পায়ের তলায় সরষে বাঙালির জন্ম লগ্ন থেকেই। পাহাড় অরণ্যের প্রতি প্রেম নতুন কিছু নয়, অত্যন্ত বেরসিক না হলে পাহাড়ের শান্ত পাইন বনের সরু আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে হেঁটে যেতে ইচ্ছা করে সবারই। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমাটিতে বহু এমন স্মরণীয় মুহূর্ত রয়েছে যেখানে দেখেছি শান্ত দার্জিলিং-এর বেশ কিছু পাহাড়ি পথ পটভূমিকায়। কিন্তু খুব আফসোসের যে দার্জিলিং শহরের সেই শান্ত লাবণ্যময় রূপটি যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। তার বদলে এখন এসেছে ভিড়ে ঠাসা জমজমাট নতুন নতুন শপিংমল, ঝা চকচকে দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি। কিছু করার নেই, এটাই বোধহয় নিয়ম। তাই ভ্রমণপিপাসু মনগুলো এখন খুঁজে নিচ্ছে পাহাড়ের ছোট ছোট সুন্দর গ্রামগুলিকে, যেখানে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়, সেই শান্ত পাইন বনের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। সেখানে বুক ভরে অক্সিজেন নেওয়া যায়। নিজেকে আলাদা করে খুঁজে নেওয়া যায়, ওই মুহূর্তগুলো তখন শুধু আমার একান্ত নিজস্ব। হয়তো এ কারণেই বারবার ছুটে যাই পাহাড় জঙ্গলের কাছে। আর মানুষের এই চাহিদার জন্যই গড়ে উঠেছে বেশ কিছু হোমস্টে, রিসর্ট।
আমার বাড়ি উত্তরবঙ্গের একটি জেলা শহর জলপাইগুড়িতে। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, আমি উত্তরবঙ্গবাসী। পাহাড় জঙ্গল নদী কী নেই আমার প্রিয় উত্তরবঙ্গে। মাত্র ২ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় কোনও অজানা ঠিকানায়। এমনই একটি অজানা ঠিকানা হলো চিসাং ভিলেজ, পাহাড়ি অরণ্য প্যারেনের কোলে একটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র পাহাড়ি জনপদ, শাল,পাইন, দেবদারু, ওক্ ও আরো কত নাম না জানা গাছের সমাহার যে রয়েছে তা না আসলে শুধু বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমি এখানে গিয়েছিলাম বেশ কিছুদিন আগে কিন্তু তার স্মৃতি এখনো অমলিন। প্রতিদিনের একঘেয়েমি ব্যস্ততা, শহরের কোলাহলকে দূরে ফেলে দিয়ে অপার শান্তি অনুভবের আদর্শ জায়গা। যেখানে নিজেকে হারিয়ে ফেলা যায় পাখির ডাক ঝরনার জলের শব্দ আর পাহাড়ি জঙ্গলের বুনো গন্ধের মাঝখানে। উঠেছিলাম স্থানীয় এক স্কুলের শিক্ষক, এন্ড্রোনিকাস রাই-এর হোমস্টেতে। ইনি অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী এবং অতিথিবৎসল একজন মানুষ। এই পাহাড়ের প্রায় একশ একর জায়গার মালিক ইনি। প্রায় জমিদারই বলা যায়। তারই মাঝে এই হোমস্টেটি তিনি গড়ে তুলেছেন অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। বর্তমানে চারটি রুম রয়েছে এই হোমস্টেতে। আরো বেশ কিছু রুমের কাজ চলছে, অদূর ভবিষ্যতেই এই রুমগুলো ব্যবহৃত হবে। এই হোমস্টের মালিক একজন নেপালি ক্রিশ্চান। বেশ সৌখিন এই ভদ্রলোক হোমস্টেটিকে নিজের মনের মত করে সাজিয়ে তুলেছেন।
উপরি পাওনা হলো এখান থেকে অসাধারণ ভিউ। ভুটান ও সিকিমের পাহাড়গুলি খুব সুন্দর ভাবে দৃশ্যমান। এখান থেকে ভুটান, ভারত, চায়নার বর্ডারে অবস্থিত ডোকলাম আর্মি বেস ক্যাম্পটি আকাশ পরিস্কার থাকলে বেশ ভালোভাবেই দেখা যায়। এখানে বাইক অথবা গাড়ি, দুভাবেই আসা যায়। আমি গিয়েছিলাম বাইকে, রাস্তা বেশ ভালো। জলপাইগুড়ি থেকে আসতে হলে লাটাগুড়ি মূর্তি ব্রিজ ক্রস করে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চন্দ্রচূড় ওয়াচ টাওয়ার পার করে একটি রাস্তা দুটি ভাগ হয়ে যায়, একটি সোজা চলে যায় আর অপরটি বাঁদিকে বেঁকে যায় খুনিয়া মোড়ের দিকে, সেই রাস্তাটি ধরতে হবে। এরপর চাপরামারি ফরেস্ট হয়ে সোজা ঝালং বিন্দুর রাস্তায় যেতে হবে। ঝালং হয়ে প্যারেন গ্রামটিকে বাঁদিকে রেখে সোজা তোদে রোড ধরে চলে যেতে হবে তোদে।
তোদে, পৌঁছানোর দু তিন কিলোমিটার আগেই একটি রাস্তা বাঁদিকে উঠে যাচ্ছে সোজা চিসাং এর ওয়াইল্ড উড হোমস্টে-তে। আমরা এখানে দু-রাত্রির জন্য ছিলাম। দিনের বেলায় পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ঘুরে বেড়াতাম ক্যামেরা হাতে, প্রচুর পাখি রয়েছে এখানে। সেসব পাখি ক্যামেরাবন্দি করতে করতেই সময় ফুরিয়ে যেত সন্ধ্যে নামত। আশপাশেই বেশ কিছু ভিউ পয়েন্ট রয়েছে। প্রত্যেকটি ভিউ পয়েন্ট থেকেই অসাধারণ দৃশ্য দেখা যায়। এছাড়াও যারা অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন তাদের জন্য দু-একটি ট্রেকিং রুটও রয়েছে। সেসব অভিজ্ঞতা বেশ রোমহর্ষক। এন্ড্রনিকাস রাই সন্ধেবেলায় ক্যাম্পফায়ার করতেন আর তার সাথে সুস্বাদু বারবিকিউ আমাদের উপহার দিতেন। কীভাবে যে দুটো দিন ফুরিয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছিল আবার নিজের নিজের কাজে যোগ দিতে হবে। ফিরতে হবে ঘরে। তবে স্মৃতির মনিকোঠায় রয়ে গেল এই চিসং, ফিরে আসবো এই অঙ্গীকার নিয়েই বিদায় জানালাম রাই ফ্যামিলিকে।
যোগাযোগ- ওয়াইল্ড উড হোমস্টে, চিসাং, তোদে তাংতা রোড, এন্ড্রোনিকাস রাই 8900370801
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team