 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             শৌভিক রায়
                                            
                                                
                                                শৌভিক রায়
                                            
                                            
                                         
                                            নদীর দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হচ্ছিলাম। প্রথম যখন নদীটি দেখি তখন জল ছিল বেশ। এখন প্রবাহ অনেকই কম। এমন নয় যে, শীতকাল বলে জল নেই। বর্ষার আর শীতের মধ্যবর্তী এই সময়ে যখন নদীরা পূর্ণ-যৌবনা, ঢলঢলে, ঠিক সেই সময়ে জয়ন্তীর এই হাল দেখে সত্যি খারাপ লাগছিল। পাশাপাশি, আর একটা হিসেব মিলছিল না। এই নদী কি সেই নদী যে ফি বছর জয়ন্তীকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়! উঠে আসে পত্রিকার শিরোনামে! বুকে পাথর নিয়ে নদীর এই শুকনো চেহারায় বিস্মিত হতেই হয় কমবেশি!
দাঁড়িয়ে আছি ডুয়ার্সের পর্যটন মানচিত্রের রানি জয়ন্তীতে। এত কথা লেখা হয়েছে জয়ন্তীকে নিয়ে যে, নতুন কথা বোধহয় সেভাবে বলবার নেই। কিন্তু জয়ন্তী বাদে ডুয়ার্স! ভাবা যায়? সেজন্যই আর একবার চেষ্টা করা, নিজের মতো জয়ন্তীকে দেখা। আর সে দেখা দেখতে গিয়ে জানতে পারছি যে, ১৮৬৫ সালে দ্বিতীয় ইঙ্গ-ভুটান যুদ্ধের পর সিনচুলা চুক্তির পর নভেম্বর মাসের ১১ তারিখ ভুটান বাংলা আর অসমের ৮৮০ বর্গকিমি জায়গা বার্ষিক ৫০০০০ টাকার বিনিময়ে সমর্পণ করে। এই এলাকার মধ্যে ছিল ভুটানিদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র মহাকালধাম। কিন্তু জয়ন্তীর দখল ছিল ভুটানের হাতেই। নিজেদের পবিত্র তীর্থস্থান পুনরুদ্ধারের চিন্তা যেমন ছিল ভুটানের, তেমনি ইংরেজরাও চাইছিল জয়ন্তীকে নিজেদের হাতে নিতে। এর পেছনে ছিল ইংরেজদের প্রবল ব্যবসা-বুদ্ধি। কেননা এই অঞ্চল যে বিশাল খনিজ ভান্ডারে পূর্ণ সে কথা ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল ১৮৬৫-৬৬ সালে গডউইন অস্টিনের রিপোর্টে। ১৮৭৫ সালে এফ আর ম্যালেটের আর একটি রিপোর্ট অস্টিনের কথাকেই সমর্থন করে। কিন্তু সে সময়ে শুধুমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে ইংরেজরা খনিজ সম্পদ সংগ্রহে আগ্রহী হয় নি। তাদের মনে তখন অন্য ভাবনা। আর এই ভাবনা থেকেই প্রমাণিত হয় যে, জয়ন্তী সে আমলে ঠিক কী ছিল।

ছবি - জয়ন্তী পাখির চোখে
জয়ন্তী সে সময় ছিল হাতি কেনাবেচার কেন্দ্র। ভারি কাজের ক্ষেত্রে বলশালী এই পশুটি ছিল মুশকিল-আসান। এদের লোভনীয় দাঁত ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। সুতরাং ব্যবসা পণ্য হিসেবে হাতির কদর ছিল আলাদা। কিন্তু মুশকিল হল, হাতি পাওয়া যেত যে অঞ্চলে, সেই জায়গাটি ছিল ভুটানের অন্তর্গত। আর সেজন্যই হাতি ধরতে গেলে নিতে হচ্ছিল ভুটানের বিশেষ অনুমতি। অতএব চলল প্রচেষ্টা। ইংরেজদের ভাগ্যলক্ষ্মী তখন সব দিক থেকেই সুপ্রসন্ন। কেননা ভুটানও চাইছিল ইংরেজদের হাত থেকে তাদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র নিজেদের হাতে নিতে। অবশেষে সে প্রচেষ্টা সফল হল ১৮৮৮ সালে। আসরে নামলেন এডওয়ার্ড ডালটন। মূলত তাঁর সুপারিশে তদানীন্তন ভারত সরকারের বিদেশ দপ্তর আজকের বক্সা দেওস্থানের পূর্বদিকের অঞ্চলটি কিনে নিলেন। ২১.৪৩ বর্গমাইলের সেই জায়গাটি নিতে তাদের খরচ হয়েছিল ১০০০০ টাকা। এই অঞ্চলটির নাম ইংরেজরা রেখেছিল জয়ন্তী ল্যান্ডস বা জৈনতি। এভাবেই জন্ম নিয়েছিল ডুয়ার্স রানি। এই সময়েই মহাকাল চলে গিয়েছিল ভুটানের দখলে। তীর্থক্ষেত্রের জন্য ইংরেজদের খুব একটা মাথাব্যথা ছিল না বলে সেদিনের দশ হাজার টাকার সঙ্গে মহাকালকেও দিয়ে তুলে দিয়েছিল তারা ভুটানের হাতে।

ছবি - জলকষ্টের জয়ন্তী
জয়ন্তীকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে হাতি কেনাবেচার ব্যস্ত ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত করতে ইংরেজদের সময় লাগে নি। তবে শুধু হাতি নয়, তাদের নজর ছিল বিপুল অরণ্য সম্পদের ওপরেও। ফলে জঙ্গল দ্রুত মুছে যেতে লাগল। যে বক্সা-জয়ন্তীতে আজও দিনের বেলায় মহীরুহদের গা-ঠেসাঠেসি করে দাঁড়িয়ে থাকায় সূর্যের আলো মাটিতে পৌঁছায় না, সেই জায়গা তবে সেকালে কী ছিল ভেবে ওঠাটাই দুষ্কর। কিন্তু বাস্তব এটাই। ১৮৯৬ সালে এইচ হেডেনের রিপোর্ট বলেছিল, জয়ন্তীতে রয়েছে লিগনাইট, ডলোমাইট এবং লৌহ তামার আকরিক। কিন্তু তবুও দীর্ঘদিন জয়ন্তীতে সেভাবে কোনও কলকারখানা দেখা যায় নি। এর কারণ সম্ভবত ডুয়ার্সের বিশেষ করে বক্সা-জয়ন্তীর দুর্ভেদ্য জঙ্গল। যাহোক, নতুন শতকে এসে কিন্তু জয়ন্তীর বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। স্থাপিত হয় কোচবিহার স্টেট রেলওয়ের জয়ন্তি-গীতালদহ রেলপথ। ১৯০১ সাল সেটি। আর এই রেলপথ স্থাপনের পূর্ণ কৃতিত্ব কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুরের। ততদিনে জয়ন্তী নদীর ওপাশে গড়ে উঠেছে চা-শিল্প। এসে গেছেন ইউরোপিয়ানরা। জয়ন্তীর কাছে-পিঠে নানা জায়গায় চা-বীজ সবুজ গাছে পরিণত হচ্ছে। বন কেটে বসত গড়ে তুলতে আর দুটি পাতা একটি কুঁড়ি তুলে ফ্যাক্টরিতে পাঠানোর কাজে ভিন রাজ্য থেকে এসে গেছে শ্রমিকেরা। তাই ভারত সরকারের অনুরোধে সাড়া দিতেই রাজাভাতখাওয়া থেকে জয়ন্তী পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছিল সেই রেলপথ। এই রেলপথ মূলত চা-শিল্পের জন্য তৈরি করা হলেও, জয়ন্তী থেকে বিশালাকার বৃক্ষদের মৃতদেহ যাত্রা শুরু করেছিল ভারতের নানা প্রান্তে ব্রিটিশদের হাত ধরে।

ছবি - জয়ন্তীর প্রজাপতি
জয়ন্তীর অবস্থা আরও বদলে গেল ট্রান বুলস, এ জে কিং আর জি সি দে প্রমুখেরা যখন জয়ন্তী নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি করলেন। এই সড়ক পথটি হয়ে গেল বক্সা জয়ন্তী সহ ডুয়ার্স যাওয়ার অন্যতম প্রধান অবলম্বন। রেলপথ, সড়কপথ ইত্যাদি সবকিছু মিলে জয়ন্তীর তখন জমজমাট অবস্থা। এখানকার সোমবারের বিরাট হাটে যোগ দিতে নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে মানুষজন আসতে শুরু করেছেন, ফলে জয়ন্তী হয়ে উঠেছে এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান জনপদ। ১৯৩২ আর ১৯৪৭ সাল দুটিও জয়ন্তীর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এই দুই বছরে যথাক্রমে বেঙ্গল লাইম এন্ড স্টোন কোম্পানি ও জয়ন্তী লাইম কোম্পানি জয়ন্তী থেকে ডলোমাইট তুলবার সরকারি সম্মতি পায়। প্রসঙ্গত ১৯৩৭, ১৯৫০ ও ১৯৫৯ সালে এই অঞ্চলের বহু গর্ভস্থ খনিজ সম্পদ নিয়ে আরও তিনটি সার্ভে করেছেন এ লাহিড়ী, ডি কে চন্দ্র ও টি কে কুরিয়ান এবং জানা গেছে, জয়ন্তী এই ব্যাপারে অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সবকিছু মিলে শিল্পে, চা-চাষে, খনিজ সম্পদ উত্তোলনে জয়ন্তী তখন উত্তরের গর্ব। জয়ন্তীকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন সবাই। চলছে বিভিন্ন উৎসব। নিয়মিত বসছে যাত্রা থিয়েটারের আসর। শোনা যাচ্ছে রবীন্দ্র-নজরুল জন্মজয়ন্তীতে কোনও কিশোরের আবৃত্তি। বিরাট দুর্গাপূজায় অংশ নিতে বহু মানুষ ছুটে আসছেন এখানে।

ছবি - জয়ন্তীর বুনো ফড়িং
কিন্তু অবস্থা পাল্টে গেল কবে যেন। আজকের জয়ন্তী মানে ২৬ মাইল কোর জংগল জিপ্সি সাফারি, পুকুরি পাহাড় এবং তাঁসিগাও নজর মিনার, ভুটিয়াবস্তি ও চুনিয়া জংগল সাফারি, ছোট এবং বড় মহাকাল গুহা। ছোট্ট এই জনপদ দেখলে কে বলবে একসময় এখানে ছিল এত কিছু! অতীতের রেলপথ বন্ধ হয়ে গেছে সেই কবে ১৯৮৬ সালে। মাঝে এই রেলপথ পুনরায় চালুর দাবি উঠেছিল। কিন্তু ১৯৮৩ সালে ব্যাঘ্র প্রকল্পের মর্যাদা পাওয়া বক্সায় এই রেলপথ চালু হওয়া বোধহয় আর সম্ভব নয়। গভীর অরণ্য গ্রাস করেছে লোহার সেই সমান্তরাল লাইনকে। বন্ধ হয়ে গেছে ডলোমাইট তোলা। অধ্যাপক অর্ণব সেন লিখেছেন, 'পাহাড়ে এখানে ডলোমাইটের বিশাল ভান্ডার। তবে ডলোমাইট তোলা নিষিদ্ধ হয়েছে। চুনাভাটির চুন-সংগ্রহও বন্ধ, পড়ে আছে নদীর ওপর পরিতক্ত্য বাংলো। পাথর তোলাও বন্ধ কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে।...১৯৯৩-এর জুলাই মাসে বন্যার দাপটে পাহাড়ের ভেঙে পড়া পাথরে নদীগর্ভ ভরাট হয়ে প্লাবনের আশংকা বাড়িয়ে দিয়েছে। সত্যি বলতে ১৯৯৩ সালের বিধ্বংসী এই বন্যাই তছনছ করে ফেলেছে প্রাচীন জয়ন্তীকে। ফলে, দেখা যায় না সেদিনের পি ডব্লিউ বাংলো, নদীর ওপর থাকা ব্রিজ। পাহাড়ের ভেঙে পড়া পাথর আর ডলোমাইট নদীবক্ষ ভরাট করে তোলায় বিপত্তি হয়েছে দুই ভাবে। নদীতে জলপ্রবাহ এমনিতে দেখা না গেলেও বর্ষাকালে নদী দুই কূল ছাপাচ্ছে। ফল, বন্যা ও বাসিন্দাদের ঘর ছাড়া হওয়া। এই মুহূর্তে জয়ন্তীর লোকসংখ্যা বারোশোর কাছাকাছি। রেভিনিউ ভিলেজের মর্যাদা পাওয়ার জন্য যা যা থাকা দরকার তার সব থাকা সত্বেও এখনও জয়ন্তী সে মর্যাদা পায় নি। জয়ন্তীর বাসিন্দা অজয় রায় লিখছেন, `রেভিনিউ ভিলেজে পরিণত হতে একটি হাই স্কুল প্রাইমারি স্কুল, প্রাইমারি হেলথ সেন্টার, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা, পি.ডব্লু.ডি. পাকা সড়ক পথ, ৫০০ জনের উপরে ভোটার, পাকা বাড়ি, তিনটের বেশি সরকারি প্রতিষ্ঠান, যাতায়াতের জন্য সরকারি ব্যবস্থা সব কিছু থাকা সত্ত্বেও আজ আমাদের জয়ন্তি গ্রাম রেভিনিউ ভিলেজ-এর আওতায় আসেনি। যদিও এই গ্রামের ২০১৪ পর্যন্ত জুডিশিয়াল লিস্ট (J L number) 45 ছিল। এখন জে এল নম্বর 45 এর পাশে জয়ন্তি গ্রামের নামের পরিবর্তে বক্সা ফরেস্ট (পানবাড়ি খন্ড) হাওয়ায় আমরা আমাদের জমি থেকে পাট্টা থেকে বঞ্চিত এবং অধিকার পাওয়ার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি।`

ছবি - পুখুরির রাক্ষুসে মাগুর
আজকের জয়ন্তীতে রয়েছে PWD-এর একটি ইনস্পেকশান বাংলো, PHE-এর ইন্সপেকশন বাংলো, বনবিভাগের বন বাংলো, CESC-এর অবকাশ বাংলো, পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের কটেজ ও একটি ধর্মশালা। ইকো ট্যুরিজমের ক্ষেত্রেও জয়ন্তী পিছিয়ে নেই। রয়েছে কমবেশি ৩৬টি হোম স্টে। এখানকার পরিবেশ আজও কসমোপলিটান। নানা বর্ণের, ভাষার, ধর্মের মানুষের বাস জয়ন্তীতে। বহু অসুবিধে নিয়েও তাঁরা মাটি কামড়ে পড়ে আছেন শুধুমাত্র জয়ন্তীকে ভালোবেসে। জয়ন্তী থেকে খানিক দূরের রাজাভাতখাওয়া, বক্সা দুর্গ ইত্যাদি সব কিছু মিলে জয়ন্তী আজও আকর্ষণীয় হলেও জয়ন্তীর কষ্ট এখনও শেষ হয় নি। কবে হবে কেউ তা জানেও না। এই ডুয়ার্স আমাদের অচেনা। জয়ন্তী-সহ ডুয়ার্সের অনন্য সৌন্দর্যে মোহিত হলেও এই ডুয়ার্স কি আপনারও চেনা?
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
