দু'বছর ঘরবন্দী থাকার পর মনটা কেমন যেন ছটফট করছিল৷ শিকল খুলে মনপাখি উড়ে যেতে চাইছে অচিনপুরে৷ চঞ্চল মন বারবার গেয়ে উঠছে, যাবই আমি যাবই৷ হাতছানি দিচ্ছে পাহাড়৷ আর পাহাড় মানেই সেই স্বপ্নসুন্দরী কাঞ্চনজঙ্ঘা৷ আমরা আট বন্ধু, অষ্টসখা, পুরনো ভ্রমণসঙ্গী৷ সবার প্রাণেই সেই পাহাড়িয়া সুর৷ অতএব, এবারে জায়গা স্থির করার পালা৷ আগেই বলেছি, আমাদের মন চলে অচিনপুরে৷ ভীড় থেকে দূরে, যেখানে মনপ্রাণ ভরে প্রকৃতিকে আস্বাদন করতে পারব, যেখানে শপিং-এর ভূত তাড়া করবে না, এমন নিরিবিলি জায়গাই আমাদের পছন্দ৷ শরণাপন্ন হলাম আমাদের পরিচিত ট্রাভেল কোম্পানির বেণুবাবুর (৯৪৩৩০৩৪৭৩৬)। ওনার পরামর্শে স্থির হল গন্তব্য, আমরা এবার যাব হিমালয়ের কোলে এক আনকোরা গ্রামীণ ইকো পর্যটনের স্বাদ অনুভব করতে।
কালিম্পং পাহাড়ের একটি ছোট গ্রাম—— 'কাশ্যম কামান'৷ তবে কালিম্পং শুনলেই যে ঘিঞ্জি শহরটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তার থেকে প্রায় ২১ কিমি দূরে এই গ্রাম৷ এ কি শুধুই গ্রাম, নাকি স্বর্গ! হাওড়া থেকে আমরা ট্রেনে পৌঁছলাম নিউ জলপাইগুড়ি৷ নভেম্বরের গোড়ার দিকে তখন হালকা ঠাণ্ডার আমেজ৷ গাড়ি আমাদের ঠিক করাই ছিল৷ স্টেশনে পৌঁছে ফোন করতেই জানলাম আমাদের রথ হাজির৷ এগিয়ে এসে হাসিমুখে সুপ্রভাত জানালেন ড্রাইভার অধীপজী৷ পাহাড়ি হলেও বাংলা বেশ সড়গড় ভদ্রলোক৷ হ্যাঁ৷ ভদ্রলোকই বটে৷ জানালেন, এনজেপি থেকে নব্বই কিমি, আড়াই-তিন ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছব, এমনই আশ্বাস দিলেন অধীপজী৷ পথেই একটি রেস্টুরেণ্টে সারা হল প্রাতরাশ৷ আবার ছুটল গাড়ি আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে৷ বাঁকে বাঁকে স্বাগত জানাতে বারবার দেখা দিচ্ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা, আকাশ এত পরিস্কার থাকবে কল্পনাও করিনি৷ যতবারই দেখি, যেন মন ভরে না! আপনিকণ্ঠ বেয়ে উঠে এল গান "মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ/ তব ভুবনে, তব ভবনে/মোরে আরও আরও আরও দাও স্থান...."৷
অবশেষে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছলাম মাউন্টেন ভিউ হোম স্টে. গাড়ি থেকে নামতেই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন জামির মালিক৷ মিষ্টি এবং সরবত দিয়ে হল অতিথি আপ্যায়ন৷ সাধারণ হোমস্টে৷ বিলাসবহুল না হলেও তাতে যত্নের বা আতিথেয়তার উষ্ণতার এতটুকু অভাব নেই৷ মুখে হাসিটি লেগেই আছে৷ আমাদের ঘর পেয়ে গেলাম৷ ছেলেরা এবং মেয়েরা ঘর ভাগ বাটোয়ারা করে নিলাম৷ বেলা প্রায় বারোটা বাজে৷ একে একে আটজনের স্নান সেরে নিতে বেশ বেলা হয়ে গেল৷ জামির জী জানিয়ে গেলেন দ্বিপ্রাহরিক আহার প্রস্তুত৷ বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই সবার মন ভরে গেল৷ শ্বেতশুভ্র পাহাড় দূরে দাঁড়িয়ে যেন হাত নাড়ছে আর বলছে, এসো বন্ধু৷ খাবার ঘরে পৌঁছেই দেখি টেবিলে সাজানো ধোঁয়া ওঠা ভাত, ডাল, উচ্ছে-আলু ভাজা, তরকারি আর ডিমের কারি৷ পরম তৃপ্তিতে সারা হল ভোজন৷
এরপর ঘরে বসে কালক্ষেপের পক্ষপাতী আমরা কেউই নই৷ সামনের রাস্তায় হাঁটতে বেরোন হল৷ ভূগোলের শিক্ষক শিক্ষিকা অঙ্কুর আর সুলগ্নাদি পাহাড় এবং প্রকৃতির পর্যবেক্ষন করছেন তাঁদের মতন করে৷ আর আমি গেয়ে চলেছি গান৷ পথে নানার পাহাড়ি ফুলের সমারোহ আর কীট পতঙ্গের অদ্ভুত ডাক৷ একটা ছিমছাম পাহাড়ী গ্রাম কাশ্যম কামান। একটি ছোট চার্চ, জলপ্রপাত ঘিরে একটি ছোট্ট পার্ক ছাড়া একটি পুরনো সিঙ্কোনা প্রসেসিং ইউনিট ব্রিটিশ আমলের সাক্ষ্য বহন করছে। পাহাড়টা জঙ্গলে ঘেরা, পাইনের বনের মধ্য দিয়ে ছোট ছোট ট্রেকিং সেরে নেওয়া যায়। নীচে তিস্তা ও রংপো মিলেমিশে বয়ে চলা আর অখন্ড নিস্তব্ধতা। অজস্র পাখপাখালির ডাকে প্রকৃতির মাঝে কী করে সময়টময় বেমালুম ভুলে হারিয়ে যাওয়া যায় তার প্রকৃষ্ট নমুনা পেলাম হাতেনাতে। অস্তমিত সূর্যের অস্তরাগ গায়ে মেখে ফিরে এলাম হোমস্টেতে৷
ফিরে এসে ফের আড্ডার আসর। গল্প করতে করতে মনটা যখন একটু চায়ের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছে, ঠিক তখনই দুই তরুণী দুটি ট্রে তে চা এবং পকোড়া নিয়ে দরজায় ডাক দিল৷ আহা! এরপর একটু বারান্দায় বেরোলাম৷ আকাশে তখন একফালি চাঁদ৷ মৃদুমন্দ ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে৷ সামনের পাহাড়ের গায়ে জোনাকির মত মিটমিটে আলো৷ চারপাশের বাড়ি আর হোমস্টেতে ঝলমল করছে আলোকসজ্জা৷ বেশ কয়েকটি হোম স্টে গড়ে উঠেছে এই সব গ্রামগুলিতে, দারিদ্র কর্মহীনতার সহজ সমাধান এ ছাড়া আর কীই বা হতে পারে! ইকো পর্যটনের মূল কথাই তো প্রকৃতি পরিবেশ ও সংস্কৃতি অক্ষুণ্ণ রেখে স্থানীয় মানুষের আয়ের সংস্থান! রাত্রি ঠিক সাড়ে নটায় হাজির রাত্রিকালীন আহার৷
পরদিন ভোরে চোখ মেলতেই বুঝলাম, তখনও অরুণোদয় হয়নি৷ বেশ ঠাণ্ডা আছে৷ বিছানায় আরেকটু গড়াগড়ি করতেই দরজায় কড়া নাড়া শুনে উঠে পড়লাম৷ বাকিরাও জেগে গেছে৷ এতক্ষনে আকাশে হালকা রঙ ধরেছে৷ সে কী অপূর্ব দৃশ্য! গলা ছেড়ে গান ধরলাম, "পূর্বগগনভাগে দীপ্ত হইল সুপ্রভাত তরুণারুনরাগে"৷ ধীরে ধীরে সোনায় মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা সুপ্রভাত জানাল৷ আজ আমরা আশপাশের কিছু জায়গা ঘুরতে যাব৷ ডেলো পেডং রিশিখোলা রামধুরা সাংসের ইচ্ছেগাঁও, সিলারিগাঁও, রংপো ভ্যালি ইত্যাদি ছাড়াও এখান থেকে দিনভর টুরে ঘুরে নেওয়া যায় গোটা কালিম্পং পাহাড়। আমাদের আজকের গন্তব্য চুইখিম, কোলাখাম, এবং কালিম্পঙয়ের ক্যাকটাস গার্ডেন ও লাভা মনাস্ট্রি৷ সব দেখে ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে ঠিক হল একটু ভা্রি প্রাতরাশ সেরে বেরোব আর মধ্যাহ্নভোজন হবে পথে৷ আলুর পরোটা আর আলু চচ্চরি খেয়ে রওনা হলাম৷ গাড়ি ঠিক করাই ছিল৷ বেরিয়ে ড়লাম হৈ হৈ করে৷ সব কয়টি জায়গাই বেশ ভাল৷ ক্যাকটাস গার্ডেনে কত বিভিন্ন প্রজাতির ক্যাকটাস! আর বৌদ্ধ উপাসনালয়টির শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ এক অনির্বচনীয় শান্তি প্রদান করে৷
পরদিন আমাদের ফেরার পালা৷ এমন স্বর্গরাজ্য ছেড়ে যেতে কি আর মন চায়! আমাদের মধ্যে কয়েকজনের আবার দার্জিলিং ঘুরে যাবার খুব ইচ্ছে৷ সময়সাপেক্ষ হলেও অনুরোধ রাখলেন অধীপজী৷ স্থির হল একটু তাড়াতাড়িই বেরোতে হবে৷ জামিরজীকে অনুরোধ করলাম কাল সকালে সকালে যদি একটু ভাত ডাল আর আলুভাজা করে দেওয়া যায়, খুব ভাল হয়৷ তিনি সম্মতি জানালেন৷ সকালে খেতে গিয়ে দেখি উপরি পাওনা বাঁধাকপির তরকারি৷
দুটো রাতের অখন্ড অবকাশ ও অসামান্য আতিথেয়তা সেরে এবার ফিরে যাওয়ার পালা। নিউ জলপাইগুড়ির পথে চা বিরতি। এই দফায় শেষবারের মত দুচোখ ভরে দেখে নিলাম কাঞ্চনজঙ্ঘাকে৷ কফির গেলাসটা হাতে নিয়ে অপলক চেয়ে রইলাম তার দিকে৷ যেমন পূর্বজন্মের ফেলে আসা সঙ্গী সে৷ কথা দিলাম আবার দেখা হবে৷ নিজের মনে মনেই বললাম, 'ভাল থেকো কাশ্যম'৷
কাশ্যম ও আশপাশের হোম স্টে-তে সরাসরিও যোগাযোগ করতে পারেন 9593155555, 7029190644
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team