মণিপুর ভারতের এক ক্ষুদ্র কিন্ত এক অপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত রাজ্য। মোট আয়তন ২২,৩৫৬ বর্গ কিমি।এর মধ্যে ২০,১২৬ বর্গ কিমিই পার্বত্য অঞ্চল। জাতি জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যে এই রাজ্য যে শুধু যে অনন্য তা-ই নয়, জনজাতিগত পারস্পরিক দ্বন্দ্বেও এই রাজ্য ঔপনিবেশিক শাসনের বিষফল ভোগ করে চলেছে।
মনে রাখতে হবে, সমগ্র উত্তরপূর্ব ভারত এমনকি পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিঙ-ডুয়ার্সও সেই বীজ বহন করে চলেছে। তাই আজ মণিপুরের যে জনজাতিগত দ্বন্দ্ব তাকে রাজনৈতিক মৃগয়ার লাভ-লোকসানের জারক রসে সিক্ত করে বিরোধী দলগুলি সেখানকার শাসক দল বিজেপির বিরুদ্ধে যে হাতিয়ার করার উৎসাহ দেখাচ্ছে তা কিন্তু আবার যে কোনো সময়ে তাদের বিরুদ্ধে বুমেরাঙ হয়ে ফিরে আসতে পারে। কারণ এই সমস্যা কিন্তু কোনো রাজনৈতিক বা আইন শৃঙ্খলা অথবা প্রশাসনিক সমস্যা নয়। মণিপুরে যখন কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল তখনও এই সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, যেমন সিপিএম সরকার পারেনি দার্জিলিঙ পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা মেটাতে। তৃণমূল সরকারও এই পার্বত্য অঞ্চলের আপাত শান্তির যে ছবিটাকে তাদের সাফল্য বলে দাবি করছে তা কিন্ত আদৌ প্রকৃত চিত্র নয়। আজকে একান্ত অনুগত বলে যে অনিত থাপার দল পাহাড়ে রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক নিরাপত্তার ছাতার তলে ক্ষমতার চেয়ারে বসেছে, তাঁরাও কিন্ত বলতে পারছেন না যে তারা পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি থেকে সরে এসেছেন। সমস্যাটা যে আসলে জাতিসত্তার এই সত্যটাকে মানতে হবে।
এও মাথায় রাখা দরকার, দার্জিলিঙ পার্বত্য অঞ্চলসহ সমগ্র উত্তরপূর্ব ভারত এক সময় মূল ভারত বলতে আমরা যা বুঝি তার অংশ ছিল না। ইংরেজ শাসকেরা তাদের ঔপনিবেশিক স্বার্থে বিভিন্ন সময়ের ব্যবধানে এদেরকে তাদের অধীনে এনেছিল। এই এলাকাকে বলা হয় নানা জনজাতির যাদুঘর। ঔপনিবেশিক শাসকেরা এদের এলাকাগুলিকে এক এক করে নিজেদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিল বটে, কিন্তু এই সব এলাকাগুলিকে যখন তাদের প্রশাসনিক সুবিধার জন্য যখন একটি রাজ্যের প্রশাসনিক ছাতার তলে যুক্ত করেছিল তখন তারা ভাববার তাগিদ অনুভব করেনি যে এই সংযুক্তির ফলে সেই সমস্ত জনজাতির তথা জনগোষ্ঠীগুলির স্বাধীন সত্তা,তাদের সংস্কৃতি, সামাজিক ঐতিহ্যগুলি সেই রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর চাপে বজায় রাখতে পারবে কিনা।
স্বাধীন ভারতের রূপকারেরাও জাতীয় সংহতির নামে তাদের স্বাধীন সত্তাকে বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর অধীনে রাখার সেই ঔপনিবেশিক ভাবনাকেই মনের মধ্যে জায়গা দিয়ে চলেছেন। ফলে জাতিসত্তার সমস্যাগুলিকে আইনশৃঙ্খলা সমস্যার মাপকাঠিতে মোকাবিলা করতে গিয়ে, একের বিরুদ্ধে অপরের লড়াই বাধতে দিয়ে, প্রশাসনিক শক্তির সাহায্যে এর মোকাবিলা করতে গিয়ে, এই জাতিগত সমস্যাকে এমন তীব্র করে তুলেছে যে সমস্যার প্রকৃত সমাধান থেকে ক্রমেই দূরত্ব বাড়ছে।
কুকি-চিন জনজাতির মেইতেই বা মণিপুরীরাই এই রাজ্যের সবচেয়ে অগ্রসর জনগোষ্ঠী। মিসাইল পর্বতের মধ্যে অবস্থিত লাগতাক হ্রদের মধ্যে নিমজ্জিত ছিল একটা সুন্দর দুন। এই হ্রদে বিভিন্ন নদীবাহিত পলি সঞ্চিত হবার ফলে প্রথমে ছোট ছোট দ্বীপ তৈরি হয়েছিল। তারপর এই দ্বীপগুলি একত্রিত হয়ে চারটি বৃহৎ দ্বীপ মৈয়াং, খোমান, আঙম এবং লোয়াং গঠিত হয়। কামরূপ রাজত্ব যখন উন্নতির শীর্ষস্থানে তখন রাজ্য থেকে নির্বাসিতদের এখানে ছেড়ে দেওয়া হত।নাগা কুকিরা এখানে আগে থাকতেই এসেছিল। ওই সমস্ত নির্বাসিত ব্যক্তিদের সঙ্গে নাগা কুকি রমণীদের সংযোগের ফলে যে মিশ্র জনজাতির সৃষ্টি হয়েছিল তারাই আজকে মেইতেই বা মণিপুরী বলে পরিচিত। ১৫শ শতাব্দীর রাজা কিয়ামবার আমলে মণিপুরীদের মধ্যে বৈষ্ণব ও শৈব-হিন্দু ধর্মের দুটি ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল। ১৮ শতকের শেষ দিকে তারা বাঙলা লিপিকে গ্রহণ করে।
মণিপুরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূত্রপাত নাগা ও কুকিদের দ্বন্দ্ব থেকে। কুকিদের পূর্ব নাম থাঠো। পূর্ববাংলার বাঙালিরা এদের কুকি বলে ডাকত। এখন এই নামেই এরা পরিচিত। কুকিরা চারিত্রিক দিক থেকেই কিছুটা আক্রমণাত্মক প্রকৃতির ছিল। বার্মার রেঙ্গুন হয়ে উঠেছিল মাদক ব্যবসার কেন্দ্র। কুকিরা বার্মা থেকে ভারতে আসা এই মাদকের বাণিজ্যপথকে নিয়ন্ত্রণ করত। এখানে শুরু হয়েছিল এর দখল নিয়ে নাগাদের সঙ্গে লড়াই। নাগা সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন তখন ছিল চৈনিক অস্ত্রে বলীয়ান। ১৯৯৫ সালেই ২০০র বেশি কুকি নাগাদের হাতে নিহত হলে তারা মণিপুরের চুড়াচাঁদপুরে পইতেদের এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিল। পইতেরা তাদের স্বগোত্র কুকিদের আশ্রয় দিলেও কুকিরা কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এই এলাকায় নিজেদের আধিপত্য স্থাপনের জন্য পইতেদেরই ওপর আক্রমণ করতে শুরু করেছিল। পইতেরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গঠন করল Zomi Revolutionary Organization। এখানেও গড়ে উঠল তাদের সশস্ত্র সংগঠন ZRA (Zomi Revolutionary Army)।
অন্যদিকে কুকিরা গঠন করল KNFP (Kuki National Front Presidential Party)। শুরু হল পারস্পরিক হানাহানি। ১৯৯৭ সালে জুন মাসের ২৪ তারিখ থেকে জুলাই-এর ৭ তারিখের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা দাঁড়াল ৬০০র বেশি। ক্ষুদ্র এই মণিপুর রাজ্যে গড়ে উঠল একের পর এক সশস্ত্র সংগঠন। একে অপরকে অবিশ্বাস তাদের জাতিদাঙ্গার কাদায় নিক্ষেপ করল। তেমনি আমাদেরও মনে রাখতে হবে, দার্জিলিঙ পার্বত্য এলাকাতেও আছে বহু জনজাতি গোষ্ঠী। এদের মধ্যে এক পাহাড়ি জাতিসত্তার ভাবনা গড়ে উঠলে হয়ত গোর্খাল্যান্ড দাবির পক্ষে সবাই একজোট হবে। কিন্ত এই দাবিকে দুর্বল করতে এদের পৃথক পৃথক সত্তাকে উসকে দিতে চাইলে এখানেও যে ঘটতে পারে আর এক মণিপুরের মত ঘটনা-- এই ভয়াবহ আশঙ্কার কথাটাও মাথায় রাখতে হবে।
মণিপুরের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি সমতলের মেইতেইরা। সমতলের তুলনায় পার্বত্য অঞ্চলের আয়তন বেশি হলেও পার্বত্য অঞ্চলের নাগা, কুকি, মিজো জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যাও মেইতেইদের থেকে অনেক কম। আবার পার্বত্য অঞ্চলে থাঙকুল নাগারা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
মণিপুরের পার্বত্য জনজাতিরা উপজাতি বলে ঘোষিত হওয়ায় তারা সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলি অনুসারে বিশেষ কিছু সুবিধার অধিকারী। তারা সমতলে এসে জমি কিনে বসবাস করতে পারবে।মেইতেইরা কিন্ত পার্বত্য অঞ্চলে জমি কেনার অধিকারী নয়। মেইতেইরা বাঙলা লিপি গ্রহণ করলেও পার্বত্য উপজাতিদের লিপি রোমান। মণিপুরী বা মেইতেই ভাষা তিব্বত-বর্মী ভাষা গুলির মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ভাষা। পার্বত্য অঞ্চলের থাঙকুল নাগারা মিশনারীদের প্রভাবে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করে দ্রুত ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মণিপুরীদের সর্বক্ষেত্রে প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে।
মেইতেইরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের জনজাতির স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছে। জনজাতির স্বীকৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংরক্ষণের সুবিধা। এছাড়া মণিপুরের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসের অধিকার নেই। মেইতেইরা তাদের সেই দীর্ঘদিনের দাবির স্বীকৃতি পেয়েছে। আর তার বিরুদ্ধেই অন্য জনজাতি বিশেষ করে কুকিরা এমন মারমুখি হয়ে উঠেছে। মেইতেইরাও পাল্টা প্রতিরোধ শুরু করেছে। তাদের আশঙ্কা যে একচেটিয়া সুবিধা তারা ভোগ করে এসেছে এবার মেইতেইরাও তার দাবিদার হয়ে উঠবে।
মনে রাখতে হবে এই ভাবনাগুলির উৎসভূমি কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকের পোষাক পরা স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক প্রভুরা। তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের পথ না বেছে ভোট বাজারের একচেটিয়া ভোট ব্যাঙ্ককে ধরে রাখতে এই সংরক্ষণের গাজর ঝুলিয়ে রাখাটাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করেছিলেন। অথচ দেশে নেই কর্মসংস্থান তবু চাকুরির আশা দেখিয়ে বেকার যুবকদের একের বিরুদ্ধে অপরের লড়াই লাগিয়ে নিজেদের ব্যর্থতাকে আড়াল করতে চাইলেন। সমস্যাটি কোনো দল বা রাজ্যের সাফল্য বা ব্যর্থতার প্রশ্ন নয়। এটি এক দীর্ঘ দিনের অমীমাংসিত আর্থ-সামাজিক সমস্যা। এই সমস্যা যেমন বিজেপি শাসিত মণিপুরে আছে তেমনি আছে কংগ্রেস শাসিত রাজস্থান, বাম শাসিত কেরালা, তৃণমূল শাসিত পশ্চিমবঙ্গেও।
দার্জিলিঙ পার্বত্য জেলা সহ উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির জনজাতির নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, ভাষা ও সাংস্কৃতিক দিকগুলি সহ এর ঐতিহাসিক পটভূমিকা ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য অঞ্চল থেকে পৃথক। এরা ছিল হয় এক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বা কোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের অংশ (দার্জিলিঙ ছিল সিকিমের অংশ)। সামাজিক ও রাজনৈতিক ভূগোলের যে সমস্ত নিয়মগুলি ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীকে এক জাতির পরিচয়ের বাঁধনে বাঁধে তা এখানে এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। আমরা যারা তথাকথিত দেশপ্রেমিক এক জাতি এক প্রাণের ভারতবর্ষ বলে দাবি করি তারাও কি পেরেছি এক জাতির পরিচয় ভারতীয় হতে? এখনো তো আমি প্রথমে বাঙালি তারপর ভারতীয়, প্রথমেই তামিল তারপর ভারতীয়...।
মনিপুরে যে জনজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে দাঙ্গার আগুন জ্বলেছে তার দায় আমাদের সবার। একে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক মৃগয়া করতে গেলে কিন্ত সেই আগুনে অচিরে নিজের ঘরও পুড়তে পারে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team