× home হোম archive আগের ওয়েব সংখ্যা panorama ডুয়ার্স সম্পর্কে play_circle_filled ভিডিও file_download মুদ্রিত সংখ্যার পিডিএফ library_books আমাদের বইপত্র
people এখন ডুয়ার্স সম্পর্কে article শর্তাবলী security গোপনীয়তা নীতি local_shipping কুরিয়ার পদ্ধতি keyboard_return বাতিল/ফেরত পদ্ধতি dialpad যোগাযোগ
login লগইন
menu
ad01112021105753.jpg
×
সংখ্যা: পৌষ, ১৪৩০
সম্পাদকের কলম
শীতের গল্পগাছা
সম্পাদক - এখন ডুয়ার্স
বিশেষ নিবন্ধ
বইমেলা মানে বই যেখানে ছুতো নিমিত্তমাত্র
প্রদোষ রঞ্জন সাহা
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি ও সংস্কৃতির লোকজন | পর্ব - ১৬
সব্যসাচী দত্ত
খোলা মনে খোলা খামে
টিনের চালে লাল টুকটুকে লেপ - আমার শীতের ছোটবেলা
রম্যাণী গোস্বামী
জলশহরের কথা
এক যে ছিল টউন | পর্ব - ৯
শুভ্র চট্টোপাধ্যায়
শিলিগুড়ি স্টোরিলাইন
টাউন স্টেশন থেকে শুরু করে এশিয়ান হাইওয়ে: শিলিগুড়ির শতাব্দীব্যাপী বিবর্তন কথা
নবনীতা সান্যাল
পর্যটন
রিনচেনপং
অনিন্দ্য পাল
শ্রীমতী ডুয়ার্স
নারী মাত্রই মেয়ে কিন্তু মেয়ে মাত্রই নারী নয়!
ড. শুচিস্মিতা দেবনাথ
পাতাবাহার
আতার পায়েস চলতে পারে একটু?
পাতা মিত্র
পুরানের নারী
সতী
শাঁওলি দে

প্রচ্ছদ ছবি

এই সংখ্যার প্রচ্ছদ শিল্পী গৌতমেন্দু রায়

উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি ও সংস্কৃতির লোকজন | পর্ব - ১৬

সব্যসাচী দত্ত
Uttorbanger Loksanskriti 16

গমীরা

নিম তিতা নিশিন্দা তিতা
তিতা আরও কয়
তার চেয়েও অধিক তিতা রে…
তার চেয়েও অধিক তিতা
দুই সতীনের ঘর

ঢাকের বাদ্যি তালে তালে বাজছে, তারই সঙ্গে নেচে নেচে গাইছেন কয়েকজন পুরুষ। বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করছে্ন, মজা করছেন, অভিব্যক্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে সে গানের গুঢ় অর্থ। পরনে ধূলি-ধূসরিত ধূতি ও স্যান্ডো গেঞ্জি। সারা গাঁ ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন নাচ-গানে গৃহস্থকে খুশি ক’রে মাগন সংগ্রহ করছেন। এঁরা ভক্ত। শিবের ভক্ত। গাঁয়ে তাঁদের পরিচয় ‘খেলটু’ বা ‘পেলেয়ার’। তাঁরাই ‘সন্ন্যাসী’।

চৈত্র মাসের শেষ সাতদিন/পাঁচদিন/তিনদিন ‘গমিরা খেলা’ হয় বিভিন্ন গ্রামে। মূলত জলপাইগুড়ি জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত। শিবকে কেন্দ্রে রেখে একটি আনুষ্ঠানিক আচার। সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানের তত্বাবধানে থাকেন একজন ‘মারেঞা’। মারেঞা শব্দটির অর্থ অনুষ্ঠান-প্রধান। অর্থাৎ যিনি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। আর থাকেন ‘দেবাংশী’। গাঁয়ের কোনও একজন অধিকারী, যিনি পূজা-অর্চনা করেন, হয়তো বা তিনি নিজেও কোনও সময় গমিরা খেলা-য় অংশগ্রহণ করতেন, এখন বয়স হয়েছে তাই তিনি দেবাংশী বা পুরোহিত। অথবা যে কেউ দেবাংশী হ’তে পারেন—যিনি পূজা সম্বন্ধীয় জ্ঞান আহরণ করেছেন। জলপাইগুড়ির গ্রামগুলিতে তাঁদের ‘দেউসী’ বলা হয়। পুরোহিত বলতে আমরা যাঁদের বুঝি তিনি তেমন নন। তিনি যে পুজো অনুষ্ঠান করেন তাতে থাকে না দেবভাষার মন্ত্রোচ্চারণ। পূর্বজদের থেকে শুনে আসা কিছু আর নিজের নির্মাণে গড়ে ওঠা বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার পূজার সময় তাঁরা করেন। সেকারণে একই পূজার মন্ত্র দেউসী বা দেবাংশী ভেদে বদলে যায়। এই অনুষ্ঠানের মারেঞা আয়োজন করবেন সব। দেউসী পুজো-অনুষ্ঠান করবেন। গাঁয়ের কিছু তরুণ ও যুবক মূল গমীরা খেলায় অংশগ্রহণ করেন। ঢাকের বাদ্যির সঙ্গে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন প্রচলিত কবিতা আবৃত্তি করেন, গান করেন, তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করেন ও বিভিন্ন শারীরিক কসরৎ দেখান।

 

গমিরা খেলার প্রথম দিন ‘শিব গাড়া’

নাই জল নাই স্থল নাইও তো আকাশ
এমন মন্ডপে নাই শ্রীগোপিলাস
শূণ্যের পৃথিবীখান শূণ্যে চরাচর
শূণ্যেতে সিজিল জীব অনাদী ঈশ্বর
অনাদী ঈশ্বর গুরু পরম গিয়ান
জলেরো উপরে দেব ধরিল ধিয়ান
জলের উপর দেব ভাসিয়া বেড়ায়
সৃষ্টি করিবারে দেব উপায়ও না পায়…। (ইত্যাদি)

এইভাবে সমস্ত দেবতাকে আহ্বান ক’রে প্রথম দিনের শিব স্থাপন ও পূজা হয়। মূলত মহেদেবের পূজা করা হয়, তবে দেবতা অপদেবতা সকলকেই আহ্বান জানানো হয়। গাঁয়ের কোনও একটি স্থানে একটি অস্থায়ী শিবের থান তৈরি করা হয়। গ্রামের কোনও একটি স্থান পরিচ্ছন্ন ক’রে সেখানে একটি মাটির বেদি তৈরি ক’রে বা না ক’রে, তাতে চারটি খুটি দিয়ে ওপরে খড়ের ছাউনি দিয়ে এই থানটি তৈরি করা হয়। সেখানে মারেঞার আয়োজনে দেউসী পুজো করেন। কেউ কেউ বংশ পরম্পরায় মারেঞা। আবার কারুর মানসিক থাকলে সেও মারেঞা হয়ে পুজোর আয়োজন করেন। অর্থাৎ সমস্ত খরচ মারেঞাই বহন করে থাকেন। ভক্ত বা খেলটুরা যতদিন ঘুরবে অর্থাৎ তিন, পাঁচ, সাতদিন—এই দিনগুলিতে শিব ফুল জল পাবেন মারেঞার হাতেই। প্রথম দিন দেউসী বিধিপূর্বক পূজা করবেন। পূজার পরে দেবতা ও দেউসীর আশীর্বাদ ও প্রসাদ গ্রহণ ক’রে ভক্তরা বেরিয়ে পড়েন। মারেঞার কিনে দেওয়া নতুন ধূতি ও স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে। সারাদিন গাঁয়ের বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাগন সংগ্রহ করেন। যেখানে সন্ধ্যা হয় সেখানেই রাতটা থেকে যান। সেখানেই আহারের ব্যবস্থা করেন সেই গৃহস্থ। খুব সাধারণ আহার তাঁদের। নিরামিষ ডাল,ভাত,সবজি। যেকোনও গৃহস্থের বাইরের আঙিনায় বা বারান্দায় তাঁরা থাকেন একসঙ্গে। শুয়ে ঘুমোনোর জন্য কোনও বিছানা ব্যবহার করেন না। নিজেদের শিবের ‘চ্যালা’ মনে করেন। তাই এই ক’দিন ভূত-প্রেতের মতই থাকেন ভক্তরা বা খেলটুরা। চুল দাঁড়ি কাটেন না। স্নান করেন না। জামাকাপড় বদলান না। দাঁত মাজেন না। এমনকি খাওয়ার আগে হস্ত প্রক্ষালনও করেন না।

গমিরা খেলাকে কেন্দ্র ক’রে প্রচলিত অনেকগুলি কাহিনির অন্যতম এই গল্পকথাটি শুনিয়েছেন ময়নাগুড়ি ব্লকের আমগুড়ি পঞ্চায়েতের চাপগড় গাঁয়ের নেবুকান্ত রায়। তিনি নিজে ‘দেউসী’ বা ‘দেবাংশী’ অর্থাৎ পূজারী। প্রাচীনকাল থেকেই কয়েক পুরুষ তাঁরা দেউসী। মারেঞাও তিনি। সাতাত্তর বছর বয়সী নেবুকান্ত বলেন, গমিরা খেলা কবে থেকে প্রচলিত—একথা অনুমান করা অসম্ভব। কেন এই পূজার প্রচলন সেকথা বলাও মুশকিল। তবে যে কাহিনি প্রচলিত তা এইরূপ—শিবের প্রিয় একটি পাঁঠা (নাকি ষাঁড়) হারিয়ে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায় সেটি চুরি গেছে। প্রিয় এই পোষ্যকে হারিয়ে শিব ভয়ঙ্কর ক্ষেপে গেলেন। খুঁজতে বেরুলো তাঁর অনুচর বৃন্দ। কোথাও পাওয়া তো গেলই না, জানা গেল প্রাণিটিকে কেউ কেটে খেয়ে ফেলেছে। এই খবর শিবের কাছে পৌঁছুতেই শিব সিদ্ধান্ত নিলেন চোরকে খুঁজে বের করতেই হবে। কীভাবে! রান্না ক’রে খাওয়ার জন্য পশুকে কাটবার যন্ত্র, আগুন, ও জল প্রয়োজন। তাই প্রথমেই গেলেন অগ্নির দেবতা ব্রক্ষ্মার কাছে। ব্রক্ষ্মা সমস্ত ঘটনা শুনে বললেন এমন কারুর রান্না ক’রে খাবার খবর আমার কাছে নেই। এরপর শিব গেলেন জলের দেবতা বিষ্ণুর কাছে। তিনি শুনে বললেন, আমিও জানি না এমন ঘটনা। যন্ত্রের দেবতা বিশ্বকর্মাও শিবকে জানালেন তাঁর কাছেও কোনও খবর নেই। তবে!

শিব মনে করলেন এসবই ষড়যন্ত্র। তাঁর মেজাজ চড়তে লাগলো। উষ্ণ শোনিত ছুটতে শুরু করল সমস্ত শরীরে। তাঁর লিঙ্গ দীর্ঘায়িত হয়ে মেদিনী ভেদ করে সমস্ত চরাচর ধ্বংসের জন্য উদ্যত হল। সকলে ভয় পেয়ে গেলেন। ছুটলেন পার্বতীর কাছে। মহেশ্বর জায়া পার্বতী বুঝলেন ঘোর অমঙ্গল আসন্ন। এখুনি নিরস্ত করতে হবে ভোলা বিশ্বনাথ কে। তিনি তাঁকে শান্ত করবার জন্য নিজের যোনি স্থাপন করলেন শিবের উদ্ধত লিঙ্গের ওপর। এতে শিব শান্ত হলেন। বললেন, আমার পাঁঠার কী হবে! পার্বতী সমাধান দিলেন। বললেন, আপনার লিঙ্গের ওপর স্থাপিত আমার যোনির একপাশে লৌহকাঁটা সংযুক্ত ক’রে ওপর পার্শ্বে একগুচ্ছ তৃণসূত্রের সাহায্যে তাকে ঘোরাতে বলুন আপনার অনুচর বৃন্দকে। এই লৌহকাঁটায় গেঁথে আসবে সে চোর।

মর্তধামে সে প্রবল ঘুর্ণনের কারণে লৌহকাঁটায় গেঁথে এল সেই চোর। জেরা ক’রে তাকে জানা গেল—হ্যাঁ পশুটিকে চুরি ক’রে খেয়েছে সেই-ই। সে তাকে কেটেছে একটি দা দিয়ে—যা নিয়ে যাওয়া হয় শ্মশানে। কারণ তাতে বিশ্বকর্মা থাকেন না। রান্না করেছে সিঞ্চার জলে (ঘরের চালা থেকে যে বৃষ্টির জল ধারায় নেমে আসে), তাতে বিষ্ণু থাকেন না। তুষের আগুন ব্যবহার করেছে কারণ তাতে ব্রক্ষ্মা থাকেন না। এই ঘটনা জেনে সকলেই বিষ্মিত,পুলকিত। কী বুদ্ধি চোরের! যে দিন এঘটনা ঘটেছিল সেদিন ছিল চৈত্র সংক্রান্তি। এই ঘটনার স্মরণেই শুরু হয় চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহে ‘গমিরা খেলা’, সে কোন প্রাচীন যুগে। আমার প্রশ্ন ছিল, এই চোর আদতে কে? তার কোনও উত্তর এখনও কারুর কাছে পাইনি।

 

পূজা পদ্ধতি

শিমুল অথবা শাল গাছের খুঁটির একটি পাশ মাটিতে প্রোথিত করা হয়। আকাশের দিকে অপর পার্শ্বে আটটি বাঁশ দিয়ে নির্মান করা হয় ঘুর্ণোনক্ষম একটি যন্ত্র। তাকে ‘চড়কি’ বলা হয়। বাঁশের তৈরি যে চড়কি তার স্থানীয় নাম ‘কেরকি’। এই যন্ত্রটি দেখতে হয় যোনির ন্যায়। শিমুল বা শালের যে বৃক্ষ ব্যবহার করা হয় তা শিবলিঙ্গের প্রতিক। আর ওপরের যন্ত্রটি পার্বতীর যোনির রূপ। একে বলা হয় চরকি। 

চৈত্র মাসের (এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ) শেষ পাঁচদিন (বা তিনদিন/সাতদিন) ভক্তরা গাঁয়ের গৃহস্থদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান ও নাচ করেন। সাথে থাকে ঢাক ও কাঁসর বাদ্যযন্ত্র রূপে। গৃহস্তকে খুশী ক’রে মাগন সংগ্রহ করেন। শুধু যে নাচ-গান করেন তা নয়। বিভিন্ন ব্যায়াম ও দলগত শারীরিক কসরৎও দেখান তাঁরা । বিভিন্ন ধরণের গান গাওয়া হয়। গমীরার নির্দিষ্ট গান যেমন আছে তেমনিই আছে মেচেনি খেলার গান, তিস্তা বুড়ির গান, ভাওয়াইয়া বা পালাটিয়ার গান। এই গানগুলিতে যৌন ইঙ্গিত থাকে।

বাই গে বাই
শিবখেলা জাগাইছে মারেঞা
চল খেলেবার যাই। 
খাবো দাবো বাই খেলা খেলাবো
এইমন দিনের নাগাল কোটে পাবো
ঠাকুর (মহাদেব)যদি দয়া করে
তয় সগে পাবো
ঠাকুর যদি না ক’রে ভাল
পাঠা দেয় ক্যান মানষি হালে হাল
যায় না মানে ঠাকুর ঠাকুর
সদায় তিন কাচাল

গমিরা খেলার শেষ হয় চৈত্র সংক্রান্তির দিন চরক পূজার মধ্য দিয়ে। চরক পূজার পরের দিন শান্তি পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ভক্তরা স্নান ক’রে নতুন বস্ত্র পরিধান করেন। সেদিন নিয়ম ভঙ্গ বা মৎসমুখীর অনুষ্ঠানও হয়। কারণ যে ক’দিন গমিরা খেলা অনুষ্ঠিত হয় সে কয়েকদিন সকলে নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন। গমিরা খেলা বা মহাদেবের এই পুজো শুরু হয়েছিল ব্যান রাজার সময়। এমন কথিত আছে কোনও কোনও অঞ্চলে। এই রাজা কোন সময় ছিলেন, কোথায় ছিলেন আর কোন সময়েরই বা কথা বলা হচ্ছে এ সম্পর্কে সচ্ছ ধারণা কারুরই নেই।

 

ভারতীয় তন্ত্রসাধনা ও গমিরা খেলা

বর্তমানে অধিকাংশ ভারতীয় পূজা পদ্ধতি তান্ত্রিক মতে হয়। বাঙালীর শারোদৎসব দুর্গাপুজো, কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা, কালী পূজা অথবা অসমের কামাক্ষ্যা, দক্ষিণ ভারতের নবরাত্র, বিহারে্র গয়ার গয়েশ্বরী ও মঙ্গলাগৌরী, পাঞ্জাবের কাংড়া দেবী, মুম্বাইয়ের মুম্বাদেবী, পার্বতীশৈলের পার্বতী, কাশ্মীরের ক্ষীর ভবানী—ইত্যাদি আরও অনেক শক্তিপুজো রয়েছে। ভারতের বাইরে নেপালে গুহ্যেশ্বরী ও আরও অন্যান্য দেশের তন্ত্রসাধনার কথা আমরা জানতে পারি। তবে তন্ত্র সাধনায় একমাত্র শক্তি পুজোই হয় না। তন্ত্র সাধনার তিনটি ধারা শৈব, বৈষ্ণব ও শাক্ত। তাই শিব, মহাদেব, মহাকাল, গম্ভীরা, গমিরা ইত্যাদি তন্ত্রপুজো প্রচলিত। আছে তন্ত্ররাস উৎসবও। তন্ত্র সাধনার দুটি বিষয় যোগতন্ত্র ও ক্রিয়াতন্ত্র। তন্ত্র বিষয়ক আলোচনায় প্রখ্যাত নিবন্ধকার চিন্তাহরণ চক্রবর্তী লিখছেন, “তন্ত্রোক্ত উপাসনা আলোচনা করিলে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যথা, মূলমন্ত্র, বীজমন্ত্র, মুদ্রা, আসন, ন্যাস, দেবতার প্রতীকস্বরূপ বর্ণ-রেখাত্মক যন্ত্র, পূজায় মৎস, মাংস, মদ্য, মুদ্রা, মৈথুন—এই পঞ্চ মকারের ব্যবহার, কার্যে সিদ্ধিলাভের জন্য মারণ, উচাটন, বশীকরণ প্রভৃতি ষট্‌কর্মের আশ্রয় গ্রহণ এবং যোগানুষ্ঠান।”

 তন্ত্রমতে দেহসাধনাই মূল। তাঁরা বিশ্বাস করেন দেহের বাইরে কোনও মূলতত্ব থাকতে পারে না। এই তনুর মধ্যেই ব্রক্ষ্মান্ডবীজ নিহিত আছে। তাইই শক্তি। ঈশ্বরের কাছে পৌঁছুনোর উপায় এই শরীর। ‘বৃহতনিগম’ গ্রন্থে তাই আছে

“বর্ত্তমানে দেহভান্ড দেখ বিচারিয়া।
তাহে ব্রক্ষ্মান্ড দেখ সাবধান হইয়া।।
ব্রক্ষ্মান্ডেতে যাহা হয় ভান্ডে তাহা আছে।
বর্ত্তমানে দেখ ভাই আপনার কাছে।।”

 স্থানভেদে ও দেউসী (দেবাংশী, পূজারী) ভেদে গমিরা খেলায় পূজা পদ্ধতি বিভিন্ন হয়ে থাকে। বাড়ির বাইরে কোনও গাছতলায় বা উন্মুক্ত স্থানে যে শিবথানের প্রতিষ্ঠা করা হয় সেখানে একটি মাটির বেদি তৈরি ক’রে পাথর ও ত্রিশুল শিবের প্রতিক রূপে মাটিতে গাঁথা হয়। সেখানে মাটিতে একটি রেখাচিত্রও অঙ্কন করা হয়। তন্ত্র সাধনায় যেমন গুরুর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তেমনই গমিরা খেলায় দেউসী। ভক্তরা বিশ্বাস করেন দেউসীর ক্ষমতাতেই তাঁরা নির্বিঘ্নে সম্পূর্ণ পূজা সফলভাবে করতে পারবেন।

এখানে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন যে তন্ত্র সাধনায় যে পঞ্চ ‘ম’-এর (মদ্য, মাংস, মৎস, মুদ্রা ও মৈথুন) কথা বলা হয়েছে তা কিন্তু এখন গমিরা খেলায় ব্যবহার করা হয় না। অতীতে হলেও হতে পারে। যে কয়দিন গমিরা খেলা চলবে দেউসী, মারেঞা ও ভক্তগণ সপরিবারে নিরামিষ আহার গ্রহণ করবেন। মৎস, মাংস, মদ্য, মৈথুন পরিহার করবেন। কেবল কখনও কখনও শিবের প্রসাদ স্বরূপ গঞ্জিকা সেবন করেন ভক্তরা। এমনও উদাহরণ আছে, যে গ্রামে গমিরা খেলা হয় সেই গাঁয়ের সমস্ত বাসিন্দা ওই ক’দিন নিরামিষ আহার করেন। নেবুকান্ত বললেন, তাঁর গ্রামের সমস্ত গৃহস্থ গমিরা খেলার তিন, পাঁচ, সাতদিন নিরামিষ আহার গ্রহণ করেন ও অন্যান্য সমস্ত নিয়ম মেনে চলেন। দেখা গেছে কেউ তার অন্যথা করলে সেই পরিবারে কোনও না কোনও অনিষ্ট হয়েছে।

(ক্রমশ)

এই সংখ্যার সূচী

করোনা কালের প্রতিবেদন ফ্রি রিডিং

Disclaimer: Few pictures in this web magazine may be used from internet. We convey our sincere gratitude towards them. Information and comments in this magazine are provided by the writer/s, the Publisher/Editor assumes no responsibility or liability for comments, remarks, errors or omissions in the content.
Copyright © 2025. All rights reserved by www.EkhonDooars.com

Design & Developed by: WikiIND

Maintained by: Ekhon Dooars Team