 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             নিখিলেশ রায়চৌধুরী
                                            
                                                
                                                 নিখিলেশ রায়চৌধুরী
                                            
                                            
                                         
                                            
                                        দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জার্মানি। ন্যুরেমবার্গ বিচার হয়ে গিয়েছে। দেশ দু’ ভাগ। পূর্ব জার্মানি, পশ্চিম জার্মানি। ধ্বংসস্তূপের উপর নতুন করে গড়ে উঠছে গ্যেটে-আইনস্টাইন-টমাস মানের দেশ। পশ্চিম জার্মানিতে তখন আইনশৃঙ্খলা সামলাচ্ছে আমেরিকান আর ব্রিটিশ ফৌজ। জার্মানিতে তখন ব্রিটিশ গ্যারিসনের থাকাটা খুব কষ্টকর ব্যাপার।
ফেলে-ছড়িয়ে খানাপিনার উপায় নেই। রেশনিং জারি রয়েছে। স্থানীয় মানুষ প্রায়ই প্রতিবাদে ফেটে পড়ছে। শহরগুলো বোমার আঘাতে চুরমার। ফুর্তিফার্তার কোনও সুযোগ নেই। সেনাঘাঁটিতে বউদের আর সময় কাটে না। স্বামীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যস্ত। ঘরে সময় দিতে পারে না। বউদের একঘেয়ে লাগে। বদ্ধ রুটিনে তারা হাঁফিয়ে ওঠে।
এই বদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় কারও কারও বউ ভাবল— মুখ বদলালে ক্ষতি কী? ব্রিটিশ সার্জেন্ট ফ্রেডরিক এমেট ডান পতঙ্গ হয়ে এমনই এক বহ্নিতে ঝাঁপ দিল। ফল সেই শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যোমকেশের গল্প ‘বহ্নিপতঙ্গে’র মতোই। খুন। খুন করে সার্জেন্ট ভেবেছিল, বেঁচে যাবে। কেউ ধরতে পারবে না। কিন্তু ১৫ মাস বাদে মাটি খুঁড়ে মৃতের কফিন তোলা হল। তখনও লাশে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ক্লু মিলল। নতুন করে ফোরেনসিক বিশেষজ্ঞ সেগুলো পরীক্ষা করলেন। এমেট ডানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল।
১৯৫৩ সালের পয়লা ডিসেম্বর ভোরবেলায় ডুইসবার্গের গ্ল্যামারগান ব্যারাকে সার্জেন্ট আর্নি ওয়াটার্সকে ঝুলতে দেখা গেল। ঝুলন্ত ওয়াটার্সকে প্রথম ‘দেখতে পায়’ সার্জেন্ট এমেট ডান। নিরপরাধ বোঝানোর জন্য সঙ্গে আর একজনকে নিয়ে গিয়েছিল এমেট। দেখলে মনে হয় আত্মহত্যা। একটা বালতি কাত হয়ে মাটিতে উলটে পড়ে আছে। মৃত ওয়াটার্স বালতির উপর দাঁড়িয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়েছে। তার পর লাথি মেরে বালতিটা সরিয়ে ঝুলে পড়েছে। গলায় দড়ি শক্ত হয়ে চেপে বসেছে।
আর্মি ইনকোয়েস্টের পর সেনাবাহিনী তদন্ত করল। তদন্ত রিপোর্টে বলা হল, মানসিক চাপ থেকেই আত্মহত্যা। যদিও সাক্ষীরা সকলেই বলল, সার্জেন্ট আর্নি ফুর্তিবাজ ছেলে ছিল। সব সময় উৎফুল্ল মেজাজেই তাকে দেখা যেত। কখনও কেউ তাকে উদ্বিগ্ন দেখেনি। তার পয়সাকড়ির টানাটানি ছিল না। লুকিয়ে রাখার মতো কোনও কেচ্ছাও তার জীবনে ছিল না। দক্ষ সৈনিক ছিল আর্নি। সেই জন্য সকলেই তাকে ভালবাসত।
তাও আর্নি আত্মহত্যা করল? কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর মিলল না। সেনাবাহিনীর প্যাথোলজিস্ট ডাঃ অ্যালান ওরম্যাক তাঁর ময়না তদন্তের রিপোর্টে জানালেন, গলায় ফাঁস বসেই মৃত্যু হয়েছে। থাইরয়েডের নীচেই গলায় যে ক্রিকয়েড হাড় থাকে তা ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু প্যাথোলজিস্টের রিপোর্টে গলদ ছিল। খুনি কে, জানাই গেল না।
২
তবু খুন করে পার পাওয়া কি অতই সোজা? ইনকোয়েস্ট রিপোর্টের কালি শুকাতে না-শুকাতেই এমেট ডান-ই সার্জেন্ট রেজিন্যাল্ড আর্নি ওয়াটার্সকে হত্যা করেছে, এমন একটা কানাঘুসো ব্যারাকে ছড়িয়ে পড়ল। বেশ কিছু দিন ধরেই সেনাঘাঁটির অন্য ফৌজিদের বউরা এমেট ডানের কেচ্ছা নিয়ে ফিসফাস করছিল। ওয়াটার্স যখন তার কোয়ার্টার্সে থাকে না তখন তার বউয়ের কাছে এমেট ডান যায়। আর্নির বউ জার্মান মেয়ে। নাম মিয়া। স্বামী ডিউটিতে গেলেই এমেট ডানের সঙ্গে মিয়া বেরিয়ে পড়ে। কখনও সিনেমা দেখতে যায়। কখনও শহর ছাড়িয়ে পিকনিক করতে।
যখন নাচের পার্টি হয়, কিংবা কোনও সামাজিক অনুষ্ঠান, এমেট ডান আর মিয়া ওয়াটার্সের গা-ঘেঁসাঘেঁসি দেখে অন্যদের মধ্যে জোর গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফুসুর। মেসের টেবিলে ডিনারের সময় এ ওর দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকে।
ইনকোয়েস্টের সময় এ সব নিয়ে কথা ওঠেনি। কিন্তু ওয়াটার্স কবরে যাওয়ার ছ’ মাস বাদেই সার্জেন্ট এমেট ডান তার বিধবাকে বিয়ে করে ফেলল। তা নিয়ে সেনাশিবিরে কেচ্ছা চরমে উঠল। ‘আমি তোমায় বলে ছিলাম না...’ ইত্যাদি। কিছু দিনের মধ্যেই তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছাল।
তাঁরা বৈঠকে বসলেন। সিদ্ধান্তে এলেন, প্রথমবারের ইনকোয়েস্ট বা শব ব্যবচ্ছেদের তদন্ত রিপোর্ট হয়তো খুব তাড়াহুড়োয় করা হয়েছিল। এমেট ডানের সঙ্গে রেজিন্যাল্ডের বিধবার বিয়ে নিয়ে বেশ কয়েকটি নামহীন চিঠিও তাঁরা পেয়েছিলেন। সামরিক দফতর (ওয়ার অফিস) এবং স্বরাষ্ট্র দফতরের (হোম অফিস) সঙ্গে কথা বলে সেনাবাহিনীকে জানানো হল, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড কেসটা হাতে নিয়েছে।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দু’জন গোয়েন্দাকে নিয়ে জার্মানিতে হাজির হলেন ডাঃ ফ্রান্সিস ক্যাম্পস। ডাঃ ক্যাম্পস হোম অফিসের বিখ্যাত প্যাথোলজিস্ট। এমেট ডান আর তার নববধূ তত দিনে ব্রিটেনে ফিরে গিয়েছে। খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৫ মাস আগে।
পুলিশ খুনের প্রমাণ চায়। কোনও গুজবের উপর আদালতে মামলা টেঁকে না। সামরিক কিংবা অসামরিক, কোনও আদালতই গুজবে বিশ্বাস করে না। ঘটনা সত্য কি না, তারা তার প্রমাণ চায়।
৩
ইংল্যান্ডের সমারসেটে এমেট ডান তখন নতুন বউকে নিয়ে ঘর বেঁধেছে। জার্মানিতে কবর থেকে আর্নি ওয়াটার্সের মৃতদেহ তোলা হল। সমারসেটে পুলিশ এমেট ডানকে জেরা শুরু করল। বিয়ের আগে মিসেস ওয়াটার্সের সঙ্গে তার কী রকম সম্পর্ক ছিল? এমেট ডান আঁচ করতে পারল, প্রশ্ন কোন দিকে গড়াচ্ছে। এমেট খেপে ‘বিপ্লবী’ হয়ে গেল। সে গলার শির ফুলিয়ে চেঁচাতে থাকল: “ভিক্টোরিয়ান ছুৎমার্গ মেনে বৈধব্য ঘোচার আগেই মিসেস ওয়াটার্সকে বিয়ে করেছি, এটাই কি আমার অপরাধ?” অনেক লোকই বলছে, সার্জেন্ট আর্নির মৃত্যুর আগে থেকেই মিসেস ওয়াটার্সের সঙ্গে সার্জেন্ট এমেট ডানের সম্পর্ক ছিল। তারা বলছে, আর্নি আত্মহত্যা করতে পারে না। কিন্তু তাদের কথার উপর ভিত্তি করে তো আর এমেট ডানকে খুনি বলে গ্রেফতার করা যায় না। পুলিশের হাতে নিশ্চিত কোনও প্রমাণ নেই।
খুনের প্রমাণ মেলে কি না, আর্নির লাশ তুলে পরীক্ষা শুরু করলেন ডাঃ ক্যাম্পস। আর্নির লাশ তত দিনে পচে গিয়েছে। মাংস খসে পড়েছে। প্রথম ময়না তদন্ত করেছিলেন ডাঃ ওরম্যাক। তিনিও দক্ষ, কর্তব্যনিষ্ঠ প্যাথোলজিস্ট। কিন্তু নতুন পরীক্ষায় দেখা গেল— শ্বাসরোধই মৃত্যুর কারণ, ভেবে তিনি ভুল করেছিলেন।
সেনা মর্গে আর্নির দেহ নিয়ে নতুন করে পরীক্ষা চালালেন ডাঃ ক্যাম্পস। লাশ কাটার টেবিলে তাঁর একাগ্রতা আর পরিশ্রম দেখে সবাই স্তম্ভিত হয়ে গেল। আর্নি ওয়াটার্সের মৃত্যুর কারণ তিনি বের করে ফেললেন।
ডাঃ ক্যাম্পস দেখলেন, আর্নির ভয়েস বক্স বা স্বরযন্ত্রে রক্ত জমে আছে। ল্যারিংক্সের ছোট হাড়গুলো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। মুরগির হাড়ের টুকরোর মতো একটা একটা করে তিনি সেগুলো তুললেন। দড়ির ফাঁসে এই হাড় টুকরো হতে পারে না। হঠাৎ করে হাত চালালে কিংবা ভোঁতা কোনও বস্তু দিয়ে আঘাত করলে এই অবস্থা হতে পারে। ফোরেনসিক বিশেষজ্ঞ হিসাবে তিনি সিদ্ধান্তে এলেন, সশস্ত্র বাহিনীর স্পেশালিস্ট কিংবা কমান্ডো প্রশিক্ষণ যাদের থাকে তারাই এভাবে আঘাত করতে পারে। শ্বাসনালীতে রক্তক্ষরণে কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যু।
এই কেস নিয়ে স্টাডি করেছিলেন জন রোলান্ড। ১৯৫৮ সালে তাঁর ‘মোর ক্রিমিনাল ফাইলস’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। তাতে রোলান্ড লিখছেন: “এমেট ডান মামলার সরকারি আইনজীবী ছিলেন মারভিন গ্রিফিথ-জোনস। তিনি মামলা সাজাতে গিয়ে দেখালেন, অত্যন্ত যত্ন নিয়ে, খুঁটিয়ে পরীক্ষা চালালেও ডাঃ ওরম্যাক তুলনামূলক ভাবে অনভিজ্ঞ প্যাথোলজিস্ট। তথ্যের বর্ণনা দিতে তাই তাঁর ভুল হয়েছে।
“ডাঃ ক্যাম্পস কবর খুঁড়ে লাশ তোলার দায়িত্বে ছিলেন। নতুন করে সেই লাশ তিনি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন। তাতে নিশ্চিন্ত হন, ঝোলার পর শ্বাসরোধের কারণে সার্জেন্টের মৃত্যু হয়নি। মৃত্যু ঘটেছে অকস্মাৎ এক মারাত্মক আঘাতে। খুনি সামনে থেকে ওয়াটার্সের কণ্ঠনালীতে করেছে। তার হাতেই আর্নি ওয়াটার্সের মৃত্যু হয়েছে।”
১৯৫৫ সালের এপ্রিলে পুলিশ দেখল, তাদের হাতে যা প্রমাণ আছে তাতে কেসটা ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে। ফোরেনসিক পরীক্ষা এত নিখুঁতভাবে করা হয়েছে, তাতে এমেট ডানের বিরুদ্ধে খুনের মামলা সাজাতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। সারকামস্টানশিয়াল বা পারিপার্শ্বিক প্রমাণের সঙ্গে তখনকার সেরা ফোরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডাঃ ক্যাম্পসের অকাট্য জবানবন্দি সুন্দরভাবে খাপ খেয়ে গিয়েছে।
এমেট ডানকে ব্রিটেন থেকে জার্মানিতে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল। ১৯৫৫ সালের ১৫ এপ্রিল তাকে সামরিক আদালতে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হল। ডুসেলডর্ফে ২৭ জুন থেকে শুনানি শুরু হল। কোন ঘটনার সূত্রে কীভাবে খুনটা হয়েছে, সরকারি আইনজীবী গ্রিফিথ-জোনস সংক্ষেপে তা তুলে ধরলেন। তিনি বিচারপতিকে জানালেন, ১৯৫২ সালের শেষ থেকে মিসেস ওয়াটার্সের সঙ্গে এমেট জোনসের অভিসার শুরু হয়। আর্নি ওয়াটার্সের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তা চলে।
মিসেস ওয়াটার্স যখন আর্নির সঙ্গে দাম্পত্য জীবন যাপন করছেন তখন মিসেস ওয়াটার্সের সঙ্গে অভিযুক্তের আচরণ কেমন ছিল, তার উপর কেসটা দাঁড় করালেন গ্রিফিথ-জোনস। আদালতে তিনি বললেন, সার্জেন্ট ওয়াটার্স যখন বাইরে ডিউটিতে যেত তখন এমেট ডান শিবিরে থেকে যেত। মিয়ার সঙ্গে তার দেখা হত। মিসেস ওয়াটার্সের সঙ্গে পিকনিক করতে গ্রামে যেত। সেনাশিবিরের টেলিফোন রেকর্ড তুলে গ্রিফিথ-জোনস দেখালেন, ডিউটি রোস্টার অনুযায়ী মিসেস ওয়াটার্সের স্বামী যখন ডিউটির কাজে অন্যত্র, মিসেস ওয়াটার্স কোয়ার্টার্সে একা তখন সেই কোয়ার্টার্স থেকে ঘন ঘন ফোন করা হয়েছে কিংবা সেখানে ঘন ঘন ফোন গিয়েছে। আদালতকে গ্রিফিথ-জোনস জানালেন, “সার্জেন্ট ব্রাউনিকে তখনই এমেট ডান বলেছিল ব্যারাকে এমন একজন আছে যার স্ত্রী ভালো নয়। তার স্ত্রীর যদি হুঁশ না-ফেরে, তাহলে সে আত্মহত্যা করতে পারে। আশা করি, আদালত হয়তো এটা খেয়াল রাখবে অভিযুক্ত এমেট ডান যখন এই বিবৃতি দিয়েছিল তখনই সে একটা জাল আত্মহত্যার চক্রান্ত ছকে ফেলেছে।”
৪
ডাঃ ক্যাম্পস আদালতে কয়েকজন সেনা অফিসারকে তলব করতে বললেন। তারা খালি হাতে লড়তে পারে। মার্শাল আর্ট জানে। বিনা অস্ত্রে যে কাউকে মেরে ফেলার প্রশিক্ষণ তারা পেয়েছে। ডাঃ ক্যাম্পস আদালতে জানালেন, “আমার মনে হয়, খুনি যখন ওয়াটার্সকে মেরেছিল তখন সে তার পাশে বসেছিল। হয় কোনও চেয়ারে, কিংবা গাড়ির সিটে।” এমেট ডানের পক্ষে দাঁড়িয়ে ছিলেন কুইনস কাউন্সেল ডেরেক কার্টিস-ব্রাউন। খালি হাতে কীভাবে মারা যায়, আদালতে সেনা অফিসাররা সেটা দেখানোর পর তিনি বললেন, “আমি আপনার থিওরি কিছুটা বুঝতে পারছি।” ডাঃ ক্যাম্পস জবাব দিলেন, “এটা থিওরি নয়। এটা পরিষ্কার মেকানিক্স। ফলিত বিজ্ঞান।”
কীভাবে আর্নি ওয়াটার্সের কণ্ঠনালীতে আঘাত করা হয়েছিল, আদালতে ডাঃ ক্যাম্পস সুন্দরভাবে তার বর্ণনা দিলেন। কবর থেকে লাশ তোলার পর কীভাবে তিনি তা আবিষ্কার করলেন, তাও বললেন। এমেট ডানের নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার আর উপায় রইল না। সে-ই প্রথম লাশ ঝুলতে দেখেছে বলার বদলে এবার এমেট ডান বলল, ওয়াটার্স তাকে রিভলভার নিয়ে ভয় দেখাচ্ছিল।
আদালতে এমেট ডানের আইনজীবী কার্টিস-ব্রাউন বললেন, “একটা .৩৮ পিস্তল নিয়ে ওয়াটার্স অভিযুক্তকে শাসাচ্ছিল। বলেছিল, ‘ব্যারাকে তুমিই সব থেকে দাম্ভিক আর ধৃষ্ট (টু বিগ অ্যান্ড টু ককি)।’ এমেট ডান ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল, ওয়াটার্স গুলি করবে। বাঁচার জন্য সে আঘাত করে। ওয়াটার্স মারা যায়। ওয়াটার্সকে মারা যেতে দেখে এমেট আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে আত্মহত্যার ঘটনা সাজায়।”
সামরিক বিধিনিয়ম অনুসারে কোর্ট মার্শালের তিন দিন পরে অভিযুক্ত এমেট ডান আত্মপক্ষ সমর্থন করতে কাঠগড়ায় উঠল। ৩৪ বছরের এমেট বলল, “সামরিক কাজে সে যখন বাইরে ছিল তখন আমি তার বউকে নিয়ে কোলনে কাটিয়েছি, এই অভিযোগ তুলেছিল ওয়াটার্স। আমি তাকে বলেছিলাম, সে তার এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে কথা বলছে। আমার আর মিয়ার মধ্যে ভালোবাসার কোনও সম্পর্ক নেই। পরে ইংল্যান্ডে দেখা হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়। আমরা ভালো বন্ধু ছিলাম। একসঙ্গে নাচতাম, এই পর্যন্ত।
“সরকারি কৌঁসুলি যা বলতে চাইছেন তার সঙ্গে সত্যের কোনও সম্পর্ক নেই।”
কিন্তু সে তখন ভাবেনি এই মামলায় সাক্ষ্য দিতে উঠবে তার এক সৎ ভাই, রোনাল্ড এমেট। ডুইসবার্গে রোনাল্ড এমেট গ্ল্যামারগান ব্যারাকের আর এক দিকে থাকত।
একেবারে লাস্ট মিনিটে তার আবির্ভাব ঘটল। রোনাল্ড আদালতে দাঁড়িয়ে বলল, খুনের দিন রাত আটটায় এমেট তার সঙ্গে দেখা করে। বলে, কথা কাটাকাটির উত্তেজনায় সে একজনকে হত্যা করেছে। রোনাল্ড যেন তাকে বাঁচায়। খুনের তদন্ত শুরু হলে যেন বলে এমেট ডান তার সঙ্গেই সারা সন্ধে কাটিয়েছে। এর পর ব্যারাক ব্লকের প্রবেশপথের কাছে সে রোনাল্ড এমেটকে নিয়ে যায়। এমেটের সঙ্গে সেখানে পৌঁছে রোনাল্ড দেখে, ঢিলেঢালা হাতাহীন বহির্বাস বা ‘কেপ’ দিয়ে সার্জেন্ট আর্নি ওয়াটার্সের মরদেহ সেখানে ঢাকা দেওয়া। এর পর আদালতে রোনাল্ড এমেটের জবানবন্দি এ রকম : “ও বলল, আমরা যদি ওকে ঝুলিয়ে দিতে পারি, তাহলে আত্মহত্যা বলে দেখানো যাবে।
“আমি রাজি হলাম না। ঘুমাতে গেলাম। এই প্রথম আমি এ কথা বললাম। আজ পর্যন্ত আর কাউকে বলিনি।”
কেন নিজে থেকে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল এমেট ডানের সৎ ভাই? আর্নি ওয়াটার্সের লাশ যখন কবর খুঁড়ে তোলা হল এবং তার গলায় আঘাতের চিহ্ন মিলল, ব্যারাকে তার খবর পেয়েছিল রোনাল্ড এমেট। এমেট ডান তত দিনে ইংল্যান্ডের চেশায়ারে তার বাড়িতে চলে গিয়েছে। বাকিটা জানা যাক সাক্ষী রোনাল্ডের বয়ান থেকে : “আমাকে সেই রাতে বলা হয়েছিল, এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়ে আর্নি মারা গিয়েছে। কিন্তু ডাঃ ক্যাম্পস বললেন, গলায় আঘাত করা হয়েছে। কোনও অ্যাক্সিডেন্ট নয়। বুঝতে পারলাম, মুখ খোলা ছাড়া উপায় নেই। ঘটনার গতিপ্রকৃতিতে অনুভব করলাম, গোটা বিষয়টা আমাকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জানাতেই হবে।”
জার্মানিতে আর্মি ট্রাইবুনাল ফ্রেডরিক এমেট ডানকে দোষী সাব্যস্ত করল। এমেট ডানের কপাল ভালো। ব্রিটেনে তখনও মৃত্যুদণ্ড বহাল ছিল। জার্মানিতে ছিল না। তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল। দণ্ডদানের পর তাকে ব্রিটেনে পাঠানো হল। সেখানে হাই-সিকিউরিটি প্রিজনে অন্য খুনি, ডাকাত, ধর্ষণকারীদের সঙ্গে এমেট ডান জেলবন্দি হল।
মিয়া অবশ্য সব সময় এমেট ডানের পক্ষে ছিল। তার মতে, এমেট ডান নিরপরাধ। সে নিশ্চিত, কোনও ভাবে হঠাৎ করে লেগে গিয়েছিল। এমেট খুন করতে চায়নি। কিন্তু মামলায় যে প্রমাণ ডাঃ এমেট ডান পেশ করেছিলেন তা এতই জোরালো ছিল যে, মিয়া এমেট ডানের নাকি কান্নায় জুরিরা কান দেননি।
৫
ব্রিটেনে ফিরে মার্জনা চেয়ে তৎকালীন সরকার এবং খোদ রানির কাছে বার বার আবেদন জানাল এমেট ডান। কিন্তু তার আবেদনে কেউ সাড়া দিল না।
এমেট ডান মামলা ক্রিমিনাল প্যাথোলজিস্ট এবং ফোরেনসিক এক্সপার্টদের চোখে একটি আদর্শ মামলা।
ক্রাইম রাইটার জর্জ ক্রোসেন লিখছেন : “এমেট ডান আর মিয়া যদি তাদের পরকীয়ায় আর একটু হুঁশিয়ার থাকত, তাহলে আর্নি ওয়াটার্সের মৃতদেহ কোনও দিনই কবর থেকে উঠত না। আর মৃতদেহ যদি তোলা না হত, এক বারের মরণ মারে যে তার মৃত্যু হয়েছে, ডাঃ ক্যাম্পস সেই ক্লু খুঁজে বের করার সুষোগও পেতেন না।
“ডাঃ ক্যাম্পস যদি এক বারের মরণ আঘাতের ক্লু খুঁজে না পেতেন, তাহলে এমেট ডান ধরা পড়ত কি না সন্দেহ। ক্রাইমের ভাষায় যাকে বলে পারফেক্ট মার্ডার, তাই ক’রে এমেট ডান ভাল তবিয়তে ইংল্যান্ডে নতুন দাম্পত্য জীবন কাটাত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে একটি মেডিকেল সায়েন্সের কাছে হেরে গেল। এই বিজ্ঞান তার চাইতে অনেক অনেক বেশি নির্ভুল।”
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
