 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             শান্তনু রায়
                                            
                                                
                                                শান্তনু রায়
                                            
                                            
                                        মস্ত রুখাশুখা নদীটার ঠিক মাঝে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল এ কোনও অজানা দেশের সীমানা যেন। এ যেন জলপাইগুড়ির সবুজ ছাড়িয়ে এক অন্য রুক্ষ বন্য ভালোলাগা।
এ গল্প আজ থেকে বছর তিনেক আগের, এক অজানা, অল্প চেনা জঙ্গলের কথা। বানারহাট রেলগেট পার করেই দুধারে সবুজ চা বাগান ছিঁড়ে রাস্তা চলে গেছে ভুটানের দিকে। কিছুটা যাবার পর ধুলো ঢাকা এবড়োখেবড়ো রাস্তা আর ক্রমশ পাল্টে যাচ্ছিল প্রকৃতি, সবুজ কমে রুক্ষ বনভূমি শুরু হচ্ছিল একটু একটু করে।
যাচ্ছি বান্দাপানি জঙ্গল ছাড়িয়ে খুব অল্প চেনা ফরেস্ট বাংলোতে। মরাঘাট চা বাগান পার করেই রাস্তা শুনশান, খুব কম লোক আসে এদিকে, রাস্তায় লোক প্রায় নেই বললেই চলে। শুনশান রাস্তায় হঠাৎ শুধু ভুটান থেকে ডলমাইট নিয়ে আসা ট্রাকের দেখা। আর মাঝে মাঝে খাপছাড়া ঝোপঝাড় আর শাল সেগুনের জঙ্গল।
পথে একটা আদিবাসী গ্রাম পার করে নদীর সামনে পড়লাম, নদীর নাম রেতি। মস্ত পাথুরে নদীটা ভুটান পাহাড় থেকে নেমে এসে ধারা হয়ে বইছে জায়গায় জায়গায় পাতা ঝড়া শীত বেলায়। নদীর বুকেই রাস্তা, খুব ধীরে কয়েকটা খরস্রোতা ধারা পার করে বুঝলাম বর্ষায় নদীটা কত ভয়ংকর আকার ধারণ করে। নদীর ঠিক মাঝখানে যখন, মনে হচ্ছিল আকাশের সীমানায় পৌঁছে গেছি যেন। কী সীমাহীন নিঝুম চারিধার সে বলে বোঝানো যাবে না। নদীর দুপারে শুধুই জঙ্গল আর দূরে দূরে নীলচে ভুটান পাহাড়ের হাতছানি। বেশ কষ্ট করে পাথুরে নদীটা পার করে এপারে এলাম, খাড়া রাস্তা ধরে নদী থেকে উঠেই মনে হলো যেন পাহাড়ের পায়ের কাছে চলে এসেছি।
নদী পার করে গভীর জঙ্গলের পথ, গা ছমছমে ওই পথের একটা আলাদা নেশা আছে, মাঝে মাঝে কিছু লেপচা আর লিম্বু জনজাতির আদিবাসী গ্রাম। বাচ্চারা গাড়ি দেখে ছুটে আসছে পাথুরে পথে। অনেকটা চলার পর বন পথ শেষে আবার নদী, নদীর নাম খাগরা খোলা, ভুটান থেকে নেমে আসা শুখা নদীটা পাহাড়ের ছায়া গায়ে মেখে শুয়ে আছে যেন। এখানেও নদীর বুকের ওপর দিয়ে চলা।
কোনওরকমে নদী পার করে আবার জঙ্গলের পথ শুরু, এ পথে কোনই লোকজন নেই। প্রায় চার কিমি যাবার পর পথেই ভারতীয় আর ভুটান আর্মির যৌথ নজরদারি দেখতে পেলাম। গাড়ি থামিয়ে ওরা বললেন তাড়াতাড়ি জঙ্গল পার হতে, এ পথে খুবই কম টুরিস্ট আসে, বেলা বাড়লে খুব হাতি আর চিতা বাঘের উপদ্রব।
প্রায় আট কিমি গভীর জঙ্গলের পথ পার করে বান্দাপানি ফরেস্ট অফিস, ফরেস্ট বাংলো আর বান্দাপানি গ্রাম, মূলত লেপচা গ্রাম এটি, পাশেই ভুটান, খাগড়া খোলা নদীটা গেছে বাংলোর গা ঘেঁষে।
বাংলোর সামনে গাড়ি থামতেই রেঞ্জার তামাং সাহেবের স্ত্রী খুব আপ্যায়ন করলেন, বললেন তিন মাস পর বাইরের লোক দেখলাম।
বাংলোতে লাইট নেই। রাতে হ্যাজাক জ্বালিয়ে দিল দুটো আদিবাসী মেয়ে। দারুণ সাজানো গোছানো বাংলোর ভেতর এ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। সন্ধে নামার পরপরই আদিবাসী মেয়ে দুটি আমাদের রাতের খাবার রেডি করে দিয়ে চলে গেল। বললো খাওয়ার আগে গরম করে নিও। দূরে কোনও আদিবাসী গ্রামে হিমেল হওয়া সঙ্গী করে ধামসা মাদল বাজছিল একটানা নেশা লাগানো সুরে।
রাতে কুয়াশা ছিঁড়ে একফালি চাঁদ উঠেছিল জঙ্গলের মাথায়। ডিসেম্বরের কনকনে ঠান্ডায় বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল এ এক অন্য বন্য ভালোলাগার জগৎ।
রাতে বাংলো থেকে নামা বারণ, হাতি আর খুব চিতার খুব উপদ্রব এই এলাকায়। নদীর ওপারে ভুটান পাহাড়ে তখন গুম গুম শব্দে মেঘগর্জন।
কিছু পরেই বৃষ্টি নামলো পাহাড় জঙ্গল কাঁপিয়ে। হিমালয়ের কোনও এক অল্প চেনা পাদদেশে কোনও এক অজানা আদিবাসী গ্রাম আর জঙ্গল ঘেরা বন বাংলোতে তখন শুধুই বন্য বৃষ্টি ধোয়া ভালোলাগা।
পরদিন খুব সকালে কুয়াশা ছিঁড়ে রোদ উঠেছিল, বাংলোর কিছু দূরেই হাতিদের টাটকা পায়ের ছাপ। রেঞ্জার সাহেব বাংলোর পেছনে চিতা বাঘের পায়ের ছাপ দেখালেন।
জঙ্গলের ঘোরার নেশায় ভারতের অনেক বন বাংলোতে থেকেছি, কিন্তু বান্দাপানি ফরেস্ট বাংলো এক কথায় অসাধারণ।
যারা জঙ্গল আর অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন তাদের জন্য অনবদ্য এই বনবাংলো। এখানে থাকার জন্য বুক করতে হবে wbsfda.org থেকে। কোভিড-এর জন্য বুকিং সাইট বন্ধ ছিল, একবার দেখে নেবেন খুলেছে কিনা। খাবার প্রয়োজনীয় রেশন নিয়ে যাওয়া ভালো, ওখানে কিছুই পাওয়া যায় না।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
