× home হোম archive আগের ওয়েব সংখ্যা panorama ডুয়ার্স সম্পর্কে play_circle_filled ভিডিও file_download মুদ্রিত সংখ্যার পিডিএফ library_books আমাদের বইপত্র
people এখন ডুয়ার্স সম্পর্কে article শর্তাবলী security গোপনীয়তা নীতি local_shipping কুরিয়ার পদ্ধতি keyboard_return বাতিল/ফেরত পদ্ধতি dialpad যোগাযোগ
login লগইন
menu
ad01112021105716.jpg
×
সংখ্যা: নভেম্বর, ২০২১
সম্পাদকের কলম
এ দেশের বুকে আরোগ্য আসুক নেমে
প্রদোষ রঞ্জন সাহা
পর্যটনের ডুয়ার্স
বান্দাপানি বনবাংলোয়
শান্তনু রায়
পর্যটনের ডুয়ার্স
বরফে ঢাকা নাথাং ভ্যালি
প্রতাপ কুমার মণ্ডল
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
গ্রামীণ ব্যাঙ্ক ও উত্তরের উত্তরণ লিপি। পর্ব - ৫
প্রশান্ত নাথ চৌধুরী
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
রাজনগরের রাজনীতি। পর্ব - ৯। স্বাধিকারের দাবিতে বারবার আন্দোলনমুখী হয়েছে কোচবিহার।
অরবিন্দ ভট্টাচার্য
ধারাবাহিক প্রতিবেদন
উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি ও সংস্কৃতির লোকজন। পর্ব - ১
সব্যসাচী দত্ত
ধারাবাহিক উপন্যাস
ডাউন হলদিবাড়ি সুপারফাস্ট। পর্ব - ১৩
সুজিত দাস
নিয়মিত কলম
মুর্শিদাবাদ মেইল। বাংলার বিস্মৃত বীর মীরমদন
জাহির রায়হান
নিয়মিত কলম
ল্যাব ডিটেকটিভ। পর্ব -৩। ডিএনএ টেস্ট অপরাধী ধরায় বিপ্লব আনলো
নিখিলেশ রায়চৌধুরী
নিয়মিত কলম
আমচরিত কথা। পর্ব - ৯। ভালবাসা ভালবাসা
তনুশ্রী পাল
নিয়মিত কলম
এই ডুয়ার্স কি তোমার চেনা? স্বর্ণকোশের কাছে
শৌভিক রায়
বিজ্ঞানের দুনিয়ায় ভারতীয় নারী
সত্যবতী মতিলাল সিরসত: ভারতে আধুনিক ক্যান্সার গবেষণার রূপকার
রাখি পুরকায়স্থ
পুরানের নারী
যযাতি পত্নী শর্মিষ্ঠা
শাঁওলি দে
পাতাবাহার
মিনি চিজ কেক
পাতা মিত্র

সত্যবতী মতিলাল সিরসত: ভারতে আধুনিক ক্যান্সার গবেষণার রূপকার

রাখি পুরকায়স্থ
BigganerDuniyayNari_Satyabati
ছবি - সত্যবতী মতিলাল সিরসত

বিশ্বব্যাপী ক্যান্সার সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। দেহের কোনও অঙ্গের অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত কোষ বৃদ্ধির জেরে ক্যান্সার বা কর্কট রোগ হয়। যে কোনও বয়সে, যে কোনও সময়ে এই রোগ থাবা বসাতে পারে মানব দেহে। একদম প্রাথমিক স্তরে এই রোগ নির্ণয় করা না গেলে, পরে মারণ আকার ধারণ করে ক্যান্সার। রোগ সংক্রমণে মৃত্যুর নিরিখে বিশ্বে ক্যান্সার দ্বিতীয়, ভারতে তৃতীয়। ভারতে সবচেয়ে বেশি প্রকোপ স্তন, মুখগহ্বর, জরায়ু, পাকস্থলী আর মলাশয়ের ক্যান্সারের। তদুপরি দেশের মোট ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর ২২ শতাংশই ঘটে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য সেবনের কারণে। তবে ক্যান্সার নির্ণয়ের পরীক্ষা পদ্ধতি আগের চাইতে অনেক উন্নত হয়েছে। অতীতের তুলনায় ক্যান্সার চিকিত্‍সাও উন্নত হয়েছে কয়েক’শ গুন। তাই ক্যান্সার আক্রান্তরা পেয়েছেন বাঁচবার নতুন আশা। সেই সঙ্গে ক্যান্সার রোগ সম্পর্কে দেশবাসীর সচেতনতা বৃদ্ধিও ক্যান্সার রোগ মোকাবিলার অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি, কার নিঃস্বার্থ অবদানের ফলস্বরূপ ভারতের ক্যান্সার গবেষণা ও চিকিৎসা আজ এত উন্নত? হ্যাঁ, তিনি এমন একজন ক্যান্সার গবেষক যিনি বর্তমান ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির স্বনামধন্য উচ্চশিক্ষাকেন্দ্রগুলি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বহু আগেই মাইক্রোবায়লজি ও ওনকোলজি গবেষণায় দেশকে পথের দিশা দেখিয়েছিলেন। মানবদেহে ক্যান্সার ও ভাইরাসের বিস্তার, ক্ষত নিরাময় ও ক্ষতস্থান পুনর্গঠন বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ক্লিনিক্যাল গবেষণার ভিত্তিতে কৃত যে সমস্ত বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ ভারতের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল রেজিস্ট্রিতে আজ অবধি নিবন্ধিত হয়েছে সেগুলিকে অনায়াসে তাঁরই গবেষণা-শ্রমের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ফল বলা যেতে পারে। তিনি এমন এক ভারতীয় নারী বিজ্ঞানী যার অনুক্ত কীর্তি-কাহিনি নিরুচ্চারে বলে দেয়, তিনিই ভারতের আধুনিক ক্যান্সার গবেষণার রূপকার – তিনি প্রখ্যাত ক্যান্সার বিজ্ঞানী ডঃ সত্যবতী মতিলাল সিরসত।  

ব্রিটিশ ভারতের (অধুনা পাকিস্তানের অন্তর্গত) সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী শহর করাচিতে ১৯২৫ সালের ৭ অক্টোবর একটি উচ্চশিক্ষিত গুজরাটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সত্যবতী। পিতার কর্মসূত্রে তাঁর সুযোগ হয় নানান দেশ ভ্রমণের। বিভিন্ন সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটে তাঁর। বেড়ে উঠবার সেই দিনগুলিতে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাচেতনা গঠনে বিদেশ বিভূঁইয়ে বসবাস ও ভ্রমণের প্রভাব ছিল অপরিসীম। সত্যবতীর পিতা-মাতা ছিলেন গোঁড়া থিয়সফিস্ট। তাই বিশিষ্ট থিয়সফিস্ট ডঃ জর্জ সিডনী অরুণডেল ও নৃত্যগুরু ডঃ রুক্মিণী দেবী অরুণডেল প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাজের (বর্তমান চেন্নাইয়ের) বেসান্ত মেমোরিয়াল স্কুলে ভর্তি করা হয় তাঁকে। ১৯৩৬ সালের জানুয়ারি মাসে অরুণডেল দম্পতি মাদ্রাজ শহরে ‘কলাক্ষেত্র’ নামে ভারতীয় সংস্কৃতি ও কলা কেন্দ্র স্থাপন করেন। ডঃ রুক্মিণী দেবী অরুণডেল সেখানে প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলা ও সঙ্গীতের নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন। এখানেই সত্যবতী সঙ্গীত, সাহিত্য, শিল্পকলা এবং দক্ষিণ ভারতীয় নৃত্যের প্রাথমিক স্বাদ পান, যা সারা জীবন তাঁর হৃদয়কে মোহিত করে রেখেছিল। মাতৃভাষা গুজরাটি হলেও, তিনি তামিল, কন্নড়, হিন্দি, মারাঠি, ইংরেজি, ফরাসি প্রভৃতি বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ভাষায় ক্রমশ সাবলীল হয়ে ওঠেন। এমন অভিনব পরিবেশে প্রচলিত শিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি, তাঁর মধ্যে ভারতের প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও ফল্গুধারার মতো বইতে আরম্ভ করে। 

সত্যবতীর জীবন-শুরুর গঠনমূলক দিনগুলিতে কল্পনা ও বাস্তবের এক আশ্চর্য মিশেল তাঁর মনে অনপনেয় ছাপ রেখে যায়। পরবর্তীকালে সেই ভাবনা ও বিশ্বাস তাঁর বিজ্ঞানী জীবনকেও ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। পিতাই ছিলেন তাঁর জীবনের প্রথম অনুপ্রেরণা। অত্যন্ত বিদ্বান এই মানুষটি জীবনের শুরুতে বোম্বের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি জাহাজকে নিজের কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন। তবে পেশা বদল করলেও, তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ পাঠক, লেখক ও সংস্কৃত পণ্ডিত। তাঁর সেই বহুমুখী প্রতিভা কন্যার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। মার্কিন মাইক্রোবায়োলজিস্ট পল হেনরি ডি ক্রুইফের লেখা একটি বই কিশোরীবেলায় পড়েছিলেন সত্যবতী। বইটির নাম - দ্য মাইক্রোব হান্টারস। বইটি সত্যবতীর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। এই বইটি পড়েই তিনি মাইক্রোবায়োলজি পড়তে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সেই আগ্রহই চূড়ান্ত রূপ পায়, যখন তিনি বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন শেষে বোম্বের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বিজ্ঞানের স্নাতক স্তরে ভর্তি হন। ২০০৮ সালে ব্যাঙ্গালোরের অ্যাকাডেমি অব সয়েন্স কর্তৃক প্রকাশিত Lilabati’s Daughters গ্রন্থে Exploring nature’s secrets শীর্ষক স্মৃতিকথায়, বিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা তাঁর আবেগের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে, সত্যবতী লিখেছেন, ‘অপটিক্যাল মাইক্রোস্কোপের লেন্সে প্রথম চোখ রেখে দেখা মাইক্রোঅর্গানিজমের মিশ্র গ্রাম-পজিটিভ ও নেগেটিভ কালচার আমাকে যেভাবে রোমাঞ্চিত করেছিল তা আমি কখনই ভুলতে পারব না।’ ১৯৪৭ সালে মাইক্রোবায়োলিজিতে সাম্মানিক সহ স্নাতক হন তিনি।

স্নাতক পরীক্ষার ফল ঘোষিত হওয়ার পরের দিন সত্যবতী সোজা হাজির হন টাটা মেমোরিয়াল হসপিটেল ফর ক্যান্সার এণ্ড এলাইড স্টাডিজের মুখ্য প্যাথলজিস্ট ডাঃ ভসন্ত রামজী খানলকরের অফিস ঘরের সামনে। ব্যস্ত মানুষ ডাঃ খানলকর। আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না নিলে তাঁর সঙ্গে দেখা করা যায় না। এদিকে প্রচণ্ড উৎসাহ-উদ্দীপনায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট না নিয়েই সেখানে চলে এসেছেন সত্যবতী। দেখা হবে কি না জানা নেই। তবু অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। ডাঃ খানলকরের সঙ্গে দেখা না করে কিছুতেই বাড়ি ফিরবেন না – এই ছিল তাঁর পণ। পাক্কা দু’ঘন্টা অপেক্ষা করবার পরে ভাগ্যের শিকে ছিঁড়ল। ডঃ খানলকর তাঁকে ভেতরে ডেকে নিলেন। দীর্ঘক্ষণ তাঁদের মধ্যে নানান বিষয়ে আলাপ আলোচনা হল। সেদিন সত্যবতী বুঝতে পারেননি, এভাবেই ডাঃ খানলকর সাধারণ আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, এবং তাঁর যোগ্যতা ও দক্ষতা যাচাই করেছিলেন। দীর্ঘ আলোচনা শেষে সত্যবতীকে চমকে দিয়ে ডাঃ খানলকর জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমি যে বিষয়গুলি সম্পর্কে বললাম, সে-কাজগুলি ঠিকঠাক করতে পারবেন তো আপনি?’ চরম উত্তেজনায় সত্যবতী বলে উঠেছিলেন, ‘অবশ্যই পারব!’ সেদিন থেকেই সত্যবতী পা রাখলেন বিজ্ঞানী জীবনে। 

ডাঃ খানলকর ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। পেশায় চিকিৎসক হলেও, তিনি ছিলেন বিজ্ঞান গবেষক, শিল্পপ্রেমী, ভাষাতত্ত্ববিদ ও সাহিত্যবোদ্ধা। তাঁর কাছ থেকে সত্যবতী বহু বিস্তৃত বৈজ্ঞানিক ও শৈল্পিক দৃষ্টি অর্জন করেন। বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে ডাঃ খানলকরই ছিলেন সত্যবতীর প্রথম পথপ্রদর্শক। 

১৯৪৮ সালে ভারত সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রক টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘ক্যান্সার রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ হিসেবে গড়ে তুলবার সিদ্ধান্ত নেয়। একজন বরিষ্ঠ গবেষক-শিক্ষার্থীর থেকে সত্যবতী হয়ে উঠলেন এই নতুন গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। ১৯৫৮ সালে প্যাথলজি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন সত্যবতী। তার পর বায়োমেডিক্যাল গবেষণা, বিশেষত জেনেটিক্স, টিস্যু কালচার এবং ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপি, সংক্রান্ত নব্য প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তিগুলি আয়ত্ত করতে ভারত সরকারের তরফ থেকে তাঁকে পাঠানো হয় লন্ডনের চেস্টার বেটি রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। সেখানে পঠনপাঠন ও গবেষণার পাশাপাশি আধুনিক বায়োমেডিকাল গবেষণার জন্য অত্যাবশ্যকীয় বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতিও আত্মভূত করেছিলেন ডঃ সিরসত। এছাড়াও সেখানে হান্স সেল্যি, অ্যালবার্ট সেজেন্ট গিয়োর্গি, লিনাস পাওলিং, অ্যালেক্স হ্যাডো, চার্লস ওবার্লিং, উইলিয়াম অ্যাস্টবারি প্রভৃতি বিশ্ব-সেরা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে গবেষণা করবার সুযোগ হয় তাঁর। 

আল্ট্রাস্ট্রাকচারাল সাইটোলজি এবং ডায়াগোনস্টিক মলিকুলার প্যাথলজি বিষয়ক ভারতের প্রথম ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপি গবেষণাগার স্থাপন করতে সত্যবতী ফিরে আসেন ভারতে। ডঃ সিরসতের সেই অত্যাধুনিক গবেষণাগারেই মানবদেহের বিশদ কোষ-কাঠামোর বিষয়ে ভারতীয় গবেষকেরা প্রথম পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিজ্ঞান লাভ করেন এবং মানব-অঙ্গের অণুগুলিকে পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের উপায় সম্পর্কে জ্ঞাত হন। ইন্ডিয়ান ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারের এই গবেষণাগারে মূলত স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিক কোষ ঝিল্লি, দ্বিতীয় পর্যায়ে ক্যান্সারের বিস্তার এবং স্তন, নাক ও রক্তের ক্যান্সার বিষয়ে গবেষণা হত। মেধাবী শিক্ষার্থীদের ভিড়ে গমগম করত এই ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্র। এই গবেষণাগারে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা নিয়মমাফিক বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণের বাইরেও অনেক মূল্যবান জ্ঞান আহরণের সুযোগ পেতেন। ক্রমশ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এই ক্যান্সার গবেষণা কেন্দ্রের সুখ্যাতি।

ডঃ সিরসতই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি ক্যান্সারের আণবিক দিকটির ওপর আলোকপাত করবার চেষ্টা করেন। মানব দেহে ক্যান্সারের ফাইবার ও টিস্যু কাঠামো সম্পর্কে তার অধ্যয়ন ও গবেষণা ক্যান্সার রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল, যা তার আগে ছিল কল্পনারও অতীত। অত্যধিক পরিমাণে চুন-পান-তামাক চিবোনোর অভ্যাসের দরুন ভারতীয়দের মধ্যে যে ভীষণ বিপজ্জনক মুখগহ্বরের ক্যান্সারের প্রাক-উপসর্গগুলি দেখা যায়, তা উপলব্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছিলেন ডঃ সিরসত। এক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদানটি হল ওরাল সাবমিউকাস ফাইব্রোসিস ও লিকোপ্লাকিয়া নামক দুটি মুখগহ্বরের রোগের অস্তিত্ব আবিষ্কার এবং এই রোগ দুটির কারণ ও পরিণাম ব্যাখ্যা করা। বর্তমানে তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটের গায়ে আমরা যে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সতর্কীকরণ বার্তা পাই - ‘তামাক মুখের ক্যান্সারের কারণ হতে পারে’ - তার কৃতিত্ব ডঃ সিরসতের ওপরই বর্তায়। 

মাইক্রোবায়োলজি সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে আরও উৎসাহিত করতে ‘দ্য ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ডঃ সিরসত। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন তিনি। এছাড়াও বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন বিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর।  

১৯৮৫ সালে ক্যান্সার রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গবেষণার কাজ থেকে অবসর নেওয়ার অব্যবহিত পরে ডঃ সিরসত টাটা ম্যামোরিয়াল সেন্টারের মেডিক্যাল এথিক্স কমিটির সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেন। তার পর তিনি ভারতীয় বিদ্যা ভবন আয়ুর্বেদিক সেন্টারে ১৭ বছর মূল্যবান গবেষণায় নিযুক্ত ছিলেন। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য থাকায়, এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকাকালীন তিনি বৃদ্ধত্রয়ীর – চড়ক, সুশ্রুত ও ভগবতের - সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি থেকে ক্যান্সার রোগের শ্রেণিবিন্যাস করবার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রগুলি অধ্যয়ন করে তিনি অবাক হয়ে যান – রোগবিদ্যায় পারদর্শী সেকালের পণ্ডিতদের বিবরণের সঙ্গে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার কী আশ্চর্য মিল! বিভিন্ন প্রকারের টিস্যু টিউমার ও তাদের জৈবিক আচরণ, বেনাইন বনাম ম্যালিগন্যান্ট টিউমার, অস্থিমজ্জা ও রক্তের ক্যান্সার সম্বন্ধে সেই প্রাচীন পণ্ডিতদের বিস্তৃত জ্ঞান ছিল। রোগ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে তাঁদের অস্ত্র ছিল - মানবদেহের নিবিড় পর্যবেক্ষণ, মৃতদেহের কাটাছেঁড়া, স্বতঃলব্ধ জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টির সমন্বয়।  

গোটা জীবন গবেষণা কার্যে মনোনিবেশ করলেও, ডঃ সিরসত সর্বদা হাসপাতালের অলিন্দে নীরবে ধুঁকতে থাকা মানবতার চরম দুর্দশা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। ইলেক্ট্রন হিস্টোকেমিস্ট্রি, ইমিউন ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপি, ইলেক্ট্রন অটোরেডিয়োগ্রাফি, ক্রাইয়ো-ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপির পাশাপাশি মারণ রোগাক্রান্ত রোগীদের প্রতি মানবিক হওয়ার বিষয়টিও তাঁকে ভীষণ ভাবাতো। ক্যান্সার রোগীদের শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন খুব কাছ থেকে, আর সে-উপলব্ধি থেকেই ১৯৮৬ সালে ডঃ সিরসত বোম্বেতে শান্তি আভেদনা আশ্রম নামে একটি সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মরণাপন্ন ক্যান্সার রোগীরা যাতে অন্তিম যাত্রার আগে জীবনের শেষ ক’টা দিন শান্তিতে কাটাতে পারেন, সে উদ্দেশ্যেই ভারতে প্রথম এমন একটি সেবাশ্রম স্থাপন করা হয়। ডঃ সিরসত ছিলেন সেই সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা অছি-পরামর্শদাতা। সেখানে ক্যান্সার রোগীদের যথাযথ যত্ন ও চিকিৎসার জন্য নিজের সময় এবং শক্তি তিনি ব্যয় করেছিলেন অকাতরে। যতদিন দেহে বল ছিল, তিনি ক্যান্সার রোগীদের সেবায় নিজেকে নিঃস্বার্থভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। এই কাজে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত তাঁর বই Death, the Final Freedom প্রকাশিত হয় ১৯৯৮ সালে।    

নেচার, নেচার নিউ বায়োলজি, জার্নাল অব কারসিনোজেনেসিস, টুমোরি জার্নাল, জার্নাল অব সেল সায়েন্স, জার্নাল অব ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট, জার্নাল অব ইনভেস্টিগেটিভ ডার্মাটলজি প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকীতে তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধ বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও জার্নাল অব বায়োসায়েন্সেস এবং ইন্ডিয়ান জার্নাল অব এক্সপেরিমেন্টাল বায়োলজি এডুকেশন সহ বেশ কয়েকটি জার্নালের সম্পাদক মণ্ডলীর সম্মানিত সদস্য ছিলেন তিনি। 

বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ডঃ সিরসতের অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি জানাতে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চের পক্ষ থেকে তাঁকে প্রদান করা হয় শকুন্তলাদেবী আমিরচাঁদ পুরস্কার। বায়োলজিক্যাল ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপি বিষয়ক গবেষণার জন্য লাভ করেন ট্রান্স এশিয়ান পুরস্কার। বিজ্ঞান ও মানবতার কল্যাণে তাঁর সারা জীবনের কর্মকান্ডকে সম্মান জানাতে ভারতীয় বিদ্যাভবন তাঁকে মর্যাদাপূর্ণ সাইটেশন লাইফটাইম এচিভমেন্ট এওয়ার্ড প্রদান করে। ১৯৭৫ সালে তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমির অব সায়েন্সেসের ফেলো নির্বাচিত হন।

ডঃ সিরসতের বৈজ্ঞানিক জীবনের প্রতিটি লড়াইয়ে প্রধান সহায়ক ছিলেন তাঁর জীবনসঙ্গী ডঃ মতিলাল ভি সিরসত। তাঁদের দুজনের মধ্যে বয়সের বিস্তর তফাৎ থাকলেও, মতিলাল সিরসত ছিলেন তাঁর বন্ধু, দার্শনিক এবং পথপ্রদর্শক। আন্তর্জাতিক স্তরে সুপরিচিত ওনকো-প্যাথলজিস্ট মতিলাল ছিলেন একজন খুব জনপ্রিয় শিক্ষক। গবেষণার কাজে ডঃ সত্যবতী সিরসত যখনই কোনো জটিলতার সম্মুখীন হতেন, তখনই মতিলাল ধৈর্য ও স্নেহের সঙ্গে তার সমাধান করতে এগিয়ে আসতেন। স্ত্রীর পেশাদার জীবনের সাফল্য তাঁকে আনন্দ দিত। স্ত্রীর কৃতিত্বে তিনি অত্যন্ত গর্ব বোধ করতেন। 

ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারের গবেষণাকর্মকে ডঃ সত্যবতী সিরসত কখনওই নিছক পেশা বলে মনে করেননি। তাঁর কাছে এই নিরন্তর গবেষণা ছিল সাধনা ও তপস্যার নামান্তর। আজীবন বৈজ্ঞানিক সত্যের অনুসন্ধানে ও মানব কল্যাণে ব্যাপৃত থেকেছেন তিনি। কাজের সঙ্গে তাঁর এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে ডঃ সিরসত ‘প্রণয়ঘটিত ব্যাপার’ বলে উল্লেখ করেছেন। দীর্ঘ সক্রিয় জীবনে গবেষণা কার্যের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান তিনি বিলিয়ে দিয়েছিলেন ভারত তথা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার শতাধিক শিক্ষার্থীদের মধ্যে। 

Exploring nature’s secrets শীর্ষক স্মৃতিকথায় ডঃ সিরসত প্রতিশ্রুতিবান নতুন বিজ্ঞানীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনারা কি সম্মানিত বিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হতে চান? জীবনের নীতিগুলি কিন্তু বড় কঠোর! নিজের ও নিজের কাজের প্রতি সৎ থাকুন। সুশৃঙ্খল থাকুন। সহকর্মী বিজ্ঞানীদের কাজকে কখনও অবজ্ঞা কিংবা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবেন না। মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করবেন - কখনওই আপনার তথ্যাবলী বা নথিপত্র বিকৃত করবেন না, অথবা প্রাক ধারণাগত তত্ত্বের সঙ্গে মানানসই এমন তথ্য বিবরণ প্রদর্শন করবেন না। সর্বোপরি, সারা জীবনই শিখতে হয় - তাই শিখুন, শিখুন এবং শিখুন! আপনারা রয়েছেন সবচেয়ে বড় একখানা অভিযানে – অনুসন্ধান করছেন প্রকৃতির গোপন রহস্যের!’ 

নিজের গোটা জীবনটাই যিনি ক্যান্সার গবেষণায় ও সচেতনতা প্রচারে উৎসর্গ করেছিলেন, ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে সেই ডঃ সিরসতই ২০১০ সালের ১০ জুলাই ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন। তবে তাঁর মতো বিজ্ঞান সাধিকার শরীরের মৃত্যু হলেও, তাঁর আত্মপরিচয় বা কীর্তির অস্তিত্ব থেকে যায়। তাই আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত ব্যক্তিত্বের অধিকারী ডঃ সিরসত তাঁর ছাত্রছাত্রী ও অনুরাগীদের হৃদয়ে পাকাপাকিভাবে রয়ে গিয়েছেন।

ডঃ সত্যবতী মতিলাল সিরসত ভারতে ক্যান্সার গবেষণার পথ প্রশস্ত করেছিলেন। আজ আমাদের দেশের ক্যান্সার গবেষণা তাঁর দেখানো সেই পথেই এগিয়ে চলেছে। তাঁর গবেষণার মূল কেন্দ্রে ছিল মুখ গহ্বরের ক্যান্সার। আজ ভারত মুখ গহ্বরের ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রস্তুত এবং এই রোগ প্রতিরোধের ব্যাপারে আরও অনেক বেশি সচেতন। ভারতীয় লোকজীবনের অঙ্গ তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে আজ ভারতের শিক্ষিত যুবসমাজ যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এতে ডঃ সিরসতের অবদান অপরিসীম। আজ যে দেশের প্রতিটি ক্লিনিকে স্তন ক্যান্সার সম্বন্ধীয় সচেতনতামূলক পুস্তিকা বা পাম্পলেট বা পোস্টারগুলি পাওয়া যায়, তার পেছনেও ডঃ সিরসতের অবদান অনস্বীকার্য। ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপি সম্পর্কিত তাঁর মূল্যবান গবেষণার ইতিবাচক ফল বর্তমান সময়ে ভারতীয়দের একটি গোটা প্রজন্ম ভোগ করে চলেছে। সত্যিকার অর্থে একজন বহুমুখী ব্যক্তিত্ব বলতে যা বোঝায় ডঃ সত্যবতী মতিরাম সিরসত ছিলেন তাই। নিঃসন্দেহে বলা যায়, তিনি ভারতের বিজ্ঞান-জগতে পদার্পণ না করলে এ দেশের ক্যান্সার গবেষণা-চিত্রটি মোটেই আজকের মতো এমন উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হত না।

এই সংখ্যার সূচী

করোনা কালের প্রতিবেদন ফ্রি রিডিং

Disclaimer: Few pictures in this web magazine may be used from internet. We convey our sincere gratitude towards them. Information and comments in this magazine are provided by the writer/s, the Publisher/Editor assumes no responsibility or liability for comments, remarks, errors or omissions in the content.
Copyright © 2025. All rights reserved by www.EkhonDooars.com

Design & Developed by: WikiIND

Maintained by: Ekhon Dooars Team