× home হোম archive আগের ওয়েব সংখ্যা panorama ডুয়ার্স সম্পর্কে play_circle_filled ভিডিও file_download মুদ্রিত সংখ্যার পিডিএফ library_books আমাদের বইপত্র
people এখন ডুয়ার্স সম্পর্কে article শর্তাবলী security গোপনীয়তা নীতি local_shipping কুরিয়ার পদ্ধতি keyboard_return বাতিল/ফেরত পদ্ধতি dialpad যোগাযোগ
login লগইন
menu
ad01112021105753.jpg
×
সংখ্যা: নভেম্বর, ২০২১
সম্পাদকের কলম
এ দেশের বুকে আরোগ্য আসুক নেমে
প্রদোষ রঞ্জন সাহা
পর্যটনের ডুয়ার্স
বান্দাপানি বনবাংলোয়
শান্তনু রায়
পর্যটনের ডুয়ার্স
বরফে ঢাকা নাথাং ভ্যালি
প্রতাপ কুমার মণ্ডল
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ও উত্তরের উত্তরণ লিপি। পর্ব - ৫
প্রশান্ত নাথ চৌধুরী
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
রাজনগরের রাজনীতি। পর্ব - ৯। স্বাধিকারের দাবিতে বারবার আন্দোলনমুখী হয়েছে কোচবিহার।
অরবিন্দ ভট্টাচার্য
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি ও সংস্কৃতির লোকজন। পর্ব - ১
সব্যসাচী দত্ত
ধারাবাহিক উপন্যাস
ডাউন হলদিবাড়ি সুপারফাস্ট। পর্ব - ১৩
সুজিত দাস
নিয়মিত কলম
মুর্শিদাবাদ মেইল। বাংলার বিস্মৃত বীর মীরমদন
জাহির রায়হান
নিয়মিত কলম
ল্যাব ডিটেকটিভ। পর্ব -৩। ডিএনএ টেস্ট অপরাধী ধরায় বিপ্লব আনলো
নিখিলেশ রায়চৌধুরী
নিয়মিত কলম
আমচরিত কথা। পর্ব - ৯। ভালবাসা ভালবাসা
তনুশ্রী পাল
নিয়মিত কলম
এই ডুয়ার্স কি তোমার চেনা? স্বর্ণকোশের কাছে
শৌভিক রায়
বিজ্ঞানের দুনিয়ায় ভারতীয় নারী
সত্যবতী মতিলাল সিরসত: ভারতে আধুনিক ক্যান্সার গবেষণার রূপকার
রাখি পুরকায়স্থ
পুরানের নারী
যযাতি পত্নী শর্মিষ্ঠা
শাঁওলি দে
পাতাবাহার
মিনি চিজ কেক
পাতা মিত্র

ডাউন হলদিবাড়ি সুপারফাস্ট। পর্ব - ১৩

সুজিত দাস
DownHaldibariSuperfast-13

২৫।

‘ঘুঘুটাকে দেখেছেন, সৌরভ? একটা পা নেই। তবু কী অবলীলায় এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খাওয়ার খুঁটে নিচ্ছে। সময় আসলে শিখিয়ে পড়িয়ে দেয় সবকিছু।’

‘এতক্ষণ পাখিটাকেই দেখছি, রাধারানি। কলারড ডোভ।’

‘হুম, আমরা বলতাম, মালা-ঘুঘু। গলার চারদিকে কী সুন্দর মালা পরিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি’, এই মুহূর্তে রাধারানি ফিরে গেছে চা-বাগিচার শৈশবে, ‘ছোটবেলায় আমাকে পাখি চেনাত ডাক্তারকাকু। এইটা বাঁশপাতি, এইটা নীলকন্ঠ আর ওই যে উড়ে যাচ্ছে দূরের থেকেও দূরে, অনেকটা পথ ঘুরে, ওই পাখিটার নাম গ্রে হর্নবিল। জল, জঙ্গল আর পশুপাখিদের আমরাই শেষ করে ফেললাম, দাত্তাসাহেব।’

রাধারানি এখনও সৌরভের কাছে একটা অলৌকিক ধাঁধার মতো। জটিল একটা এক্সট্রা উপপাদ্য যা সলভ করা অসম্ভব। সফল মোটিভেশনাল স্পীকারের জীবন ছেড়ে এই ঘূর্ণিপাকে নিজেকে এমন ভাবে জড়িয়ে ফেলেছে, বলবার নয়। প্রতিটা অপারেশন নিখুঁত। সার্জেনের ছুরির মত ক্লিনিকাল প্রিসিশন! ‘কোড গ্রিন’-কে লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে, নিজের ফ্যান ফলোয়িং অক্ষত রেখে যে কাজ প্রায় একার হাতে বয়ে নিয়ে চলেছে, এটা অতিমানবীয়।

‘ফাঁসিদেওয়াতে আমার শেষ অনুষ্ঠানের ইমপ্যাক্ট কেমন, দাত্তাসাহেব? ওই এলাকা তো আপনার জুরিসডিকশনের মধ্যেই পড়ে।’

‘খুবই ভাল। বিশেষ করে আদিবাসীদের নিয়ে তোমার যে রূপরেখা, তা কিন্তু এই অল্পশিক্ষিত, চিরতরে গরীব করে রাখা মানুষগুলোর মনে ধরেছে। তোমার কথার ফাঁকে ফাঁকে ধামসা মাদলের দ্রিমি দ্রিমি আওয়াজে ফাঁসিদেওয়ার আকাশ বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠছিল, সেই সন্ধেতে।’

‘এনি অফিসিয়াল ইনপুট?’

‘নাথিং অ্যাজ সাচ। তবে এবারে খুব কঠিন নজরদারি ছিল তোমার ওপরে। অন্তত দুশো প্লেইন ক্লোদ ছিল। অনেকে সরাসরি কলকাতা থেকে। এসপি সাহেবের নির্দেশ ছিল তোমার বক্তৃতার ভিডিও করবার। আইবি থেকে সেই বক্তৃতার বাংলা এবং ইংরেজি ট্রান্সক্রিপ্ট পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাদেরকে। কোথাও বোধহয় এবারে একটা সন্দেহের আবহ কাজ করিছল।’

‘দেন?’

‘তারপর কিছুই না। অন্তত আমার লেভেলে কোনও ইনপুট নেই এখনও পর্যন্ত। আমি খুব খুঁটিয়ে শুনেছি, ইংরেজি তর্জমাও পড়েছি। শব্দচয়ন নিখুঁত, ইটস আ টাইট রোপ ওয়াকিং। আইনি লক্ষণরেখার সঙ্গে চু-কিত-কিত খেলে গেছো একঘন্টার বক্তৃতায়। যখনই মনে হচ্ছিল এবারে পিছলে যাবে শব্দগুলি, ঠিক তখনই ফিরে এসেছ সাবলীলভাবে। ইটস গ্রেট। হাজার কাটাছেঁড়া করেও কিচ্ছু পাওয়া যাবে না। বক্তৃতা দাও যখন, তোমার জিভে সরস্বতী ভর করে।’

‘দাত্তাসাহেব, গোটা ডুয়ার্স জুড়ে ট্রাইবাল ল্যান্ড নিয়ে একটা বিরাট ছেলেখেলা হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই। এই সরকারের প্রথম দিকে ভূমিসংস্কারের সময় বেশ ভালো কাজ হয়েছিল কিন্তু তারপরে যে কে সেই! পার্টি আর প্রশাসন এক হয়ে গেলে যা হয় আর কী। একটা অংশ আবার পুরনো আলট্রা লেফট পথের দিকে ঝুঁকছে আর বাকিরা এলিট অ্যামং দেম।’

‘হ্যাঁ, মদ হাঁড়িয়া আর শিকার দিয়ে ভুলিয়ে রাখা মানুষগুলোকে আর কতদিন এভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, কেউ জানে না। আদিবাসীদের একটা অংশের মধ্যে আনরেস্ট খুব প্রবল। তবে আলট্রা লেফটরা নিজেরাই শতধা বিভক্ত আর ওরা মূলত আরবান চিন্তাভাবনা দিয়ে বিষয়টা ধরতে চেষ্টা করে। এন জি ও-র ক্যামোফ্লেজে বেশিদিন কোনও আন্দোলন টিকিয়ে রাখা যায় বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া এই অঞ্চলের মানুষেরা একবার দেখেছে তাই দ্বিতীয়বার বুদ্ধকে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকাতে দেখলেও ওদের বিশেষ হেলদোল হবে বলে আমার মনে হয় না।’

‘আমরা রক্তপাত চাই না কিন্তু কোথাও গিয়ে এই আদিবাসী ঠকিয়ে বড়লোক হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে একটা শিক্ষা দিলেই এভরিথিং মে কাট ডাউন টু সাইজ। আর কে না ঠকাচ্ছে! ওই এন জি ও মার্কা আরবানদের ফরেন ফান্ডিং জানেন? গরীব আদিবাসীরা এদের কাছে জাস্ট শো-পিস্‌।’

‘কিন্তু একবার মাদল বেজে উঠলেই তিরের ফলা কোন ঠিকানায় উড়ে যাবে, কেউ জানে না।’

‘এই ব্যালেন্সটাই এবার রাখতে হবে। ভায়োলেন্স গিভস মোর হিট দ্যান লাইট, দাত্তাসাহেব। এইসব মানুষদের রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে কোনও লাভ নেই।’

‘ট্রু, ম্যাম। এনি ব্লুপ্রিন্ট?’

‘তৈরি হচ্ছে, ওদেরকে সেলফ সাফিসিয়েন্ট করার সঙ্গে সঙ্গে জমির অধিকার বোঝানোর দিকটা শুরু হয়েছে লাস্ট দু’বছরে। এবারে কাজে নামতে হবে। খুব ধীরে। আপনি সূচনা পেয়ে যাবেন।’

 

মিনতি বসুনিয়া খুব কম কথার মানুষ। তবে ওর হাতের চা কথা বলে। এই বসুনিয়া পরিবারের দুজন মানুষ খুব লো প্রোফাইলে চলে। গজলডোবায় দুজনেই অজাতশত্রু। এই বাড়ির বেসক্যাম্প আপাতত ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। আসলে কোথাও বেশিদিন টানা কাজ করতে নেই, এটাই থাম্ব রুল। আজ মিনতি বসুনিয়ার মুখে তিস্তা ব্যারাজ থেকে একখন্ড মেঘ উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। মিনতির হাতের চুড়িগুলো অন্যসময়ে সারাদিন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে। আজ আর কোথাও কোনও টুংটাং আওয়াজ নেই। আসলে এই কয়দিনে রাধারানি আর মিনতি বসুনিয়ার মধ্যে একটা অদ্ভুত সখ্য গড়ে উঠেছিল। দুই মেরুর দু’জন নারী। আপাত কোনও মিল নেই, তবু। হয় না, দুজনের মধ্যেকার সামান্য হাসি বিনিময়, একটু ছুঁয়ে থাকা... এসবের মধ্যে দিয়েই মিনতি আর রাধারানি বড় কাছাকাছি ছিল এই কয়েকটা দিন। আজ রাতের ট্রেনে ফিরে যাবেন রাধারানি। তাই মিনতির মন ভালো নেই। লুকিয়ে কেঁদেছে অনেকবার। চা দিতে আসার সময়েও চোখ দুটো করমচা ফুলের মতো লাল।

 

ডাউন হলদিবাড়ি সুপারফাস্ট রাত আটটায় ছাড়ে এনজেপি থেকে। এসি ফার্স্ট ক্লাস কামরায় ওপরের বার্থে ওঠে রাধারানি। পাশে ছোট্ট একটা স্লিং ব্যাগ। ওর মধ্যেই টুকিটাকি দু-একটা প্রয়োজনীয় জিনিষ। ট্রেনে নিজের সঙ্গে খুব একটা বেশি কিছু নিতে অভ্যস্ত নয় রাধারানি। ট্র্যাভেল লাগেজ যত কম হয় ততই ভালো। নিচের বার্থে একজন মাঝবয়েসি কাঁচা পাকা চুলের ভদ্রলোক। হাতে পেপারব্যাক, মুখে মিশুকে হাসি। টুকটাক কথা বিনিময় হয়। রাধারানি খেয়াল করে ভদ্রলোকের চুল ক্রুকাট, চোয়াল শার্প এবং নখ নিখুঁত ভাবে কাটা। নিজের মনেই মৃদু হাসে রাধারানি। তাহলে এতদিনে পুলিশের লোক ফিজিক্যালি শ্যাডো করা শুরু করল! দরকার না থাকলেও একবার ওয়াশরুমে যায় রাধারানি। ইচ্ছে করেই ক্রু-কাট-কে বলে যায়, ‘একটু খেয়াল রাখবেন, ব্যাগটা রইল।’

 

রাতের অন্ধকার চিরে ডাউন হলদিবাড়ি সুপারফাস্ট নিজের মত চলেছে শেয়ালদার দিকে। ওপরের এসি ভেন্ট থেকে ঠান্ডা হাওয়া নেমে আসছে কুলকুল করে। রেলওয়ের দেওয়া পাতলা কম্বলটা নিজের গায়ে টেনে নেয় রাধারানি। ব্যাগ হাতে নিয়েই বুঝেছে একপ্রস্থ তল্লাশি হয়ে গেছে। ভালো করে না দেখেও রাধারানি বুঝতে পারে ভেতরের ছোট্ট ডায়েরিটা আর নেই। এবারে জোর হাসি পায় রাধারানির। কয়েক সেটের মধ্যে একটা ছিল ওই মেরুন ডায়েরিটা। তারিখ দিয়ে লেখা আছে টুকিটাকি খরচাপাতি।

কসমেটিক্স থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন। এই হিসেব হাতে পেলে পুলিশ হয়ত ওর শরীর খারাপের ডেট পিনপয়েন্ট করতে পারবে। এর থেকে একচুল বেশি বা কম কিছু ওই মেরুন ডায়েরিতে নেই। পৃথিবীর সব ডায়েরিই রেড হেরিং। কোথাও পুরো সত্যিটা লেখা হয় না। আর এই ডায়েরি তো ম্যানুফাকচারড।

 

তিস্তা নদীর চর জুড়ে কাশ ফুটতে শুরু করেছে। নদীর জলে ইতিউতি ভেসে বেড়াচ্ছে কয়েকটি ডিঙি নৌকো। ছইগুলি রং বেরং-এর। স্পারে বসে তিস্তার দিকে তাকালেই মনটা ভাল হয়ে যায়। আসলে শরৎ একা আসে না, সঙ্গে নিয়ে আসে প্রকৃতির রঙিন পসরা। এমনিতেই তিস্তার স্পারে শেষ বিকেলে একটা ভিড় হয়। ইদানীং সেই ভিড়টা অপরাহ্ন থেকেই শুরু হচ্ছে। প্রেমিক-প্রেমিকা, মডেল-ফটোগ্রাফার, মাঝবয়েসি স্বামী-স্ত্রী... এমত ভিড়ে তিস্তার স্পার এই শেষ দুপুরেও সরগরম। মেয়ে এবং মহিলারা এখন সকলেই দুর্গা সাজতে চাইছে। সাদা শাড়ি, লাল পাড় এমনকী কপালে ত্রিনয়ন! সকলেই দুর্গা, কেউ বা মাটি থেকে সামান্য লাফিয়ে শূন্যে দশভুজার রূপ ধরেছেন। এটাই ট্রেন্ড। তাই তিস্তার পাড়ে ভিড়, ভিড় যাযাবর পাইস হোটেলেও। এ এক আজব পাইস হোটেল। এখনও চাটাইয়ের বেড়া, টিমটিম করে জ্বলা হলুদ আলো, রোগা টেবিলবয়, মালিকের প্রখর নজর প্রতিটা টেবিলের দিকে। খরিদ্দার বিল মিটিয়ে দেওয়ার পর গম্ভীর মুখে বুড়ো বলে, ‘আসুন এবারে।’ তবু এই হোটেলে লোকের আনাগোনা নিরন্তর। বুড়ো মালিক সক্কাল সক্কাল দিনবাজারে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মাছ কেনে, সবজিও। প্রায় বুকের কাছে বাঁধা ট্রাউজারের বেল্ট, মুখে দরদামের তারাবাতি তবে কাঁচামালে কোনও ভেজাল নেই। তাই ‘যাযাবর’ রমরম করে চলছে। কপালে বড় টিপ, লেয়ার কাট চুল এবং স্লিভলেস দুর্গারাও বাধ্য বরের সঙ্গে এসে চাঁপার কলির মতো আঙুল দিয়ে বেছে নিচ্ছে চিতল কিংবা ইলিশের কাঁটা। একটু বাদেই তিস্তার চর, কাশের সাদা, নরম জমির ওপর ভরা পেটে লাফ, মাটির থেকে ওপরে সকলেই নিজেকে ধরে রাখতে চায়। এরপর ফটোশপ, ফেসবুকে লাইক। পাশে বাধ্য স্বামী। তার হাতে ডিএসএলআর। ট্রেন্ড।

 

 

‘ট্রেন্ডগুলো কেমন বদলে যাচ্ছে দেখেছিস?’, কথা বলার সময়েও আজকাল অরিত্রর আঙুল গিটারের তার ছুঁয়ে থাকার ভঙ্গিতে হাওয়ায় চলাফেরা করে।

‘হ্যাঁ, তবে অন্য একটা বদল খুব টের পাচ্ছি বাতাসে’, আজকাল লিরিক লেখার সময়ে পীযুষদার কলম যেন আমার ওপর ভর করে। সব কিছু জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।’

‘শোন কুনাল, এখন আমরা প্রত্যেকেই তুলো ক্ষেতে কাজ করি। দৃশ্যত সাদাকালোর কোনও বিভাজন রেখা নেই। সেই উচ্চারিত দাসপ্রথাও নেই। তবু আমরা সকলেই নিজের অজান্তেই ক্রীতদাস হয়ে বসে আছি। ভাটিয়ালি আর মেমফিস ব্লুজ-এর যে ফিউশনটা বানাচ্ছিস, ওটা মন দিয়ে বানা। তুই আর পীযুষদা বস একদিন একসঙ্গে। গানটাই আমরা পারি। উই ক্যান পুল দ্য স্ট্রিং দিস ওয়ে। সুর মানুষের একদম ভেতরে গিয়ে জাগিয়ে তোলে। সবটাই সিস্টেমের ওপর দোষ দিয়ে লাভ নেই, রাষ্ট্রের ওপরেও। আসলে সিস্টেমের মধ্যে কিছু মানুষ ম্যানিপুলেট করে। সৎ এবং ভালো লোকের সংখ্যা এখনও বেশি। নইলে সবকিছু হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ত।’

‘এই তো দিদিমণি ইন ফুল স্যুইং’, নিজের জয়েন্টের শেষটুকু জন্নতের দিকে এগিয়ে দেয় জোজো।

‘আমাদের প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার মুখেই সেদিনের ওই ব্লাস্ট নিয়ে কী ভাবছিস?’

মহুয়ার এই প্রশ্নের উত্তর ওদের কারো কাছেই নেই তবে গোটা অনুষ্ঠানটা নির্বিঘ্নে চলতে দিয়ে একেবারে শেষলগ্নে এসে ওই ধামাকা… এই ব্যাপারটা ভাবিয়ে তুলছে সকলকে। পাহাড়পুরে ওদের অনুষ্ঠানটাকে প্রায় শেষ করতে দিয়ে তারপরেই ওই ঘটনা। আশ্চর্যের না! দিন দুয়েক আগেও টাউন ডিএসপি ওদের সকলকে কফি খেতে ডেকেছিলেন। সঙ্গে মিত্র নামের ওই আইসি। টাউন ডিএসপি-র বয়েস বেশি না, সাতাশ-আঠাশ হবে হয়ত। অসম্ভব শার্প, দারুণ কথাবার্তা তবে কফি এবং কথার ভেতরে কোথাও যেন খুব আড়ালে একটা জেরা লুকিয়েছিল। ভদ্রলোকের গানের ওপর বেশ দখল, কুনালের সঙ্গে জমে গিয়েছিল। এমনকী ওর গানের সঙ্গে চার্লি প্যাটনের মিসিসিপি ব্লুজ-এর নোটেশনে কোথায় কোথায় মিল বলে চলেছিলেন অবলীলায়। এককথায় টাউন ডিএসপি বেশ ইম্প্রেস করে ফেলে ‘ভার্জিন মোহিতো’র পুরো দলটাকেই। এই গোটা কথোপকথনের সময় আইসি মিত্র পাশের চেয়ারে বসে মেপে যাচ্ছিল মহুয়া আর জন্নতকে। চোখ দিয়ে জামাকাপড় খুলে নিচ্ছিল প্রায়।

দু’রাউন্ড কফি শেষ করে বেরিয়ে আসার সময় টাউন ডিএসপি হঠাৎ ডেকে ওঠেন, ‘জন্নত, একটু শুনবেন?’

‘হ্যাঁ, স্যর। বলুন?’, বাকিরা বাইরে বেরিয়ে গেছে ততক্ষণে।

‘আপনি আর আরাত্রিকা মালবাজারে বাপির হোটেলে লাঞ্চ করার পর কোথায় গিয়েছিলেন?’

‘এর উত্তর কি দিতেই হবে আমায়?’

‘ইটস আ ভেরি সিম্পল কোশ্চেন, জন্নত। আমরা কেউই আনমার্কড নই। আমাদের প্রতিটা চলাফেরা, এমনকী নিঃশ্বাসও কোথাও না কোথাও রেকর্ড হচ্ছে। আপনারও। বাপির হোটেলে লবণ বেশি দেয় একটু যা আপনি পছন্দ করেননি, সেদিনও ছোট মাছের চচ্চড়িতে লবণ বেশি ছিল বলে আপনি একবার মুখে দেওয়ার পর ছুঁয়েও দেখেননি।’

‘বেশ, তিনবছর আগে, আমার জন্মদিনে, ১১ই নভেম্বর আমি একটা ভাল পর্নসাইট হিট করেছিলাম, ডিএসপি স্যর। এখন মনে পড়ে না সাইটটার নাম। আপনার রেকর্ডে থাকলে জানিয়ে দেবেন প্লিজ। আই অ্যাম মিসিং দ্যাট সাইট ব্যাডলি।’

তরুণ অফিসারের মুখের রেখায় কৌতুকের ছাপ ক্রমশ স্পষ্ট হয়, ‘সেটাও কেউ না কেউ মনে রেখেছে, ইয়ং লেডি। এভরি মুভমেন্ট ইজ আন্ডার স্ক্যানার। কেউ না কেউ, কোথাও না কোথাও নিঃশব্দে জরিপ করে যাচ্ছে।’

‘বেশ, শুনুন তবে, আমি সোজা মধুপুর ফিরে এসেছিলাম। আরাত্রিকা ম্যামের কথা বলতে পারব না। জানিও না। আমি ঠিক পুলিশের মতো ততটা কৌতূহলী নই।’

‘আমাকে কৌতূহলী হতেই হয়, হয়ত আপনাদের জন্যই। এমনিতেই ডি এম ম্যাডামের সঙ্গে পাঙ্গা নিয়ে বেশ ভাল একটা ব্লাইন্ড স্পট বানিয়ে রেখেছেন। যা সহজে নজরে পড়ে না কিন্তু অনুভব করা যায়।’

‘এই সব প্রশ্ন কি ওঁরই নির্দেশে?’

‘না, একেবারেই না। প্যাটার্নটা বুঝছি’, আইসি-র দিকে তাকিয়ে টাউন ডিএসপি হাসেন, ‘মিত্র, উড ইউ এক্সকিউজ আস ফর আ মোমেন্ট।’

আইসি মিত্র বেরিয়ে যাওয়ার পর যুবক পুলিশ অফিসারটি জন্নতের দিকে তাকিয়ে থাকে, ‘জন্নত, ‘ভি ফর ভেন্দেত্তা’ দেখেছেন?’

‘অনেকবার।’

‘পাশের লোকটিও আপনার হতে পারে। আই মিন আপনার মতের লোক হতে পারে শুধু মুখোশের আড়ালে বলেই হয়ত লোকেট করতে পারছেন না।’

‘আমি বৃত্তের অনেকটা বাইরে, স্যর। আপনি ভুল যায়গায় টোকা মারছেন।’

‘ব্যাসার্ধ বাড়িয়ে নিতে বলুন। অনেক মানুষ ফেন্সের বাইরে ওয়েট করছে। ইটস আ স্নো বল এফেক্ট। সামান্য বরফ কুচি থেকে হিমবাহ তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া। বেস্ট অফ লাক।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ স্যর, ইয়োর পয়েন্ট ইজ ওয়েল টেকেন।’

 

 

 

তিস্তার চর থেকে স্পারে উঠে আসছে দুর্গারা। পাশে ভারি লেন্স হাতে নিয়ে পুরুষ প্রবরেরাও। সূর্য ক্রমশ ডুবছে নদীর ওপার বরাবর। রঙিন ছই দেওয়া ডিঙিগুলোর সিল্যুট এক অপূর্ব প্যানোরামিক দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে। ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে কেউ যেন সিঁদুর গুলে দিয়েছে গোটা তিস্তা জুড়ে। যাযাবর হোটেলে ঝাঁপ পড়ে গেছে অনেকক্ষণ। একবেলার হোটেল। স্লিভলেস দুর্গাদের হাতে লঙ্কা পেঁয়াজ দিয়ে মাখা ছোলার ঠোঙা। কপালের ত্রিনয়ন ধেবড়ে গিয়ে অনেকটাই স্বাগতালক্ষী স্টাইল এখন। হলদিবাড়ির ‘মাইক্রো’ লঙ্কার ঝালে দুর্গাদের নাক লাল কিংবা বেগুনী হয়ে উঠেছে। চরের কাশফুল স্থির হয়ে আছে হাওয়ার অভাবে। আলো একেবারে মরে এলে মধুপুর শহরের তিন চাকার সব ভ্রাম্যমাণ বাসরঘর ভিড় করবে এই স্পারগুলোর ওপর। প্রতিটা রিকসায় একজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা। বাঁধা রিকসা, বাঁধা যুগল। তিনচাকা থেকে ভেসে আসা মৃদু চুম্বন এবং আশ্লেষের শব্দে একসময় সত্যি সত্যিই সূর্যটা ডুবে যায় ময়নাগুড়ির দিকে। ঝুপ্পুস এক অন্ধকার নেমে আসে মধুপুর শহরে।

 

 

কিছু কিছু মৃত্যু জানান দিয়ে আসে। রঘুডাকাতের মতো।

বিকেল থেকেই তেজেন ডাক্তার বুঝতে পারছিলেন শেষের সেই সময় সমাগত। উদ্বিগ্ন মুখে বিল্বমঙ্গল রায় এবং সুহাসিনী বসে আছেন সামনে। বিল্বমঙ্গল বারবার বলছিলেন মধুপুর কিংবা শিলিগুড়ির হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার কথা। ডাক্তার জানেন ওঁর সময় শেষ হয়ে এসেছে, ‘যাওয়ার সময়টুকু শান্তিতে যেতে দাও, বড়বাবু। এই বাগানেই সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছি তোমাদের আশ্রয়ে, এখানেই চোখ বন্ধ করতে চাই।’ সুহাসিনী তেজেন ডাক্তারের এমত কথায় চোখে আঁচল চাপা দেন। বিল্বমঙ্গল মাঝেমধ্যেই সোফা থেকে উঠে পায়চারি শুরু করছেন।

‘উতলা হচ্ছ কেন, কী পাইনি আমি এই জীবনে। এই সবুজ, নির্মল বাতাস আর বাগানিয়া মানুষের ভালোবাসা। এর বেশি তো কিছু চাইনি আমি। প্রাপ্তির ভাঁড়ার পূর্ণ হয়েছে বড়বাবু। দুঃখ কোরো না তোমরা। কোনও আক্ষেপ ছাড়াই চলে যেতে দাও। শেষ দাবার দানটাও আমিই জিতেছি। তোমার রাজা মন্ত্রীকে নাস্তানাবুদ করে।’

রাতের দিকে ডাক্তারের কথা বন্ধ হয়। শেষ বেলায় বন্ধুর কানে মুখ রেখে জড়ানো গলায় বলার চেষ্টা করেন, ‘রাধারানির খেয়াল রেখো। ও মেয়ে এক নরম আগুনের শিখা। কাউকে পোড়াবে না তবে নিজে ছাই হয়ে যেতে পারে।’

‘তোমার রাধারানি-কে যতটুকু সম্ভব আগলে রাখব, বোঝোই তো, ওকে থিতু করানো অসম্ভব। তুমি চিন্তা সঙ্গে করে নিয়ে যেও না। আমাদের মেয়ে পৃথিবীর ভালো করে চলেছে।’

তেজেন ডাক্তার চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়লেন একসময়। মুখের কোণে স্মিত একটা হাসি। নিখুঁত কামানো গাল থেকে এখনো নীলচে আভা। জামবাড়ি বাগানের কুলিলাইনে কান্নার রোল উঠল। চার্চের যিশুর পাশ দিয়ে উড়ে গেল কয়েকটি রাতচরা পাখি। তারক ব্যানার্জির নেশাগ্রস্থ ময়ূরের কেকাধ্বনি চিরে ফেলল জামবাড়ি চা-বাগানের মধ্যরাত।

মধ্যযামে শব্দের তীক্ষ্ণতা বাড়ে।

ওদিকে ডাউন হলদিবাড়ি সুপারফাস্ট নামের লৌহদানব চলছে নিজের গতিতে। রাধারানির চোখে জাগরণ এবং সুপ্তির লুকোচুরি। বাইরে একটার পর একটা চেনা অচেনা স্টেশনের নাম ফলক আশ্বিনের শিশিরে ভিজে একাকার।

 

২৬।

আওয়াজটা সরাসরি বুকে এসে লাগে। প্রতিটা বিটে পিলে চমকে যায় যেন। মিছিলটা এখনও ভেনাস মোড়ে। তবে আওয়াজ সেভক মোড় অবধি পৌঁছে গেছে। এই নতুন সাউন্ড সিস্টেমের নাম ডিজে বক্স। সেভক মোড়ের খবরের কাগজের দোকানে বসে বুকে হাত ঠেকায় ভগবান। কালে কালে কত যন্ত্র যে আর আসবে। শিলিগুড়ি এলে এই দোকানে এসেই মাগনায় উত্তরবঙ্গ বার্তা পড়ে ভগবান দাস বেহালাবাদক। কাগজওয়ালা দীনেন ওর পুরনো বন্ধু। একসময়ে জঙ্গল সাঁওতালের ডানহাত ছিল। এখন খবরের কাগজ বিক্রি করে বটে কিন্তু নিজে রাজনীতির পাতাটা পড়ে না। ভগবানকে খুব ভালোবাসে। দোকানে এলেই কার্সিয়াং মেডিক্যাল হলের পাশের চায়ের দোকান থেকে আদা দেওয়া কড়া লিকার চা নিয়ে দুই বন্ধু গল্পে মাতে। ভগবান তিন জনের জন্য অপেক্ষা করছে। চারজনে মিলে বাতাসী যাবে। ওই তিনজন আপাতত ওখানেই কয়েকমাস ওখানেই থাকবে। কিন্তু ডিজে বক্সের শব্দে এখানেও টেঁকা দায় হয়ে উঠেছে এখন। মধুপুরে এই আজব মাইকের উপদ্রব এখনও তেমন শুরু হয়নি। কিন্তু শিলিগুড়িতে আজকাল কারণে অকারণে এই দ্রুম দ্রুম আওয়াজ। খবরের কাগজ দেখেই টের পেয়েছিল এটা বোধহয় কারো ভোটে জিতে আসার বিজয় মিছিল। এখন মিছিলের মুড়োটা দেখে নিশ্চিত হয় ভগবান। বিজয় মিছিলই বটে।

মিছিল বলে মিছিল!

মিউনিসিপ্যালিটি ইলেকশন জেতার পরে এত লম্বা মিছিল, ভাবা যায়! একেবারে সামনে মঙ্গল কলস মাথায় নিয়ে প্রায় শ’খানেক মহিলা। তারপর খোলা ট্রাকে বিরাট উঁচু উঁচু প্রায় দশটি ডিজে বক্স। তার পেছনে শ’দুয়েক উদ্দাম যুবকের দল। বিচিত্র সেই নাচের মুদ্রা। বেশিরভাগেরই পরনে জিন্স, গায়ে জামা নেই। যুবকের দল এই ভরদুপুরেও পেটে মদ নিয়ে চড়া রোদে নৃত্যরত। নাচের দলকে ফলো করছে একটি হুডখোলা জীপ। সেই জীপের ওপর বাসন্তী পাঞ্জাবি পরিহিত শ্রীমান বিশ্বজিৎ পাল অ্যালিয়াস চিকা বিশু। একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বোঝা যায় চিকা বিশুর কপালে ঘাম, ঠোঁটে ভুবনজয়ী হাসি। মুখের ভেতর মিঠাপাতা একশ বিশ জর্দার পান ঠাসা। এই রৌদ্রে জর্দা হিসেব বুঝে নিচ্ছে। মাথা আর কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম নেমে আসছে শরীর বেয়ে। ৫৪ নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত প্রার্থীর বাসন্তী পাঞ্জাবি জবজব করছে একেবারে। এই বিশ্বজিৎ পালকে দেখে পেত্যয় হয় না সেদিনের এনজেপি-র হকার বাহিনীর একচ্ছত্র তোলাবাজ চিকা, চিকা বিশু আজ জনপ্রতিনিধি। কালে কালে আরো কত কিছু যে দেখতে হবে। তবে একে বাটা সুভাষের সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখেছে ভগবান। ‘কোথাকার মায়াজল কোথায় গড়ায়।’

তবে মিছিলের রগড় বেশ চেটেপুটে উপভোগ করে ও। মিছিলের একদম শেষে প্রচুর ভদ্রলোক। এদের বেশিরভাগই লম্বাঝুলের পাঞ্জাবি, মুখে দাড়ি আর কাঁধে সুতির ঝোলাব্যাগ। মনে মনে চিকা বিশুকে তারিফ করে ভগবান। ছোকরা ঘুঘু, শিয়াল আর বিলাই-কে এক মাচায় নাচিয়ে ছেড়েছে বটে। একসময় বাপের গু-মুতের দোকানে বসে খুচরো কালেকশন করা রোগা ছেলেটা এতদূর চলে আসবে! ভ্যালা রে নন্দলাল, বেঁচে থাক চিরকাল। নিজের মনেই খিক্‌ খিক্‌ করে হেসে ওঠে ভগবান।

খিক্‌ খিক্‌ করে আরো একজন হাসছে বটে এই মিছিলের একদম ল্যাজার দিকে। পরনে গোলাপি জহর কোট, চোঙা গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট। পায়ে কুয়োভাদিস জুতো। এঁকে আমরা চিনি। প্রশান্ত কর, ম্যানেজিং এডিটর, খবরিলাল নিউজ পোর্টাল। প্রশান্তর রাহু, কেতু, বৃহস্পতি সব তুঙ্গে এখন। যেদিকে তাকাচ্ছে, সেদিকেই টাকা। এই মিউনিপ্যাল নির্বাচনে একা চিকা বিশুই মালামাল করে দিয়েছে ওকে। পোর্টালে নিউজ প্রতি কন্ট্রাক্ট ছিল, যত রিচ তত টাকা। নতুন কেনা আই ফোন থেকে লাইভ করে চলেছে প্রশান্ত। এতক্ষণে কয়েক হাজার ভিউয়ার, কমেন্টের বন্যা। প্রশান্ত জানে, এই দু-তিন দিন খুব ভাইটাল। এই ক’দিন চিকা বিশুর সঙ্গে ওর সখ্য হেতু অমর আকবর অ্যান্টনি-র দলের থেকে হু হু করে মাল আসছে। রোজ ডিনার, রোজ স্কচ। সব দলের মহিলা সমাজসেবীরাও ক্ষণে ক্ষণে ফোন করছে প্রশান্তকে। প্রশান্ত যতটা জানে তার চাইতে একটু বেশিই বলে তবে রহস্য বজায় রেখে। কুচো সাংবাদিক থেকে বড় হওয়ার মূলমন্ত্রই হল রহস্য। এই রহস্যই টাকা আনে। টাকা, আরো টাকা আনে। বুলেট পঞ্চার একটা এক্সক্লুসিভ নিয়েছে, নগদানগদি দশ হাজারে। তবে সবকিছুর মধ্যেও বাটা সুভাষের মুখটা অমরীশ পুরীর মত ভেসে উঠছে। যে যতই লাফাক না কেন, লাটাই তো ওর হাতেই। তবু হাতের লক্ষ্মী ফেলতে নেই। যা আসছে, দুহাত ভরে নিয়ে নিচ্ছে প্রশান্ত। এমন সুসময় জীবনে আর কখনো আসবে কিনা, সন্দেহ আছে। ২৭/২৭ টাই। চিকাই এখন রঙের টেক্কা। মাদারির খেল-এ ডুগডুগি বাজানোর এটাই লাস্ট চান্স।

তা চিকা বিশু খেল্‌ই দেখিয়েছে বটে।

ঠাকুর যখন দেন, ছপ্পর ফুঁড়েই দেন। একমাত্র নির্দল হিসেবে জিতেছে বিশু। ৫৫টি ওয়ার্ডের এই মিউনিসিপ্যালিটিতে অমর আর আকবরের পার্টি জোট বেঁধে ২৭টি আসন জিতেছে। অ্যান্টনির দল একাই ২৭টা। একমাত্র নির্দল শ্রী বিশ্বজিৎ পাল। এখনও এ তল্লাটে দলবদলের বাতাস লাগেনি। নিজের দল বা জোট ছেড়ে কোনও কাউন্সিলারই এধার ওধার করবে না। তাই বোর্ড গড়তে ওকেই চাই। দুই পক্ষের তরফ থেকেই যোগাযোগ শুরু হয়েছে। চিকা এখন সুখের সপ্তম স্বর্গে। পুরনো একটা ছড়া মনে পড়ে যায় ভগবানের, যা শুনিয়ে একসময় এই রোগা ছেলেটাকে ক্ষ্যাপাত ওর বন্ধুরা, ‘চিকা, চিকা, ব্যোম্‌ চিকা / চিকার দাম পাঁচ সিকা।’ এই মুহূর্তে তরাইয়ের এই শহরটিতে সবচাইতে দামী মানুষটির নাম চিকা বিশু। সোনার বাটখারা দিয়ে ওর ওজন মাপা হবে এই ক’দিন। আজকের এই মিছিলে ওর নিজের লোক ছাড়াও তিনটে দলের লোকই আছে। বাটা সুভাষ এর মধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে চেয়ারম্যান পদ না পেলে কাউকে সমর্থন নয়। এবং আশ্চর্যজনকভাবে দুই পক্ষই এতে রাজি। কোনদিকে যাবে, এই সিদ্ধান্ত নিজেকেই নিতে হবে। শুধু ট্রেড লাইলেন্স, রাস্তা এবং আরো কয়েকটি মালাইদার বিভাগ নিয়ে এখন ভাবছে দুটো পক্ষই। চিকা এখন টক অফ দ্য টাউন। আজকের উত্তরবঙ্গ বার্তার প্রথম পাতায় ভাবী চেয়ারম্যান হিসেবে চিকার রঙিন ফুল-সাইজ ছবি। বাসন্তী পাঞ্জাবি, গলায় মোটা সোনার চেন, লোকনাথবাবার লকেট।

চিকা রকস্‌।

মিছিল ভগবানের সামনে দিয়ে সেভক মোড় পেরিয়ে এয়ারভিউ হোটেলের দিকে এগোতে থাকে। এতক্ষণে ডিজে বক্সের আওয়াজ খানিকটা সয়ে এসেছে। বুকের ভেতরটায় ততটা আঘাত দিচ্ছে না আর। বরং বেহালাবাদকের বেশ চনমনে মনে হচ্ছে নিজেকে। আওয়াজেও কেমন একটা ইয়ে আসে। দুমদাম আওয়াজ কিছুক্ষণের জন্য মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতাটাকে কিডন্যাপ করে ফেলে। ভগবানের মনে পড়ে ও কেন অপেক্ষা করছে। এইচ ডি, সাবিত্রী আর শুক্রা আসবে এখানে একটু বাদেই।

 

মিছিলটা চলে যাওয়ার খানিক বাদেই তিনজনে এসে উপস্থিত হয় সেভক মোড়ের ম্যাগাজিন স্টলটিতে। একটা পুরনো রংচটা মারুতি ভ্যানে। দীনেনের সঙ্গে করমর্দন করে বিদায় নেয় ভগবান। বাম হাত দিয়েই দুজনে হাত মেলায়। দীনেনের ডান হাতের পাঁচটা আঙুলই এক এক করে কেটে নিয়েছিল প্রদীপ দারোগা, থার্ড ডিগ্রীর বেতাজ বাদশা ছিল সেইসময়। এখন দীনেনের দোকানেই আড্ডা মারতে আসে বুড়ো। ছেলেটা অতিরিক্ত ড্রাগ ডোজে মারা গেছে, মেয়েটা ডিপিএস-এ পড়ায়, ভাঙা বিয়ে। সময় কখন কাকে কীভাবে মিলিয়ে দেয়, কেউ জানে না।

মারুতির পেছনের সিটে গিয়ে বসে ভগবান। আপাতত কয়েকমাসের জন্য এই তিনজন বাতাসীতেই থাকবে। সামনের মিছিল মাল্লাগুড়ি অবধি যাবে তাই এয়ারভিউ মোড় থেকে বাঁদিকে গাড়ি ঘুরিয়ে নৌকাঘাটের রাস্তা ধরে এইচডি। কাওয়াখালি হয়ে এই রাস্তা একটু ঘুরপথে বাতাসী যায় বটে তবে এই রুটে গাড়ি ঘোড়া অনেক কম। শুক্রা উসখুস করছে অনেকক্ষণ ধরে,

‘ভগবান-দা, থাকার জায়গাটা কেমন? খাওয়া-দাওয়া?’

‘আমি কি আর অত জানি রে ব্যাটা? তবে সুভাষদা ওর কর্মচারীদের খারাপ রাখে না। তোকে তো ভালই মাইনা দিবে শুনলাম।’

‘ভগবান-দা, দোষ দিও না শুক্রাকে। নাংডালা চা-বাগানে আলু আর টমেটোর ঝোল খেয়ে খেয়ে ওর মুখ পচে গেছে’, স্টিয়ারিং হাতে রাস্তার দিকে চোখ তবু শুক্রার হয়েই উত্তর দেয় এইচ ডি।

‘চিন্তা করিস না বাপ, বাতারিয়া নদীতে ভালো মাছ আছে। ফাঁকা সময়ে ধরবি আর খাবি। বাতাসী হাটেও না ম্যালা মাছ-মাংস। সপ্তায় একদিন।’

খানিকটা আশ্বস্ত হয় শুক্রা। উঠতি বয়েসের ছেলে। একপেট খিদে নিয়ে বাঁচে সবসময়। যাইহোক, এতদিনে একটা ‘পার্মানেন’ কাজ পেয়েছে। কাজ জুটে যাওয়ার আনন্দ আর নতুন জায়গা নিয়ে খানিক আশঙ্কা, এই দুইয়ের মাঝে চাঁদিয়াল ঘুড়ির মত আকাশে লাট খেতে থাকে এই সদ্য যুবকের চিন্তাভাবনা। ম্যানেজার হিসেবে মাথার ওপর হরিদা আছে, এটাই অনেক। তবে সাবিত্রীদি সঙ্গে কেন, এটা বুঝে পায় না শুক্রা। তাও আবার স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে। জাউক গিয়া, অত ভাবনা ভাবলে চলে নাকি? ওরা যে এমনিতেও প্রায় স্বামী-স্ত্রীর মতোই থাকে, এটা ভালোই জানে শুক্রা।

 

 

নতুন জায়গায় এসে কাজ বুঝে নিচ্ছে এইচ ডি। শুক্রাও পুরনো সুপারভাইজারের থেকে শিখে নিচ্ছে মজদুরদের ওয়ার্ক-লগ, হপ্তা পেমেন্ট এবং অন্যান্য বিষয়গুলো। বাতাসী থেকে একটু ভেতরে বাতারিয়া নদীর পাশে এই প্লাইউড কারখানা। প্রায় ষাটজন শ্রমিক, বেশিরভাগই স্থানীয় আদিবাসী। ম্যানেজারের একটা ছোট্ট অফিস, লাগোয়া দুই কামরার থাকার জায়গা। শুক্রার থাকার ব্যবস্থাও মেশিনঘরের পাশে একটা কাঠের ছাউনিতে। সুভাষ-দা ভালই ব্যবস্থা করে রেখেছে এই কারখানার মধ্যেও। বিকেল থেকেই সাবিত্রী ঘর গুছোচ্ছে, নিজেদের এবং শুক্রার ঘরটাও। আজকে আর রান্না বান্নার পাট নেই। রুটি তরকা নিয়ে আসবে হরিদা ওদের তিনজনের জন্য। কাল থেকে নতুন ‘সংসার’।

সন্ধ্যাবেলা ভগবান আসে সাবিত্রীদের নতুন ঘরে,

‘কী দিদি, গোছগাছ সারা? নতুন জায়গা, মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে।’

‘আসলে আপার চ্যাংমারির ওই লেবু আর কলাবাগানের সঙ্গে একটা মায়ায় জড়িয়েমড়িয়ে ছিলাম, ভগবান-দা।’

‘কয়েকমাসের ব্যাপার। এরপর শুক্রা বাদ দিয়ে তোমরা দুজনেই তো আবার সেই পুরনো জায়গায়।’

‘সুভাষদা কিংবা মিলনজীর থেকে কোনও নির্দেশ এসেছে?’, এইচ ডি সরাসরি জিজ্ঞেস করে।

‘দ্যাখো হরি, এই এলাকা আমার হাতের তালুর মতো চেনা। ভরা যৌবনে এখানেই জোতদারদের বাড়িতে বাড়িতে আগুন লাগিয়েছি, মানুষ মেরেছি। কিছু পুরনো লোক এখনও চেনে আমাকে।’

‘জানি, ভগবানদা, সেই পথকে তোমরা অনেকেই ভুল মনে করো এখন। কয়েকজন পুলিশ আর জোতদার মারলেই বিপ্লব হয় না। আমাদের এখনকার কাজটা করতে হবে অনেক গভীরে গিয়ে। গত দু-তিন বছরে ‘ট্রিপল আর’ ভেতরে ভেতরে অনেক কাজ করে গেছেন। যত সেলফ হেল্প গ্রুপ দেখছ, অর্ধেকের বেশি ‘কোড গ্রিন’-এর লোক। এরা বাইরে বাইরে সকলেই রুলিং পার্টির লোক। ওদের মিছিলে গিয়ে মাদলও বাজায়। কিন্তু মনের ভেতরে তুষের আগুনের মতো রাগ পুষে রাখা আছে।’

‘ঠিক হরি, জমিনের জন্য ক্ষোভ। বাপ ঠাকুর্দারা অনেকেই দুটো মুরগি আর এক বোতল বাংলা মদের বিনিময়ে বিঘার পর বিঘা জমি লিখে দিয়েছে। সেই জমিনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে এখন ওরা।’

‘শোনো, তুমি যে কয়েকদিন থাকবে আমাকে কিছু লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দাও, বাকিটা আমি বুঝে নেবো।’

‘এই প্লাইউড ফ্যাক্টরির প্রায় সবাই ‘কোড গ্রিন’-এর লোক। বুধিয়া আর সোমরার সঙ্গে বাটা সুভাষের সরাসরি যোগাযোগ। টাকা পয়সা সব কিছুই সুভাষ ওদের মাধ্যমে পাঠাবে।’

এইসব কথাবার্তার মধ্যে শুক্রা একবাটি রাই সরিষা দিয়ে বানানো ফাক্‌সার ঝাল আর দুই বোতল বাংলা নিয়ে আসে। মদ্যপান শেষ হলে ভগবান শুক্রার ঘরে চলে যায়। কাল সকালেই ও ফিরে যাবে মধুপুর। সুপ্রভাত উকিলের সঙ্গে অনেক কাজ আছে। এখানকার বিএলআরও অফিস থেকে একবান্ডিল পুরনো পর্চা উদ্ধার করেছে। সব ট্রাইবাল জমির খতিয়ান। কিছু জেরক্স কপিও। আসল হোক বা জেরক্স, জমির পুরনো চরিত্র অনেকটা বোঝা যাবে। তাছাড়া উকিলবাবু পাতাল থেকেও জমির আসল মালিক খুঁজে আনতে পারেন। দেখা যাক।

মদ খাওয়ার পর হরি খানিকটা দার্শনিকের মতো ব্যবহার করে। চিৎ হয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে সারা পৃথিবীর জমিন হয় কিনে নয় দখল করে সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেবে। জমির গন্ধ, গাছের পাতার সবুজ আর মাটির ভাপ মাথার ভেতরে এক্কাদোক্কা খেলে কড়া বাংলা মদের সঙ্গে। কয়েকঘন্টায় সাবিত্রী এই ঘরটাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ফেলেছে। তক্তাপোষের ওপর তোষক। তোষকের ওপর মিলের সস্তা চাদর। চাদরে উড়ে আসা পাখি। বাইরের ঘর থেকে ধূপের গন্ধ ভেসে আসছে। খুব কাছ দিয়ে বয়ে চলেছে বাতারিয়া নদী। নদীর বুকে শুয়ে থাকা বড় বড় পাথরের ওপর জলের ধাক্কা খাওয়ার শব্দে কোনও বিরাম নেই। রাত দশটার সময় এখানে গভীর রাত। বড় রাস্তা থেকে অনেকটা দূরে এই কারখানা। উঁচু ভাটাম গাছগুলো থেকে রাতের পাখিরা উড়ে যাচ্ছে চতুর্দিক। বাতাসী, ফাঁসিদেওয়া, নক্সালবাড়ি, পানিট্যাঙ্কি, খড়িবাড়ি। পাখিদের নিজস্ব কোনও এলাকা ভাগ করা নেই। রাতের পাখিরা তো আরো বিন্দাস। মাথার ওপরে রৌদ্রের মানচিত্র নেই, দিনের বেলার কাইক্যাচাল নেই, গাঢ় এক তমসা কিংবা নরম চাঁদের আলোয় তাদের রাজপাট। আহা, চিৎ হয়ে শুয়ে পাখিদের হিংসা করতে থাকে হরিদাস সাহা, লোকাল করেসপনডেন্ট, ‘দ্য ডেইলি নিউ এজ’, সম্পাদক, ‘জলঢাকা নিউজ’। এভাবেই, এইচ ডি, বিয়িং এইচ ডি, একসময় অনুভব করে শরীর জেগে উঠছে ডিসপুট জমির আলপথ দিয়ে।

সাবিত্রীর চেনা শরীরকে প্রতিবারই নতুন মনে হয় এইচ ডি-র। পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো এক এক করে আবিষ্কার করে পুরনো টিলা, নতুন গিরিখাত, বৃষ্টি ছাঁটে ভিজে যাওয়া পাহাড়ি চোরাবাটো, নাম না ফুলের বৃন্ত। তুঙ্গ মুহূর্তের পর সব চুপচাপ। শুধু বাতারিয়া নদীর জল আর পাথরের যুগলবন্দী। খানিক বাদে শাড়ি পালটে ফেলে সাবিত্রী। সেই সাদা খোলের শাড়ি, মোটা ব্লাউজ। সবচেয়ে কাছের ভাটাম গাছটা থেকে একটা নাইটজার ডেকেই চলেছে। চোখ বন্ধ অবস্থায় হরির সামনে ভেসে ওঠে নাগরাকাটায় নিজের ছোট্ট বাড়িটার কথা। তরুবালা এখনও জেগে আছেন তক্তপোষের ওপর। সুতির মশারির ভেতর থেকে বলেই চলেছেন,

‘হরি, অ হরি, এলি বাপ?’

‘হরি, অ অ অ হরি, এলিরে বাপ?’

 

(এরপর আগামী সংখ্যায়)

এই সংখ্যার সূচী

করোনা কালের প্রতিবেদন ফ্রি রিডিং

Disclaimer: Few pictures in this web magazine may be used from internet. We convey our sincere gratitude towards them. Information and comments in this magazine are provided by the writer/s, the Publisher/Editor assumes no responsibility or liability for comments, remarks, errors or omissions in the content.
Copyright © 2025. All rights reserved by www.EkhonDooars.com

Design & Developed by: WikiIND

Maintained by: Ekhon Dooars Team