 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                                                 মমি জোয়ারদার
                                            
                                                
                                                মমি জোয়ারদার
                                            
                                            
                                         
                                            
                                        লাটাগুড়ি একটা সময় আমার মতো অনেকেরই খুব পছন্দের জায়গা ছিলো। বিশেষত লাটাগুড়ি থেকে চালসা যাওয়ার রাস্তাটা, ভীষণ রোমাঞ্চকর। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে সেই রোমাঞ্চে ভাটা পড়ছে। এক তো লাটাগুড়ির রাস্তার দুপাশে এখন শুধু হোটেল আর রিসর্টের সারি, কংক্রীটের জঙ্গল হয়ে গেছে। শেষ যখন গেছি, ফ্লাইওভারের কাজ চলছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কিছুই করা গেলো না। যত দেখি তত হতাশ হই। এখন যা হচ্ছে তাতে হতাশার সাথে সাথে আতঙ্কও বাড়ে। লাটাগুড়ি এখন রিয়াল এস্টেট কোম্পানিগুলোর নজরে পড়েছে।
গরুমারা জাতীয় উদ্যানের খুব কাছে বেশ কয়েকটি আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠছে। এই প্রকল্পগুলি সবই জাতীয় উদ্যানের বাইরে তাই হয়তো প্রকল্পগুলির বাস্তবায়নে আইনি জটিলতা তৈরি হয়নি, কিন্তু প্রকল্পগুলি কতটা পরিবেশ বান্ধব সেটা অনুমোদন দেওয়ার আগে ভেবে দেখার প্রয়োজন ছিলো। এই প্রকল্পগুলি বেশিরভাগ জাতীয় উদ্যানের সীমানার ৫ কিলোমিটারের (কমবেশি হতে পারে) মধ্যে। এক একটি আবাসনে প্রায় ১৫০-২০০ অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায় এক একটিতে প্রায় ১৫০-২০০ পরিবারের বাস। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু থেকে শেষ পুরোটাই পরিবেশের ওপর এক বিশাল ধাক্কা। তবে সেটা সাধারণ শহর বা গ্রামাঞ্চলে হলে নিজেদের স্বার্থেই আমরা সহ্য করে নিতাম। কিন্তু এটা যখন একটা জাতীয় উদ্যানের পাশে, বন্যপ্রাণ সংরক্ষিত অঞ্চলের পাশে হয় তখন তা সংরক্ষিত পরিবেশের ওপর অত্যাচারের সামিল, তাদের সঙ্কটের মুখে ফেলে দেওয়া আর কিছু নয়।
এক একটা আবাসন প্রকল্প প্রায় পাঁচ থেকে পঁচিশ একর জমির কাছাকাছি। বেশ কিছু বহুতল অ্যাপার্টমেন্টের সঙ্গে সেখানে থাকবে কিছু ডুপ্লেক্স, কিছু কটেজ, সুইমিংপুল, অ্যামিউসমেন্ট পার্ক, অডিটোরিয়াম, আরও কত কিছু। বলা যায় এক একটা মিনি টাউনশিপ। অনেকটা জায়গা জুড়ে যখন পরপর অনেকগুলি বহুতল গড়ে ওঠে তাতে যে পরিমাণ খননকার্য ও নির্মাণকার্য হয় তার প্রভাব বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। দীর্ঘদিন ধরে খননকার্য যে শব্দ-দূষণ উৎপন্ন করে তা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের পশুপাখিদের জন্যে খুবই কষ্টদায়ক। আমাদের, মানে মানুষের পক্ষেও এই কষ্ট সহ্য করা কঠিন হয়, তবু আমরা শ্রেষ্ঠ জীব, নিজেদের কর্মের দায় আমাদের। কিন্তু মাটিতে উৎপন্ন মৃদু কম্পন ও শব্দদূষণ বিভিন্ন পশুপাখিদের যারা শব্দের সাহায্য নিয়ে দিক পরিবর্তন করে, খাদ্যান্বেষণ করে, সঙ্গীদের আকর্ষণ করে, বা শিকারীদের এড়িয়ে যেতে পারে তাদের স্বাভাবিক জীবনকে ভীষণভাবে ব্যাহত করে।
এই বিপুল নির্মাণ যজ্ঞের জন্য যে কাঁচামাল দরকার, বালি, পাথর, সিমেন্ট ইত্যাদি তা বাইরে থেকে এনে প্রকল্পের স্থানে জড় করা হয় এবং দীর্ঘদিন ধরে তার ব্যবহার হয়। আমাদের পাশের বাড়ি বা নিজের বাড়িতেই ছোটোখাটো কনস্ট্রাকশনের কাজ হলেও আমরা অতিষ্ঠ হয়ে যাই। দরজা জানলা বন্ধ করে থাকি, দশ বারো দিনেই হাঁপিয়ে উঠি। সেখানে এই প্রকল্পগুলি সম্পূর্ণ হতে লেগে যায় খুব কম হলেও তিন চার বছর। তার ওপর বিলাসবহুল এইসব আবাসনে প্রচুর টালি, গ্রানাইট মার্বেলের ব্যবহার হবে। সেসবের কাটাই ও পালিশের কারণে বাতাসে প্রচুর ধূলিকণার সৃষ্টি হবে। এছাড়াও আছে এইসব সামগ্রী আনা-নেওয়ার জন্যে অহরহ ভারি গাড়ির ব্যবহার। এই মারাত্মক বায়ুদূষণ জাতীয় উদ্যানের পশু-পাখি বা অন্যান্য জীবেদের স্বাভাবিক জীবনের জন্য ক্ষতিকারক বৈকি।
এইসব প্রকল্প নির্মাণ সম্পূর্ণ হওয়ার পরও কি সমস্যার সমাধান হয়? উত্তর, একেবারেই না। বরঞ্চ এরপর আরও নতুন সমস্যার উদ্রেক হয়। এক একটা আবাসন প্রকল্প, যেখানে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ পরিবারের থাকার ব্যবস্থা হয়, এবং সেই সঙ্গে অত্যাধুনিক জীবন যাপন, বনভূমির স্বাভাবিক পরিবেশকে আমূল পালটে দিতে পারে। এই বড় বাজেটের আবাসন প্রকল্পগুলিতে স্বাভাবিকভাবেই উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষজন থাকতে আসবেন এবং ধরেই নেওয়া যায় তারা প্রত্যেকে ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, এয়ারকন্ডিশনার ইত্যাদি ব্যবহার করবেন। এই অত্যাধুনিক সামগ্রীগুলি যে মারাত্মক দূষণের কারণ তা বলার আর অপেক্ষা রাখেনা। তাহলে সহজেই অনুমেয় দূষণের মাত্রা কতটা বাড়তে পারে।
পরিবেশ বিপর্যয়ের আরও একটা দিক হলো আলো। একেই তো হোটেল, রিসর্টগুলোর নৈশালোক পার্শ্ববর্তী জীবজন্তুদের জন্যে কখনই সুখকর নয়। তার উপরে এই সব আবাসনগুলোর আলো তাদের নৈশ জীবনে বিশাল অন্তরায় সৃষ্টি করবে বলাই বাহুল্য। নিশাচর পশু পাখিরা, দিনের আলোয় যারা স্বচ্ছন্দ নয়, রাতের অন্ধকারে ভালো দেখতে পায়, শিকার করে তাদের স্বাভাবিক জীবন তথা অস্তিত্ব বিঘ্নিত হবে।
বড় বড় আবাসন প্রকল্পগুলি ভূ-গর্ভস্থ জলস্তরেও প্রভাব ফেলে। কারণ অতগুলি পরিবারের জলের সংস্থান অবশ্যই ভূ-গর্ভস্থ জল। তার ওপরে অনেকটা জায়গা জুড়ে কংক্রীটের নির্মাণ গড়ে ওঠায় ভূ-গর্ভে জলে অনুপ্রবেশের হারও তুলনায় কমে যায়। সেই সঙ্গে থাকে প্রচুর পরিমাণ প্লাস্টিকজাত জিনিসের ব্যবহার। যা আমাদের আধুনিক জীবনের অঙ্গ। এইসব প্লাস্টিকজাত বর্জ্য ভূগর্ভে জলের অনুপ্রবেশ আরো কমিয়ে দেবে। সাধারণভাবে তা খুব বড় সমস্যার সৃষ্টি না করলেও বনাঞ্চলে তার প্রভাব অবশ্যই পড়তে পারে। ভূ-গর্ভস্থ জলের স্তরে সামান্য পরিবর্তন হলেও ওই অঞ্চলের উদ্ভিদের প্রকারের পরিবর্তন হতে পারে, যা জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রে পরিবর্তনের কারণ হবে। একই সঙ্গে আছে জল দূষণের সমস্যা। এতগুলি পরিবারের বসবাসের ফলে যে বিপুল বর্জ্য উৎপাদন হবে তা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেই নিষ্কাশিত হবে নিশ্চয়ই। কারণ আমাদের দেশের বিশেষত উত্তরবঙ্গের শহরগুলির বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা যে উন্নত নয় সে তো জানাই আছে। আর লাটাগুড়ির মতো পঞ্চায়েত চালিত একটি গ্রামে যে সেটা ভালো হবে না তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং জাতীয় উদ্যান সংশ্লিষ্ট জলের উৎসগুলির দূষিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
এই প্রকল্পগুলি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বাইরে হলেও বলাই বাহুল্য এই অংশেও প্রচুর বৃক্ষ, গুল্ম, বীরুৎ উদ্ভিদের উচ্ছেদন হয়েছে বা হবে। যার প্রভাব কিন্তু সংরক্ষিত এলাকার বাস্তুতন্ত্রেও পড়বে। কারণ এই উদ্ভিদকূল অনেক পাখি বা অন্য জীবের বাসস্থান বা খাদ্যের সংস্থা্ন, যারা হয়তো আবার জাতীয় উদ্যানের ভেতরের বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। আবার প্রকল্প সম্পূর্ণ হওয়ার পর যখন অনেক মানুষের যাতায়াত বেড়ে যাবে, প্রচুর গাড়ির যাতায়াত বাড়বে, তাদের সঙ্গে সঙ্গে ওই অঞ্চলে কিন্তু পোষ্য ছাড়াও নানাভাবে অনেক নতুন নতুন উদ্ভিদ বা প্রাণীরও আগমন ঘটবে। এই নতুন উদ্ভিদ বা প্রাণীকুলও কিন্তু জাতীয় উদ্যানের বাস্তুতন্ত্রের, জীব বৈচিত্র্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। জাতীয় উদ্যানের জীবকুলের সংক্রমণের সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে। ফলে জাতীয় উদ্যানের প্রাণিকুলের সামনে সমূহ বিপদ, বলাই বাহুল্য।
আর একটা অবশ্যম্ভাবী বিপদ হলো আন্তর্জাল তরঙ্গ। বর্তমানেও ওই অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিসেবা আছে। কিন্তু অতগুলি অতিরিক্ত মানুষের বসবাস মানেই, আরও চাহিদা, যা মেটানোর জন্যে বিভিন্ন মোবাইল পরিষেবা কোম্পানির শক্তিশালী ইন্টারনেট টাওয়ার বসবে। যা উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল উভয়ের জন্যেই আতংকের বিষয়। এতে তাদের প্রজননে, বৃদ্ধিতে, রোগ সম্ভাবনায়, বড়সড় ক্ষতিকারক প্রভাব পড়বে এ আজ পরীক্ষিত সত্য।
এবারে অনেকেই হয়তো যুক্তি দেবেন, ব্যাং-এর ছাতার মতো হোটেল রিসর্ট হচ্ছে যখন নির্বিবাদে আইনের পরোয়া না করে তখন আর আবাসন প্রকল্প হলে ক্ষতি কী? অবশ্যই ক্ষতি অনেকটাই বেশি। হোটেল রিসর্টগুলো তুলনায় ছোট ছোট প্রকল্প এবং বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন অংশে বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে উঠছে। ফলে পরিবেশের ওপর তাদের ক্ষতিকর প্রভাব পড়লেও তা তুলনায় কম ও প্রকৃতিও হয়তো কিছুটা মানিয়ে নেওয়ার সময়ও পেয়েছে। এবং আরও একটা বিষয়, প্রজনন ঋতুতে জাতীয় উদ্যান পর্যটকদের জন্যে বন্ধ থাকে, ফলে হোটেল রিসর্টগুলো পর্যটকের ঢল অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ সময়ে চলে, সারা বছর খুব একটা নয়। যদিও সামান্য ক্ষতিও কাঙ্খিত নয়, কিন্তু আবাসনগুলোকে তো কোনো সময়ের নিরিখে বন্ধ রাখা যাবে না, ফলে সেখানে সারাবছর ধরেই মানুষের আনাগোনা চলবে, প্রচুর যানবাহন চলবে, তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রভাব যে প্রতিবেশি জীবকুলের ওপর পড়বে তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
বিভিন্ন বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত করা হয়েছে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য, তাদের বৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে। সেখানে এই আবাসন প্রকল্পগুলি জীব বৈচিত্র্যের জন্যে এক বিরাট অভিশাপ। জীব বৈচিত্র্য ধ্বংস হলে আমাদেরও বিপদ। আমরা এই সরল সত্যটাকে কিছুতেই আমল দিচ্ছিনা। যদিও আমরা সবই জানি, সবই বুঝি। তবু আমাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে আমাদের জ্ঞানের সম্ভার প্রতিনিয়ত হার মানছে। জাতীয় উদ্যানের এত কাছে এই আবাসন প্রকল্পগুলির অনুমোদন দেওয়ার আগে এই সমস্ত বিষয় ভেবে দেখার প্রয়োজন ছিলো না? এই সম্পর্কে আইন কী বলে তা নিয়ে আমার সঠিক ধারণা নেই। জাতীয় গ্রীন ট্রাইবুনাল এক্ষত্রে কী ভূমিকা নিয়েছে তাও পরিষ্কার জ্ঞাত নয়। বক্সা-জয়ন্তীর মতোই এখানেও জাতীয় গ্রীন ট্রাইবুনালের সদর্থক ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন।
তবে এভাবেই চলতে থাকলে ভবিষ্যতে হয়তো আরও রিয়াল এস্টেট কোম্পানি ডুয়ার্সের এই অঞ্চলে ভিড় করবে। ডুয়ার্সের এই সবুজ, এই শান্তি বিক্রির লোভকে এখন প্রশ্রয় দিলে একদিন হারিয়ে যাবে আমাদের সবুজ সম্পদ। বন্যপ্রাণ লুপ্ত হলে আগামীতে জাতীয় উদ্যান তার মর্যাদা খোয়াবেই কোনও সন্দেহ নেই। আর সবুজ বা জাতীয় উদ্যান না থাকলে যারা ফ্ল্যাট বাড়ি বা সবুজের স্বপ্ন বেঁচে টাকা কামিয়ে সরে পড়লেন তাঁদের কী হবে জানা নেই, কিন্তু যারা এক কাঁড়ি টাকা দিয়ে সেই স্বপ্ন কিনলেন কিংবা স্থানীয় মানুষ যাদের জীবিকা পর্যটন নির্ভর তাঁদের তো বোকা বনে যাওয়া ছাড়া তো অন্য কোনও উপায় থাকবে না। এই কঠোর বাস্তব ছবির কথা যে কোনও একটি স্কুল পড়ুয়া ছাত্রও বলে দিতে পারবে, অথচ স্থানীয় প্রাজ্ঞ মানুষ, প্রগতিবাদী পরিবেশ কর্মীরা যারা হাইওয়ের বা ফ্লাইওভারের গাছ কাটা নিয়ে ধর্ণায় বসেন, কিংবা সেমিনারে বক্তব্য রাখেন তাঁরা কেন মৌনব্রত পালন করছেন সেটাই বড় অবাক করে দেয়!
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
