বইমেলা বলতে আমরা বেশির ভাগ মানুষই অবশ্য কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলাকে ধরে নিই। কিন্তু তার বাইরেও যে বৃহত্তর পশ্চিমবঙ্গ, সেখানে শীতকাল এলেই আজও শুরু হয়ে যায় বইমেলার মরসুম। জেলায় মহকুমায় মহল্লায় নানান আকারের সরকারি ও অসরকারি বইমেলা আমাদের বাংলার একান্ত নিজস্ব অনন্য সংস্কৃতি হয়ে বেঁচে আছে আজও। সংগঠিত উদ্যোগে এই বইমেলার বয়স আমাদের দেশে পঞ্চাশ, আমাদের বাংলায় প্রায় পঞ্চাশ। জনশিক্ষা প্রকল্পের আওতায় সরকারি উদ্যোগে জেলাভিত্তিক বইমেলা শুরু হয়েছিল মূলত বাঙালির বই প্রকাশনা ব্যবসাকে উৎসাহিত ও প্রসারিত করবার উদ্দেশ্যেই। মেলার মরসুমে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত লাইব্রেরীগুলিকে বই কিনবার নির্দেশ ও অর্থ দেওয়ার প্রথা বহু ক্ষুদ্র সদর্থক প্রকাশনার অস্তিত্ব রক্ষার পাশাপাশি কয়েক দশক ধরে ছাপোষা বাঙালির বই কেনার অভ্যাসকে বাঁচিয়ে রেখেছিল সন্দেহ নেই।
কিন্তু আমরা যারা বাল্যকাল থেকে বইমেলার আলো ও আবেগ নিয়ে বড় হয়েছি তারা বড় হবার পরে আর বাড়ির ছোটদের হাত ধরে বইমেলামুখী করার ফুরসত পাইনি। বরঞ্চ পিঠে তাদের সিলেবাসের বস্তা চাপিয়ে দিয়ে তাদের নিয়ে পড়িমরি করে ছুটেছি কোচিং ক্লাসে, ফাঁক পেলে সুইমিং-ড্রয়িং-বাচিক-মিউজিক-থিয়েটার-ক্যারাটে টিউশনে, উঁচু ক্লাসে উঠলে সেসবও বাদ। নিজেরা বাল্যকালে রাত জেগে লুকিয়ে সাহিত্যের নেশা করলেও তাদের সে সুযোগ দিয়েছি কতটা? কদিন তাদের পাশে বসিয়ে নিজেদের কৈশোরে পড়া কোনও জব্বর কাহিনি শুনিয়েছি? কিন্তু এর পরে ওদের বইপড়ার অভ্যেস কমে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলে কিংবা বইমেলায় তরুণ প্রজন্মের উপস্থিতি কম দেখলে সব দোষ প্রথমে টিভি তারপর স্মার্টফোনের ওপর চাপিয়ে দিয়ে পাপমুক্ত হয়েছি।
ফলত যা হওয়ার তাই হয়েছে। আমাদের আগের বইপড়ুয়া প্রজন্ম মোটামুটি অফ কিংবা ঘরে সেঁধিয়ে গিয়েছে (ব্যতিক্রমীরা ছিলেন-আছেন)। আর আমাদের পরের প্রজন্ম বই দেখতে বা কিনতে বা নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকতে বইমেলায় যাওয়ার টান অনুভব করে না। তাই বলে সিলেবাসের বাইরে বই পড়তে তারা আর একেবারেই ভালোবাসে না একথা ঠিক নয়, বই চাইলে তারা অনলাইনে অর্ডার করেই পেয়ে যায়। অতএব বাকি পড়ে রইলাম আমাদের প্রজন্মের গুটিকয় মানুষ, শীতের সন্ধ্যায় যারা কানে মাফলার বেঁধে মেলার মাঠে যাই, ডিএ-নেই ছেলেটা-বেকার ঘরে-অশান্তি ইত্যাদি নানান বিষণ্ণতা বুকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করি, পুরনো অভ্যেসে টুকটাক কেনাকাটি করি, কেউ কেউ লেখালেখি করবার সুবাদে মঞ্চে উঠে পদ্য পড়বার বা কিছু বলবার সুযোগ পায়। সন্ধে হলেই সেই সুবিশাল মঞ্চে গাঁক গাঁক করে সংস্কৃতি বাজে, কান পাতা দায়। বইমেলায় আজ তাই ঝলমলে মেলা থাকলেও বই স্রেফ ছুতো হয়ে টিঁকে থাকে।
বই বেচে জীবনধারণ করা ক্ষুদ্র প্রকাশকদের এতদিন চলছিল এই বইমেলা মরসুমের উপর নির্ভর করেই। কিন্তু জেলা বইমেলাগুলিতে এখন খুচরো বিক্রির চাইতেও বড় ভরসা সরকারি অনুগ্রহ অর্থাৎ লাইব্রেরী পারচেজ। কারণ ‘বইপ্রেম’-কে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার মহান উদ্দেশ্যে স্থানীয় নেতাদের সদ্দিচ্ছায় মেলা এখন জেলা সদর ছেড়ে মহকুমায় বা ব্লকে বেড়াতে যায়, খুচরো বিক্রি তখন একধাক্কায় এক চতুর্থাংশ বা এক পঞ্চমাংশ হয়ে যায়। প্রকাশকদের পেটের চিন্তার চাইতেও ‘পুস্তক প্রেমের প্রসার’ যেখানে বৃহত্তর স্বার্থ সেখানে প্রকাশকের কোনোক্রমে স্টল-বইবহন-থাকাখাওয়ার খরচটুকু উদ্ধার করে পালিয়ে আসা ছাড়া তো আর কোনও উপায় থাকে না। মেলায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও এখন বেঁধে দেওয়া হয়েছে, কলকাতার প্রকাশকদের চাইলেই যে কোনও জেলা মেলায় স্টল মেলে না, অনুমোদিত প্রকাশক সংস্থার মেম্বার হয়ে বরাতে জুটলে তবেই। যাদের জোটে না তাদের আশ্রয়স্থল হয়ে দ্বীপের মত জেগে আছে কয়েকটি বেসরকারি বইমেলা, মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের ইচ্ছেশক্তিতে ভর করে। কিন্তু সেগুলিও বইয়ের ব্যবসায় বিকল্প হয়ে উঠতে পেরেছে কি?
আসলে গত পঞ্চাশ বছরে পাঠক এবং আরও অনেক কিছু বদলে গেলেও বইমেলার ধরণ ধারণ সেই একই রকম রয়ে গেছে। স্থানীয় ঘুমন্ত লাইব্রেরীগুলিকে জাগিয়ে তুলতে গেলে যেমন বেসরকারি উদ্ভাবনী উদ্যোগ প্রয়োজন, তেমনি পাঠ্যক্রমের বাইরের বই ব্যবসাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে বইমেলার আঙ্গিকেও পরিবর্তন ঘটাবার প্রয়োজন আছে বলেই মনে হয়। স্কুল পড়ুয়াদের এনে রুট মার্চ করালে কিংবা অংকন-আবৃত্তি-নৃত্য-গীতি করালেই তাদের বই প্রেম বাড়েনা, মেলায় তাদের বই সংক্রান্ত ইনভলভমেন্ট বাড়াবার কথাও ভাবতে হবে। তারাই বাঁচিয়ে রাখতে পারে ভবিষ্যতের বইমেলাকে। কলকাতা বইমেলার মডেলে অন্যান্য শহরগুলিতে (যেখানে বইয়ের কদর এখনও হয়) সরকারি-প্রাইভেট হাত ধরাধরি করে মেলা করলে বই বাণিজ্যে কিছুটা হলেও টাটকা বাতাস ঢুকতে পারে। নইলে আগামীতে বইমেলায় বই থাকবে, লোকজনও হয়ত থাকবে, কিন্তু বইয়ের বাণিজ্য বলে কিছু থাকবে না।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team