২০১৮ সালে মুক্তি পেয়েছিল অক্ষয় কুমার অভিনীত হিন্দি ছবি ‘প্যাডম্যান’। যে বাস্তব চরিত্রর উপর সিনেমাটি নির্মাণ করা হয়েছিল তাঁর নাম মুরুগানান্থম অরুনাচলম, দক্ষিণ ভারতের কোয়েম্বাটুরের বাসিন্দা, ২০১৬র পদ্মশ্রী। আজকের দিনেও পাড়াগাঁয়ে মেয়েদের ঋতুশ্রাব বা পিরিয়ড হলে তাদের একঘরে করে রাখা হয়। শহরের দোকানে আজও প্যাড কিনতে গেলে নিষিদ্ধ বস্তুর মতো কাগজে মুড়ে দেওয়া হয়। অথচ এটি একটি নিছকই শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। ১৯৯৮ সাল থেকে অরুনাচলমের লড়াই শুরু হয়েছিল সমাজের এই ট্যাবুর বিরূদ্ধে। এ খবর অনেকেরই জানা। কিন্তু যেটা সকলের জানা নেই তা হলো এই ছবি মুক্তি পাওয়ার বছর পাঁচেক আগে থেকেই কোয়েম্বাটুর থেকে ২৭৪২ কিলোমিটার দূরে উত্তরবঙ্গের কোচবিহারে আরেক প্যাডম্যান শুরু করেছিল একই রকম লড়াই। ডুয়ার্সের প্রত্যন্ত এলাকার মহিলাদের হাতে স্যানিটারি প্যাড তুলে দিতে শুরু করেন নীলাঞ্জন দত্ত, ভবঘুরে রাজা বলেই যার পরিচিতি।
ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে থেকে ২০২২-র একটা সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়েসি প্রায় ৫০% মেয়েরা আজও মাসিক বা পিরিয়ডের সময় পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করে থাকে। এর উপরে যাদের বয়স তাদের কথা তো কহতব্য নয়। এর আগে ২০১৯-এর একটা সার্ভেতে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পিরিয়ডের সময় একেবারেই হাইজিন মেনটেন করা হয় না। এর ফলে প্রচুর রোগ দেখা যায় মহিলাদের মধ্যে। পিরিয়ডের সময় অপরিষ্কার পুরনো কাপড় বা ন্যাকড়া ব্যবহার করলে জ্বর, তলপেটে ব্যথা, মুত্রনালীতে সংক্রমন ও জরায়ুতে ইনফেকশন হতে পারে। সেটা দীর্ঘস্থায়ী হলে পরবর্তীতে তা জরায়ুতে ক্যান্সারে পরিনত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর কারণ এই যুগে দাঁড়িয়েও তারা পিরিয়ড নিয়ে নানান কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। এ অবস্থায় সবচেয়ে জরুরি হল সামাজিক সচেতনতা। যা কিনা সরকারী উদ্যোগ ছাড়া কোনো মতেই বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়।
পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে একমাত্র কোচবিহার জেলায় ২০১৯ এর নভেম্বরের দিকে প্রশাসনিক স্তর থেকে পাইলট প্রজেক্ট হিসাবে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বেছে নেওয়া হয় দিনহাটাকে। শুরুতে ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ মিশন (NFHM) এর গাইড লাইন মেনে সেখানে মেয়েদের মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন সার্ভে করা হয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বেশীরভাগ ক্ষেত্রে হাইজিন একেবারেই মানা হয় না। সুতরাং তাদের শুধু সচেতন করলেই হবে না, সবাইকে প্যাড ব্যাবহারে অভ্যস্ত করতে হবে। সেক্ষেত্রে খুব কম পয়সায় মেয়েদের হাতে তুলে দিতে হবে স্যানিটারি প্যাড। বাজারে প্যাডের দাম বেশী এবং তা বায়োডিগ্রেডেবেল নয়। সে কারণেই হাইজিনকে প্রাধান্য দিয়ে যতটা সস্তায় প্যাড তৈরি করা যায় সেই চেষ্টা চলে। সেই অনুযায়ী প্রজেক্ট তৈরির কাজ শুরু হয়। তৈরি হয় কয়েক লক্ষ প্যাড। নাম রাখা হয় বান্ধবী। দিনহাটা বিভিন্ন স্কুলের কয়েকটি মেয়েকে বান্ধবীর ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর করা হয়। ১৪ অগাস্ট ২০২১ এ কন্যাশ্রী দিবস উপলক্ষে জেলার প্রতিটি ব্লকে স্কুলের যেসব মেয়েরা অংশ গ্রহন করেছিল তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় বান্ধবীর প্যাকেট। পরবর্তীতে এই প্যাড বাইরেও বিক্রি করা হয়েছিল। প্রজেক্টটি সফল হওয়ায়, ২০২২ সালে বড় আকারে করার জন্য চিন্তা ভাবনা শুরু হয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ব্যবহৃত ডিসপোজেবেল স্যানিটারি ন্যাপকিন সারা বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষ টন বর্জ্য তৈরি করে। অপচনশীল উপাদান দিয়ে তৈরি হওয়ার জন্য এই বর্জ্য পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর। জানা গিয়েছে, সেদিক থেকে দেখতে গেলে বান্ধবী স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি, বায়োডিগ্রেডেবেল অর্থাৎ পচনশীল, অর্থাৎ পরিবেশ বান্ধব। নির্দিষ্ট গুণগত মান ঠিক আছে কি না, তা দেখার জন্য তৈরি হওয়া কিছু প্যাডের স্যাম্পেল রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
শুরু করেছিলাম যার কথা দিয়ে, সেই নীলাঞ্জন দত্ত কিন্তু আজও লড়ে যাচ্ছেন একক ভাবে। তার এই প্রচেষ্টাকে সম্মান জানিয়ে প্যাডম্যান নামটি দিয়েছেন উত্তরবঙ্গের পদ্মশ্রী প্রাপক অ্যাম্বুলেন্স দাদা করিমূল হক। কোচবিহারের ছেলে নীলাঞ্জন দত্ত তার স্বর্গত মায়ের নামে করেছেন ‘অঞ্জলী স্যানিটারি ন্যাপকিন ফ্রি প্যাড ব্যাঙ্ক’। সামর্থ অনুযায়ী প্যাড কিনে নিজের গাড়ি ভর্তি প্যাড নিয়ে ছুটে গেছেন কোচবিহার ও আশেপাশে জেলার কোনায় কোনায়। চাবাগান, বস্তি, নিষিদ্ধপল্লী সবখানে গিয়ে সেখানকার মেয়েদের সচেতন করেছেন, প্রতি মাসের প্যাডের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। একক প্রয়াসে আজ পর্যন্ত ১৬ লক্ষ মহিলার হাতে প্যাড তুলে দিয়েছেন তিনি। যা সত্যিই অভাবনীয় ব্যাপার। পিরিয়ডের সময় মেয়েরা প্যাড পড়বে, এটাকেই তিনি তার লক্ষ্য বানিয়ে হাজার হাজার নারীর জীবন পরিবর্তন করেছেন। সুদূর উত্তরে এই কাজ শুরু করে আজ তিনি তা ছড়িয়ে দিয়েছেন দক্ষিণবঙ্গেও।
শৈশব থেকে কৈশোরে পা দেওয়ার সাথে সাথে মেয়েদের মনের যেমন পরিবর্তন হয়, তেমনি পরিবর্তন হয় শরীরের। এ সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার। কিন্তু আমাদের সমাজে পিরিয়ড নিয়ে সচেতনতা যেমন কম, তেমনি এ বিষয়ে আলোচনা করতে চায় না প্রায় কেউই। সেই সচেতনতা জাগানোর জন্য সরকারি উদ্যোগ যেমন প্রয়োজন তেমনই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে। গর্বের কথা হলো এই বাংলায় দুটি ক্ষেত্রেই উদ্যোগের শুরু হয়েছে এই প্রান্তিক জেলা কোচবিহার থেকেই।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team