনেক বেশি গুরুতর হয়ে উঠেছে এই দূষণ। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, নিজেদের সুখী দেশ হিসেবে জাহির করা ছোট্ট প্রতিবেশি ভুটান, যারা দেশের ৬০ শতাংশ সবুজ অরণ্যে ঢাকা বলে গর্ব করে, তাদের সৌজন্যেই আমাদের ডুয়ার্সের নির্মল পবিত্র জল-আকাশ-বাতাস দূষিত হয়ে উঠছে, অথচ তারা এখনও কর্ণপাত করছেন কই?
অথচ দেখা যাচ্ছে ২০১৭ সালেই ভুটানের সংবাদ মাধ্যম ডুয়ার্স সন্নিহিত পাসাখার এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট থেকে ছড়ানো দূষণ নিয়ে সরব হয়েছে। শত শত মানুষের জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শিল্পতালুকের এই দূষণ আদৌ কতটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে সে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রতিবেদক। দূষণের মাত্রা এতটাই বেশি যে বছর কয়েক আগে বাচ্চাদের একটি স্কুলকে নাকি ওই এলাকা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। যাদের অন্যত্র যাওয়ার উপায় নেই তারাও মনে করছেন এই দূষণ তাঁদের আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে, সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকার পথ আর খোলা নেই। ২০১৪ সালেই ভুটানের জাতীয় পরিবেশ কমিশন থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রপাতি ও নজরদারি বাধ্যতামূলক বলে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু তা যে বাস্তবে কার্যকর হয় নি তার বড় প্রমাণ হলো, তাদের ২০১৬ ও ২০১৮ সালের রিপোর্টেও দূষণের মাত্রা কমার কোনও উল্লেখ মেলেনি। এই দূষণ বাড়তে বাড়তে আজ ওপারে তো বটেই, সীমান্তের এপারেও ডুয়ার্সের হাজার হাজার মানুষের জীবন বিপন্ন করে তুলেছে।
ফুন্টশোলিং শহর থেকে ১৮ কিমি দূরে পাসাখায় সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার অবস্থানগত সুবিধার জন্য শুরু হয়েছিল ভুটানের প্রথম শিল্পতালুক। এখন সেখানে বাড়তে বাড়তে গোটা চল্লিশেক সংস্থার প্ল্যান্ট, যার বেশিরভাগটাই খনিজ ভিত্তিক শিল্প। এদের অর্ধেক সংখ্যক প্ল্যান্ট থেকেই নদীর জলে অবাধে মিশছে বিষাক্ত বর্জ্য, বাতাস কালো হয়ে যাচ্ছে ধোঁয়ায়। তিনদিক পাহাড়ে ঘেরা থাকায় বাতাসে কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া ঘনীভূত হচ্ছে বেশি। ফলশ্রুতি, কালজানি ও তোর্সা নদীর জলে বাহিত রাসায়নিক থেকে কঠিন পেট ও চর্ম রোগে ভুগছে সীমান্তের এপারে কালচিনি এবং মাদারিহাট-বীরপাড়া ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষ। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কারখানাগুলি থেকে প্রতিদিন নির্গত ধোঁয়ার কারণে প্রবল শ্বাসজনিত সমস্যা, দুরারোগ্য কাশি, এমনকী ক্যান্সারের মত মারণ রোগ। কালচিনি ব্লকের মোট ২১টি চাবাগানে এই সব রোগ এখন আকছার হচ্ছে বলে জানালেন স্থানীয় চিকিৎসক ও ওষুধের দোকানগুলি। স্থানীয় মানুষের মতে, এই দূষণের ফলে ক্ষতি হচ্ছে নদীর মাছ ও ইকোসিস্টেমে এবং স্থানীয় কৃষিতেও। তারাই বললেন, ওপারে ভুটানেও ধানের ফলন নাকি ব্যাহত হচ্ছে। অনেকেরই আশংকা, এই দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে আলিপুরদুয়ার জেলার অন্যত্র, নদীবাহিত দূষণে বিপন্ন হতে চলেছে বক্সা টাইগার রিজার্ভ ও জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্কের দুর্লভ বন্যপ্রাণ।
মেঘ-পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা ছবির মতো ডুয়ার্সের গ্রামগুলি আজ রোগ-মৃত্যুর উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। একে ধুঁকতে থাকা চা শিল্প, বেরোজগারি ও নেশায় ডুবে থাকা জনপদগুলিতে ঘিরে আছে হতাশা, তার উপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আবির্ভূত এই দূষণ পিছিয়ে থাকা প্রত্যন্ত ডুয়ার্স ভূমিকে অন্ধকারের কোন অতলে ঠেলে দিচ্ছে তা ভেবে কূল পাই না। খবরে প্রকাশ, একটি স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়ে ২০১৯ সালে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং তা এখনও বিচারাধীন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, উত্তরের এতগুলি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে, তাঁরা কখনও এ নিয়ে একজোট হয়ে আওয়াজ তুলেছেন কি? আসলে সবাই তাকিয়ে আছে কেন্দ্র সরকারের দিকে, কেউ কেউ এ নিয়ে কেন্দ্রের মন্ত্রীদের কাছে চিঠিচাপাটিও হয়তো করেছেন, কিন্তু এতে আদতে সুরাহা হয়েছে কতোটা সন্দেহ আছে। ডুয়ার্সের মানুষেরা অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তিস্তার জলের মতোই কি এই আন্তর্জাতিক সমস্যারও আসু কোনও সমাধান নেই?
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team