× home হোম archive আগের ওয়েব সংখ্যা panorama ডুয়ার্স সম্পর্কে play_circle_filled ভিডিও file_download মুদ্রিত সংখ্যার পিডিএফ library_books আমাদের বইপত্র
people এখন ডুয়ার্স সম্পর্কে article শর্তাবলী security গোপনীয়তা নীতি local_shipping কুরিয়ার পদ্ধতি keyboard_return বাতিল/ফেরত পদ্ধতি dialpad যোগাযোগ
login লগইন
menu
ad01112021105753.jpg
×
সংখ্যা: জানুয়ারি, ২০২২
সম্পাদকের কলম
উত্তরের মঙ্গল কামনা
প্রদোষ রঞ্জন সাহা
পর্যটনের ডুয়ার্স
কাশ্যম কামান
নন্দিনী চক্রবর্তী অধিকারী
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
সততা ও সহকর্মীদের সখ্যতা ব্যাংকের প্রতি আমাদের দায়িত্ববোধকে অটুট রাখতো। পর্ব - ৭
প্রশান্ত নাথ চৌধুরী
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি ও সংস্কৃতির লোকজন। পর্ব - ৩
সব্যসাচী দত্ত
ধারাবাহিক উপন্যাস
ডাউন হলদিবাড়ি সুপারফাস্ট। পর্ব - ১৫
সুজিত দাস
নিয়মিত কলম
মুর্শিদাবাদ মেইল। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম ‘বইমেলা’ শুরু কিন্তু এই মুর্শিদাবাদেই
জাহির রায়হান
নিয়মিত কলম
কোচবিহার কড়চা। এক অভাগা মহকুমা শহরের নাম তুফানগঞ্জ
অমরেন্দ্র বসাক
নিয়মিত কলম
ল্যাব ডিটেকটিভ। পর্ব - ৪। খুনের অপরাধী যখন হেরে যায় মেডিক্যাল সায়েন্সের কাছে
নিখিলেশ রায়চৌধুরী
নিয়মিত কলম
আমচরিত কথা। পর্ব – ১১। খাতা কালি কলম
তনুশ্রী পাল
নিয়মিত কলম
এই ডুয়ার্স কি তোমার চেনা? এক অন্য জয়ন্তীর কথা
শৌভিক রায়
পুরানের নারী
বেদবতী সীতা
শাঁওলি দে

আমচরিত কথা। পর্ব – ১১। খাতা কালি কলম

তনুশ্রী পাল
AmcharitKatha11

তো তখন কি-বোর্ড, মাউজ আর কম্পিউটারের স্ক্রিনে ফুটে ওঠা ঝকঝকে অক্ষর তো বহুদূরের কথা ডটপেনের দাদাগিরিও ছিলনা। এই ফটাফট লেখ, কালি ফুরোলে রিফিল পাল্টে ফ্যালো বা ইউজ এন্ড থ্রো-র চক্করে আয়ু ফুরোলেই আউট, তেমন দিন আসতে ঢের দেরি। সরস্বতী পুজোয় হাতেখড়ি পর্বের পর প্রথম পেলাম স্লেট পেনসিল আরও পরে কাঠপেন্সিল খাতা আরও পরে দোয়াতে নিব ডুবিয়ে লেখার লম্বা পেন, সর্বশেষে কালিভরা কলম। দোয়াত থেকে ড্রপারে কালি নিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পেনের পেটে চালান কর তারপর লেখো। আবার পেন্সিলের ক্ষেত্রে ব্লেডে চেঁছে শিস বের করে তবে না অক্ষরের সাধনা! তা পেন্সিল বেশি সূচ্যাগ্র করতে গেলে পুনঃপুনঃ ভাঙবে এবং ছাত্রের কাজ পুনরায় সযত্নে শিস বের করার মহৎকর্মে লিপ্ত হওয়া; এভাবেই সময় বহিয়া যাবে। এবারে মাষ্টারমশাই অংক বা ক্লাসওয়ার্কের খাতা দেখতে চাইবেন এবং শূন্য পৃষ্ঠার মালিকের হাতের তালু, পিঠ ও পায়ে শপাং শপাং।  

কাচের দোয়াতে নীলরঙা কালি তাতে পেনের লম্বা নিব ডুবিয়ে লাইন টানা খাতায় লেখার মজাই ছিল আলাদা। দোকানে পাওয়া যেত ক্ষুদ্রাকৃতির গাঢ় নীলরঙা ট্যাবলেট, মা আমাদের তিন ভাইবোনকে চার পাঁচটা করে ভাগ করে দিতেন। দোয়াতে জল ভরে তাতে ট্যাবলেট গুলিয়ে খানিক অপেক্ষা, তৈরি হয়ে গেল নীল কালি। কিপ্টেমি করে দুটো ট্যাবলেট জমিয়ে রেখে দুটো দোয়াতে ফেললে কালি হবে ফ্যাকাশে, হাল্কা নীল। লেখাও হবে তেমনি, শাদা কাগজে অক্ষর তেমন স্পষ্ট ফুটবেই না। আর কপালে জুটবে বুড়া মাষ্টারমশাইয়ের কানমলা, কান ধরে ওঠবোস ইত্যাদি বিবিধ প্রকার শাস্তি সঙ্গে বিস্তর বকাবকি।

শৈশবকালে দেখা আরেকপ্রকার কালি কলম ও লেখকের কথা মনে পড়ে। ঠাকুমার সঙ্গে সেই গোস্বামী বাড়িতে অনেকবারই গেছি। চার ভিটেয় চারটি ঘর আর মাঝে তকতকে উঠোন, একধারে পরিপাটি লেপাপোঁছা তুলসীমঞ্চ, তার গা ঘেঁষে একটা হলদে রঙা করবীফুলের গাছ। বাঁশের দরজা ঠেলে সে পরিচ্ছন্ন উঠোনটিতে গিয়ে দাঁড়ালেই মনটা আনন্দে ভরে যেত। সে বাড়ির কর্তামশাই থাকতেন পুবদিকের সবচেয়ে উঁচু ভিটের ঘরটিতে। তিনি বিকেলের দিকে পুরনো পুঁথি থেকে সম্ভবত সংস্কৃত ভাষায় কিছু পাঠ করতেন তারপর বাংলায় তার ব্যাখ্যা করতেন। সে পাঠ শুনতেই ঠাকুমা এবং আরও অনেক বয়স্ক মহিলা সেবাড়িতে যেত। সেসব পাঠের কিছুই বোধগম্য হত না আমার, সে বয়স হয়নি তখন। ঠাকুমা সঙ্গী করে নিয়ে যেতেন আমি পেতাম একটা অন্যরকম পরিবেশের স্বাদ। কর্তামশাইয়ের নাতি নাতনিদের সঙ্গে লুকোচুরি এক্কাদোক্কা খেলে মহা আনন্দে সময়টুকু কেটে যেত। প্রমাণ সাইজের নিচু একটা চৌপায়ায় বসে কর্তামশাই পুঁথি থেকে পাঠ করতেন, সামনে একটা জলচৌকির ওপর ওনার নিজে হাতে তৈরি মোটা কাগজের খাতা, পৃষ্ঠাগুলো খানিক ঘিয়ে রঙের। লম্বা নিবওয়ালা লম্বাটে কলম আর দোয়াতে কালচে খয়েরি রঙের কালি। সে কালি খয়ের টয়ের আরও কিছু উপকরণ মিশিয়ে উনি নিজের হাতেই তৈরি করতেন, শুনেছিলাম। লম্বাটে পাতলা চেহারার মানুষটির পরনে একটা শাদা ফতুয়া আর খাটো ধুতি। কপালে আর কন্ঠদেশে চন্দনের ছোঁয়া। চমৎকার উচ্চারণে শান্ত ধীর গলায় তিনি কিছু পাঠ করতেন। ওনার চৌপায়ার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে দেখতাম খানিক কাঁপা হাতের লেখায় সার সার অক্ষরমালা। স্কেলের মাপজোক বা ড্রইং ছাড়াই ঠাকুমা যেমন নিখুঁত ফোঁড় তুলতেন কাঁথায় ঠিক তেমনই নিখুঁত পরিচ্ছন্ন সমমাপের অক্ষরে অক্ষরে ভরে থাকত কর্তামশাইয়ের খাতা। আজ এত যুগ পেরিয়ে এসে ভাবি কী লিখতেন বড়কর্তামশাই, কোথায় সেসব খাতা? কোনও গ্রন্থের ভাষ্য বা টীকা লিখতেন? নাকি নিজ সৃষ্ট মৌলিক শ্লোক? কে দেবে উত্তর? তবে একবার সুযোগ ঘটলে সে রচনাগুলো অবশ্যই দেখবো। খাতা কালি কলম প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে কত গুণবান মানুষের কথাই মনে পড়ে যাচ্ছে। অমন এক প্রত্যন্ত গ্রামে বসে কেমন গভীর ও নিষ্ঠ ধ্যানে জীবন কাটিয়ে গেছেন বড় কর্তামশাই!

ছোটোবেলায় রেডিমেড খাতা খুব কমই কেনা হত; দিস্তে ধরা কাগজ আসত দোকান থেকে। মোটা সুচ সুতোয় খাতা সেলাইয়ের একটা জমজমাট পর্ব চলত প্রত্যেকবার নতুন ক্লাসে ওঠবার পর। সঙ্গে থাকতেন বাবা। পরম আগ্রহে উৎসুক আমরা তাঁকে ঘিরে বসতাম। বিষয় অনুযায়ী রোগা-পাতলা, ছোটো-বড় খাতা সেলাই হত, কাগজের ভাঁজের ওপর নির্ভর করত খাতার আকার প্রকার। রাফ খাতাটি হত সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান; চৌকোনা ছোটো শাদা কাগজের টুকরোয় বাবার সুছাঁদ হাতের লেখায় ফুটে থাকত নাম, ক্লাস, রোলনং ইত্যাদি আত্মপরিচয়। ঘরে তৈরি ময়দার আঠা লিপ্ত হয়ে সগর্বে মলাটের ওপর শোভা পেত সে বয়ান। সেই বাল্যকালে কিছু না বুঝলেও এখন বুঝতে পারি পঠনপাঠনে মহা উৎসাহী, একক উপার্জনে বৃহৎ এক যৌথপরিবারের দায়িত্ব কাঁধে দেশভাগের শিকার সে মানুষটি রেডিমেড খাতা না কিনে শত ব্যস্ততার মধ্যেও কেন এত এত খাতা সেলাই করে দিতেন। যাইহোক নতুন মলাটযুক্ত বইখাতা বগলে চেপে আমরা সগর্বে স্কুলের পথে পা বাড়াতাম সদলবলে।

দোয়াত আর কালি প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট গল্প বলি শুনুন, কত কাল আগের ঘটনা কিন্তু স্মৃতির এ্যালবামে ঝকঝকে তার মজাদার উপস্থিতি। তখন প্রাইমারির ছাত্র, ক্লাস টু থ্রি হবে হয়তো। স্কুলের কী একটা ফাংশান, মাষ্টারমশাই দিদিমণিরা সব ছাত্রছাত্রীদের নাচ গান আবৃত্তি শেখাতে লাগলেন। যদিও নাচের বাসনা প্রবল কিন্তু আমার ভাগ্যে কবিতা আবৃত্তি, শেখাচ্ছেন সেই বুড়া মাষ্টারমশাই। তিনি আদৌ আমার পছন্দের তালিকায় ছিলেন না। কারণও ছিল, প্রথমত রোগা পাতলা বেঁটেখাটো মানুষটির হাতে সর্বদাই একটি পাতলা ছিপছিপে বেত এবং যত্রতত্র তার ব্যবহার। আধময়লা ধুতি পাঞ্জাবীর এখানে ওখানে নীলের ছোপ; কাছে গেলে পাওয়া যেত নস্যির গন্ধ। ময়লা মতন রুমাল বা কাপড়ের টুকরো খানিক পরেপরেই ওনার পকেট থেকে বেরুতো আর উনি সশব্দে নাক-টাক পরিস্কার করতেন। দৃশ্যটি মোটেই তেমন শোভন কিছু ছিল না। ওনার শাস্তিগুলোও ছিল ভারি উদ্ভট! বেতের দাওয়াইয়ের সঙ্গে তর্জনি দিয়ে পেটে খোঁচা, কানমলা, নিলডাউন, চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকানো ইত্যাদি ইত্যাদি। বকাঝকার সময় কঠিন কঠিন শ্লেষাত্মক বাক্য ছুঁড়ে দিতেন, যেমন আঙুল দিয়ে পেটে খোঁচা লাগিয়ে বলতেন, ‘হুম প্যাট টিমটিমা কইরা খালি ভাত খাও, হুমম। বুদ্ধিশুদ্ধি ব্যাবাক প্যাটে চইলা গেসে’। মাথায় গাট্টা মারার বদভ্যাসও ছিল, গাট্টা দিয়ে বলতেন,‘গুবোর গুবোর হ্যাঁ? গুবোর সাড়া কিসুই নাই মাথার মইদ্যে হুমম’। চুলের ঝুঁটি ধরেও ঝাঁকানি লাগাতেন। প্রতিদিন সুর করে করে নামতা পাঠ চলত স্কুলছুটির আগে। মিউজিক কম্পোজারদের মতো তার লাঠিটিও নামতার সুরের সঙ্গে এধার ওধার দুলতে থাকত আর মোটা কাচের ওপার থেকে তার ক্ষুদ্র চোখদুটি প্রতিটি ছাত্রের ঠোঁটের নড়াচড়া লক্ষ্য রাখত। মোটকথা ওনার সন্নিকটে যাওয়া মোটেই নিরাপদ ছিল না। শিশুমন এমনিতেই বড় নরম আর ভাবপ্রবণ। সেটা ওনার খেয়াল থাকত কিনা কে জানে।

যাইহোক সেই কঠিনপ্রাণ বুড়া মাষ্টারমশাইয়ের কাছে কবিতা মুখস্থ ও আবৃত্তির প্রশিক্ষণ শুরু হল। কবিতা কাজী নজরুল ইসলামের ‘খুকী ও কাঠবিড়ালি’ কবিতার আবৃত্তি শেখাতে গিয়ে মাষ্টারমশাই সত্যি খুব খুশি হয়ে উঠেছিলেন আর আমরা সব ছাত্রছাত্রীরাও যেন সেই খুশির ছোঁয়ায় বেশ হাল্কা মনে ওনার কাছে গিয়ে ঘিরে বসতে লাগলাম। ওনার খুব পুরনো কালচে মতো একটা চশমার বাক্স থাকতো পাঞ্জাবীর পকেটে, প্রথম প্রশিক্ষণের দিন থেকেই সেটি বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘নে দুইহাতে অঞ্জলি পাইতা যত্ন কইরা ধর। মনে কর তর হাতে ছুট্ট একটা কাঠবিড়াল বইসা আসে, হ্যাঁ। তুই তখন আদর কইরা তার লগে কতাবাত্তা কইতাছিস, বুজছ তো। হুমম। ক এইবার, কাঠবিড়ালি! কাঠবিড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও? / গুড়-মুড়ি খাও? দুধ-ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ? / বেড়াল-বাচ্চা? কুকুর-ছানা? তাও?/ ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক! / খাও একা পাও যেথায় যেটুক!/ তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও?/ ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার ! যাও!’ পেটে ছোট্ট খোঁচা লাগিয়ে ‘হোঁৎকা পেটুক’ শব্দের মানে যেন খানিক বুঝিয়েই দিলেন। আরও নানান অঙ্গভঙ্গি সহযোগে মহাউৎসাহে উনি আবৃত্তি শেখাতে লাগলেন। সযত্নে শিখন প্রক্রিয়া চলল। সবটা নয়, অতবড় কবিতার গোটা কয়েক স্তবক মুখস্থ করার জন্যে বলে দিলেন। স্কুল ছুটির সময় চটি বইটি হাতে দিয়ে বললেন, ‘বাড়ি নিয়া মুখস্থ করবা। লাইন কয়ডা সুন্দর কইরা খাতায় লেইখ্যা নিও। সোমবারে বইডা আমারে ফিরত দিবা। যাও গা।‘ বই নিয়ে বাড়ি ফিরি। সে বইয়ে কাঠবিড়ালির রঙিন ছবি, আরও অন্যান্য কবিতা ও ছবি। বইটি সারাক্ষণের সঙ্গী হয়ে উঠল। বাড়ির চারপাশে, পেয়ারা গাছে, জঙ্গলে, বেড়ার ধারে চক্ষুদুটি কাঠবিড়ালি খোঁজে। পাখ পাখালি, সাপ ব্যাং, গরু ছাগল, মোষ, কুকুর, বিড়াল, হাঁস, মুরগি চারিধারে কিন্তু কাঠবিড়ালির চিহ্ণও নেই! কবিতা মুখস্থ হয় না তেমন খালি কাঠবিড়ালির অনুসন্ধান জারি থাকে। বইয়ের ছবি দেখে দেখে কাঠবিড়ালি আঁকার চেষ্টা জারি থাকে।

লাল মেঝেওয়ালা সামনের বড় বারান্দায় ঠাকুমা নতুন কাঁথা পেতেছেন। বড় কাঁথার জন্যে বড় জায়গা চাই, পুরনো নরম ধুতি বা শাড়ি কয়েক প্রস্ত টানটান একেবারে সমান করে পেতে প্রথমে চারধারে সেলাই করে নিয়ে তারপর সরাসরি রানফোড়। বাড়ির আরও সব কাজ সামলে ঠাকুমা অনেকদিন ধরে একটু একটু করে একেকটা কাঁথা সেলাই করে ফেলতেন। তাঁর কাছেপিঠে ঘুরঘুর করার অভ্যাস ছিল আমাদের। তাঁর নানা কাজের সহযোগী ছিলাম বটে। যেমন এই সেলাই পর্বে শাড়ির পাড়ের সুতো তুলে লাচি বানানো। রান্নাঘরের ধারে তাঁর লাউগাছে জল, সার দেওয়া। বড় গামলায় রাখা বড়ি দেওয়ার মাসকলাই ডালবাটা একটা কাঠের বাতা দিয়ে ফেটানো। ঠাকুমা এধারে ওধারে অন্য কাজে গেলে, রোদ্দুরে শুকুতে দেওয়া ডালের বড়ি, আচার বা আমসত্ত পাহারা দেওয়া এমন আরও অনেক। তো সেদিন কাঁথা সেলাইরত ঠাকুমার সামনে নানা অঙ্গভঙ্গি সহযোগে খুকী ও কাঠবিড়ালি কবিতা শোনাচ্ছি। একবার করে বই দেখছি একবার ওই অর্ধেক রচিত কাঁথায় দাঁড়িয়ে-বসে ওই কান্ড চলছে। পাশে খাতা ও কালির দোয়াত; কেননা সেখানেও অর্ধ চিত্রিত কাঠবিড়ালি। তো এইরকম নাচাকোঁদা করতে করতে পায়ে লেগে উল্টে পড়ল কালির দোয়াত! ঠাকুমার শাদা ধবধবে কাঁথা, আমার স্বাস্থ্যবান রাফখাতা আর বুড়া মাষ্টারমশাইয়ের বই সবই সেই নীলবর্ণ শৃগালের মতো নীলবর্ণে রঞ্জিত হল মুহূর্তেই। ঠাকুমা চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘আহা রে! কী করস লো মাইয়া। বই খাতা ব্যাবাক গেল গিয়া হু। এহন কী হইব ক। তোর মায়ে পিঠের ছাল চামড়া আস্ত রাখবনি রে মাইয়া? আহা রে!‘

কালিমাখা বইটির চেহারা দেখে প্রাণপাখি উড়ে যায় আমার! শুধু মাষ্টারমশাইয়ের লিকপিকে সেই কঠিন বেতটির চেহারা চোখে ভাসে। কাল সোমবার স্কুলে গিয়ে বই ফেরৎ দেওয়ার দিন! স্কুলে যাওয়া বা পড়াশুনো করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও মনের কোনোও কোণেই আর পড়ে থাকে না। কাঠবিড়ালি হয়ে পেয়ারাগাছে উঠে বসে থাকতে ইচ্ছে করে খুব। সেই অভিশপ্ত সোমবার যথারীতি এসে হাজির হল, দুশ্চিন্তা আর আতংক তাড়িত আমি স্কুলে পৌঁছলাম। মনে করতে গিয়ে দেখি খুকী ও কাঠবিড়ালি কবিতার একটি চরণও মনে পড়ছে না! উল্টে পড়া কালির দোয়াত ও আনুষঙ্গিক সব ঘটনাই পরপর ছবির মতো চোখের ওপর ভেসে ভেসে উঠছে! যাইহোক টিফিনের পরে সে রিহার্সাল শুরু হল। একেকজন দিদিমণি ও মাষ্টারমশাই একেক দল ছাত্রকে শেখাচ্ছেন। যথাসময়ে বুড়া মাষ্টারমশাই আমাকে ডাকলেন, পা ঘসটে ঘসটে অতি ধীর পদক্ষেপে টেবিলের দিকে অগ্রসর হই, অনেক চেষ্টাতেও ‘কাঠবিড়ালি! কাঠবিড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও’ ছাড়া আর একটি লাইনও স্মরণে আসে না! ওনার হাতের বেতটি ক্রমে অস্থির হয়ে ওঠে। আমি আস্তে করে বইটি উলটে ধরে ওনাকে দিই, কারণ প্রথম পাতাটি কালিমালিপ্ত হলেও পেছনের পাতাটি পরিস্কারই ছিল। উনি বইটি সোজা করে ধরে ক্ষুব্ধনেত্রে প্রচ্ছদটি নিরীক্ষণ করে গর্জে ওঠেন, ‘হাত পাত! হাত পাইতা দাঁড়া, শয়তান মাইয়া।’ তারপর আর কী! শপাং শপাং! এবং অনুষ্ঠান হতে বিতাড়িত!

আরেকটি লেখালেখি সংক্রান্ত ঘটনার কথা বলে আজকের মতো এই পর্বের ইতি টানবো। তখন এক স্কুলে পড়াই, নিত্যযাত্রী। ঘড়ির কাঁটার তাড়নায় জীবন কাটে। ওই ব্যস্ততার মধ্যে এক অভাবিত সমস্যা দেখা দিল, উৎস এক ছাত্রের পিতা। বাস থেকে নামার পর প্রায়ই সাক্ষাৎ হয়, একগাল হেসে বলেন, ‘এখন কেমন আছেন ম্যাডাম?’ প্রেয়ার ধরার তাড়ায় ছুটতে ছুটতে একগাল হেসে জবাব দিই, ভালো ভালো, আপনি?’ উত্তর শোনবার সময় আর কোথায়? ছুটির পরেও সাক্ষাৎ পাই বাস স্ট্যান্ডে বা পথের ধারে। একগাল হেসে জানান, ম্যাডাম স্কুলের পিছনেই আমার বাড়ি, টিফিনের সময় একটু যদি আসেন খুব ভালো হয়। খুব উপকার হয় আমার। কবে আসবেন? কালকে আসেন তাহলে।‘ ‘আচ্ছা যাবোখন একদিন।‘ ‘না দিদি কালকে না হলে পরশু আসেন, আপনাকে কয়েকটি কাগজ দেখাতে চাই। দেখলেই সব বুঝবেন। আপনি সাহিত্যের মানুষ।‘ অগত্যা একদিন কলিগ বীথি ও লিলি সহ গেলাম। দিস্তা দিস্তা আধময়লা কাগজের বান্ডিল, সবই ওনার লেখা উপন্যাস! অতি অতি অতি ক্ষুদ্র ও শ্রীকৃষ্ণের মতো বাঁকা ছাঁদে দাঁড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ অক্ষরমালা। তিনি গ্রন্থ নির্মাণে উৎসুক এবং আমার সাহায্যপ্রার্থী। বাড়িতে নিয়ে এসে আমি যাতে পাঠ করি সে অনুরোধও রাখেন। গলা অব্দি শুকিয়ে কাঠ মুহূর্তেই! যাইহোক ভেবেচিন্তে শেষতক কতিপয় প্রকাশনা দপ্তরের ঠিকানা লিখে ওনার হাতে দিয়ে অনুরোধ জানাই, ‘পাঠিয়ে দিন, নিশ্চয়ই কিছু হবে। পরে আপনাকে আরও ঠিকানা দেব। আপাতত এগুলোতে চেষ্টা করুন।’

এই সংখ্যার সূচী

করোনা কালের প্রতিবেদন ফ্রি রিডিং

Disclaimer: Few pictures in this web magazine may be used from internet. We convey our sincere gratitude towards them. Information and comments in this magazine are provided by the writer/s, the Publisher/Editor assumes no responsibility or liability for comments, remarks, errors or omissions in the content.
Copyright © 2025. All rights reserved by www.EkhonDooars.com

Design & Developed by: WikiIND

Maintained by: Ekhon Dooars Team