নয়-নয় করে বার আটেক বেড়ানো হয়ে গেল সিকিমে। তবু এখনো বাকি রয়ে গেছে বেশ কতকগুলো জায়গা। আসলে ভৌগোলিক ভাবে সিকিমকে দিক অনুযায়ী ভাগ করলে যা দাঁড়ায় সেই উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম –এই চার অংশ, প্রকৃতির অসীম সৌন্দর্য-সম্ভার নিয়ে নিরন্তর ভ্রমণ বিলাসীদের আকর্ষণ করে চলেছে যুগে যুগে। বছরের বিভিন্ন সময়ে ঋতুবৈচিত্রে তাদের রূপের বহর বিভিন্ন রকমের। সেই সৌন্দর্যের টানে সেবছর এপ্রিলে দলবল নিয়ে দৌড়েছিলাম পুর্ব-সিকিমের “নাথাং”। রূপকথা ট্রাভেলস-এর সাথে ওল্ড-সিল্করুটে প্রথমে আরিতার ও নিমাচেন হয়ে তারপর নাথাং ভ্যালি। সিকিম-চীন সীমান্তে অবস্থিত অফুরান বরফের রাজ্য নাথাং না দেখলে – বাদ থেকে যাবে এক হিমসুন্দর ভ্রমণের নান্দনিক অভিজ্ঞতা।
প্রথম রাতটা আরিটার লেক-এ কাটিয়ে পরদিন প্রাতরাশ সেরে রওনা দিলাম রেশমপথের দিকে। কিছুটা এগিয়ে পথে পড়লো রংলিবাজার। এখানের সরকারি দপ্তর থেকে নাম ও ছবি সহ সিল্করুট বেড়ানোর পারমিট করানোর জন্য সবাইকেই সাময়িক যাত্রাবিরতি নিতে হয়। চালক ভাইদের সাথে মানসও ব্যস্ত হয়ে পড়লো তাড়াতাড়ি কাগজপত্র যোগাড় করতে। পারমিট নিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়িপথে আরও খানিকটা উঁচুতে উঠে পৌঁছলাম নিমাচেন। এখানে পাহাড়ের ঢালে দারুণ লোকেশনে এক পাহাড়ি ঝোরার সামনে আমরা সেদিনের মতো ঢুকে পড়লাম ‘চু এ্যান্ড জুলটিম’ লজে । দুপুরের লাঞ্চ খাওয়ার মাঝে খবর এলো যে নাথাং-এ বরফ পড়ছে। ফলে রাত কাটলো বেশ উত্তেজনায়।
সকালে হাল্কা হয়ে, চা খেয়ে আমরা যে যার মতো তৈরি হয়ে রাস্তায় গাড়ির কাছে নেমে এলাম। কতক্ষণে রওনা দেবো এই ভাবনায় আর তর সইছে না –ওদিকে আবার বরফ পড়া বন্ধ হয়ে যাবে না তো! অবশেষে নিমাচেন থেকে বেরিয়ে সিল্ক-রুট বা রেশমপথে পদমচেন হয়ে পৌঁছলাম ৯৫০০ ফুটের জনপ্রিয় স্পট জুলুক। জুলুক পেরিয়ে “থাম্বি” ভিউ পয়েন্ট (১১,১০০ফুট) এলাম এ অঞ্চলের বিখ্যাত পাহাড়ি রাস্তার বাঁক দেখতে দেখতে। এখান থেকেই সবুজ পাহাড় হারিয়ে রুক্ষ পাহাড়ি খাড়াই পথের যাত্রা। মাঝেমাঝে পথের দুধারে শুকিয়ে যাওয়া ঘাস আর মাটিতে পড়া ছড়ানো বরফের ফাঁকে আলো করে ফুটে আছে নানা রঙের রডোডেনড্রন। থাম্বিতে সকলেই কিছুক্ষণ সময় কাটায় এখান থেকে মাউন্ট কাঞ্চনজংঘাকে সুন্দর দেখা যায় বলে। আমাদের কপাল খারাপ – অত্যধিক মেঘ-কুয়াশার কারণে তিনি দেখা দিলেন না। তবে এ পাহাড়ের সুবিখ্যাত পাখি “মোনাল”-এর দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল এখানেই।
এরপর ১২,০০০ ফুটের লুংথুং পেরিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবে পাহাড়ে ফুটে থাকা সাদা রডো-র হাসি দেখে লক্ষণচকে পৌঁছে দেখি, চতুর্দিক বরফে ঢেকে রয়েছে। কুয়াশার মতো বরফের গুঁড়ো উড়ে চোখে মুখে, ক্যামেরার লেন্সে এসে ঢুকছে। এখানে রাস্তার দুপাশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অজস্র বাঙ্কার বরফে ঢেকে আছে। এখান থেকে ডানদিকে বেশ কিছুটা গেলে কুপুপ আর বাঁদিকের রাস্তা ধরে এগোলে নাথাং, আমাদের সেদিনের গন্তব্য। অত বরফ দেখার আনন্দ হাঁ-করা বিস্ময়ে পরিণত হলো নাথাং ভ্যালিতে (১২,৭০০ ফুট) পৌঁছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির সাথে চিনির বড় দানার মতো বরফ পড়তে লাগলো সেরাতের আস্তানা ‘গোল্ডেন ট্রাউট হোটেল’-এ ঢোকার সময়। এত বরফ পড়ছে যে অঞ্চলের প্রত্যেকটা বাড়ির সামনে, আশপাশে জমে আছে ডাঁই করা বরফ – যেন বড় কুমির বা তিমি মাছ শুয়ে বরফের সান্নিধ্য উপভোগ করছে। এখানের একমাত্র গোম্পার আঙিনা ও ছাদে এতো বরফ যে দরজা খোলাই দায়। আমরাও জ্যাকেট, টুপি, মাফলারে আপাদমস্তক ঢেকে নিজেদের গরম রাখছি চিকেন পকোড়া আর ধোঁয়া-ওড়া কফিতে। মাঝে মাঝে রুমের জানলা খুলে মন-ক্যামেরায় পুরো বরফে মোড়া নাথাং-এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধরে রাখছি।
বেশ কিছুক্ষণ পর বরফ বৃষ্টি ধরলে পায়ে হেঁটে আশপাশে ঘুরতে বের হলাম। ছোট্ট এই উপত্যকায় বরফের সৌন্দর্যের মতোই স্থানীয় অধিবাসীদের সাধারণ জীবনযাত্রাও যথেষ্ট বৈচিত্রময়। প্রধাণত বৌদ্ধ, অংশত হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষগুলো ‘ভুটিয়া’, ‘শেরপা’ অথবা ‘প্রধান’ পদবীধারী। মুখ্য ভাষা হিন্দি ও নেপালি হলেও তিব্বতিও বেশ চলে। প্রায় শ-দেড়েক পরিবারের বাস এই পাহাড়ি গ্রামটিতে। টিনের চালের কাঠের তৈরি বাড়িতে বসবাসকারী প্রতি পরিবারের একজন করে পুরুষ সেনাবাহিনী অথবা সরকারি চাকুরিতে নিযুক্ত। অন্য পুরুষেরা পরিবহন বা হোটেল ব্যবসার স্ঙ্গে কৃষিকাজ, ইয়াক ও গবাদি পশু পালন করে। আলু, ভুট্টা, রাইশাক ও বাঁধাকপি এখানে চাষ হয়। ইয়াকের দুধ ও মাংস এরা পুড়িয়ে বা রান্না করে খায় –তাছাড়া লোম ও চামড়া থেকে তৈরি নানা সামগ্রী বিক্রি করে। দিন-রাতের পাহারার জন্য সব বাড়িতে থাকে দু-তিনটে জাঁদরেল লোমশ কুকুর। অল্পসময় ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে বৃষ্টি ও বরফ পড়ার কারণে সন্ধে নামলো সময়ের আগেই। নাথাং উপত্যকায় ‘সোলার সিস্টেমে’ আলো জ্বলে উঠছে এক এক করে। মোবাইলের দোকানে কথা বলে জানলাম –এখানে রোমিং নেই, ফলে বিএসএনএল নেটওয়ার্কে ল্যান্ড বা মোবাইলে যত খুশি কথা বলা যায়। তবে জেনে রাখা ভালো, পূর্ব-সিকিমের সীমান্ত অঞ্চল সংলগ্ন নানা জায়গায় মিলিটারি ক্যান্টনমেন্ট থাকার কারণে ছবি তোলা সহ বেশ কিছু বিধিনিষেধ জারি আছে ।
সিকিমের বেশিরভাগ পাহাড়ি জনপদের মতো নাথাং ভ্যালির মানুষজন সন্ধ্যা নামলে নিজেদের বাড়ি বা হোটেলে থাকতে বেশি পছন্দ করে। শীতকালে রাতের তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বা আরওয়নিচে নেমে যায়। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে সকলে গরম স্যুপ, ম্যাগির সঙ্গে মাংস বা অন্যান্য গরম খাবার খেতে ভালবাসে। রান্নাঘরের একদিকে “বুখারি” নামক টেবিলের তিন দিকে বসে গরম পরিবেশে খাওয়ার ব্যবস্থা। রাত্রে খাওয়ার সময় টেবিলের উপরে ছাদের দিকে চোখ পড়লো। একটা সরু তারে পরপর গেঁথে ইয়াকের মাংসের টুকরোতে, বুখারির মাঝে আটকানো টিনের চোঙার মধ্যে দিয়ে সারাদিন ধরে আগুনে ওম লাগানো হচ্ছে। কয়েকদিন পর সেই মাংস আরো সুস্বাদু হয়ে ওঠে। ইয়াকের মাংস খাওয়ার সৌভাগ্য না হলেও ইয়াকের দুধ থেকে তৈরি পাহাড়ে হাঁটার সময় চুইংগাম-ছুরপি বা ছুরা অবশ্য পরখ করে দেখেছি অনেকবার।
নাথাং ভ্যালির মহিলারা প্রাত্যহিক জীবনে ভীষণ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ভোরে উঠে ঘরের আঙিনায় পরিবারের মঙ্গল কামনায় ধূপি গাছের ডাল-পাতায় আগুন জ্বালিয়ে ধোঁয়া দেওয়ার পর গৃহপালিত পশুদের খাবার দেওয়ার পালা। তারপর কাপড়কাচা, রান্নাবান্না সহ সব কাজ শেষ করে বাড়ি লাগোয়া দোকানে জোরকদমে ব্যবসা চালায়। এদের দোকানে মুদি ও নানা মনিহারী দ্রব্য ছাড়াও পাওয়া যায় শীতবস্ত্র, পোশাক ও চীন থেকে সস্তায় আনা জুতো, ব্যাগ, খেলনা সহ প্রচুর উপহার সামগ্রী। শীতের আধিক্যে মদ্যপান এখানের স্বাভাবিক অভ্যাস। ফলে দু-এক ঘর অন্তর বিদেশী মদ বিক্রীর দোকান আছে। প্রতিটি বাড়ির ভিতর বা বাইরে সিকিমবাসীদের শুভচিহ্ন স্মারক নানা রঙের ‘লুংদার’ জোরালো হাওয়ায় উড়তে দেখা যায়। নাথাং-এ ব্রিটিশ আমলের “ওয়ার-মেমোরিয়াল” ছাড়াও আছে শ্রীকৃষ্ণের মন্দির। সাধারণ যানবাহন বলতে এখানের একমাত্র জিপ-স্ট্যান্ড থেকে শুধু শেয়ার জিপ সিকিমের নানা দিকে যাতায়াত করে। নাথাং-এ চুরি ডাকাতি হয় না বললেই চলে। পরিবহনের অভাব একটু থাকলেও এ অঞ্চলে ভ্রমণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। ফলে এখনকার নাথাং-এর টিনের চালের একরত্তি বাড়িগুলো বছর কয়েকের মধ্যে নিশ্চয়ই পাল্টে যাবে ছিমছাম স্বাচ্ছন্দের হোটেল বা ইকোট্যুরিজমের ফসল ক্রমবর্ধমান হোমস্টেতে। যেহেতু সিকিম সরকারও ট্যুরিজমকে জনপ্রিয় করার জন্য অধিবাসীদের যথেষ্ট অর্থসাহায্য করে থাকেন।
নাথাং-এ রাত্রিবাস এক রোমাঞ্চকর অনুভূতির। হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা আর বরফ বৃষ্টি নিয়ে রাত কাটলো। পরদিন আকাশ পরিষ্কার দেখে পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম ঐতিহাসিক রেশম পথের অন্যতম গিরিবর্ত্ম জেলেপ-লার রাস্তায়। এ পথ সোজা চলে গেছে জেলেপ-লা (১২৯০০ফুট) পেরিয়ে চীন-তিব্বত সীমান্ত পর্যন্ত। খ্রিস্টজন্মের আগে থেকে তিব্বতের প্রাণকেন্দ্র লাসার সাথে এদেশের যে বাণিজ্যবিনিময় চলে এসেছে বহু বছর ধরে, তাতে মুখ্য ভূমিকা ছিল সিকিমের এই নাথাং ভ্যালির। ইন্দো-চীন সীমান্তে জেলেপ-লা আর নাথুলা পাসের মধ্যে দিয়ে যোগাযোগকারী দুটি পথই ‘রেশম-পথ’। পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং, পেডং, জুলুক হয়ে জেলেপ-লা গিরিবর্ত্মগামী পথের মাঝে এই নাথাং ভ্যালিতে ব্যবসায়ীরা পথ শ্রমের ক্লান্তি কাটাতে একরাত বিশ্রাম নিত। তাই ছোট পাহাড়ি জনপদ হলেও বাণিজ্যের কারণে নাথাং-এর অবস্থান গুরুত্বপূর্ন ছিল। যুগ ও কালের নিয়মে রেশম পথে বাণিজ্য আজ বন্ধ। ফলে নাথাং এখন শুধু ইতিহাস বহনকারী আকর্ষনীয় এক ভ্রমণগন্তব্য। বরফে মোড়া এ উপত্যকার সৌন্দর্য কোন অংশেই ছবিতে দেখা সুইৎজারল্যান্ডের থেকে কম নয়। ঋতুবৈচিত্রে ভারতবর্ষে যা দেখার জায়গা আছে,তা এক মানবজীবনে শেষ করা যাবে না। একা হিমালয় পাহাড়ের অপার ভ্রমণবৈচিত্র বিদেশ না যাওয়ার আক্ষেপ ভুলিয়ে দেয়।
নাথাং যাওয়ার উপযুক্ত সময় মার্চ থেকে মে অথবা সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাস। থাকার জন্য গোল্ডেন ট্রাউট হোটেল, সানসেট রিট্রিট, থেম্পা অথবা তাসি লুং ফু হোমস্টেতে যোগাযোগ করতে হবে। শিলিগুড়ি থেকে নিয়মিত গ্রুপ নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছেন হলিডেইয়ার ৯৪৩৪৪৪২৮৬৬ ও আরো কয়েকটি বিশ্বস্ত সংস্থা।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team