আবার একটা বড়দিন চলে এলো। উত্তরবঙ্গের ছোটবড় অসংখ্য চার্চের মতো জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া সাহেবদের তৈরি একশো পঞ্চান্ন বছরের পুরনো গির্জাটিও সেজে উঠেছে আলোকসজ্জায়, আধুনিক এলইডি বাল্বে। আলো পড়ে ঝকঝক করছে ব্রিটিশ আমলের বার্মা টিকের পালিশ করা চেয়ারগুলো। গির্জার মাথায় ঢং ঢং ঘণ্টাধ্বনি মনে করিয়ে দেয় ছোটবেলার কথা। বাবার সঙ্গে একবার এখানে এসেছিলাম। মায়ের বুনে দেওয়া সোয়েটার আর মাথা ঢাকা টুপির জমাট বুননে তখন ফাঁকফোকর খুঁজতে ব্যস্ত তুহিনশীতল উত্তুরে বাতাস। কিন্তু আমার সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। হাঁ করে তাকিয়ে দেখছি গির্জার প্রার্থনা ঘরের জানলায় রঙিন বেলজিয়াম গ্লাসের গায়ে ক্রুশবিদ্ধ যীশুর অপরূপ বেদনাবিধুর মুখশ্রী।
সেই সঙ্গে এও মনে পড়ল, তখন আমাদের উত্তরবঙ্গে কী প্রচণ্ড শীতই না পড়ত। দুপুর বারোটাতেও রোদের তেজ ম্লান। কুয়াশার পুরু পর্দা ঠেলে সূর্য বেচারা আসত গড়িমসি করে এবং এসেই ‘পার্ট ভুলে গেছি, পালাই বাবা’ – বলে দুপুর তিনটের মধ্যে স্টেজ ছেড়ে উধাও! একটানা চার পাঁচদিন কুয়াশায় গলা পর্যন্ত ডুবে থাকল গোটা জলশহর - এমনটাও আকছার ঘটেছে। তখনও সভ্যতা এতখানি যন্ত্র নির্ভর হয়ে ওঠেনি। স্নানঘরে গিজারের বালাই ছিল না। কেটলিতে করে বাড়ির সকলের স্নানের জন্য পালা করে জল ফোটানো হত স্টোভে। অন্য সময় ওখানে বসানো থাকত চায়ের ডেকচি। শীতের সকালে বাবার ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা চাই। নয়তো খবরের কাগজটা জোলো লাগে। মায়ের ডাকাডাকিতে লেপের ওম ছেড়ে উঠে হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে ব্রাশ করতাম দুই বোন। একটুখানি রোদের জন্য কাতর চোখে উঠোনের এদিক ওদিক তাকাতাম। পেলেই ওমনি জায়গা দখলের কাড়াকাড়ি।
কিন্তু কোথায় রোদ?
আমাদের বাড়ির পিছন দিকে পাঁচিলের ওপাশে সাহাকাকুদের সুপুরি বাগানটা ভোরবেলার টাটকা কুয়াশা মেখে কেমন ভৌতিক দেখাত। শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা করলা নদীর একহাত উপরে কোনও অদৃশ্য জেলে যেন মিহি জাল বুনে রেখেছে। জুবিলি পার্কের বটগাছটা ঝুপসি আঁধারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে। নদীর পাশ দিয়ে রিকশ চেপে স্কুলে যাই। চোখেমুখে হিমেল বাতাসের ঝাপটা এসে লাগে। কিছুক্ষণ পর নাকে কোনও সাড় পাই না।
ওদিকে পরিযায়ী পাখিরা নাকি দল বেঁধে চলে এসেছে রাজবাড়ির দিঘিতে। বাড়ির সকলে মিলে মহা উল্লাসে তাদের দেখতে ছুটলাম এক রবিবারের সকালে। দিঘির মাঝের চরায় হিমালয় থেকে আসা হাঁসেদের প্রভাতী বৈঠক বসেছে। ঘাটে দাঁড়িয়ে খালি গা, হাফ প্যান্ট পরা সেনপাড়ার রবিদা ওর চমৎকার শরীরটা খেলায় একটু, তারপর ঘাটের সিঁড়ি থেকে সোজা ডাইভ দিয়ে পড়ে দিঘির বরফঠাণ্ডা জলের মধ্যিখানে। জলের আয়না ভেঙে খানখান হয়ে যায়। উল্টোদিকের সারি সারি দেবদারু গাছ কেঁপে ওঠে শীতে। ভারি পোশাকে মাথা থেকে পা অবধি ঢাকা দর্শকের ভিড়ে এক চরম বিস্ময়ের অস্ফুট স্বর গুনগুনিয়ে উঠেই পরক্ষণে সেটা মিলিয়ে যায় ঘাট থেকে রাজবাড়ির সিংহদুয়ারে যাওয়ার কুয়াশায় ডুবে থাকা পথে। টুপটুপ হিম পড়ে মাথার টুপি চুপচুপে ভিজে যায়। বড়রা চায়ের খোঁজে ইতিউতি চায়। এত ভোরে কোনও দোকানের ঝাঁপ খোলে নি। তখন বাড়ি ফিরে যাওয়াই স্থির হয়।
আলসে ভোর একটু বেলার দিকে গড়াতেই পাড়ার গলিতে গলিতে সুর করে বেজে ওঠে ধুনুরির হাতের মিঠে বোল। কাজের দিনে সকলে অফিস ইস্কুলে বেরিয়ে যাওয়ার পর পাড়ার মা-কাকিমারা রান্নাখাওয়ার পাট সেরে নিজের নিজের ঝোলাব্যাগে উলকাঁটা পুরে মিলিত হয় পাপিয়াকাকিমাদের বাড়ির আড়েবহরে বিশাল উঠোনটায়। হালকা রোদে পিঠ রেখে মোড়ায় বসে উলবোনা, গল্পগাছা, পাড়ার রোমাঞ্চকর খবরের আদানপ্রদান চলে। পাপিয়াকাকিমার মতো সেলাইফোঁড়াই, উলের ডিজাইন ওই তল্লাটে কেউই জানত না। মফস্বলের রাস্তার ধারে ধারে তখন শপিং মলের এত রমরমা নেই। আধুনিক ব্র্যান্ডের রেডিমেড গরম পোশাকের বিজ্ঞাপন আমাদের মগজ ধোলাই করেনি। মায়েদের হাতে বোনা সাদামাটা সোয়েটার আর বেঁচে যাওয়া উল দিয়ে রঙবেরঙের টুপি, হাতমোজা, পঞ্চুতেই আয়নায় নিজেদের অপ্সরা মনে হত।
শীত এলেই বাড়ির বাগানে ফুলগাছ ছাড়াও নিজে হাতে সবজি লাগানো মায়ের নেশা। ছুটির দিনে মায়ের দেখাদেখি আমরাও মনের সুখে মাটি ঘাঁটতাম। সার মেশানো মাটি টবে ভর্তি করে ওতে একে একে রক্তগাঁদা। পিটুনিয়া। ডালিয়া। বাগান যেন আলো হয়ে থাকত। কাজের ফাঁকে ফাঁকেই মায়ের নজর এড়িয়ে জমির গাছ থেকে কড়াইশুঁটি ছিঁড়ে খোসা ছাড়িয়ে মুখে ফেলতাম টুপটাপ। আহ, কী মিষ্টি দানা। কচি কচি গাজর, পালং, ধনেপাতার সবুজে উপচে পড়ত বাগান। তাছাড়া আলসেমি করার জন্য শীতের ছুটির দুপুরগুলো তো অব্যর্থ। স্নানের পর ক্রিম মেখে তুলতুলে গাল পেতে দিতাম মিষ্টি রোদ্দুরের তলায়। দোতলার ছাদের টিনের চালে সকাল থেকেই রোদে টুকটুকে লেপগুলো বিছানো। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর মা হাতে হাতে দার্জিলিংয়ের কমলালেবু ধরিয়ে দিত। একহাতে গল্পের বই। অন্যহাতে কমলার কোয়া। অনেক পাখি আসত বাগানে। মাটিতে হেঁটে বেড়িয়ে পোকাটোকা ধরে খেত।
দুপুর ফুরিয়ে যেতেই কনকনে হাওয়া ছাড়ত। তখন ঘরে ঢুকে পড়তে হত। পছন্দের লেখাগুলো বারবার পড়েও আশ মেটে না। আনন্দমেলার পাতায় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘ইতি তোমার মা’ উপন্যাসের শেষ লাইনে এসে কতবার চোখ থেকে টপটপ করে জল ঝরে পড়ে পাতার ওই জায়গাটা ভিজিয়ে ফেলেছে, গুনে দেখিনি। রাতে লেপের তলায় ঢুকেছি শীর্ষেন্দুর ‘ঝিলের ধারে বাড়ি’ নিয়ে। অনু বিলুর অ্যাডভেঞ্চারে বুঁদ হয়ে গেছি। লীলা মজুমদারের ‘গুপির গুপ্তখাতা’ পড়তে পড়তে হঠাত খেয়াল হল পায়ের তালু এমন ঠাণ্ডা যেন বরফে চোবানো। অগত্যা বই সরিয়ে রেখে হাত-পা ভালো করে ঘষে শীতটাকে বাগে আনার চেষ্টা। এসব করতে করতেই হইহই করে এসে যেত বইমেলা। শীতের সন্ধ্যাগুলো দিব্যি কেটে যেত বইয়ের উষ্ণতায় আর বন্ধুদের সান্নিধ্যে। বড়দিনে কেকের গন্ধে ভুরভুর করত ঘরদুয়ার। তখনও আমাদের কেক আভেন ছিল না। মাকে দেখেছি উনুনের ঢিমে আঁচে উত্তপ্ত তাওয়ার উপরে বালি রেখে তার উপর কেকের পাত্র বসিয়ে ঢাকনার উপরে জ্বলন্ত কাঠকয়লা ছড়িয়ে দিতে। পরে ওই ইলেকট্রিক আভেন পাড়ার বহু বাড়ি ঘুরেছে।
আর বছরের শেষটা তো হল চড়ুইভাতির আদর্শ সময়। উঠোনেই মাটি খুঁড়ে উনুন তৈরি হল। খড়ির গনগনে আগুন জ্বেলে সবাই মিলে গোল হয়ে তাকে ঘিরে বসেছি। কড়াইতে মুচমুচে করে ভাজা হচ্ছে বেসনে চোবানো ফুলকপি আর ক্যাপসিকাম। মা কখনও খুন্তি দিয়ে ভাজাগুলো উল্টে দিতে বললে যেন বর্তে যেতাম। রাতের মেনু খিচুড়ি আর বেগুনভাজা। ফুটফাট শব্দে খড়ি ফাটছে। আগুনের রঙটা গাঢ় কমলা থেকে লালে বদলে যাচ্ছে। সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে আছি সেদিকে। মাঝেমাঝে ঝুঁকে এসে হাতপা ভালো করে সেঁকে নেওয়া হচ্ছে। সবশেষে আঁচটা নিভু নিভু হয়ে এলে তার ভিতরে গুঁজে দেওয়া হল তেল মাখানো গোটা পাঁচেক আলু। আঁচে সেদ্ধ হয়ে গেলে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে তেল-নুন-লঙ্কা দিয়ে মেখে মুখে দিতেই সঙ্গে সঙ্গে অনুপম স্বাদ-গন্ধ-ঝাঁঝে মনকে মোহিত করে তুলত যে সুখাদ্য তারই নাম দ্য গ্রেট আলুপোড়া।
এইসব সামান্য আয়োজন। তাতেই শীতের ছোটবেলাটা ভরে থাকত নিখাদ আনন্দ ও অফুরান প্রাণপ্রাচুর্যে। একটা দৃশ্য দিয়ে লেখা শেষ করি। বাবার চেতক স্কুটারে চেপে আমি আর বোন গৌরীহাট হয়ে চলেছি করলা ভ্যালি চা-বাগানের দিকে। শীতের চাবাগান বড়োই মনোরম। পথের মাঝে পড়েছে সিগন্যালবিহীন রেলওয়ে ক্রসিং। জমাট কুয়াশায় দু’হাত দূরের কিচ্ছু দেখা যায় না। এমন সময় দূর থেকে শোনা গেল ক্ষীণ হুইসেলের আওয়াজ। স্কুটার থেকে নেমে লাইনের ধারে অধীর অপেক্ষায় তিনজন। ধীরে ধীরে শব্দের তীব্রতা বাড়তে বাড়তে ঝমঝম করে অতবড় ট্রেনটা হঠাৎ কুয়াশার দেওয়াল ফুঁড়ে উদয় হল ঠিক আমাদের সামনে।
প্রত্যাশিত। কিন্তু এমনি চমকেছি যে বুকের ভিতরটা ঢিবঢিব করে উঠেছে। আবার একই সঙ্গে মনে অসম্ভব আনন্দের দোলা লাগছে!
হৃদয়ের এমন ঢেউ জাগা, ঢেউ নামা – এই দোলাচলের নামই হয়তো জীবন। এরই নাম বেঁচে থাকা।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team