প্রতিবার গরম পড়লেই আমাদের মধ্যে একটা অনুভূতি বারবার ফিরে ফিরে আসে, উফ আর পারা যাচ্ছে না! এবারের গরমটা কিন্তু সত্যিই বীভৎস! গতবারের তুলনায় এবার অনেকটা বেশি! কই আগে তো এত গরম পড়ত না! আমাদের ছোটবেলায় কোথায় ছিল এসি?
ঠিক তেমনই প্রতিবার গ্রীষ্ম এলেই ঠাণ্ডা সরবতে চুমুক দিতে দিতে আমাদের মনে পড়ে যায়, সত্যি এত গাছ কাটলে কি আর চলে? সরকার বলে গাছ লাগান, কিন্তু লাগাইটা কোথায় বলুন তো? ওই ছোট্ট ব্যালকনির টবে? পথেঘাটে গাছ লাগালে সে গাছ বাঁচিয়ে রাখা বড় করা কি অতই সহজ? সত্যিই তো, বহুতল খুপরিতে বাস করা মানুষের নিজের পায়ের নীচের মাটিই হারিয়ে গিয়েছে কবে, তো গাছের জন্য মাতই আর কোথায় মিলবে বলুন?
প্রত্যেক বছর বৈশাখ পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠ এলে প্রকৃতি যখন চারিদিকে হলকা ছড়ায়, আম-জাম-লিচু-কাঁঠাল সব গাছেই পেকে যায়; কিংবা বিচ্ছিরি নিম্নচাপে বাতাসে আর্দ্রতা অসহ্য বাড়িয়ে তোলে, তখনই ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে আসে আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস। আমরা জ্ঞানী গুণী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সেমিনার করতে বসি, এই ক্রমবর্ধমান গরমের হাত থেকে বাঁচবার পথ খুঁজি, বৃক্ষরোপনের ছবিতে ভরে যায় সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল, কিন্তু কত্তা গরম কমে কই? আমাদের আতংকের কাঁটা চড়তেই থাকে, দোকানে এসি-র বিক্রি বাড়তেই থাকে, মেঘের ছায়া ক্রমাগত দূরে সরতেই থাকে, কিন্তু থার্মোমিটারের পারদ পড়ে কই? এই দারুণ নিদাঘে চাতক পাখির মতই একই কিসিমের খাবি খায় খেলার মাঠহীন শৈশব, পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া জমির চাষি আর অরণ্যহীন বন্যপ্রাণ, তবু উষ্ণতা বেড়েই চলে।
উষ্ণায়ন বা জলবায়ুর পরিবর্তন আগামীদিনে বিশ্বের অর্থনীতিতে বিশাল প্রভাব ফেলতে চলেছে, অতএব টনক নড়েছে দুনিয়ার তাবড় শিল্পপতি কুবেরদের এবং স্বভাবতই সেই সঙ্গে বিশ্বনেতাদেরও। প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে আর বেশিদূর এগোনো মানেই নিজেদের অন্তিমকাল ডেকে নিয়ে আসা, এই বোধ সম্ভবত উদয় হয়েছে দুনিয়ার ভাগ্যনিয়ন্ত্রকদের মাথায়। তাই দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা, ষাট শতাংশ ভূমি, পঁচাত্তর শতাংশ বাণিজ্য, উৎপাদনের আশি শতাংশ এবং পঁচাশি শতাংশ জিডিপি সম্বলিত সব দেশগুলির কর্তাব্যক্তিরা বসছেন শীর্ষ বৈঠকে ও নিরন্তর আলোচনায়। এইবার তাঁদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু হল, সবুজ উন্নয়ন, জলবায়ু ভিত্তিক অর্থনীতি ও প্রযুক্তি এবং পরিবেশ-সচেতন জীবনযাত্রা। মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ এবং অণুজীবের পারস্পরিক নির্ভরতার উপরেই যে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব, মহা উপনিষদের সেই ভাবনাই হতে চলেছে আগামীদিনের বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মূল সূত্র।
বেটার লেট দ্যান নেভার। এই ইংরাজি শব্দবন্ধটিকে নির্ভর করেই বলা যায়, মানুষ সব পারে। সে যদি আন্তরিক ভাবে চায় এই পৃথিবীকে ফের সবুজ গাছ ও ঘাসে ভরিয়ে তুলতে তবে তা কি খুব অসম্ভব কাজ? সে যদি চায় নদীর জলধারাকে কলুষমুক্ত করে তুলতে তবে সেটাও কি কঠিন কিছু? সে যদি চায় অরণ্যের গভীরতা বাড়িয়ে বন্যপ্রাণকে তাদের স্বতস্ফূর্ত জীবন নিশ্চিত করতে তবে সেটা রূপায়ণ করা কি অবাস্তব ভাবনা? আসলে তাকে সেই ভাবনার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই একমাত্র কাজ, বাকি সে নিজেই করে নেবে। প্রকৃতিতে একে অন্যের উপরে নির্ভরশীলতার মূল ভাবনাটাই আমাদের মন থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। আজ বিশ্বনেতারা ও শিল্প নায়কেরা এর গুরুত্ব অনুভব করতে পারছেন, তাঁরাই দুনিয়া জুড়ে মানুষের অভ্যাসকে চালিত করেন, অতএব তাঁরাই পারবেন আজকের মানুষের এতদিনের ধ্যানধারণা ও চলাফেরাকে বদলে দিতে।
রাষ্ট্রের প্রশ্রয় না থাকলে কখনও যথেচ্ছ গাছ কেটে বা পুকুর ভরাট করে কিংবা চাষের জমি চরিত্র বদলে ইমারত নির্মাণ সম্ভব নয়। রাষ্ট্রের অনুমোদন না পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে নদীর গতিপথ যত্রতত্র রুদ্ধ করে দেওয়া সম্ভব হয় না। তেমনই সরকারি সবুজ সংকেত না থাকলে ন্যাশনাল পার্কের লাগোয়া কংক্রিটের আবাসন প্রকল্প শুরুর কথা কল্পনায় আনা যায় না। গত পঁচাত্তর ধরে আমরা দরিদ্র মানুষের কল্যাণের নামে, শিল্প ও কর্মসংস্থানের অজুহাতে বা স্রেফ নিজেদের সম্পদ বাড়াবার গোপন লালসায় আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে যে আত্মঘাতী ভুলগুলি করে এসেছি, সেসব এক মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে সরকারের এক অঙ্গুলি হেলনে। ক্ষমতা দখলের যাবতীয় রাজনীতির উর্ধ্বে গিয়ে অন্তত দেশ চালকেরা বুঝতে পেরেছেন, দেশ বাঁচলে তবেই তো শাসন!
আগামী দিনের স্কুল ছাত্রটিকে তার খেলার মাঠ কিংবা চাষিকে তার হারিয়ে যাওয়া জমি ফিরিয়ে দেওয়া যাবে কিনা জানিনা, তবে আপনার মহল্লায় পাখিদের কলকাকলি ফিরিয়ে আনা বা আপনার পাশের নদীতে হারিয়ে যাওয়া মাছেদের লাফালাফি দেখতে পাওয়া, কিংবা আপনার আবহাওয়ায় সবুজ শীতল বাতাসের আনাগোনা কিন্তু কঠিন কিছু নয়। প্রযুক্তিকে মানবতা কেন্দ্রিক হতে হবে, উন্নয়ন হবে মিলিত সমন্বয়ের, আর আমাদের প্রত্যেকের নিজেদের জীবনযাত্রায় প্রকৃতির প্রতি আরেকটু খেয়াল রাখলেই এই ‘অসাধ্য সাধন’ সম্ভব।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team