 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                                                 শ্যামলী সেনগুপ্ত
                                            
                                                
                                                শ্যামলী সেনগুপ্ত
                                            
                                            
                                         
                                            
                                        হেঁটে যাচ্ছিলাম ফেলে আসা পাড়ার রাস্তা দিয়ে। কামিনি ফুলের মায়াময় সুবাসে সুবাসিত রাস্তা আম-জাম-কাঁঠালের স্নিগ্ধ শীতল ছায়ায় যেন কোল পেতে দিয়েছে পথিককে। ঘন তেজপাতা গাছের গায়ে লতিয়ে ওঠা আহ্লাদী মাধবীলতার সাদা আর গোলাপী থোকা থোকা ফুলে গুণগুনিয়ে কখনো রাগ বিলাবল কখনো আহির-ভৈঁরো গাইছে মৌমাছি ও ভ্রমর-ভ্রমরী।
আজ ইঁচড় পাড়া হবে বীণা জ্যেঠিমার বাড়িতে। আজ গরম মশলায় কষানো ইঁচড়ের গন্ধে ম-ম করবে পাড়ার রাস্তা। ফর্সা থান পরা জ্যেঠিমা দাঁড়িয়ে থেকে নির্দেশ দিচ্ছেন কোনগুলো কাঁঠালের জন্য থাকবে আর কোনগুলো পেড়ে পাড়ায় বিলি করা হবে। চার-চারটে কাঁঠাল গাছ এ বাড়িতে। তিনটে আম গাছ। জাম,সজনে, পেয়ারা,ডালিম কী নেই ! শুধু কি তাই, রয়েছে বারো রকমের জবা, গন্ধরাজ, কামিনী, কুন্দ, রকমারি লিলি, টগর, চাঁপা, গোলাপ। কতরকম যে পাতাবাহার!
আজ আবার তরু জ্যেঠিমার বাড়ির সবকটা নারকেল গাছ পরিস্কার করে নারকেল পাড়া হবে। চারটে লোক কাজে লেগেছে। আজ এই রাস্তার দুই পারের সব বাড়িতে একটা করে নারকেল যাবে। যদিও এ পাড়ার বেশিরভাগ বাড়িতেই নারকেল, সুপারি,কাঁঠাল গাছ আছে। তবুও এক বাড়ি থেকে অন্যান্য বাড়িতে ফলফুলুরি যাবেই। এই না হলে পাড়া! এখানে ভালোবাসা, ভরসা, ঈর্ষা, অসূয়া, কুটকচালি আর মায়া সব একসাথে মিলেমিশে থাকে।
সেই সময়, আজ থেকে বছর পনের আগেও পাড়ায় পাড়ায় ছিল বাড়ি ভর্তি গাছপালা।ওই যে শুরু হল বিরাট বিরাট হাম্বার দিয়ে দুমদাম বাড়ি ভাঙার পালা, সেই থেকেই কাটা পড়ল এইসব মায়াবৃক্ষ, যারা শুধুমাত্র ফল-ফুল দিত, তা নয়, এই গাছপালারা মেঘ থেকে নামিয়ে আনতো বারিধারা। ভারি শীতে দুই বাড়ির মাঝে কুয়াশা জমে এমন সাদা হয়ে যেত যে এবাড়ি থেকে ওবাড়ি দেখা যেত না আর তার কারণ ছিল এইসব মায়াবৃক্ষ। গাছগুলি ছিল ছাতার মতো। আপদে বিপদে তারা সহায়। আম্রপল্লব, কলাপাতা, দূর্বা, লেবুরপাতা, তেজপাতা, কারি পাতা, নিম পাতা, শিউলি পাতা, সজনে পাতা ও ফুল-- এসব বাড়িতেই পাওয়া যেত। নারকেল পাতা থেকে কাঠি বার করে ঝাঁটা বানিয়ে নেওয়া হত বাড়িতেই।
পাড়ার টিনের চালের বাড়ি অথবা নিজের মনের মতো বানানো বাড়িগুলি এখন তগুণতি। টিনের চালের বাড়ি তো নেইই। আম-কাঁঠালের বাগানওয়ালা বাড়িগুলো জি প্লাস থ্রি,জি প্লাস ফোর করে নিজেদের উচ্চতা ধাপে ধাপে বাড়িয়ে যাচ্ছে। ফ্ল্যাটের সুপার-বিল্ট বাড়াতে গিয়ে খোলা জায়গা কমে যাচ্ছে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে গ্যারেজ সুতরাং রকমারি ফোর হুইলারের ভিড় সেখানে। কোনও কোনও অ্যাপার্টমেন্টে অবশ্য পাঁচিল ঘেঁষে এক ফালি জায়গায় বাহারি ফুলগাছের বাহারি টব। ফুল দেখি না টব দেখি!

ছায়াবৃক্ষদের জায়গা নেই সেখানে। শিউলি অথবা স্থলপদ্ম লাগালে আবাসিকরা ভয় পায়, শুঁয়োপোকা হবে! আসলে জমির ওপর ভিত গড়ে ওঠার আগেই ঝপাঝপ কোপ পড়ে বড় গাছের গায়ে। নৃশংস করাত হনন করে শ্বাসবায়ুর আদিমতম উৎসকে। আকাশে ডালপালা মেলে দেওয়া একটা আম গাছ অথবা একটা ঝাঁকড়ামাথার জাম গাছের অবদান ভুলে আমরা স্কোয়ারফুট মাপার খেলায় মেতে উঠি। তারপর নির্দিষ্ট স্কোয়ার ফুটের চিলতে ব্যালকনি ভরে ওঠে অ্যালোভেরা, মিনিয়েচার তুলসী মঞ্চের বাস্তুশাস্ত্রের ঘোরপ্যাঁচে। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা, যেমন আবাসনের ভেতরে প্রায় পায়ে ধরে রেখে দেওয়া এক টুকরো জমিতে বাঁচিয়ে রাখা তেজপাতা গাছটি অথবা টিয়ার পালকের মতো সবুজ নিমগাছটা কোনও এক অলৌকিক কারণে শুকোতে শুরু করে। আবাসনের বিশেষজ্ঞরা জানিয়ে দেন মরা গাছ রাখতে নেই। আ মলো যা! গাছ তো মরেনি। ডালপালা তো শুকোবেই। বরাবর দেখে এসেছি শুকনো ডালপালা ছেঁটে দেওয়া হয়। ইদানিং দেখছি রীতিমতো করাত দিয়ে কাটা হচ্ছে শুকনো ডালপালা! সোনায় সোহাগার মতো জুড়ে বসছে মোবাইল ফোনের টাওয়ার। বিভিন্ন আবাসনের আবাসিকরা এককাট্টা হয়ে লোভের বশে ছাদের উপর বসাচ্ছেন মোবাইল টাওয়ার। আইনকে নিজের হাতে রাখা তো জলভাত! সুতরাং নিরীহ নারিকেল, সুপারি গাছগুলো পাড়া থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
মনে আছে,বেশ কয়েক বছর আগে এক বন্ধুর তেতলা বাড়ির ছাদে উঠে দেখেছিলাম দূর দিগন্তে পাহাড়ি-নীল সীমারেখার সঙ্গে কেমন লেপটে রয়েছে ঘন সবুজ। কিছুদিন আগে তাদের জি-ফোরের ছাদ থেকে দেখলাম সারি সারি জলের ট্যাঙ্ক আর মোবাইল টাওয়ার। আবাসনের বিন্যাস ও বিস্তার শুধুই পাড়া-সংস্কৃতি ঘুচিয়ে দিচ্ছে তা নয়, ভুলিয়ে দিচ্ছে মায়াবৃক্ষের স্নেহমাখা আঁচলের গন্ধ। আমরা সুলভ বাতাস ভুলে দামি কৃত্রিম বাতাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি ক্রমশ।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
