এবার সংখ্যা প্রকাশে কিঞ্চিৎ বিলম্ব ঘটেছে। তার প্রধান অজুহাত হিসেবে শীতের আবির্ভাবের কথাই বলতে হয়। ঠান্ডার আচমকা প্রকোপে আরণ্যক ডুয়ার্সের জীবন যাত্রা কেমন যেন স্লথ হয়ে যায়। বিকেল গড়াতে না গড়াতেই সন্ধ্যা নেমে আসে, ঘরে ফেরার পালা চরাচর জুড়ে, এমনকী গৃহপালিত অবলা জীবদের মধ্যেও ত্রস্তভাব চোখে পড়ে। ডুয়ার্সে শীতকাল মানেই মিঠেকড়া রোদে সেঁকা সকাল, পিকনিক মন, সন্ধ্যায় জবুথুবু সংক্ষিপ্ত চায়ের ঠেকে মোদি-দিদি নিয়ে ক্লান্ত বিতন্ডা, বাতাসে ভেসে বেড়ানো অ্যালকোহলের অনুমোদিত ঘ্রাণ আর তারপর সুদীর্ঘ রাত্রি। তার মাঝেই টুকিটাকি কানে আসে চিতাবাঘের জখম, হাতিদের হামলা, অ্যাম্বুলেন্সের অভাবে চা শ্রমিকের মৃত্যুর খবর ইত্যাদি। ডুয়ার্সে শীতের চিত্র আজও কমবেশি একই রকম রয়ে গেছে।
তবে নতুন খবরও আছে। যেমন বাঘবনে আর মানুষ থাকতে পারবে নি কো! ন্যাশন্যাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটির নির্দেশিকায় বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্তর্গত জনবসতি গাঙ্গুটিয়া ও ভুটিয়াবস্তির বাসিন্দাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, এরপর একে একে আসবে অন্যগুলি। মানুষের ভিড়ের ঠেলায় যখন বাঘবন থেকে পালিয়ে গেছে স্বয়ং ব্যাঘ্র মহারাজ, সরকার বাহাদুর যখন রেগেমেগে টাইগার প্রজেক্টের তকমাই কেড়ে নেওয়ার উপক্রম করেন,তখন নিরুপায় বন বিভাগের কঠোর না হয়ে উপায় নেই। কড়াকড়ি কোন মাত্রায় পৌঁছেছে তার আন্দাজ পাওয়া গেল, যখন জানা গেল বনদফতরের নতুন জারি করা ক্যাম্পিং-ফি দিতে নাকি নারাজ আলিপুরদুয়ারের প্রকৃতি প্রেমী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি, প্রবল অনুরোধ সত্ত্বেও সেই ফি মকুব করা হয়নি। এতদিনকার ফ্রি-তে পড়ে পাওয়া জঙ্গল ব্যবহারে এখন হঠাৎ করে পয়সা দিতে হলে আপত্তি তো থাকবেই, অতএব সেখানে এবার নাকি নো নেচার ক্যাম্প!
অবশ্য কারো কারো বক্তব্য বক্সা পাহাড় এলাকা এমনিতেই ক্রমে জনহীন হয়ে পড়ছে, তাদের সমূলে উৎখাত করতে আর আলাদা করে বেগ পেতে হবে না। কারণ এমনিতেই কাজকাম নেই, চা বাগানের সংকট ও অপ্রতুল মজুরি, বেসিক শিক্ষা-স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অভাব, কমলালেবু আদার চাষে সমস্যা ইত্যাদি নানান যন্ত্রণায় জেরবার এখানকার আদি জনজাতির মানুষ, একটু সাবালক হতেই তাঁরা বেরিয়ে পড়ছে ভাগ্যের খোঁজে, পেটের সংস্থানে পাড়ি দিচ্ছে সচ্ছল রাজ্যগুলিতে। ফলে সেখানে গ্রামকে গ্রাম প্রায় জনশূন্য, জোয়ান মরদ বলতে কেউ নেই। তেমনই একটি খবরে অনেকের নজর পড়ে থাকবে, সে খবর কিন্তু এই বক্তব্যকেই সমর্থন করছে। সেটি হলো কালচিনি ব্লকের বিজয়পুরবস্তি নামে এক প্রায় জনমানবহীন গ্রামে ফের জনবসতি গড়ে তুলে সেটিকে পর্যটনযোগ্য স্থানে পরিণত করার কথা বলছেন জেলা প্রশাসন।
আসলে একেকটা শীতকাল প্রান্তিক ডুয়ার্সের মানুষগুলির ভাগ্যে বোধহয় দুর্দিন ছাড়া আর কিছু বয়ে আনে না। শীত পেরোলেই দেশের সাধারণ নির্বাচন, রাজনৈতিক দলগুলির প্রাক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বহরে এই পরিস্থিতির যে আদৌ কোনও বদল হবে না সে কথা মানুষগুলি এখন মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে, তাই তারা সাতপুরুষের চেনা জল-জঙ্গল-মাটির মায়া ত্যাগ করে পরবাসের পথ বেছে নিয়েছে। চা শিল্পের ক্রমাগত অধোগতি, শ্রমিকদের জীবিকার পরিবর্তন ও ভিনদেশে পাড়ি, গ্রামগুলিতে জনমনিষ্যির অভাব, স্কুলগুলিতে ছাত্রছাত্রীর অভাব আগামীতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বর্ণখনি এই ডুয়ার্সে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার স্বর্গরাজ্য খুলে দিতে পারে, সেই আশংকার কথা বলছেন ডুয়ার্সের প্রাজ্ঞ মহল। বহিরাগত মানুষের স্রোত ভূগর্ভে জলস্তর, অরণ্যাঞ্চলের বায়োডাইভার্সিটি তথা পরিবেশের ভারসাম্য কতোটা বিঘ্নিত করবে তা এখনই নির্ণয় করা হয়ত সম্ভব নয়। তবে আগামী দিনে বাংলার এই প্রান্ত প্রদেশের জনবিন্যাসে যে আরও বদল আসতে চলেছে সে কথা আন্দাজ করা যায়, অন্তত তারই ইঙ্গিত মিলছে সুস্পষ্ট।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team