পঞ্চায়েত নির্বাচনের রক্তভেজা বারুদের গন্ধ শুকোতে না শুকোতেই রাজনীতির কারবারিরা মন দিয়েছেন তাঁদের পরবর্তী প্রজেক্ট অর্থাৎ দেশের সাধারণ নির্বাচনের দিকে, সেটাই স্বাভাবিক। আর পঞ্চায়েত নির্বাচনের হিংসা নিয়ে নতুন কিছু বলবার নেই, তা এখন বাংলার কৃষ্টির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। ইতিহাস লিখবার সময় মৃত্যুকেই যদি হিংসার মাপকাঠি হিসেবে ধরে নেওয়া হয় তবে ২০০৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে মোট নিহতের সংখ্যা ছিল ৭৫, আর তার কুড়ি বছর পর ২০২৩ সালের নির্বাচনে বিশাল ব্যয়ে নিয়ে আসা কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োগ করবার পরেও মৃতের সংখ্যা ৫০ পেরিয়ে গিয়েছে।
প্রশাসনিক নির্বিকারত্ব না থাকলে এই হিংসা সম্ভব নয় একথা যেমন সবাই স্বীকার করেন, ঠিক তেমনি এটাও ঠিক যে, এই হিংসায় কোনও প্রার্থীর বা নির্বাচন কর্মীর, এমনকী স্থানীয় কোনও কুখ্যাত গুণ্ডারও মৃত্যু হয় না। মারা পড়ে অজ্ঞাত কুলশীল কিছু গাঁয়ের মানুষ, মৃত্যুর পরে যাদের নাম প্রথম জানা যায় এবং তাদের নানান দলের জার্সি পরিয়ে দেওয়া হয়। সত্যি কথা বলতে, পঞ্চায়েত নামক যে মধুভাণ্ড দখলের জন্য এই হানাহানি, নিহত হতভাগ্য মানুষগুলি বেঁচে থাকলে ভোটের পরে সেই চৌহদ্দির ধারেকাছেও কোনওদিন যাওয়ার সুযোগ পেত কিনা সন্দেহ আছে। তবু তারা বউ-বাচ্চা-বাপ-মায়ের কথা পরোয়া না করে অকারণে প্রাণ দিয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে, এটাই বোধহয় আমাদের শহীদ হওয়ার সেই পরম্পরা। নতুন শতকের তেইশটা বছর পেরিয়েও যে ছবিতে কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। ফারাকটা শুধু এই, কুড়ি বছর আগে সোশ্যাল মিডিয়ার জোর ছিল না, এখন হিংসার চলচ্চিত্র দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের কাছে। দ্বিগুণ হিংসা ও ঘৃণা হয়ে তা ফেরত আসছে, মনুষ্যত্ব বধের খেলায় মেতে উঠছে সমগ্র গ্রাম বাংলা।
অথচ গ্রাম বাংলা কিন্তু রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরেই। শিল্প নেই, তাই চাকুরি নেই, অতএব কৃষিই হওয়া উচিত ছিল গ্রামের মানুষের প্রধান ভরসা। এ রাজ্যে সত্তর লক্ষের বেশি কৃষি ভিত্তিক পরিবার, পরিবার পিছু জমির পরিমাণ অন্য রাজ্যের তুলনায় অনেক কম, অতএব জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো ছাড়া কোনও উপায় নেই। সরকারি কৃষি বিজ্ঞানীরা রয়েছেন সহায়তা করবার জন্য, সেচ দপ্তর রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে, কিন্তু তবু উৎপাদনশীলতা বাড়লো কই? গবেষকদের মতে, গ্রামের মানুষের কৃষিবিমুখতাই এর প্রধান কারণ। তথ্য বলছে, আমাদের রাজ্যে কৃষি থেকে পরিবার পিছু আয় পঞ্চাশ বছর আগে থেকেই ক্রমাগত কমতে শুরু করছিল। এই শতাব্দীর গোড়ায় তা ছিল মোট আয়ের এক তৃতীয়াংশ, যা গত কুড়ি বছরে কমতে কমতে মোট আয়ের এক-পঞ্চমাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ গ্রামের নতুন প্রজন্ম কৃষি উদ্যোগ থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে, খুঁজে বেড়াচ্ছে মজুরি ভিত্তিক আয়ের পথ। বিপুল পরিমাণ গ্রামীণ তরুণ শহরে বা অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে মজুরির খোঁজে। লক্ষ্য করে থাকবেন, এবার পঞ্চায়েত ভোটের আগে-পরে কদিন আপনার শহরে ফুটপাথে গজিয়ে ওঠা সারি সারি ঝুপড়ি খাবারের দোকানগুলি সব বন্ধ ছিল, রাস্তায় অটো-টোটো খুব কম ছিল, বাজারে মাটিতে বসা ছোট ছোট সব্জিওয়ালারা বা বাড়িতে কাজের ঠিকে লোকেরা সব অনুপস্থিত ছিল। কারণ তারা সবাই দেশে গিয়েছিল ভোট দিতে। এর থেকেই অনুমান করা যায় কী বিশাল পরিমাণ গ্রামীণ মানুষের জীবিকা এখন শহরের উপর নির্ভর করে!
আর যাদের নিরুপায় হয়ে গ্রামেই থেকে যেতে হয়েছে, নাম-কা-ওয়াস্তে পারিবারিক কৃষি আর নানান সরকারি ভাতার পয়সায় তাদের জীবন ধারণ চলছে কোনওরকমে। হাত বাড়ালেই মদ ও ডেইলি লটারির নেশার অন্ধকারে তারা কেউ কেউ হাতড়ে বেড়াচ্ছে ভবিষ্যৎ। সরকারি চাকুরি নেই, অতএব মিছিলে হাঁটলে এখন সেই গ্যারান্টিও নেই, বরং এখন তার জন্য প্রয়োজন হয় মোটা অংকের অর্থ। এই মানুষগুলিকে কৃষিতে ফের উৎসাহিত করাটা হয়তো কঠিন কাজ, অর্থলিপ্সু নেতাদের সে সময় কই? বরং তাদের প্রলোভন দেখিয়ে হিংসার পথে নামিয়ে দেওয়াটা অনেক সহজ। তাই আদালতে হত্যে দিয়ে বা ‘আর হিংসা নয়’ নিছক এই শহুরে স্লোগান কিংবা গান বেঁধে কিন্তু এই অসুখের সমাধান হবে না, এ রোগ বাসা বেঁধেছে অনেক গভীরে। সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণায় যদি দেখা যায় নির্বাচন উপলক্ষে এই প্রবল হিংসা তাদের পুঞ্জীভূত হতাশারই ভয়াবহ রূপ, তবে নিশ্চিতরূপে বলতে পারি সেই হতাশার আঁচেই জ্বলে মরতে হবে গাঁয়ের মোড়লদের, সেদিনটা সম্ভবত আর খুব বেশি বাকি নেই।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team