‘লোকনাট্য’ শব্দটির ব্যবহারে বেশ কিছু পন্ডিতের আপত্তি রয়েছে। তাঁদের বক্তব্য, ‘লোক’ শব্দটির সঙ্গে একটি অন্ত্যজ পরিবেশ তৈরি হয়। যে কারণে এই সংস্কৃতির গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়। বলা উচিৎ বাংলার ঐতিহ্যশালী বা পরম্পরাগত সংস্কৃতি। আমাদের আলোচ্য সংস্কৃতি, নাট্য, নৃত্য যে অবিভক্ত বাংলা তথা ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য সে বিষয়ে দ্বি-মতের অবকাশ নেই। লোকসংস্কৃতি, লোকনাট্য, লোকনৃত্য এই শব্দগুলির সঙ্গে ‘লোক’-এর ব্যবহারে সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে কোনওভাবেই ক্ষুন্ন করবার অভিপ্রায় কারুর কখনও ছিল না। এ একান্তই ব্যবহৃত হয়ে আসা শব্দ। বহুল প্রচলন হয়ে এসেছে। সকলের কাছে পরিচিতিও বটে। লোক শব্দের ব্যবহারে নাগরিক কৃত্রিম সংস্কৃতি থেকেও পৃথক হয়ে যায় আমাদের ঐতিহ্যমন্ডিত সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ধারা। হিমালয় সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের লোকসংস্কৃতি ও লোকনাট্য সম্পর্কে বিক্ষিপ্ত আলোচনা হলেও বিস্তৃত ভাবে এবিষয়ে লেখালিখি খুব কম। নিজে থিয়েটার ও মূকাভিনয়ের সঙ্গে আছি। তাই থিয়েটার চর্চার সাথে সাথে আগ্রহ বোধ করেছি লোকনাট্যকে জানতে ও বুঝতে। তাই গাঁ-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে দেখতে চেয়েছি এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির রূপ ও তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শিল্পীদের। বুঝতে চেয়েছি তাঁদের বোধ ও দর্শনকে। যতটুকু জেনেছি বুঝেছি তাইই ভাগ করতে চেয়েছি সকলের সঙ্গে। মনে রাখতে হবে এ কোনও গবেষণা পত্র নয়। কিছু অভিজ্ঞতার বিনিময়। সে অভিজ্ঞতা সময়ের সঙ্গে বদলে যেতে থাকে। একের অভিজ্ঞতা অন্যের সাথে না মেলাই স্বাভাবিক।
উত্তরবঙ্গের অত্যন্ত বৈচিত্রময় হ’ল এখানকার ভাষা। এ অঞ্চলের বসবাসকারী মানুষেরা ব্যবহার করেন বিভিন্ন ভাষা ও উপভাষা। একই ভাষার নানান Dialect আমাদের চমকিত করে। A peculiar form of language differing from the standard or literary speech. ভাষা-উপভাষা দুইই অন্য অনেক ভাষা থেকে শব্দ, বলবার ধরণ, বাক্যগঠনের প্রণালী যেমন গ্রহণ করেছে নিজের শরীর থেকে বর্জন করেছে অনেক কিছু। এ এক বহমান ঘটনা। কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির অধিকাংশ মানুষ ব্যবহার করেন ‘কামরূপী উপভাষা’। এই উপভাষাই অঞ্চল বিশেষে বাচনভঙ্গির কারণে বদলে যেতে থাকে। উত্তর দিনাজপুরে রয়েছে ‘কাইথী বাঙলা’, ‘সূর্জাপুরী’ বাঙলা’। এই জেলার কোনও কোনও মানুষ কামরূপী বাঙলার অন্য একটি ধরণ বলবার সময় ব্যবহার করেন। ভাষার ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায় প্রতি আট-দশ কিলোমিটার পর পর কথায় শব্দ ব্যবহারের ধরণ, শ্বাসের প্রয়োগ, উচ্চারণের ভঙ্গি বদলে যায়। এখানে প্রচলিত আছে ‘কামরূপী বাঙলা’ ও ‘কোটিবর্ষীয় বাঙলা’। কোটিবর্ষীয় বাঙলায় প্রাকৃত ঘেঁষা অপভ্রংশ ও ভগ্ন তৎসম উচ্চারণের শব্দের আধিক্য বেশি। মালদহ জেলার বিহার সংলগ্ন মানুষগণ ব্যবহার করেন হিন্দি প্রভাবিত বাঙলা ‘খোট্টাই উপভাষা’। প্রচলিত রয়েছে ‘বরেন্দ্রী বাঙলা’ ও ‘মুসলমানী বাঙলা’। মুসলমানী বাঙলায় আরবী, ফারসী শব্দের ব্যবহার খুব বেশি। ভাষার ঐতিহাসিক দিক ও আঞ্চলিক প্রভাব বিষয়ে আলোচনা আমার কাজ নয়। তা করবেন ভাষা বিজ্ঞানী। আমি আর একটি বিষয়ের উল্লেখ করে ভাষা বিষয়ে আমার এই আলোচনা শেষ করবো।
কিছু সংখ্যক মানুষের ব্যবহার্য শব্দ মূল ভাষা ও উপভাষার সঙ্গে মিলেমিশে যায়। যেমন ‘পোকচোল’ (পন্ড হওয়া বোঝাতে), ‘গাম্বাট’(বোকা), ‘সেই’ (অসাধারণ), ‘ব্যাপক’ (দারুণ)— শব্দগুলি আগে শুধু ছেলে-ছোকরাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিছু মানুষের কাছে এই শব্দগুলি মান্য নয়। শব্দের অন্ত্যজ শ্রেণীর। তবে এখন এসব বহুল প্রচলিত। এছাড়াও সিনেমা-সিরিয়ালের হিন্দির ব্যবহার বাঙলায় প্রচুর। আবার শোনা যায় ‘দেহাটা মোর কাগজের নাখা পাতেলা হয়্যা গেইসে’(শরীর খারাপ), ‘মোক বিনা টিকিটে ফারাক্কা নিগাবো’(বিপদে ফেলা) ইত্যাদি। এভাবেই বিভিন্ন সময়ে শব্দ বা শব্দগুচ্ছ আমাদের ভাষায় মিশে যাচ্ছে। দার্জিলিং জেলার মানুষ ব্যবহার করেন নেপালী, কামরূপী বাঙলা। ধীমালদের আছে অঞ্চল প্রভাবিত নিজস্ব কথ্য উপভাষা। জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ারের মানুষ বাঙলার অন্যরকম উচ্চারণ ব্যবহার করেন বলবার সময়ে। যেমন খেয়েছি স্থানে ‘খাইছি’, কী করছিস স্থানে ‘কী করতেছিস’, করছো স্থানে ‘করতেছ’ ইত্যাদি। ছ, স-এর স্থানে ইংরিজি এস-এর ন্যায় উচ্চারণ জ ও য-এর জায়গায় ইংরিজি জেড-এর উচ্চারণ। এ হ’ল স্থানীয় বৈশিষ্ট। উত্তরবঙ্গের বিস্তির্ণ অঞ্চল জুড়ে চা-বাগিচা ও অরণ্য। চা-বাগানের শ্রমিক ও বনবস্তি অঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন ধরণের উপভাষা ব্যবহার করেন। চা-শ্রমিকদের আনা হয়েছিল ছোটনাগপুরের মালভূমি ও রাঁচির বিভিন্ন স্থান থেকে। তাই উত্তরবঙ্গে সাদরি, বোরো, রাভা, টোটো, ওরাঁও, সাঁওতাল, মুন্ডা, খেরিয়া ইত্যাদি ভাষাগুলি বহুল প্রচলিত।
লোকনাটকে, গানের ভাষায় অঞ্চল অনুযায়ী শব্দ ব্যবহারের বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। একটি নাটকেই ভাষার নানা রূপ আমরা দেখতে পাই। চরিত্রগুলির সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা প্রভাব ফেলে নাট্য উপস্থাপনে। কখনও শিষ্ট বাঙলার ব্যবহার আমরা পাই। অঞ্চল বিশেষে বাচনভঙ্গীর প্রভাবে লোকনাট্যের চরিত্রদের কথা বলার ধরণ প্রভাবিত হয়। তাঁদের নিজস্বতা বিষয়বস্তুকে আকর্ষণীয় ক’রে তোলে। অর্থাৎ ভাষা, উপভাষা ও কথ্য উপভাষার বিভিন্নতা বৈচিত্রপূর্ণ।
উত্তরবঙ্গের লোকনাট্য সহজ সরল উপস্থাপনার এক আকর্ষণীয় নাট্যকর্ম। জীবন-নির্যাস থেকে গড়ে ওঠা এক একটি নাট্যমুহূর্তকে উপভোগ করতে দেখেছি হাজার হাজার মানুষকে। আমরাও মুগ্ধ হই। জীবন বয়ে চলে সময়ের সাথে। সময়কে পাথেয় ক’রে বদলে নেয় তার গতি, মূল ধারাকে অনেকাংশে অক্ষুন্ন রেখেই। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত আবার রাতের শেষে ভোর হওয়া – বিন্যস্ত জীবনে নির্দিষ্ট থাকে আচার ও আচরণ। বয়ে চলে অবিরাম। শান্ত বয়ে চলা জীবনে হঠাৎ করেই কোনও একদিন ঘটে গেল এমন একটা কিছু, যা কিনা তরঙ্গ ছড়িয়ে দিল চারিপাশে। অন্য অনুভব দোলা দিল। হয়তো এমনই কোনও একটি ঘটনায় নাট্যবীজ অঙ্কুরিত হ’ল। ঘটনার বিশ্লেষণে উঠে এল দর্শন। অভিজ্ঞতা বাড়লো জীবনে। লোকনাট্য অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেয় অন্যের সাথে। দর্শন, জীবনচর্যায় এক অসাধারণ ঘটনা। সেখানে ব্যক্তিমানুষের ঘটনা হয়ে ওঠে সমাজের।
সমাজে ঢেউ তুললেই সে ঘটনা থেকে নাট্য নির্মাণ ঘটবে তা তো নয়। ঘটনায় নাটকীয় অনুভব থাকা প্রয়োজন। উত্তরবঙ্গের কৃষিজীবি জীবনে অবসর মেলে বেশ। বর্ষায় হাড়ভাঙা খাটুনির পর দীর্ঘ বিশ্রাম। এরপর ফসল ঘরে তোলার আনন্দে রসে মজে মন। কেউ বাঁধেন গান, কেউবা রচনা করেন সংলাপ বা কাহিনি – অনেকে মিলে মেতে ওঠেন নাট্যনির্মাণে। মুখে মুখে নাট্যঘটনা জমে ওঠে, দোতরা-বাঁশিতে খেলে সুর। কত যে ঘটনা। সংসারের কথা, অবৈধ সম্পর্কের কাহিনি, পঞ্চায়েত নীতি, রাজ্য ও দেশের পরিস্থিতি, তাৎক্ষণিক বিষয় সমূহ। কোনও উৎসব অনুষ্ঠানকে ঘিরে জমে ওঠে লোকনাট্যগুলি।
জনজীবনে সামাজিকতা, লোকাচার চলে পাশাপাশি। লোকাচার অর্থাৎ জীবনচর্যাকে কেন্দ্র ক’রে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আচার আমাদের জীবনে জড়িয়ে রয়েছে। লোকাচার এক একটি জনজাতির সংস্কৃতির পরিচয় দেয়। উত্তরবঙ্গে লোকাচার ভিত্তিক নাট্য গড়ে উঠেছে। এধরণের অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক গ্রামের আর্থিক বা সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত কোনও ব্যক্তি। রাজবংশীরা এঁদের বলেন ‘মারেঞা’ তাঁর স্ত্রী ‘মারেঞানী’। এ বিষয়ে কিছু পরে আলোচনা করছি।
উপস্থাপনের রীতি ও নাট্যবৈশিষ্টগুলির প্রতি লক্ষ্য রেখে লোকনাট্যগুলিকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন পন্ডিতগণ। একটি আনুষ্ঠানিক বা আচার ভিত্তিক লোকনাট্য ও অন্যটি অবসর বিনোদনের লোকনাট্য। আচার ভিত্তিক লোকনাট্য বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান বা আচারকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হয়। তাতে থাকে দেবতাদের গুণকীর্তন। আর অবসর বিনোদনের নাটকে উঠে আসে সমাজের বিভিন্ন ঘটনাবলী, ইতিহাস, পুরাণ ইত্যাদি। এখন অবশ্য সমাজের নানান রঙ মিশে যাচ্ছে আনুষ্ঠানিক লোকনাট্যে। বিশিষ্ট গবেষক শিশিরকুমার মজুমদার লোকনাট্যের দুটি ভাগ করেছেন। ‘অনানুষ্ঠানিক’ ও ‘আনুষ্ঠানিক’। আনুষ্ঠানিক যা লোকাচার ভিত্তিক। এই ধরণের লোকনাট্যগুলি অনুষ্ঠিত হয় তিথি মেনে। গৃহস্থের মানসিক অনুসারেও। অনানুষ্ঠানিক লোকনাট্য কোনও উৎসব বা কোনও ক্লাবের বা সংঘের উদ্যোগে হয়ে থাকে। এর কোনও নির্দিষ্ট সময় থাকে না। বর্ষার সময়টুকু বাদ দিয়ে বছরের যেকোনও সময় অনুষ্ঠিত হয়। চৈত্র মাস পর্যন্ত। তারপরেই কৃষিজীবি মানুষের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায় খুব।
আনুষ্ঠানিক লোকনাট্যগুলি হ’ল বিষহরা, চোরচুন্নী, কুশান, সত্যপীরের পালা, রাবণকাটা নাচ, জঙ গান, রামায়নি গান, জলমাঙার গান, মোখা নাচ, ঝাড়নী গান, ভাজই গানের পালা, গম্ভীরা, গমিরা খেলা ইত্যাদি ।
অনানুষ্ঠানিক লোকনাট্যগুলি হ’ল দোতারাডাঙা পালা, পালাটিয়া, নটুয়া, রাজধারী, খন, আলকাপ, দোমনী, বোলবাহি ইত্যাদি ।
উত্তরবঙ্গের মোট একুশ হাজার আটশো পঁয়ত্রিশ বর্গ কিলোমিটার এলাকার আশি শতাংশ মানুষ থাকেন গ্রামীণ এলাকায়। যাঁদের জীবন জড়িয়ে রয়েছে মাটির সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে। লোকনাট্য, নৃত্য প্রকৃতি নির্ভর। সে নির্ভরতা গড়ে উঠেছে স্বাভাবিক জীবনযাপনের ছন্দে। এখনও গ্রামগুলি প্রায় একান্নবর্তী পরিবারের মতই। সম্পর্কের গভীরতা কিছু কমেছে ঠিক, দূরত্ব বাড়েনি। এখনও পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস অটুট, যা নাগরিক জীবনে ধ্বংসের মুখে। গাঁয়ের কোনও এক বাড়িতে অনুষ্ঠান হ’লে মেতে ওঠে গোটা মহল্লা। চাষবাসের শুরুর সময় গ্রাম ঠাকুরের যে পুজো, তা করা হয় গাঁয়ের সকলে মিলেই।
লোকনাট্যের আসরের জন্য খুব বেশি কিছু আয়োজনের প্রয়োজন হয় না। কারুর বাস্তুভিটে সংলগ্ন বড় অঙ্গন বা ফসল তুলে নেওয়ার পর খালি মাঠ, গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মাঠে আসর বসে। আনুষ্ঠানিক লোকনাট্যের জন্য মাঠ পরিস্কার করে, মাটি দিয়ে সামান্য উঁচু করে সমতল করা হয় গোবর দিয়ে লেপে। চারটি বাঁশ পুঁতে তার ওপর সামিয়ানা টাঙানো হয়। ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে যায় খবর। মহিলা, পুরুষ, শিশু, বুড়ো, বুড়ি সকলে এসে জোটে । অভিনয় চলে সারারাত, একাধিক দিন। পাতও পড়ে খাওয়ার জন্য। আসরকে ঘিরে চারিপাশে বসেন দর্শক। খড়ের ওপর ত্রিপল বিছিয়ে।
সাধারণত বেশি রাতে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে চলে সারারাত। যেসব গাঁয়ে এখনও বিজলি পৌঁছয় নি সেখানে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয় অন্য উপায়ে। জেনারেটরের ব্যবস্থা করা হয়। লাউড স্পিকার ব্যবহার করা হয়। আর প্রচুর দর্শক ঘিরে থাকেন আসরকে। কখনও সে সংখ্যা দু’হাজারের কাছাকাছি!
লোকনাট্যের আসরে মূল অভিনয় স্থল থেকে একটি সরু পথ সাজঘর পর্যন্ত চলে যায়। সেপথেই কলাকুশলীগণ আসাযাওয়া করেন। অভিনয়ের স্থানটি বৃত্তাকার। একটি বড় বৃত্তের মাঝে একটি ছোট বৃত্ত। সে বৃত্তের ঠিক মাঝে বসেন বাদ্যযন্ত্রী গণ। আর বসেন ‘অধিকারী’। তিনি নির্দেশকও বটেন। তিনি অভিনয়ও করেন। ছোট বৃত্ত ও বড় বৃত্তের মাঝের যে পরিসর সেখানেই চলে অভিনয়। বড় বৃত্তের চারপাশে বসেন দর্শকেরা। মঞ্চসজ্জা নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র আচরণ, ব্যবহার ও আঙ্গিক দ্বারা ঘটনার স্থান নির্দেশ করা হয়। একই অঞ্চল কখনও জমিদারের বাড়ি, গরীবের কুড়ে, চলার রাস্তা হয়ে যায়। অভিনয় স্থল অপ্রতুল থাকে না। তাই নাট্যশিল্পীরা অভিনয় করেণ প্রাণখুলে, হাত-পা ছড়িয়ে। অভিনয় সামগ্রীও ব্যবহার করেন তাঁরা খুব সামান্য ও সাধারণ। খুব সহজেই যা মেলে। আবহ নির্মানে ব্যবহার করা হয় হারমোনিয়াম, খোল, ঢোল, দোতরা, বাঁশী, সানাই, তবলা, ডুগি, মোখা বাঁশি, করতাল ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। এখন কী-বোর্ডও ব্যবহার করা হয়। যা অনেকেই পছন্দ করেন না। বেহালা, ব্যানার ব্যবহারও খুব পুরোন।
রূপসজ্জা ও পোশাক অভিনয়ের আর একটি জরুরি বিষয়। সস্তার রঙ দিয়ে মুখে চড়া মেক-আপ করেন শিল্পীরা। প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত রঙও ব্যবহার করা হয়। পরচুল বা কৃত্রিম গোঁফ-দাড়ি প্রয়োজন হলে নিজেরাই তন্তুজাত দ্রব্য দিয়ে তৈরি করে নেন। খুব প্রয়োজন না হ’লে পোশাক ক্রয় করা হয় না। নিজেরা জোগাড় করেন কখনওবা ভাড়ায় সংগ্রহ করা হয়। সংলাপ রচিত হয় স্থানীয় কথ্য উপভাষায়। মূলত কামরূপী বাঙলা, কোটিবর্ষীয় বাঙলা, কাইথি বাঙলা, খোট্টাই ভাষা ব্যভহৃত হয়। এর পাশাপাশি শিষ্ট বাংলার প্রচলনও আছে। সবটাই নির্ভর করে দলটি কোন অঞ্চলের, নাটকটি কেমনভাবে সাজানো হয়েছে, নাট্যঘটনা বা কাহিনি কী ধরণের। সংলাপের অধিকাংশই রচিত হয় তাৎক্ষণিক, নাট্য চলাকালীন। তাই একই নাটকের প্রতিটি প্রদর্শনীতে সংলাপ বদলে বদলে যায় স্বাভাবিক ভাবেই। নাটকের মূল আদল ঠিক থাকে।
নাট্য সংলাপ উচ্চারণের সময় এক ধরণের সুরের ব্যবহার করা হয়। শব্দগুলি টেনে টেনে বলার রীতি আমরা খেয়াল করি। তা বলা হয় উচ্চস্বরে। এর কারণ অনেক মানুষের কাছে যেন কথাগুলি পৌঁছয়। আর থাকে গান। অনেক গান থাকে একটি নাটকে। এইজন্যই লোকনাট্যকে পালাগানও বলা হয়। নাট্যঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত গান তো থাকেই, আমরা দেখেছি নাট্যকাহিনির বাইরের গানও ব্যবহার করা হয়। নিজস্ব সুর তো রয়েইছে, অনেক সময়ই প্রচলিত জনপ্রিয় চলচ্চিত্র বা অন্য ধারার গানের সুরের ব্যবহারও আমরা পাই। লোকনাট্যে অংশগ্রহণকারী প্রায় প্রত্যেকেই অভিনয় যেমন করতে পারেন তেমনই পারেন গান গাইতে, বাদ্যযন্ত্র বাজাতে। এ তাঁদের সহজাত। তাঁদের আলাদা ক’রে অনুশীলনও করতে হয় না খুব বেশি। একসঙ্গে তিন চারদিন বসে নিলেই হ’ল। ফলে চাপিয়ে দেওয়া নয়, অন্তর থেকে উঠে আসে বিষয়টি। অনেক শিল্পীই আছেন অক্ষরজ্ঞানহীন, কিন্তু সমস্ত পালাটি সংলাপ গীত সহ অনর্গল আবৃত্তি করে যেতে পারেন। সারাদিন ক্ষেতে মাঠে কাজ করেন। পরিশ্রম হয় হাড়ভাঙা। রোদে পোড়েন, জলে ভেজেন, আর গান গাইতে শুরু করেন যখন বা অভিনীত চরিত্রে প্রবেশ করেন তখন অন্য মানুষ। অপরিসীম প্রাণশক্তি। অগাধ রসবোধ।
লোকনাট্য বিভিন্ন বিষয়কে ঘিরে গড়ে ওঠে। স্থানীয় ঘটনার সঙ্গে মিশে যায় রাজ্য বা দেশের আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচির কথা যেমন প্রচার করা হয় তেমনই তাঁরা সরকারের খারাপ দিক নিয়ে সমালোচনার কথাও বলতে পিছপা হন না। সেসব কথা অবলীলায় উঠে আসে। কখনও আরোপিত মনে হয় না।
এ বিষয়গুলি আলোচনার আরও কিছু অবকাশ পাবো যখন লোকনাট্যগুলি নিয়ে জেলাভিত্তিক বিস্তারের সময়। তাই এখন আমরা বেরুবো জেলা ভ্রমণে। কোচবিহার থেকে শুরু ক’রে মালদহ পর্যন্ত। সে এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team