এমনটা হবে আশাই করে নি কেউ। মেলামেশা তো বাড়ছিল উৎসব মরসুমের সেই গোড়া থেকেই। কিন্তু তৃতীয় ঢেউয়ের আশংকা যখন পুজো বা দিওয়ালির পরেও বাস্তবে দেখা দিল না তখন খানিকটা নিশ্চিন্তির হাওয়া বয়ে গিয়েছিল মনে। তাই শীতের আমেজে নতুন বছরকে আহবান জানাতে এবং অতিমারি জয়ের উদযাপন করতেই যেন মানুষের ঢল নেমেছিল পথে। সেই সুযোগে নখদন্তহীন হয়েও ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল অনবধানতায়। নতুন শতাব্দীতে মিডিয়ার ক্রমহ্রাসমান বিশ্বাসযোগ্যতার ফলেই গণমাধ্যমের আগাম সতর্কীকরণকে সেভাবে পাত্তা দিতে চায় নি মানুষ। চেতনা ফিরল সরকারি বিধিনিষেধ লাগু হবার পর, সংক্রমণ ততদিনে যথেষ্ট বিস্তার লাভ করেছে। রাস্তাঘাট ফের ফাঁকা হতে শুরু করল। ঘরে ঘরে সর্দিকাশি-জ্বর-মাথাব্যথা এই মরসুমের অতি পরিচিত উপসর্গ হলেও ‘পজিটিভ’ তকমা এবং স্থানীয় ক্লিনিকগুলিতে ডাক্তারের অনুপস্থিতি তার গম্ভীরতাকে বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে। টেস্ট বাড়ছে, স্বভাবতই পজিটিভ-এর অঙ্ক বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। এর শেষ কবে কেউ জানে না। দোকানপাট দিনমজুর ফের বিক্রয়হীন খাবি খাচ্ছে, আরটিপিসিআর প্যাথল্যাবের আবার রমরমা বাড়ছে, আর নিউজ চ্যানেলের অন্তহীন আলোচনাচক্রের সঙ্গে অব্যাহত আছে ভোট চাইবার মিছিল। নতুন বছরের সূচনাতেই এইসব পুরনো অপ্রীতিকর চিত্র কি আশা করেছিল কেউ?
সংক্রমণ সেভাবে না ছড়ালেও মন খারাপের হাওয়া পৌঁছে গেছে বাংলার উত্তরে। দীর্ঘদিন পরে ধীরে ধীরে আবার জমে উঠছিল হিমালয়-তরাই-ডুয়ার্সের পর্যটন। পাহাড়ে বরফের খবরে রোমাঞ্চিত মধ্যবিত্ত পরিবার ছুটছিল সবুজের মাঝে গিয়ে একটু মুক্তির স্বাদ নিতে। দুটো পয়সার মুখ দেখতে শুরু করেছিল উত্তরের পর্যটন নির্ভর দরিদ্র মানুষগুলি। হঠাৎ করে তাদের মুখের ওপর যেন কেউ শাটার নামিয়ে দিল দুম করে। সবচেয়ে সহজ কাজ কিন্তু এই বন্ধ করে দেওয়া। যেমন একসময় কথায় কথায় পাহাড় বনধ হতো! এই ভরা মরসুমে সাধারণ মানুষগুলির পেট চালাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণমূলক পর্যটনের প্রস্তাব বা দাবি কেন আসে না সেইসব পাহাড়ী ‘বিপ্লবী’দের কাছ থেকে? একটি পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের বিপন্ন অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য তাদের একটি বাক্যও খরচ হয় না, কেন? কোন গুহায় মৌনী সাধুবাবা হয়ে ঢুকে পড়েছেন সেইসব পাহাড়ী ‘সিংহ’ বা আদি জনজাতির আগুনখেকো নেতারা? আসলে তাঁদের ‘বিপ্লব’ যে কখনই উত্তরের বঞ্চনার প্রতিবাদে বা উন্নয়নের জন্য ছিল না, তা ছিল আখের গোছাবার জন্য, সেই সত্য আজ উত্তরের মানুষগুলির কাছে পরিস্কার। উত্তরের পাহাড়-নদী-অরণ্য-চাবাগানের বহুদিনের কান্না তাই আজ মোবাইল ফোনে দুঃস্থ হোমস্টে মালিক বা ভাড়া গাড়ির ড্রাইভারের করুণ প্রশ্ন হয়ে ভেসে আসে, সুদিন কি আমাদের আর আসবে না কোনোদিনও, দাজু?
উত্তরের মানুষের কারুরই এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। যেমন তার জানা নেই, উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক সম্পদের কোনোদিন সঠিক ব্যবহার হবে কিনা! চা বাগান সমস্যার কোনো সমাধান সূত্র মিলবে কিনা! ইকো পর্যটনের স্বার্থে কোনো পরিবেশ বান্ধব পরিবহন পরিকল্পনা, পরিকাঠামো উন্নয়ন ও ইকোপর্যটনের গাইডলাইন তৈরি হবে কিনা! উত্তরের নদী ও জঙ্গল সংরক্ষণে সাস্টেনেবল প্রজেক্ট বা টাস্ক ফোর্স গঠন হবে কিনা! পাট রেশম বেত বাঁশ নির্ভর হস্তশিল্পের জন্য কিংবা আম আনারস ম্যান্ডারিন কমলালেবুর মতো অত্যন্ত লাভজনক অর্থকরী ফসলের জন্য উপযুক্ত বিপণন সহায়তা মিলবে কিনা! আদি জনজাতির জন্য সঠিক শিক্ষাক্রম হবে কিনা! উত্তরের লোকশিল্প ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও প্রসারে উদ্যোগ নেওয়া হবে কিনা! মালদহ কোচবিহার বালুরঘাটের বিমানবন্দর থেকে আদৌ উড়ান চালু হবে কিনা!
এরকম আরো অজস্র প্রশ্নের উত্তর আর আশা করে না উত্তরের মানুষ। সে জানে এমন করেই আশাহীনতার মাঝে নির্বিকার আরেকটা নতুন বছর কাটবে তার। স্বাধীনতার একশ বছর পেরিয়েও তার নিয়তি অপরিবর্তিত থাকবে এমনটাই ধরে নিয়েছে সে। তবু শত দুঃখ ক্লেশ হতাশার মাঝে সূর্যোদয়ের এক মুক্ত অনাবিল আদিগন্ত আকাশ নিয়ে সে আমন্ত্রণ জানায় পরিযায়ীদের। তামাম বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মঙ্গল কামনা করে পদ্মসম্ভবার হিমালয়।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team