জলপাইগুড়ি শহরের যে দিকটায় আমার বাড়ি সে দিকটায় সকাল দুপুর সন্ধে কিংবা রাত, কখনোই কোনো টোটো বা রিক্সা আসতে চায় না। শহরের যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে জিলা স্কুলের সামনে যাবো বললেই হয় সপাটে ‘যাব না’ বলে দেয় অথবা সামলাতে হয় বহু প্রশ্নবাণ। ছোটো থেকে এটাই দেখে দেখে মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগতো, পরে রাগও হয়েছে বহুবার। এমন এক জায়গায় বাড়ি যেখানে যাতায়াতের নানাবিধ অসুবিধা। মাঝে মধ্যেই মনে হয়েছে শহরের সবথেকে রদ্দি দিকটায় আমাদের বাড়ি। তবে, তখনও আমি এটা জানতাম না যে ব্রিটিশরা ১৮৬৯ সালে জলপাইগুড়ি শহর গড়ে তোলার পর এই হাকিমপাড়া টাউন ক্লাব সংলগ্ন অঞ্চলকেই সাহেব পাড়ার তকমা দিয়েছিলো। আর নিজের শহর নিয়ে এরকম আরও বহু কথাই নিয়ে জানতে পারতাম না যদি অধ্যাপক রূপন সরকারের ‘তিস্তাপারের জলপাইগুড়ি’ বইটা হাতে না আসতো। লেখককে ব্যক্তিগত জায়গা থেকে চিনি বলেই হয়তো জানি যে যেকোনো বই লেখার ক্ষেত্রে কতটা নিপুণতা নিয়ে কাজ করেন তিনি। এই বইয়ের শেষে উল্লিখিত গ্রন্থপঞ্জী দেখলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে কতটা গবেষণা করে, বিভিন্ন নথি ঘেঁটে এই বইটি লেখা হয়েছে। তবে, বইটির মূল আকর্ষণ শুধুমাত্র বইটির সুগভীর গবেষণা নয়, বরং এর বিষয় এবং লেখার ধরন। বইটির লাইনগুলো কখন যেন জলপাইগুড়ি শহরের মুখের ভাষাতে পরিণত হয়। বিমূর্ত শহর যা বলতে পারে না, কিন্তু যা লেখা রয়েছে প্রতিটি রাস্তায়, প্রতিটি দেওয়ালে, মাঠে, ঘাটে সব কথা যেন বের করে আনে এই বইটি। এক কথায় এই বইটির মাধ্যেমে জলপাইগুড়ি শহরের আক্ষরিক অর্থেই যেন পুনর্জন্ম হয়।
ইতিহাস আমাদের অতীতের সাথে দেখা করায়। চেনায় আমাদের শিকড়। এক প্রখ্যাত ঐতিহাসিকের ভাষায় বলা যেতে পারে, ইতিহাস হলো অতীত এবং বর্তমানের এক নিরন্তর সংলাপ। তবে, ইতিহাসের এই সংলাপ মূলত ততদিন অবরুদ্ধ হয়ে থাকে যতদিন না একে কেউ স্বচেষ্টায় উন্মোচন করেন। এই বইতে সেটাই করেছেন অধ্যাপক রূপন সরকার। এবার অনেকের হয়তো মনে হতেই পারে যে শহরের ইতিহাস তো বাড়িতে দাদু দিদার কাছে কিংবা পাড়ার রোয়াকে পাড়ার বয়োঃবৃদ্ধদের কাছ থেকেই জানা যায়। তবে হঠাৎ, নতুন করে একটা আস্ত বই পড়তে যাওয়া কেন ? আমার মনে হয় বই পড়তে যাওয়া একারণেই যে, স্রেফ রাস্তা দেখেই বলে দেওয়া সম্ভব নয় তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা ইতিহাস। যেমন করে ফোলা হাত দেখেই বলা যায় না সেটা ভেঙেছে কিনা। তার জন্য যেমন ডাক্তার দরকার, দরকার এক্স রে রিপোর্টের তেমনি ইতিহাস উদ্ধারের জন্য গবেষণার দরকার, দরকার তথ্যনিষ্ঠ অনুসন্ধানের। আর তাছাড়াও পাড়া কিংবা বাড়ির বয়োঃবৃদ্ধরা সময়ের কতটা পেছনে গিয়ে গল্পটা বলতে পারবেন সে নিয়েও সন্দেহটা থেকেই যায়। কারণ, একজন ইতিহাসবিদ যেভাবে টাইম ট্রাভেল করতে এবং করাতে পারেন সেটা মামুলি লোকের পক্ষে করা মুশকিল বৈকি। তাই পাড়ার রোয়াকে বাবুপাড়ার নাম কেন বাবুপাড়া, টাউনক্লাব থেকে পিডাব্লুডি পর্যন্ত এতটা সবুজায়ন কেন, কোথায় ছিলো জলপাইগুড়ির প্রথম ইউরোপিয়ান ক্লাব, কারা বিশু সিংহ এবং শিশু সিংহ এবং সর্বোপরি একটা জনমানবহীন এলাকা কীভাবে ১৮৬৯-এর পর একটা নাগরিক প্রাণকেন্দ্রে পরিনত হলো সেসব জানা যায় না। যেগুলো বিস্তারিতভাবে জানা যায় “তিস্তাপারের জলপাইগুড়ি” বইটি থেকে। না, এই বইটি কোনো গল্পের নই নয়। নয় কোনো ঐতিহাসিক উপন্যাস। তবে, এমনভাবেই এই ইতিহাসসমৃদ্ধ বইটি লেখা হয়েছে যা আপনাকে ভ্রমণ করাবে জলপাইগুড়ির আদিলগ্নে। ইতিহাসের টানে কোচবিহার রাজবাড়ী কিংবা জলপেশ মন্দির তো অনেক ঘুরলেন, এবার চট করে এই বইটার হাত ধরে একটু ঘুরে দেখুন না জলপাইগুড়ি শহরটা, তার জন্ম ও বেড়ে ওঠার কথকতা!
তিস্তাপারের জলপাইগুড়ি
ড. রূপন সরকার
এখন ডুয়ার্স
দাম ৩৬০টাকা
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team