প্রত্যন্ত জেলা কোচবিহারের অসম সংলগ্ন এই মহকুমার কথা আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই ইতিহাস উল্লেখ প্রয়োজন। কারণ তাতে সহজেই বোধগম্য হবে যে তুফানগঞ্জ মহকুমা কীভাবে একের পর এক দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে। অথচ কোচবিহারের রাজনৈতিক ইতিহাসে তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুরের একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। আমরা জানি ১৭৭৩ সালের ৫ই এপ্রিল নাজিরদেব খগেন্দ্রনারায়ণ কৃত চুক্তির ফলে কোম্পানীর করদ মিত্র রাজ্যে পরিণত হলো কোচবিহার এবং ধরেন্দ্রনারায়ণ প্রথম রাজা হিসেবে ব্রিটিশ আধিপত্য মেনে নিলেন। ১৭৮৩ সালে হরেন্দ্রনারায়ণ সিংহাসন আরোহনের চার বছরের মধ্যে রাজ্যের শাসনতান্ত্রিক কর্তৃত্ব নিয়ে রাজমাতা কামতেশ্বরী দেবী ও তুফানগঞ্জের অন্তর্গত বলরামপুরে বসবাসকারী নাজিরদেব বা রাজ্যের মুখ্য সেনাধ্যক্ষ খগেন্দ্রনারায়ণের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয়। রাজনৈতিক খেলার হার জিত আছে, এই খেলায় খগেন্দ্রনারায়ণ হেরে গেলেন। একই সাথে বলরামপুর তথা তুফানগঞ্জও ক্রমে চলে গেল অবহেলিত অন্তরালে।
ইতিহাস থেকেই জানা যায়, হরেন্দ্রনারায়ণের রাজত্বের শেষ পর্বে ১৮৩৪ সালে মেজর ফ্রান্সিস্ জেনকিন্স্ কোচবিহার রাজ্যের কমিশনার নিযুক্ত হন। তখন ফ্রান্সিস্ জেনকিন্স্ গভর্ণর জেনারেল পদে উত্তর–পূর্ব সীমান্ত প্রদেশের প্রতিনিধি হিসাবে গৌহাটিতে অবস্থান করাকালীন একাধিকবার কোচবিহার এসেছিলেন। তার আসার পথটি ছিল গৌহাটি–ধুবড়ী–তুফানগঞ্জ বন্দর বা বলরামপুর বন্দর পর্যন্ত জল পথে। মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ১৮৬১ সালে রাজ্যকে নতুন করে গঠন করবার উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং ৫ বছরের মধ্যে মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুরের রাজত্বকালে ১৮৬৬ সালের ৩রা মার্চ কোচবিহার রাজ্যে তুফানগঞ্জ প্রথম মহকুমার গৌরব লাভ করে।
গৌরব লাভ করলো বটে, তবে তা বজায় থাকল না বেশী দিন। দুর্ভাগ্য এখানে এসেও হাজির। কারণ ১৮৭২ সালে কোচবিহার রাজ্যে আরো চারটি মহকুমা স্থাপিত হলো – কোচবিহার সদর, দিনহাটা, মাথাভাঙ্গা ও মেখলিগঞ্জ। আর অন্যদিকে ১৮৭৩ সালের ১লা মে কোনও এক অজানা কারনে তুফানগঞ্জ মহকুমার অবলুপ্তি হল। ফলে প্রশাসনিক দিক থেকে শুধু নয়, ধীরে ধীরে সব দিক থেকেই তুফানগঞ্জ মহকুমা পিছিয়ে পড়তে লাগল স্বাভাবিক নিয়মে।
কোচবিহারে ১৮৬০ সনে স্থাপিত হল জেনকিন্স স্কুল। এরপর ১৮৯০ সনে মেখলিগঞ্জ, মাথাভাঙ্গা ও দিনহাটা মহকুমায় উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হলো। আর তুফানগঞ্জ মহকুমায় উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হলো তার ঠিক ২৬ বছর পর, ১৯১৬ সনে। একে অবহেলা বলব, না পিছিয়ে পড়া বলব বুঝে উঠতে পারছি না? তবে শিক্ষার ক্ষেত্রে সে সময় থেকেই সামগ্রিকভাবে পিছিয়ে পড়ল মহকুমা যা আজও বর্তমান। আরো মজার ব্যাপার হলো, কোচবিহার রাজ্যে প্রথম ডাক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল ১৮৬৫ সনে, তুফানগঞ্জ থেকে তুফানগঞ্জ ব্লক ২ নং এর ভৈষকুচি (বর্তমান মহিষকুচি) পর্যন্ত। বড়ই সুখের বা গর্বের বিষয়! ডাক ব্যবস্থা চললও প্রায় ১৯ বছর। কিন্তু ১৮৮৩ সনে তারও অবলুপ্তি ঘটল অবশেষে ১৮৯২ সালের ১৫ই জুন মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুরের আদেশে তুফানগঞ্জ মহকুমাকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। ভাগ্যের পরিহাস, হওয়ার কথা ছিল বয়োজ্যেষ্ঠ, আর হয়ে গেল সর্বকনিষ্ঠ, আর সেই ট্রাডিশন যেন আজও একই রকম রয়ে গিয়েছে।
প্রথমেই শিক্ষার ক্ষেত্রে আসি। জেলায় মহাবিদ্যালয় দিনহাটার পরেই ১৯৭১ সালে তুফানগঞ্জে স্থাপিত হয়। কিন্তু জেলার একমাত্র জওহর নবোদয় বিদ্যালয়টি তুফানগঞ্জে স্থাপিত হলেও এখন উঠে যাওয়ার পর্যায়ে আছে। এখনও নিজস্ব স্থানে যেতে পারেনি। পাশেই বারভিশায় তৎকালীন জলপাইগুড়ি জেলার নবোদয় বিদ্যালয় দেখলে আপশোষের সীমা থাকবে না। এখানে অবহেলা নয়, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আর টানা পোড়েনের জন্য নবোদয় বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবন আর ছাত্রী আবাস রুগ্ন অবস্থায় চলছে। অনেক কষ্টে পলিটেকনিক কলেজ স্থাপিত হয়েছে অল্প কয়েক বছর হলো। একটি মহিলা মহাবিদ্যালয়ের খুবই প্রয়োজন। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
মহকুমার শিল্প কারখানা বলতে শুধু ইঁট ভাটা। এ ছাড়া কৃষিজ উৎপন্নজাত ফসল ভিত্তিক শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকলেও গড়ে ওঠেনি। ছোট ছোট একটি দুটি সরষের তেলের মিল আছে না থাকার মতো। অন্য মহকুমাগুলির তুলনায় মৎস চাষে পিছিয়ে। তুফানগঞ্জ পৌরসভা এলাকায় চূড়ান্ত অব্যবস্থা রাস্তাঘাট থেকে সর্বক্ষেত্রে। অথচ আলিপুরদুয়ারে বা সে দিনের পৌরসভা ধূপগুড়িতে গেলে বোঝা যায় ফারাকটা কতোখানি। ধূপগুড়ি পৌরসভা ইতিমধ্যেই যেখানে ইলেকট্রিক চুল্লীর ব্যবস্থা করেছে, সেখানে তুফানগঞ্জ পৌরসভার অধীনস্থ শ্মশানঘাট ও আবর্জনা ফেলবার স্থান হয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ বিঘ্নিত করে।
১৯৬২ সালে বিধানসভায় প্রথম কোচবিহার জেলায় অবিভক্ত কমিউনিষ্ট পার্টির একমাত্র সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় জীবন দে। তাঁর আমল থেকেই দাবি রেলপথ ময়নাগুড়ি থেকে যোগীঘোপা। ৬০ বছর চলে গেলেও এখনও কাজ চলছে, কবে শেষ হবে ‘দেবা ন জানন্তি’। তুফানগঞ্জ রেলস্টেশন আছে বটে কিন্তু দূরপাল্লার কোনো ট্রেন নেই। রাজ্যরাণী এক্সপ্রেস নামে একটি ট্রেন সপ্তাহে তিনদিন শিলঘাট থেকে ধুবড়ী হয়ে আলিপুরদুয়ার পর্যন্ত চলে ভায়া তুফানগঞ্জ। কিছুদিন আগে শিলঘাট থেকে একটি নতুন ট্রেন শিয়ালদহ পর্যন্ত চালু হয়েছে। ঐ ট্রেনটি তুফানগঞ্জ স্টেশনের উপর দিয়ে গেলে কার কি ক্ষতি ছিল? অন্তত একটি দূরপাল্লার ট্রেন তো হতো, সে সপ্তাহে একদিনই হোক। কেউ বলার নেই? নাকি স্রেফ অবহেলা? ভাবতে হবে, অন্তত ভাবা প্র্যাকটিস্ করতে হবে তুফানগঞ্জবাসীর।
তুফানগঞ্জের যাঁরা রূপকার ছিলেন বা আছেন, তাঁরাও যে এই মহকুমা শহরটির উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে দায়ী এ কথা অনস্বীকার্য। মহকুমা হাসপাতাল বানাতে হবে, সুতরাং শহরের মাঝখানে বানাও। পুরাতন হাসপাতালের যথেষ্ট জায়গা থাকা সত্বেও নতুন করে যে স্থান অধিগ্রহণ করে তা বানানো হলো সেখানকার ১৮৬০ সাল থেকে চলে আসা বাণীরহাট বন্দর বা বাজার বা ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত দোলমেলার ঐতিহ্যের কথা তাঁরা ভাবলেনই না! একটু গ্রামের দিকে গিয়ে বানালে কী ক্ষতি হতো? তাও এমন বিল্ডিং বানানো হলো যে সেটিকে নাকি আর দোতলা করাই যাবে না! তেমনই রবীন্দ্র ভবনটিকে পৌরসভার পাশে বা অন্যত্র নির্মাণ করলে বর্তমান খোলা জায়গাটি নাগরিকদের ব্যবহারের জন্য কি উন্মুক্ত স্থান হিসেবে রেখে দেওয়া যেত না? জানি না একে অবহেলা বা পিছিয়ে পড়া বলা যাবে কিনা জানি না তবে বড়ই অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন তাঁরা।
সেই ১৯৫২ সাল থেকেই তুফানগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে সরকারি দলের বিধায়করা নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু এখনও পর্যন্ত তাঁদের কেউ মন্ত্রীত্ব পান নি। প্রশ্ন হলো কারও যোগ্যতাই ছিল না? একে শুধু অবহেলা বলে না অবজ্ঞাও বলে? এমনকী তুফানগঞ্জবাসী এও দেখেছেন ২০১১ সালে অন্য মহকুমা থেকে নিয়ে এসে বিধায়ক হলেন। কেন মহকুমাতে কোনও যোগ্য ব্যক্তি কি ছিলেন না? একে কী বলা চলে – মহকুমাবাসীর প্রতি শ্রদ্ধা নাকি অসম্মান! কোচবিহারে জিলা পরিষদ গঠন হওয়ার পর প্রথম জিলা পরিষদের সভাধিপতি কিন্তু তুফানগঞ্জ থেকেই এবং বাম জামানায় চার চারটা টার্ম সভাধিপতি তুফানগঞ্জ মহকুমা থেকেই। কিন্তু লাভের লাভ শূন্য। একটি বিশেষ দলের কুড়ি বছর সভাধিপতির পদ অলঙ্কৃত করলেও মহকুমায় কোন স্থায়ী উন্নয়ন চোখে পড়ে কি? এরপর শাসক দলের জেলা সম্পাদক এই মহকুমার হলেও তাতে মহকুমার আখের লাভ বা উন্নতি কোথায়?
কথায় আছে না – ‘অভাগা যে দিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়’। আমাদের তুফানগঞ্জ মহকুমার সেই অবস্থা। আচ্ছা আপনাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে যে কোচবিহারের প্রাচীনতম মেলা কোনটি? চোখ বন্ধ করে উত্তর একটাই রাসমেলা। আগেই বলি রাসযাত্রা উৎসবটি আমাদের কোচবিহারের খুবই প্রাচীন। জয়নাথ মুন্সী ‘রাজোপাখ্যান’- এর প্রত্যক্ষ খন্ডে এর একটি বিবরণ দিয়েছেন। ১৮২২ খ্রীষ্টাব্দে রাজবাড়ীতে ভুতের উপদ্রব হওয়ায় মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ তাঁর রাজধানী আঠার কোঠায় স্থানান্তরিত করেন। ঐ সনের কার্ত্তিক পূর্ণিমাতে তিনি নতুন গৃহে প্রবেশ করেন। ঐ দিন রাসযাত্রাও অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৮২১ সনে রাজবাড়ী স্থানান্তরিত হয়ে আসে ধলুয়াবাড়ীতে এবং ১৮২৮ সনে আবার কোচবিহার শহরে। দেবতার মন্দিরও কোচবিহার শহরে রাজবাড়ীর সীমানায় স্থাপিত হয়। কিন্তু রাসযাত্রা উৎসবের আর কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। W. W. Hunter সাহেব তাঁর ‘Statistical Account of Bengal, V(X)’ গ্রন্থে কোচবিহার প্রসঙ্গে (প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৮ খ্রীঃ) উল্লেখ করেছেন – "The Only fair in the year is the Godadhar mela, held on a certain day in the month of Chaitra at a place on the right bank of the Kaljani River, about eleven miles from Cooch Behar town, It continues for three days." অর্থাৎ গদাধরের স্নান মেলা শুধুমাত্র তুফানগঞ্জ মহকুমার প্রাচীনতম মেলাই নয়, তৎকালীন কোচবিহারের একমাত্র মেলা।
পরবর্তীকালে ০৩/১০/১৮৮৩ তারিখের রাজ্যর শাসন সংক্রান্ত প্রতিবেদনে কোচবিহার রাজ্যের তিনটি মেলার উল্লেখ পাওয়া যায় – গদাধরের স্নান মেলা, হলদিবাড়ীর মেলা এবং দেওয়ানগঞ্জের মেলা। আবার লক্ষ্যণীয় যে ১৮৮৩-১৮৮৪ সনের প্রতিবেদনে পাঁচটি মেলার উল্লেখ মেলে – গদাধর, হলদিবাড়ী, কালিরঘাট, শীতলখুচী, শিবতলা। এভাবেই ১৮৮৪-১৮৮৫ সনের প্রতিবেদনে নাম পাওয়া যায় – গদাধর, কালিরঘাট, হলদিবাড়ী, দিনহাটা, শীতলকুচী। লক্ষ্য করুন বিভিন্ন সনে বিভিন্ন মেলার নাম – কোনটা বাদ গেছে আবার কোনটা যুক্ত হয়েছে। কিন্তু গদাধরের স্নান মেলার উল্লেখ প্রথম থেকেই অপরিবর্তিত রয়েছে। এ থেকে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না যে, তুফানগঞ্জ মহকুমার ১ নং ব্লকের নাটাবাড়ী ১ নং অঞ্চলের পানিশালা গ্রামে গদাধর ও কালজানি নদীর সঙ্গমস্থলে চৈত্রমাসের অশোকাষ্টমী তিথিতে অনুষ্ঠিত গদাধরের স্নান মেলাই কোচবিহার রাজ্যে প্রাচীনতম মেলা? কিন্তু কজন জানেন বা মানেন যে কোচবিহার রাজ্যের প্রাচীনতম মেলাটি ছিল তুফানগঞ্জ মহকুমায়।? একে ভাগ্যের বিড়ম্বনা ছাড়া আর কীই বা বলা যায়?
এক কথায় বলতে গেলে, ভাগ্যের বিড়ম্বনাতেই হোক, শাসকের অবহেলাতেই হোক কিংবা জনগণ বা জনপ্রতিনিধিদের উদাসীনতার কারণেই হোক, সেই ইতিহাসের কাল থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান সত্ত্বেও ক্রমেই আলোকবৃত্তের বাইরে পেছনের সারিতে চলে গিয়েছে তুফানগঞ্জ, এবং সেখান থেকে উত্তরণের কোনও প্রচেষ্টাই স্বাধীনতা উত্তরকালে কখনও দেখা যায় নি।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team