পুরাকালের নারীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সুন্দরী, স্নিগ্ধ আর চিত্তাকর্ষক। সাধারণ মানুষ তো বটেই তাঁদের রূপে মুগ্ধ ছিলেন রাজরাজড়া থেকে শুরু করে মুনি ঋষিরাও। কত দেবতাও যে তাঁদের দেখে কামনালিপ্ত হয়েছিলেন তা ঠিক নেই। অনেকের তো কঠোর তপস্যাও মাঝপথে থেমে গিয়েছিল এদের সৌন্দর্যের কাছে হার মেনে। ঋষি বিশ্বামিত্রের কথা তো আমরা সবাই জানি।
আদি কবি থেকে শুরু করে আরও অনেক কবি লেখকেরা কত অপরূপ শ্লোক রচনা করেছেন এদের রূপের বর্ণনা দিয়ে। রম্ভা, মেনকা, ঊর্বশী, ঘৃতাচি, তিলোত্তমা স্বর্গের সবচাইতে সুন্দরীদের কয়েকজন। যদিও এদের প্রায় প্রত্যেকের জন্মের পেছনে রয়েছে কিছু কারণ। বিশেষ কিছু কার্যসিদ্ধি করার জন্যই এই চোখ ধাঁধানো সুন্দরীদের মর্ত্যে আগমন।
খুব সুন্দরী কাউকে বোঝাতে আমরা প্রায়শই অপ্সরা শব্দটা ব্যবহার করে থাকি। আসলে প্রকৃত অপ্সরা এঁরাই। তিলোত্তমা ছিলেন এমনই এক অপ্সরা যার রূপের বিশেষত্বই এই যে তাতে তিলমাত্র অসুন্দর কিছু নেই। সুন্দরী কলকাতা শহরকে কি আর সাধে তিলোত্তমা বলে? সুতরাং এই শব্দের অর্থ শুনলেই বোঝা যায় যে এ হল সর্বোচ্চ শ্রেষ্ঠ এক নারী।
মহাভারতে আমরা তিলোত্তমার কথা প্রথম জানতে পারি। মহাভারতের আদিপর্বে পঞ্চপান্ডবকে দেবর্ষি নারদ তিলোত্তমার জন্মের কাহিনী বলেন। পঞ্চপান্ডব দ্রৌপদীকে তাঁদের পত্নী হিসেবে স্বীকার করার পর যাতে তাঁকে নিয়ে পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে কোনো বিবাদ না হয় এ বিষয়ে সতর্ক করাই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য।
পুরাণে তিলোত্তমাকে নিয়ে অনেক কাহিনি প্রচলিত আছে। তবে এসবের মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয় সুন্দ-উপসুন্দের লড়াই। এমনি এমনি সুন্দরী তিলোত্তমার জন্ম হয়নি। এর পেছনে ছিল স্বয়ং ব্রহ্মার হাত। পুরাকালে হিরণ্যকশিপুর বংশে সুন্দ ও উপসুন্দ নামে দুই রাক্ষস ছিলেন। তাঁদের পিতা ছিলেন নিকুম্ভ। সুন্দ ও উপসুন্দ পরস্পরকে চোখে হারাতেন। যা কিছু পেতেন দুইভাই সমান ভাগে ভাগ করে নিতেন। তাঁদের মধ্যে ভালোবাসা ছিল তীব্র। রাজ্য থেকে শুরু করে বিছানা, খাবার-দাওয়ার এমনকি নারীদেহও তাঁরা পরস্পর ভাগ করে নিতেন সমান সমান। তাঁদের দুজনের মিলিত অত্যাচারের মাত্রাও ছিল সীমাহীন।
একবার এই দুই ভাই তিন ভুবন জয়ের লক্ষ্যে স্বয়ং ব্রহ্মার তপস্যায় রত হয়। কঠোর তপস্যার মাধ্যমে ব্রহ্মার আরাধনা করেন তারা। এতটাই কঠিন ছিল সে তপস্যা যে কথিত আছে তারা নিজেদের মাংসও কেটে আগুনে নিবেদন করে। সেই মুহূর্তে নাকি তাদের দেহ থেকে এমন তীব্র তীক্ষ্ণ তাপ বের হচ্ছিল যে দেবতারাও সেই তাপে যন্ত্রণা পান। দেবতাদের মনে ভয়ও ছিল ব্রহ্মা তপস্যায় তুষ্ট হলে যদি এমন কোনো বর দেন তবে হয়ত রাজ্যহারাও হতে হবে তাঁদের।
এই কারণে বহু অপ্সরাকে তাদের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু সুন্দ উপসুন্দকে টলানো সম্ভব হয়নি কিছুতেই।
এরপর নিরুপায় দেবতারা এমন বিভ্রম তৈরি করেন যাতে মনে হয় ওদের স্ত্রী, মাতা, কন্যাকে কোনো ভয়ঙ্কর রাক্ষস তাড়া করছে, এবং ভয়ে ওরা আর্তনাদ করছে, নিরাপত্তা চাইছে দুই ভাইয়ের কাছে। কিন্তু সেই আর্তনাদ শুনেও সুন্দ উপসুন্দের তপস্যা ভাঙে না।
অবশেষে ব্রহ্মা তপস্যায় সন্তুষ্ট হন, এবং দুই ভাইকে দেখা দিয়ে ইচ্ছেমতো বর চাওয়ার কথা বলেন। সুন্দ উপসুন্দ তিনটি বর চান। এক, সবরকম অস্ত্রের ব্যবহার যাতে তারা করতে পারে, দুই, সব রকম রূপ ধারণ করতে পারে এবং সর্বশেষ বর হল, তারা অমর হতে চায়।
প্রথম দুই বর দিতে ব্রহ্মা রাজি হলেও তিন নম্বরটা কিছুতেই মানতে চান না। তখন দুই ভাই জানায় যে এমন বর তবে তাদের দেওয়া হোক যাতে শুধু ওরা দুই ভাই যেন পরস্পরকে হত্যা করতে পারে, অন্য কেউ না। কারণ দুই ভাইয়ের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যা কিছু হয়ে যাক ওরা দুজন দুজনকে কিছুতেই হত্যা করবে না কোনোদিন।
ভগবান ব্রহ্মা রাজি হলেন এবং সুন্দ ও উপসুন্দ তাদের তপস্যা থেকে বিরত হল। বাড়ি ফিরে শুরু হল তাদের উদযাপন। তাদের আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কারণে রাক্ষসদের শহরের প্রতিটি বাড়ি থেকে সেসময় হাসির শব্দ শোনা যেত।
এরপর দুজনেই সিদ্ধান্ত নিল তিন ভুবন জয় করবেন। দুই অসুর ভগবান ব্রহ্মার কাছ থেকে আশীর্বাদ পেয়েছিলেন জেনে, দেবতারা ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং এইভাবে সুন্দ ও উপসুন্দ ইন্দ্রলোক তারপর, যখন তারা পৃথিবী জয় করার সিদ্ধান্ত নিল, তখন ব্রাহ্মণরা তাদের আশ্রম থেকে পালিয়েছিল, কারণ তাঁরা জানত যে তাঁদের অভিশাপগুলি ব্রহ্মার বরের জন্য অকার্যকর হবে।
হাতির রূপ নিয়ে সুন্দ ও উপসুন্দ গুহায় লুকিয়ে থাকা ঋষিদের খুঁজে বের করে হত্যা করেছিল। বাঘের রূপ নিয়ে তারা অন্যান্য ঋষি ও ক্ষত্রিয়দের হত্যা করেছিল যতক্ষণ না পৃথিবী শূন্য হয়ে যায়! পৃথিবী খাঁ খাঁ করত, সবাই গৃহহীন, খাদ্যহীন, পালিয়ে পালিয়ে বাঁচত। না হত কৃষিকাজ, না ছিল গৃহপালিত পশুদের কদর।
আর কোনো উপায় না দেখে তখন ঋষিরা ভগবান ব্রহ্মার কাছে গেলেন এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে বর্ণনা করলেন। তখন ভগবান ব্রহ্মা বিশ্বকর্মাকে বললেন একজন সুন্দরী নারী তৈরি করতে যিনি সমস্ত পুরুষের হৃদয়কে সম্পূর্ণরূপে মোহিত করতে সক্ষম।
তখন বিশ্বকর্মা মহাবিশ্বের সবচেয়ে সুন্দরী নারীর দেহ নির্মাণ করেন। যখন এটি সমাপ্ত হয়েছিল, তাতে ক্ষুদ্রতম অংশও ছিল না যা দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অক্ষম ছিল। ভগবান ব্রহ্মা সেই দেহকে প্রাণ দিয়েছিলেন এবং তার নাম দিলেন তিলোত্তমা।
সেই সময় সুন্দ ও উপসুন্দ কুরুক্ষেত্রে ছিল। ব্রহ্মা তিলোত্তমাকে তাদের কাছে যাওয়ার আদেশ দিলেন এবং তাঁর অপরূপ সৌন্দর্যে তাদের মোহিত করতে বললেন। এমনভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে বললেন যাতে দুটি রাক্ষস একে অপরের সাথে ঝগড়া করে।
তিলোত্তমা ব্রহ্মা, অন্যান্য দেবতা ও ঋষিদের প্রদক্ষিণ করেন এবং প্রস্থান করেন। শুধুমাত্র ভগবান ইন্দ্র এবং ভগবান শিব ভান করেছিলেন যে তারা মনের মধ্যে অশান্ত ছিল, এবং এইভাবে তারা তাদের মাথা ফেরায়নি। যদিও ভগবান শিব তাকে দেখতে খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন, তার কাঁধ থেকে আরও চারটি মুখ উদ্ভাসিত হয়েছিল যখন তিনি তার ডান থেকে তার পিছনে, তার বাম দিকে এবং তারপরে আবার তার সামনে চলেছিলেন। ইন্দ্রও তাকে দেখার জন্য খুব আগ্রহী ছিলেন এবং এর ফলে তার সারা শরীরে এক হাজার চোখ দেখা দেয়। শুধুমাত্র ভগবান ব্রহ্মাই তার দেহের দিকে তাকালেন না। আবার কেউ কেউ বলেন ব্রহ্মা তাকে দেখার জন্যই নাকি পাঁচদিকে পাঁচটি মুখ তৈরি করেন। তবে এই কাহিনিগুলো বিতর্কিত।
যাইহোক, এরপর সুন্দ ও উপসুন্দকে মারবার মতো কেউ না থাকায় তারা দেবতার মতো জীবন উপভোগ করতে শুরু করে।
একদিন তিলোত্তমা স্বর্গীয় উদ্যানে সেখানে সুন্দ ও উপসুন্দ ছিলেন সেখানে আসেন। লাল রেশমের একটি মাত্র টুকরো পরেছিলেন তিলোত্তমা যা তার নারীত্বকে আরও উদ্ভাসিত করছিল। তিলোত্তমা বাগানে প্রবেশ করলেন যেন কিছু ফুল তুলতে চান। দুই ভাইই মদ পানে মত্ত ছিল এবং তিলোত্তমা তাদের কাছে এলে দুই ভাই তার হাত ধরে ফেলে। তিলোত্তমার সৌন্দর্যে দুজনেই এমন মোহিত হয়ে পড়েন যে মনে হচ্ছিল আগে কোনোদিন এমন নারী তারা দেখেইনি।
তারা দুজনেই এই মেয়েটিকে নিয়ে "আমি তাকে প্রথম দেখেছি" এবং "এই মেয়েটি আমার" বলে চিৎকার করে মারামারি শুরু করে তারা ভারী মুগুরগুলি তুলে নিয়ে একে অপরকে হিংস্রভাবে আঘাত করতে শুরু করে এবং দুই ভাই রক্তে স্নান করে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মারা যায়।
সুন্দা ও উপসুন্দের মৃত্যুর পর ভগবান ব্রহ্মা তিলোত্তমার প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়ে তাঁকে স্বর্গে স্থায়ী বাসস্থান দান করেন এবং তাঁকে আশীর্বাদ করেন যে, সৌন্দর্যের কারণে, কেউ দীর্ঘ সময়ের জন্য তিলোত্তমার দিকে তাকাতে পারবে না।
ইন্দ্রও এরপর তিন জগতের সার্বভৌমত্ব ফিরে পান, পৃথিবীও ফিরে পায় তার আগের সৌন্দর্য।
এই ছিল তিলোত্তমার কাহিনি। এইটি পুরাণে সবচাইতে জনপ্রিয় হলেও কিছু জায়গায় তিলোত্তমাকে প্রাক-জন্মে কুশ্রী বিধবা হিসেবে অথবা অসুর রাজকন্যা উষা হিসাবেও বর্ণনা করা হয়েছে যিনি ঋষি দুর্বাসা দ্বারা পুনর্জন্মলাভ করতে অভিশপ্ত হয়েছিলেন।
পুরাণের নারীদের নিয়ে আলোচনায় সুন্দরী নারীদের মধ্যে তাই তিলোত্তমার নাম বিবেচিত হবেই।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team