পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত পড়লে জানা যায় সেখানকার বিভিন্ন চরিত্র ও তাঁদের পূর্বজন্মের কথা। বেশিরভাগ চরিত্রই বিভিন্ন কালে তাঁদের নানারকম কর্মফলের কারণে বিভিন্ন নামে জন্ম লাভ করেছিলেন। প্রতিটি চরিত্রই তাঁদের আগের বা পরের জন্মের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। বেদবতী তাঁদেরই মধ্যে অন্যতমা।
রামায়ণ শুরুর অনেক অনেক বছর আগে দশানন রাবণ একবার ত্রিভুবন জয়ের সংকল্প করেন ও কুবেরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। যক্ষেরা তা টের পেলে কুবেরকে জানায় এবং দু-পক্ষের তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। প্রবল লড়াইয়ের পর দশানন কুবেরের শিরোদেশে গদা দিয়ে আঘাত করলে কুবেরের পরাজয় হয়। দশানন তখন তাঁর জয়ের চিহ্ন স্বরূপ কুবেরের অপূর্ব পুষ্পকরথটি গ্রহণ করেন। পুষ্পকটি নির্মাণ করেছিলেন বিশ্বকর্মা।
কিছুদূর চলার পরই পুষ্পকটি তার গতিরোধ করে আর এক পা-ও এগোয় না। রাবণ ক্রুব্ধ হন, মন্ত্রীদের কাছে কারণ জানতে চান। মারীচ তখন রাবণকে জানান, ধনপতি কুবেরই এ রথ চালাত। এখন যেহেতু রাবণ চালাচ্ছেন তাই হয়ত রথটি আর চলছে না।
সেসময় ওখানে উপস্থিত ছিল কৃষ্ণপিঙ্গল মূর্তি মহাবল শিব অনুচর, নন্দী। রাবণের রাগ অনুমান করে নন্দী জানালেন ভগবান শঙ্কর দেবী পার্বতীর সঙ্গে ক্রীড়ারত, তাই এই রথের গতিরুদ্ধ হয়েছে। সেই মুহূর্তে কারোরই ক্ষমতা নেই ওই পথ অতিক্রম করে।
রাবণের রাগ আরও বেড়ে যায়। তিনি রাগে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে বলে ওঠে, কে এই শঙ্কর? সেই সঙ্গে নন্দীর বানরমুখ দেখে তাঁকেও বিদ্রুপ করতে ছাড়ে না। নন্দী তখন রাবণকে অভিশাপ দেন একদিন নিজের কর্মফলেই রাবণ ধ্বংস হবে আর তাঁকে ও তাঁর কুলকে ধ্বংস করার জন্য জন্ম নেবে হাজার হাজার বানর। নন্দীর কথা শুনে রাবণের মন্ত্রীরা সব আর্তনাদ করে ওঠে, বলে শিবের তপস্যা করতে। রাবণ হাজার বছর স্তব করলে মহাদেব প্রসন্ন হন এবং একটি চন্দ্রহাস নামে খড়গ প্রদান করে বলেন যে এর সাহায্যে তিনি বাকী জীবন নির্বিঘ্নে কাটাতে পারবেন। কিন্তু ওটি হাতছাড়া হলে তা আবার শিবের কাছেই ফিরে যাবে। দশানন ভীমনাদে গর্জন করেছিলেন বলে সেদিন থেকে তাঁর নাম হয় রাবণ।
শিবের বর পেয়ে রাবণ ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য পর্যটন শুরু করলেন। ঘুরতে ঘুরতে একদিন হিমালয়ের এক অরণ্যে এসে রাবণ এক পরমা সুন্দরী রমনীর দেখা পেলেন। সেই রমনী তখন তপস্যা করছিলেন, মাথায় জটা পরনে কৃষ্ণাজিন। রাবণ মুগ্ধ চোখে তাঁকে দেখতে লাগলেন এবং কামার্ত হয়ে পড়লেন। রমনীর অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ রাবণ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেম, ‘কে তুমি? এই যৌবনকালে তপস্যাই বা করছ কেন?’ সেই কন্যা তখন রাবণকে জানালেন যে তিনি বৃহষ্পতি পুত্র মহর্ষি কুশধ্বজ। তাঁর জন্মের সময় পিতা বেদ পাঠ করছিলেন আর তাই তিনিও বাঙময়ী মূর্তিতে জন্মলাভ করেন। এইজন্য তাঁর নাম বেদবতী। দেবতা থেকে শুরু করে গন্ধর্ব, যক্ষ এমনকি রাক্ষসরাও তাঁকে বিবাহ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পিতা ইচ্ছা ছিল শ্রী বিষ্ণুকেই তাঁর জামাতা করার। এই কথা শুনে দৈত্যরাজ শুম্ভ রেগে গিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় মহর্ষি কুশধ্বজকে হত্যা করে, সেই দেখে বেদবতীর মাতাও সহমরণে যান। পিতা মাতার ইচ্ছানুসারে বেদবতীও তাই বিষ্ণুকে পতিরূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করছেন। বেদবতীর কথা শুনে রাবণ বিষ্ণুকে তাচ্ছিল্য করে বলেন, কোনোদিক থেকে বিষ্ণু তাঁর যোগ্য নয় এবং সমকক্ষও নয়, তাই বেদবতীর উচিত তাঁর সঙ্গে যাওয়া।
বেদবতী জানান, বিষ্ণু এই তিনভুবনের অধিপতি। তাঁকে অবজ্ঞা করার লোক কেউ নেই। এই কথা শুনে রাবণ রেগে গিয়ে বেদবতীর চুল ধরে তাঁকে টেনে নিয়ে যেতে চান। সেই মুহূর্তে বেদবতী বলে ওঠেন, রাবণের কাছে ধর্ষিত হয়ে তিনি থাকতে চান না। মন্ত্রবলে বেদবতী সেখানেই আগুন জ্বালান এবং সেই আগুনে ঝাঁপ দিতে দিতে বলেন, রাবণকে অভিশাপ দিয়ে তিনি তপোনাশ করতে চান না, তাই অন্য কোনো জন্মে তিনি এক ধার্মিকের অযোনিজা কন্যারূপে জন্ম গ্রহণ করবেন এবং সেই কন্যার কারণের রাবণের বিনাশ ঘটবে।
এই অযোনিজা কন্যাই হল সীতা যিনি ধর্মপ্রাণা রাজা জনকের কন্যারূপে জন্মগ্রহন করেন, পরে রামরূপী বিষ্ণু অবতারের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। এর পরের ঘটনা সবার জানা, যা পুরাণে রামায়ণ নামে পরিচিত।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team