কচ পরবর্তী সময়ে যার নাম দেবযানীর জীবনের সঙ্গে আমৃত্যু লেপ্টে ছিল তিনি হলেন শর্মিষ্ঠা। অসুররাজ বৃষপর্বার কন্যা শর্মিষ্ঠা ছিলেন সুন্দরী ও বুদ্ধিমতি। তবে পুরাণে যেভাবে দেবযানীর নাম উচ্চারিত হয় শর্মিষ্ঠার নাম সেভাবে নয়। শর্মিষ্ঠার সন্তানই পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের সম্রাট হয়েছিলেন আমরা ভুলে যাই সেকথাও। সেদিক থেকেও ওঁর গুরুত্ব কম নয়।
পুরাণে বৃহস্পতি পুত্র কচ অসুরগুরু শুক্রাচার্যের কাছ থেকে সঞ্জীবনী মন্ত্র শিখে দেবতাদের কাছে ফিরে গেলে দেবযানীর জীবনে শর্মিষ্ঠার আগমন ঘটে। ঘটনাক্রমে শর্মিষ্ঠা একবার ভুল করে দেবযানীর বস্ত্র পরে নেন। ক্ষুব্ধ হন দেবযানী শর্মিষ্ঠার ওপর। যেহেতু দেবযানী গুরুকন্যা ও শর্মিষ্ঠা রাজার পুত্রী তাই দেবযানী তাঁর শিষ্যার এই অনাচার মেনে নিতে পারেননি। শর্মিষ্ঠাও রেগে নিজেকে দাতার কন্যা হিসেবে ঘোষনা করেন, কারণ রাজার দয়াতেই সকলেই পালিত হন। কথায় কথায় দুজনের মধ্যে বাকবিতন্ডা শুরু হয় ও শর্মিষ্ঠা রাগ করে দেবযানীকে একটা কূপের মধ্যে ফেলে দেন এবং তাঁকে মৃত ভেবে বাড়ি ফিরে যান। ঠিক সেই সময়ই রাজা যযাতি মৃগয়া করতে গিয়ে শ্রান্ত ও ক্লান্ত হয়ে কূপের কাছে আসেন। কূপের ভেতর উঁকি দিতেই তিনি অসম্ভব রূপবতী এক কন্যাকে দেখলেন। পরিচয় পর্বের পর দেবযানী তাঁকে তাঁর দক্ষিণ হাত ধরে কূপ থেকে তুলতে বললেন। যযাতি তাঁকে উদ্ধার করে নিজের রাজধানীতে নিয়ে গেলেন।
কথাটা দেবযানীর পিতা শুক্রাচার্যর কানে যেতেই তিনি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। দেবযানী পিতাকে পেয়ে শর্মিষ্ঠার সব কথা জানালেন। শর্মিষ্ঠা তাঁকে স্তুতিকারী যাচকের কন্যা বলে সম্বোধন করেছেন, আর নিজেকে বলেছেন দাতার কন্যা। এই কথা যদি সত্য হয় তবে দেবযানী শর্মিষ্ঠার কাছে নতি স্বীকার করবেন।
শুক্রাচার্য হাসলেন। মেয়েকে আশ্বস্ত করে বললেন, দেবযানী কার কন্যা সকলেই জানেন। এমনকি ইন্দ্রদেব, যযাতি এবং স্বয়ং বৃষপর্বার কাছেও তা গোপন নেই। কিন্তু শুক্রাচার্য নিজের প্রশংসা করতে চান না, তাই তিনি মেয়েকে শর্মিষ্ঠাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য বললেন। কিন্তু দেবযানী রাজী হলেন না। তাঁর মতে নিচ লোকের কাছে অপমানিত হওয়ার চাইতে মৃত্যুও ভালো। শুক্রাচার্য তখন রেগে বৃষপর্বার কাছে গিয়ে জানালেন যে এই রাজ্যে আর তিনি বাস করবেন না। বৃষপর্বা সব শুনে গুরুর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন ও দেবযানীকে প্রসন্ন হওয়ার জন্য অনুমতি চাইলেন। দেবযানী তখন বৃষপর্বাকে বলেন, ওঁর যখন বিয়ে হবে তখন আরও অনেক দাসীর মতো শর্মিষ্ঠাকেও তাঁর সঙ্গে দাসী হয়ে থাকতে হবে। বৃষপর্বা বাধ্য হয়ে রাজি হলেন, শুক্রাচার্যের ক্রোধের ভয়ে শর্মিষ্ঠাকেও সম্মতি দিতে হল।
এর কিছুকাল পর আরও একবার যযাতির সঙ্গে দেবযানীর দেখা হয়। সেদিনও যযাতি মৃগয়ায় এসে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। অন্যদিকে দেবযানী শর্মিষ্ঠা ও আরও সহস্র দাসীসহ সেখানেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। যযাতি দেবযানীকে দেখে মুগ্ধ হন, কিন্তু গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা এই পরিচয় জানতে পেরে তিনি তাঁর মনোভাব জানালেন না। যযাতি শর্মিষ্ঠাকে দেখেও অবাক হলেন, জানতে চাইলেন কী এমন কারণ যার জন্য অসুররাজকন্যা তাঁর দাসী হয়েছে!
পরিচয় পর্ব শেষে দেবযানী যযাতিকে নিজের ভর্তা ও সখা হওয়ার অনুরোধ করলেন। দেবযানী যযাতিতে বলেছিলেন যেহেতু রাজা কূপ থেকে উদ্ধার করার সময় ওঁর দক্ষিণ হাত গ্রহণ করেছেন তাই ধর্মমতে যযাতিই তাঁর স্বামী। অসবর্ণ বলে যযাতি প্রথমে রাজী না হলেও পরে শুক্রাচার্যের কথায় দেবযানীকে গ্রহণ করেন ও শর্মিষ্ঠাসহ তাঁকে নিজের রাজধানীতে নিয়ে যান। শুক্রাচার্য শর্ত রাখেন শর্মিষ্ঠাকে সসম্মানে রাখার কিন্তু কোনোদিনই যেন শর্মিষ্ঠা রাজার শয্যাসঙ্গিনী না হন।
দেবযানী ও যযাতির দুটি পুত্র হয়। তাঁর সুখ দেখে শর্মিষ্ঠা মনে মনে দুঃখ পেলেন। নিজের জীবনকে ব্যর্থ মনে হচ্ছিল তাঁর। কী লাভ এমন যৌবনের যেখানে স্বামী নেই, ঘর নেই, পুত্র হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন দেবযানীর মতোই নিজে নিজেই পতি বরণ করবেন।
এর কিছুদিন পর রাজা যযাতি একবার অশোকবনে বেড়াতে গেলে শর্মিষ্ঠা তাঁকে সম্বোধন করে বললেন, রাজা তো তাঁর রূপ, কুল, শীল সবই জানেন, তাই রাজা যেন তাঁর ঋতুরক্ষা করেন। কিন্তু যযাতি শুক্রাচার্যের নিষেধ মনে করে শর্মিষ্ঠাকে প্রত্যাখ্যান করেন। শর্মিষ্ঠা মরিয়া হয়ে বললেন, ''ন নর্মযুক্তং বচনং হিনস্তি/ন স্ত্রীষু রাজন ন বিবাহকালে/ প্রাণাত্যয়ে সর্বধনাপহারে/পঞ্চানৃতান্যাহুরপাতকানি।" এর অর্থ হল, মহারাজ, পরিহাসে, মনোরঞ্জনে, বিবাহকালে, প্রাণসংশয়ে এবং সর্বস্ব নাশের সম্ভাবনা -এই পাঁচ অবস্থায় মিথ্যা বললে পাপ হয় না। তবু যযাতি মানলেন না। তিনি রাজা, তিনি কীভাবে মিথ্যাচার করবেন? তবে তো প্রজারাও তাঁকেই অনুসরণ করবে। তখন শর্মিষ্ঠা বললেন, সখীর পতি নিজের স্বামীর মতোই, তাই দেবযানীকে বিয়ে করার সময়ই তিনি শর্মিষ্ঠার পতি হয়েছেন।
শর্মিষ্ঠার অনেক অনুনয় বিনয়ের পর যযাতি তাঁকে বিবাহ করলেন কিন্তু সবটাই হল গোপনে। পরে শর্মিষ্ঠার পুত্র জন্মালে দেবযানী তাঁকে সন্দেহ করলে শর্মিষ্ঠা অবলীলায় বলে দিলেন যে এক বেদজ্ঞ ঋষির সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। দেবযানী মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে শর্মিষ্ঠার গর্ভে আরও দুই পুত্র জন্মানোর পর দেবযানী জানতে পারেন শর্মিষ্ঠার এই অনাচার। ক্রোধে সখীকে তিরস্কার করে দেবযানী চলে যান শুক্রাচার্যের কাছে। শুক্রাচার্য সব শুনে অভিশাপ দিলেন যযাতিতে, জরাগ্রস্থ হবেন তিনি৷ যযাতি কান্নায় ভেঙে পড়লে শুক্রাচার্য বলেন যদি যযাতির পাঁচ পুত্রের মধ্যে কেউ যৌবন দেয় তবেই তিনি যৌবন লাভ করবেন। ঘটনাক্রমে কেউই রাজি হয় না। শেষে তিনি শর্মিষ্ঠা ও তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র পুরুকে অনুরোধ করায় তিনি রাজি হন ও যযাতি যৌবন লাভ করেন। কালক্রমে এই পুরুর বংশধরেরাই ভরত বংশের সূচনা করেন।
শর্মিষ্ঠার চরিত্রটি দেবযানীর থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। দেবযানী দৃঢ়চেতা, স্পষ্টবাদী। প্রথমে কচ ও পরে যযাতির জন্য তিনি ছিলেন একনিষ্ঠা প্রেমিকা, স্ত্রী। অন্যদিকে শর্মিষ্ঠা কথা দিয়েও কথা রাখতে না পারা এক নারী, যে ধর্মের দোহাই দিয়ে অন্যায় করতেও পিছপা হন না, অথচ তা স্বীকারও করার সাহস তাঁর নেই। যযাতির বিশ্বাসভঙ্গ, জরাগ্রস্থ হওয়া এমনকি নিজের দেবযানীর সঙ্গী হওয়া সবের জন্যই ও নিজেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী। নিজের অবস্থান না জেনে তর্ক করতেও পিছু হটেন না শর্মিষ্ঠা। তাই খল চরিত্র না হয়েও নায়িকা হয়ে উঠতে পারেনি শর্মিষ্ঠা। চিরকাল দেবযানীর আড়ালেই ঢাকা পড়ে গেছে এই রমনী অথচ যে না থাকলে হয়ত ভরত বংশের সূচনাই হত না।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team