‘কী হল রে জান…. পলাশির ময়দানে নবাব হারাল পরাণ/তির পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে, গুলি পড়ে রয়ে/ একলা মীরমদন বল কত নেবে সয়ে/ছোট ছোট তেলেঙ্গাগুলি লাল কুৰ্ত্তি গায়/হাঁটু গেড়ে মারছে তীর মীরমদনের গায়’। না রক্তস্নাত শত প্রচেষ্টাতেও সেদিন শেষ রক্ষা হয়নি বাংলার, শেষ রক্ষা হয়নি সেনাপতি মীরমদনের। তাঁর বীরত্বের কথা, তাঁর শোকগাঁথা ছড়িয়ে রয়েছে গানে, গল্পে, কবিতায়।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার একজন বিশ্বস্ত গোলন্দাজ সেনাপতি ছিলেন মীরমদন। প্রথম জীবনে তিনি কাজ করতেন ঢাকায়, হোসেন কুলি খানের ভ্রাতুষ্পুত্র হাসান উদ্দিন খানের অধীনে। তাঁর দক্ষতা ও কর্মকুশলতার সন্ধান পেয়ে তাঁকে মুর্শিদাবাদে এনে সেনাপতির আসন দেন তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলা। বখশী মীরমদন ছিন নতুন সেনাপতির সম্পূর্ণ নাম।
১৭৫৭ সাল বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে ঘটনাবহুল সময়। বণিকের মানদন্ড রাজদন্ডে বদলানোর সূত্রপাত হল তখনই। ভিনদেশীয় বণিক ইংরেজরা ভারত শাসনের বীজ রোপন করে পলাশি যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে। ২৩ শে জুন ১৭৫৭ বৃহস্পতিবার শেষ বারের মতো উদিত হয় স্বাধীন বাংলার সূর্য।
২২শে জুন গভীর রাতে গঙ্গা পার হয়ে পলাশির আমবাগান লক্ষবাগে শিবির স্থাপন করলেন রবার্ট ক্লাইভ। ভোরের সূর্য ওঠার আগেই বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা। আমবাগান সজ্জিত হল রণসজ্জায়। নবাবের সেনাবাহিনীর তুলনায় সৈন্য সংখ্যা কয়েক গুন কম, তবে তাঁর বন্দুকবাজের দল ছিল ভয়ঙ্কর, দক্ষ ও কুশলী। আর তাঁর আসল শক্তি তো মীরজাফর, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, জগৎশেঠ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ বিশ্বাসঘাতক। সুতরাং ক্লাইভের যুদ্ধ জয় কেবল সময়ের অপেক্ষা!
ওদিকে নবাব বাহিনীও প্রস্তুত। সকাল আটটায় ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে তোপ দাগলেন নবাবের ফরাসি সেনানায়ক সিনফ্রে। শুরু হল যুদ্ধ। একদিকে মীরমদনের নেতৃত্বে মোহনলাল, নবে সিং হাজারি প্রমুখ গোলন্দাজ বাহিনী লড়াই শুরু করলো শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে আর অন্যদিকে নিস্পৃহভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে রইলো মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দূর্লভ। তবে বিশ্বাসঘাতকেরা নিশ্চেষ্ট থাকলেও ইংরেজ বাহিনীকে প্রবল ভাবে আক্রমণ করলেন মীরমদনেরা। আধ ঘন্টার মধ্যেই ইংরেজদের গোটা তিরিশেক সেনা ঘায়েল। মীরমদনের গোলন্দাজ বাহিনীর প্রতাপে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল ইংরেজ বাহিনী। চতুর ক্লাইভ প্রমাদ গুণলেন, এভাবে চললে এক-দুই দন্ডেই তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন তাঁরা। সুতরাং রাতের আঁধারে বিপক্ষের বিরুদ্ধে আক্রমণের মনস্থির করলেন তিনি, কেননা অন্ধকারে যুদ্ধ চালাতে সিদ্ধহস্ত নয় দেশি ফৌজ। দক্ষিণ দেশের যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় ক্লাইভ সে ব্যাপারে অভিজ্ঞ। সেই কৌশলে এবং পাশাপাশি মীরমদনের প্রবল পরাক্রমে পরাভূত হয়ে সেনাসহ আমবাগানে আশ্রয় নেন ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ। উদ্দেশ্য কোনওক্রমে সন্ধ্যে অবধি লড়াই জারি রাখা।
তবে শুধু বিশ্বাসঘাতকেরা নয়, প্রকৃতিও বোধহয় বিরূপ ছিল নবাবের প্রতি। দুপুরের দিকে হঠাৎই আকাশ ঝেঁপে বৃষ্টি নামে যুদ্ধক্ষেত্রে, ফলস্বরূপ গোলাবারুদ ভিজে যায় নবাব বাহিনীর। তবুও ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন সাহসী মীরমদন এবং অপর সেনাপতি মোহনলাল। বৃষ্টি থেমে গেল ইংরেজ বাহিনীকে ঘিরে ধরার জন্য আরো অগ্রসর হলেন তাঁরা, সম্মুখভাগে মীরমদন স্বয়ং। ওদিকে সম্মুখে নবাবী গোলন্দাজ বাহিনীর অগ্রসর প্রতিহত করতে কামান দাগতে শুরু করলো ইংরেজ ফৌজ, হঠাৎই এক গোলার আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন বাংলার অকুতোভয় সৈনিক মীরমদন। দিনটা ছিল ২৩ জুন ১৭৫৭।
বিশ্বস্ত সেনাপতি মীরমদনের মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে গেল নবাবী সৈন্য, ভেঙে পড়লেন তরুণ নবাব সিরাজউদৌল্লা। সুযোগটা কাজে লাগালো বিশ্বাসঘাতকেরা। প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের কুপরামর্শে যুদ্ধ বন্ধের আদেশ দিলেন সিরাজ। আর সেটাই হল কাল। দিকভ্রান্ত ও রণক্লান্ত নবাবের বাহিনীকে পরাজিত করতে আর বেগ পেতে হয়নি ব্রিটিশদের। অচিরেই জয় পেল তাঁরা। আর এভাবেই একজন মহান, দুঃসাহসী সেনানায়কের মৃত্যুতে তরান্বিত হল বাংলার পরাধীনতার শৃঙ্খল।
তারপর যুগের পর যুগ ধরে বয়ে চলেছে ভাগিরথীর জলধারা। বাংলার স্বাধীনতার সূর্য রক্ষার্থে যে ব্যক্তি নিঃসঙ্কোচে প্রাণ দিয়েছিলেন পলাশির প্রান্তরে, তিনি সমাধিস্থ আছেন অগোচরে, অলক্ষ্যে, অবহেলায়। এক সমাধিক্ষেত্রের সামান্যতম নিদর্শন ছাড়া আর কিছুই নেই তাঁর। কথিত আছে, মীরমদনের অনুগত কিছু সৈনিক তাঁর মৃতদেহকে গোপনে কবরস্থ করেন পলাশি হতে ৪-৫ মাইল দূরে রেজিনগরের নিকটে ভাগিরথী নদী তীরবর্তী ফরিদপুর গ্রামের ফরিদতলায়। ওখানেই রয়েছে ফরিদ সাহেব নামক জনৈক মুসলিম পীরবাবার সমাধি। আর সেই ফরিদপুরে ফরিদ খানের সমাধির পাশে সমাধিস্থ আছেন পলাশি যুদ্ধের অন্যতম বীর সেনাপতি মীরমদন। এছাড়াও পলাশির স্মৃতিসৌধের নিকট চাষ জমির ভেতরে রয়েছে তিনটি অনুচ্চ স্মারক, যা মীরমদন, নবে সিং হাজারি এবং বাহাদুর খানের স্মৃতিতে প্রোথিত। মীরমদনের সমাধি, ফরিদতলা পীর আস্তানা, পলাশির যুদ্ধ এবং সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় সম্বন্ধে তৎকালীন গ্রাম্য কবিগণের রচিত গান আজও পলাশির নিকটবৰ্ত্তী গ্রামবাসীদের মুখে শুনতে পাওয়া যায়-‘কী হল রে জান/পলাশির ময়দানে নবাব হারাল পরাণ/নবাব কাঁদে সিপুই কাঁদে আর কাঁদে হাতি/কলকেতাতে বসে কাঁদে মোহনলালের বেটি’।
এখন কেমন আছে ফরিদপুর? কেমন আছে তার বীর বাসিন্দা? একদিন যাওয়া হল দেখতে। দেখার কাজে সহযোগিতা করলেন ইংরাজি সাহিত্যের পড়ুয়া স্থানীয় সোফিয়া নাজনিন। তার নিকটাত্মীয়রাই দেখভাল করেন আস্তানাটির। গাছগাছালি ঘেরা একটি চটান। পাশে একটি বৃহৎ পুষ্করিনী। জনমুখে যার পরিচিতি পীর পুকুর হিসেবে। পীর সাহেরের সমাধি মন্দিরটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট। প্রায় নির্জন ছায়াময় ফরিদপুর পীর আস্তানাটিতে প্রতি সপ্তাহের মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার কিছু লোক সমাগম হয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভক্তের দল পীর সাহেবের কাছে মানত রাখে ভক্তি ভরে। কারো পূর্বের করা মানত মান্যতা পেলে তিনিও আসেন কথা রাখতে। অনেকে ঐ দিনটিতে ওখানেই নানা ব্যঞ্জনের রান্না করে সে খাবার বিতরণ করেন আগ্রহীদের মধ্যে।
ভালো করে খেয়াল করলে ফরিদ সাহেবের কবরের পাশাপাশি মীরমদনের সমাধিতেও দেখা মেলে সিঁদুরে রঙের। আগত পীর সাহেবের অনুরাগীরা অনেকেই মীরমদনকে আর একজন পীরের মর্যাদা দিয়ে তাঁর আরাধনা করেন সজ্ঞানে। তাঁর কবরের দ্বারে রঙিন সুতোর গিঁট বেঁধে মানত রাখেন তাঁকে সাক্ষী মেনে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ বীর যোদ্ধা মানুষের মনে অজান্তেই উপবিষ্ট হন পীরের আসনে। ব্যস, ইতিহাস খ্যাত বাংলার বীর যোদ্ধা মীরমদনের প্রাপ্তি বলতে ওটুকুই। আর যেন তাঁর পাওয়ার নেই কিছু। সে কথা মনে করায় ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রোথিত বিবরণটিও, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার একজন সেনাপতি পলাশির যুদ্ধে নিহত মীরমদনের এই সমাধিটি ফরিদ নামে একজন ফকিরের সমাধির অঙ্গনে অবস্থিত। একটি প্রাচীর বেষ্টিত স্থানে অবস্থিত ইহা একটি সাধারণ কবর মাত্র’।
সাধারণ কবরে শুয়ে থাকা অসাধারণ ব্যক্তিটির অবদান ভুলে গেছে স্বাধীন দেশ ও তার নাগরিক সমাজ। তাঁর বীরত্ব, তাঁর ভূমিকা, তাঁর আত্মত্যাগ কালের কোঠরে গুমরে মরে বর্তমানে। ইতিহাসের নির্লিপ্ততায় চাপা পড়ে যায় ইতিহাস। অভিমানে আকাশের পানে চেয়ে উত্তর পানে মাথা রেখে চিরঘুমে শুয়ে থাকে মীরমদন, পাশ দিয়ে পলাশি প্রান্তরের পানে কলকল শব্দে বয়ে চলে ভাগিরথী সেই আগের মতোই।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team