 
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                             
                                            
                                        নির্বাচন পরবর্তী লকডাউন আমাদের যাবতীয় আশা ও উদ্যমের মূলে ভয়াবহ আঘাত করেছিল সন্দেহ নেই। পত্রিকা পরিবেশক ও বিক্রেতাদের গলায় হতাশার সুর আমাদের অনিশ্চয়তার আঁধারে ঠেলে দিয়েছিল। সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ‘এখন ডুয়ার্স’ পত্রিকা প্রকাশ। এরপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষুদ্র প্রকাশনী সংস্থার বাণিজ্যিক উদ্যোগ তাৎক্ষণিক ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি ফিরে পায় নি। বেশ কিছু হকার ও বিক্রেতা ম্যাগাজিন যেমন বিক্রির পেশা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, তেমনই বিজ্ঞাপনের বাজারও দীর্ঘ নিদ্রা থেকে জেগে ওঠে নি। ফলে বড় বড় সাময়িকীগুলির পরিস্থিতিও খুব একটা সুখকর নয়। এই অবকাশে ছাপা পত্রিকা পড়বার অভ্যেস থেকে বহু মানুষ সরে এসেছে। দৈনিক সংবাদপত্রের বিক্রিতে উল্লেখযোগ্য হ্রাস খালি চোখেই দেখা যায়। খবরের আপডেট পেতে কিংবা নিজস্ব মতামত পেশ করতে স্মার্টফোনে ভরসা বেশি করছে আজকের মানুষ।
অতএব অনন্যোপায় হয়ে নিজেদের পাঠক সম্প্রদায়কে খুঁজে নিতে আমরাও ডিজিটাল মাধ্যমের শরণাপন্ন হলাম। এতে দেশ বিদেশের বেড়াজাল অতিক্রম করে অনেক বেশি সংখ্যক পাঠকের কাছে নিয়মিত পৌঁছতে পারব, এই আশা আমরা রাখি। তবে আমরা এখনও বিশ্বাস রাখি মুদ্রিত কাগজের কোনও বিকল্প হয় না, তাই ছাপা সংকলন আমাদের অন্যান্য বইপত্রের মতোই বিশেষ সংখ্যা হয়ে মাঝে মধ্যেই প্রকাশিত হবে। এই বঙ্গদেশে আজ বইপত্রের কারবার করে সংসার প্রতিপালন করা অতীব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু দেখা যায় এই রঙ্গে ভরা বঙ্গে সাহিত্যচর্চার কোনও ঘাটতি নেই, এই মন্দার পুজোবাজারে শারদীয়া সংকলনের পরিমাণে কমতি নেই, প্রিন্ট-অন-ডিমান্ডের কল্যাণে গল্প-কবিতার বন্যা অব্যাহত আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো সাহিত্যের পাঠক যে ক্রমাগত বিলুপ্তির পথে তা নিয়ে লেখকবর্গের কোনও উদ্বেগ চোখে পড়ে কি? গ্রন্থাগারগুলি যেখানে প্রাগৈতিহাসিক পরিত্যক্ত বাড়ির মতো নিথর হয়ে পড়ে থাকে, জ্ঞানের ভান্ডার সামলাবার দায়িত্ব যেখানে নিয়েছে গুগল, সেখানে সিলেবাসের বাইরে বইয়ের প্রয়োজনীয়তা মানুষকে বোঝাবার দায়িত্ব কিন্তু কাঁধে তুলে নিতে হবে লেখকদেরকেই। সরকার জেলায় জেলায় বইমেলা আয়োজন করতে পারেন, বই কেনাবেচার আসর তৈরি করে দিতে পারেন, কিন্তু বই কেনার প্রতি মানুষের আগ্রহ ফিরিয়ে আনতে মাঠে নামতে হবে সর্বস্তরের লেখক সমাজকেই। বইমেলায় দাঁড়িয়ে নিজের বই বিক্রি করলে কিংবা অটোগ্রাফ দিলেই তা হয় না, প্রত্যেক লেখকের দায়বদ্ধ থাকা উচিত পুরো প্রকাশনা শিল্পের প্রতি।
লেখকদের মনে রাখতে হবে মুদ্রিত বাংলা বইয়ের আড়াইশ বছরের ইতিহাসে এমন করুণ দুর্যোগকাল আগে কখনও আসেনি। দেশজুড়ে আঞ্চলিক ভাষার প্রাধান্য, ইংরেজি পড়া লোকের সংখ্যা বাড়ছে না, তবু ইংরাজি বইয়ের বাণিজ্যে এমন ঘাটতি কিন্তু চোখে পড়ে না। কেবল ডিজিটাল মাধ্যমকে দোষারোপ করা অর্থহীন, কারণ একটি মাধ্যম কখনই আরেকটি মাধ্যমের প্রতিযোগী হতে পারে না, বরং সঠিক পরিকল্পনা থাকলে পরিপূরক হিসেবেই কাজ করে। লেখক-পাঠকের সরাসরি যোগাযোগ বাড়ালে বইয়ের গুরুত্ব ও চাহিদা বাড়তে পারে, আর এই যোগাযোগ স্থাপন অতি সহজে সম্ভব কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমেই। মুদ্রিত বইয়ের প্রচারে সোশ্যাল মিডিয়া যেমন ইতিমধ্যেই যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছে, তেমনই করোনাকালে লেখকরা নানা ডিজিটাল উদ্যোগ নেওয়ার ফলেই যে পাঠকের বইমুখী মনোভাব বেড়েছে তার তাজা প্রমাণ এই সময়ে বইয়ের অনলাইন অর্ডারে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।
এদিকে বছর ফুরিয়ে এল, আমাদের পরমায়ুও ফুরিয়ে আসছে একটু একটু করে। বিদ্যালয়ের পথ ভুলে যাওয়া বিষণ্ণ শৈশব কৈশোর ঘরে ঘরে এলোমেলো আঁকিবুঁকি কাটে, অহেতুক ঘ্যানঘ্যান করে। চলে যাওয়ার আগে তাদের কী কৈফিয়ত দিয়ে যাব বলুন তো? এ কোন জোড়াতালি দেওয়া শতচ্ছিন্ন ভবিষ্যৎ তাদের জন্য রেখে যাচ্ছি আমরা? কোভিডের মতো দুর্যোগকে মোকাবিলা করতে গিয়ে যে কচিমনগুলিকে ঠিকমত পরিচর্যা করা সম্ভব হল না, কুঁড়িগুলি সঠিক প্রস্ফুটিত হলো না, তার দায় কি অদৃষ্টের হাতে ছেড়ে দিয়ে পার পাবো আমরা? নাড়ির টান ছিন্ন করে যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত তরুণকে পরিযায়ী হতে বাধ্য করছি আমরা, ভিনদেশি অসহায়তার মধ্যে নিক্ষেপ করছি নিজেদের হাতে, এই বাংলার মেধা-শ্রম সম্পদ দিয়ে বাকি দুনিয়াকে সমৃদ্ধ করে নিজের দেশকে দেউলিয়া নিঃস্ব করার অপরাধ কি আমাদের আগামী মার্জনা করবে?
নিজেদের বিধির লিখন নিজেদের ললাটে নিজেরাই এঁকেছি আমরা। বড় আক্ষেপ রয়ে গেল, যাওয়ার আগে প্রত্যক্ষ করে যেতে হচ্ছে মুমূর্ষু পাহাড়-অরণ্য-নদীর জরাগ্রস্ত রূপ, নিজের প্রিয় মাতৃভাষার করুণ বিলুপ্তি। তবু দীপাবলীর শুভ সন্ধ্যায় মোমের নরম আলোয় সন্তানের প্রিয় মুখ চেয়ে প্রার্থনা করি, এ মাটিতে ফের স্বপ্ন ফলাও প্রভু, এদেশের বুকে আরোগ্য আসুক নেমে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team
