স্রেফ একটা আবেদন। পুলিশের সামান্য একটা আবেদনে গোটা ব্রিটেন জুড়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে গেল।
পুলিশ এক সাইকোপ্যাথকে খুঁজছিল। দুই কিশোরীকে খুন করেও সেই বিকৃতকাম বহাল তবিয়তে ঘুরছিল। পুলিশ কোনও সূত্রই খুঁজে পাচ্ছিল না। পুলিশ ঠিক করল, তিন গ্রামের দু’ হাজার বাসিন্দার আঙুলের ছাপ নেবে। না হলে অপরাধী ধরা মুশকিল হবে। কিন্তু এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট তোলার কাজটা আগেকার ইঙ্কপ্যাড নিয়ে আঙুলের ছাপ তোলার মতো ছিল না। অপরাধ দমনের ইতিহাসে এটাই প্রথম জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিং। একজনের লিভিং টিস্যু বা জীবন্ত কোষের সঙ্গে নিহত দুই স্কুলছাত্রীর দেহে মেলা টিস্যুর নমুনা মিলিয়ে দেখা। এই টেকনিকের আবিষ্কর্তা লিসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অ্যালেক জেফ্রিস। পরবর্তী কালের ‘স্যার’ অ্যালেক জেফ্রিস।
খুনি নানা ভাবে ক্লু মুছে ফেলতে পারে। বাঘিনী যেমন ছেলে হলে বাঘের থাবা থেকে বাঁচাতে লেজ দিয়ে নিজের থাবার চিহ্ন মুছে এগয়, পাকা খুনিও অনেক সময় তা-ই করে। খুব সতর্ক ভাবে নিজের উপস্থিতির সূত্র মুছে ফেলে। যেমন এখনকার হ্যাকাররা করে। পাকিস্তানের সামরিক গুপ্তচর বাহিনী ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের মদতপুষ্ট লস্কর-ই-তইবার মতো কট্টরপন্থী মুসলিম সন্ত্রাসবাদী শক্তি যেমন মোবাইল ফোন ব্যবহারের পর সিমকার্ডের আইডি মুছে ফেলতে পারে। কিন্তু মানুষের ডিএনএ কখনও মিথ্যা বলে না। একবার যদি লাশে কিংবা খুনের জায়গায় পাওয়া ডিএনএ-র সঙ্গে কারও ডিএনএ মিলে যায়, খুনি ধরতে পুলিশের আর অসুবিধা হয় না।
গোটা একটা গ্রাম জুড়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট তোলার সিদ্ধান্ত আগে কখনও হয়নি। এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠল। বলা হল, নাগরিকের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। একটি বড় রাসায়নিক কোম্পানি জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিংয়ের লাইসেন্সের অধিকারী বলে দাবি করল। পুলিশের পুরানো নির্ভরযোগ্য পদ্ধতির জায়গায় নতুন আবিষ্কার কাজ করবে কি না, তা নিয়ে অনেক অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার প্রশ্ন তুললেন। কিন্তু নতুন পরীক্ষা সবাইকে চমকে দিল। জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিং ১০০ শতাংশ কাজ দিল। অপরাধী ধরা পড়ল।
এই কেসের পর থেকে ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে অপরাধী চিহ্নিত করা শুরু হল।
২
লিসেস্টারশায়ারে দুটি কিশোরী তিন বছরের ব্যবধানে খুন হল। দুটি খুনই এত বীভৎস খুন, ওই তল্লাটের মানুষ বহু বছর তা ভুলতে পারেনি। প্রথমে খুন হল ১৫ বছরের কিশোরী লিন্ডা মান। লিসেস্টারশায়ারের নরবরোতে থাকত। কাছেই আর একটি গ্রাম এনডারবি। সেখানে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল লিন্ডা। স্কুলের পড়া ঝালিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি সন্ধ্যাবেলায় দুজনে মিলে গানের রেকর্ডও শুনল। তারিখটা ছিল ১৯৮৩ সালের ২১ নভেম্বর। সন্ধেটা বন্ধুর সঙ্গে আনন্দে কাটিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরল লিন্ডা। কিন্তু সে আর বাড়ি ফেরেনি। পর দিন সকালে একটা ফুটপাতের ধারে লিন্ডার লাশ পাওয়া গেল।
কোনও ম্যানিয়াক ভয়ংকর রাগ নিয়ে মেয়েটিকে বীভৎস ভাবে ধর্ষণ করেছে। তার পর মেয়েটিরই স্কার্ফ দিয়ে তাকে শ্বাসরোধ করে মেরেছে। পুলিশ খুনিকে ধরতে গোটা এলাকা জুড়ে ব্যাপক তল্লাশি অভিযান শুরু করল। গোটা ব্রিটেন জুড়ে সাহায্যের আবেদন জানানো হল। লিন্ডার খুনের সময় যত শিশু খুনি এবং যৌন অপরাধী ব্রিটেনের বিভিন্ন জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে পুলিশ কম্পিউটারের মাধ্যমে তাদের সম্বন্ধে ক্রস চেক করা হল। মাসের পর মাস তদন্ত চলল। পুলিশের সদর দফতরের এমারজেন্সি ইনসিডেন্ট রুমে সিআইডি অফিসাররা অষ্টপ্রহর একটা ফোনের অপেক্ষায় বসে রইলেন। কিংবা, এমন একটা ক্লু যার সূত্র ধরে তাঁরা খুনির পিছনে ধাওয়া করতে পারবেন।
খুনের কেস তামাদি হয় না। তদন্তও থেমে থাকে না। কিন্তু রোজকার অপরাধ দমনের কাজে পুলিশ বাহিনীকে অনবরত ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই কিছু দিন তদন্ত চালিয়ে পুলিশকে লিন্ডা মানের ফাইল গোটাতে হল। অপরাধী অধরা রয়ে গেল।
তিন বছর কেটে গেল। আবার একটা নৃশংস খুন। ঠিক যেভাবে লিন্ডা মান খুন হয়েছিল সেই একই প্রণালীতে আর একটি মেয়েকে খুন করা হল। এই মেয়েটিরও বয়স ১৫। নাম ডন অ্যাশওয়ার্থ। লিন্ডা মানের মতো ডন অ্যাশওয়ার্থও এনডারবিতে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে হেঁটে ফিরছিল। ১৯৮৬ সালের ৩১ জুলাই। কিন্তু লিন্ডার মতো ডনেরও আর বাড়ি ফেরা হল না। তিন দিন বাদে, এনডারবি আর নরবরোর মাঝামাঝি, এবারেও একটা ফুটপাতের ধারে খড়ের নীচে আংশিক ঢাকা-পড়া অবস্থায় ডন অ্যাশওয়ার্থের লাশ পাওয়া গেল। তাকেও ধর্ষণ করা হয়েছে। লিন্ডার থেকেও তার শরীরে ক্ষত আরও মারাত্মক। এবার সুন্দর দেখতে মেয়েটিকে আরও বেশি কষ্ট দেওয়ার জন্যই যেন বিকৃতমস্তিষ্ক খুনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
অকুস্থলে গিয়ে পুলিশের অভিজ্ঞ অফিসাররা বুঝতে পারলেন, দুটো খুন একই লোকের কাজ। ওই এলাকাতেই কোথাও এক সাংঘাতিক দানো লুকিয়ে আছে, যে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। কিছুতেই নিজের বিকৃত খিদে চেপে রাখতে পারে না। পোস্ট মর্টেম রিপোর্টেও ডন অ্যাশওয়ার্থের মুখে-মাথায় আর স্ত্রী অঙ্গে ভয়াবহ ক্ষতর চিহ্ন মিলল।
আবার ব্যাপক খানাতল্লাশি। নাকাবন্দি করে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে সরজমিন ক্লু খোঁজা। আবার ব্রিটেন জুড়ে জনসাধারণের কাছে আবেদন। যদি এমন কিছু মেলে যাতে খুনির হদিশ পাওয়া যায়। পুলিশ নিশ্চিত, খুনি এলাকারই বাসিন্দা। কারণ, নরবরো থেকে এনডারবি-র মধ্যে সব পথঘাট তার চেনা। শর্টকাট পায়ে চলার রাস্তা, ফুটপাতগুলোও চেনে। পাঁচ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে লিসেস্টার শহর। গ্রামের ধার দিয়েই রাজপথ। সব দেখে পুলিশের দৃঢ় ধারণা, খুনি আগন্তুক নয়। কিন্তু দুটি খুনের ক্ষেত্রেই সে কোনও ক্লু রেখে যায়নি। পুলিশ হতাশ। এ রকম একটা ম্যানিয়াক ধর্ষণকারী খুনি কর্পূরের মতো উবে গেল?
যদিও দুটি খুনের মাঝের সময়টায় প্রফেসর অ্যালেক জেফ্রিস যে অকস্মাৎ জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিং আবিষ্কার করে বসে আছেন, সেটাই খুনি জানত না। অত কষ্ট করে দুটো খুনের সূত্র মুছে ফেলার পরিশ্রম বৃথা গেল।
৩
পৃথিবীর বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অকস্মাৎ হয়েছে। যেমন নীল বা ইন্ডিগো। আগে নীলের চাষ হত। ভারতে নীলের চাষ করার সময় নীলকর সাহেবরা অত্যাচার করত। সেই অত্যাচার নিয়ে দীনবন্ধু মিত্র ঊনবিংশ শতাব্দীতে ‘নীলদর্পণ’ নাটক লিখেছিলেন। রেভারেন্ড জেমস লং সেই নাটক অনুবাদ করে জেলে গিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষ গান বেঁধেছিল, “নীল বানরে কল্লে ছারেখার/ অকালেতে হরিশ (সাংবাদিক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যাপাধ্যায়) ম’লো/ লঙের হ’লো কারাগার/ চাষিদের প্রাণ বাঁচানো ভার।” রাসায়নিক ইন্ডিগো আবিষ্কার হল আকস্মিকভাবে।
পাশ্চাত্যের এক ল্যাবরেটরিতে এক বিজ্ঞানীর বকযন্ত্র টেবিল থেকে পড়ে ভেঙে গিয়েছিল। মেঝেতে দুটো রাসায়নিক মিশে যায়। তাতেই রাসায়নিক ভাবে নীল তৈরি হয়ে যায়।
অ্যালেক জেফ্রিসের ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিংয়ের আবিষ্কারও হয়েছিল আকস্মিক ভাবে। লিসেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর জেফ্রিস হিমোগ্লোবিন জিন নিয়ে গবেষণা করছিলেন। সেই গবেষণা করতে গিয়ে হঠাৎই তিনি মানবদেহের ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) আবিষ্কার করে ফেলেন। সব মানুষের দেহের কোষেই ডিএনএ মেলে। এক জনের ডিএনএ-র সঙ্গে আর এক জনের ডিএনএ মেলে না। এক ফোঁটা রক্ত পরীক্ষা হলে খুনি আর কোনও ভাবেই পার পাবে না।
নিজের কালজয়ী আবিষ্কার সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রফেসর অ্যালেক জেফ্রিস অবশ্য যাবতীয় কৃতিত্ব বিশ্ববিদ্যালয়কেই দিয়েছিলেন। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মতো প্রকৃত বিজ্ঞানী ও গবেষকরা বিনয়ী হন। জেফ্রিসও তেমন ছিলেন। ডাঃ জেফ্রিসের বক্তব্য ছিল, যে কোনও ভালো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মতো তাঁর আবিষ্কারও অন্য কিছু খুঁজতে গিয়েই হয়ে গিয়েছে। ব্রিটেনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোভাবে প্রাথমিক স্তরের বৈজ্ঞানিক শিক্ষা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, এই জেনেটিক আবিষ্কারের মাধ্যমে তা বোঝা গেল।
জেফ্রিস বলেছিলেন, এক ফোঁটা রক্ত থেকে এক জন ব্যক্তির নিজস্ব বার কোডটা বের করে আনা যায়। সাধারণ রক্তপরীক্ষা বা অন্য কোনও পরীক্ষায় এই বার কোড জানা কখনই সম্ভব নয়। প্রফেসর জেফ্রিসের আবিষ্কার ছিল ফোরেনসিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক বিশাল অগ্রগতি।
তাঁর আবিষ্কারের কথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে গোটা ব্রিটেন জুড়ে পুলিশ কর্তারা গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। এই রকম দুর্দান্ত আবিষ্কারের ফল কী হতে পারে তা বুঝতে পেরে কেউ আর বসে রইলেন না।
নরবরোর দুটি খুনের তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ডিটেকটিভ ইনস্পেকটর ডেরেক পার্সি। সন্দেহভাজনদের তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে তিনিই প্রথম ডাঃ জেফ্রিসের ফিঙ্গারপ্রিন্টিং পদ্ধতি কাজে লাগালেন। রিচার্ড বাকল্যান্ড নামে ১৭ বছরের এক কিশোরকে পুলিশ ডন অ্যাশওয়ার্থের খুনের জন্য সন্দেহ করেছিল। অ্যাশওয়ার্থের লাশ মেলার পর সে অকুস্থলে ঘুর ঘুর করছিল। যে রাতে ওই খুনের ঘটনা ঘটে সেই রাতে কোথায় ছিল, কী করছিল সে ব্যাপারে কোনও পরিষ্কার উত্তর রিচার্ড দিতে পারেনি। পুলিশ তাকেই আটক করল। ডাঃ জেফ্রিসের জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিং ছেলেটাকে বাঁচিয়ে দিল।
দুটো লাশেই একই ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সেই ডিএনএ-র সঙ্গে রিচার্ড বাকল্যান্ডের ডিএনএ মিলল না। রিচার্ডকে ছেড়ে দিল পুলিশ।
এর পরেই তিনটে গ্রাম মিলিয়ে দুই হাজার ব্যক্তির ডিএনএ টেস্টের সিদ্ধান্ত নিল পুলিশ। ডিএনএ টেস্টের এত বড় অভিযান আর কখনও দেখা যায়নি। পুলিশের তখনও দৃঢ় ধারণা, খুনি স্থানীয় বাসিন্দা। এই রকম একটা পরীক্ষার ব্যবস্থা না-করলে তাকে কখনই ধরা যাবে না। পুলিশ তাদের আবেদনে বলল, এই পরীক্ষা একেবারেই স্বেচ্ছাধীন। কারও ইচ্ছা না-হলে তিনি এই জেনেটিক পরীক্ষায় যোগ নাও দিতে পারেন। এই আবেদন জানানোর উদ্দেশ্য, যাঁরা ডিএনএ টেস্টিংয়ে হাজির হবেন না, পুলিশ তাঁদের উপর নজর রাখবে।
পরীক্ষা নেওয়ার যাবতীয় বন্দোবস্ত যখন হয়ে গিয়েছে, এমন একটা সময়ে নতুন সমস্যা দেখা দিল। ১৯৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে বিখ্যাত রাসায়নিক কোম্পানি ইম্পিরিয়াল কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (আইসিআই) বিবৃতি দিয়ে জানাল, “পুলিশ যে আমাদেরই টেস্ট টেকনিক ব্যবহার করছে তা আমাদের জানা ছিল না। আমরা উদ্বিগ্ন। জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিংয়ের ব্যাপক পরীক্ষা নেওয়ার অধিকার এবং সামর্থ্য শুধুমাত্র আমাদেরই আছে। কিন্তু লিসেস্টারের পুলিশ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগই করল না।”
আইসিআই প্রফেসর জেফ্রিসের কাছ থেকে নতুন আবিষ্কারের কপিরাইট কিনে নিয়েছিল। ফলে, তাদের মনে হচ্ছিল পুলিশ বেআইনি কাজ করছে। এছাড়া গণহারে ডিএনএ টেস্টিংয়ের পুলিশি সিদ্ধান্তে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে প্রতিবাদ করল কোনও কোনও মানবাধিকার সংগঠন। প্রশাসন সব বিক্ষোভই শান্ত করল। ডিএনএ পরীক্ষার দায়িত্ব নিল অল্ডারম্যাসটনের সরকারি ল্যাবরেটরি।
নরবরো, লিটলথর্প আর এনডারবি— এই তিনটে গ্রামে ১৭ থেকে ৩৩ বছর বয়সের ষত বাসিন্দা ছিল সবাইকেই চিঠি পাঠিয়ে ডিএনএ পরীক্ষায় অংশ নিতে আবেদন জানাল পুলিশ। বিপুল সাড়া পেল। ছাত্র থেকে প্রাক্তন সৈনিক, সকলেই ডিএনএ পরীক্ষায় নাম তোলার জন্য ফোন করতে থাকল। বোঝা গেল, এত দিন ধরে ওই এলাকার বাসিন্দাদের মনে একটা পাথর চেপে বসে ছিল। সবাই সবাইকে সন্দেহ করছিল। আমার পাশের বাড়িতে যে আছে, সেই খুনি নয়তো? এই সন্দেহ থেকে প্রতিবেশিরা পরস্পরের উপর নজর রাখছিল। খুনি খোঁজা এক ধরনের ডাইনি খোঁজার হিস্টিরিয়ায় পরিণত হয়েছিল। পুলিশের ডিএনএ পরীক্ষার আবেদনে বেশির ভাগ গ্রামবাসীই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
৪
এক জনই কেবল নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে ডিএনএ পরীক্ষায় শামিল হল না। লিটলথর্প গ্রামের বাসিন্দা অ্যালান পিচফর্ক। ২৭ বছরের অ্যালান পিচফর্ক একটা বেকারিতে কাজ করত।
সংবাদপত্রে তদন্তের খবর পড়ে অ্যালান বুঝল, ডিএনএ পরীক্ষা সে এড়াতে পারবে না। বেকারিতে কাজে গিয়ে সে তার সহকর্মীদের বলল, ১৯৮১ সালে বিয়ের আগে মেয়েদের সামনে সে নিজেকে অশ্লীল ভাবে মেলে ধরত। এর জন্য তার জেলও হয়েছিল। মদ খেয়ে ফুর্তির মেজাজে সে বিয়ের আগে তার ‘কীর্তি’র কথা সহকর্মীদের শোনাল। সহকর্মীরা শুনে হাসছে দেখে পিচফর্ক বলল, সে বিকৃতমনস্ক নয়। অবশ্যই সে অপরাধই করেছিল। কিন্তু নিতান্তই ফাজলামি টাইপের অপরাধ। আইবুড়ো অবস্থায় চ্যাংড়ারা যা করে। পেটি কেস। কিন্তু পুলিশকে তো বিশ্বাস নেই। দুটো খুনের সূত্রে পুরানো কেস ধরে তাকেই না ফাঁসিয়ে দেয়। ডিএনএ টেস্ট করে বলে দিল, তুমিই খুনি।
এই ভাবে গপ্পো সাজিয়ে পিচফর্ক তার সহকর্মীদের পীড়াপীড়ি করতে লাগল। তারা যদি তার হয়ে ডিএনএ টেস্টে রক্ত দিয়ে আসে। পুলিশ জানতেও পারবে না, সে বাড়িতেই ছিল। তার হয়ে প্রক্সি দেওয়ার জন্য প্রথমে সে কমবয়সী একটি ছেলেকে ৫০ পাউন্ড দিতে চাইল। আর এক জনকে ২০০ পাউন্ড। শেষ পর্যন্ত ২৩ বছর বয়সের এক সহকর্মী অ্যালানের নাছোড়বান্দা আরজিতে রাজি হল। ইয়ান কেলি। বেকারিতে কাজের শেষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে অ্যালান পিচফর্ক কেলিকে তার সই নকল করা শেখাল। নিজের পারিবারিক জীবনের কিছু তথ্যও তাকে মনে রাখতে বলল। ১৯৮৭ সালের ২২ জানুয়ারি ইয়ান কেলি অ্যালান পিচফর্ক সেজে ডিএনএ টেস্টিং রুমে ঢুকল। ইয়ানের রক্তের নমুনা নেওয়া হল। খুনির ডিএনএ-র সঙ্গে সেই নমুনা মিলল না। সন্দেহের তালিকা থেকে অ্যালান পিচফর্কের নাম বাদ গেল।
ক্রমাগত বায়না করে অ্যালান পিচফর্ক ডিএনএ টেস্টে ইয়ান কেলিকে প্রক্সি দিতে রাজি করালেও, কেলির সন্দেহ হল। সে বেকারিতে ফিরে সহকর্মীদের তার সন্দেহের কথা বলল। আগের মামলায় পুলিশ ধরেছিল বলে এবারে তারা খুনের কেসে ফাঁসিয়ে দেবে, এতে কেমন যেন খটকা লাগে। সবাই ডিএনএ টেস্টে অংশ নেওয়ার জন্য উৎসুক। অথচ, অ্যালান পিচফর্ক তাতে রাজি হচ্ছে না কেন? টেস্টে অ্যালান অংশ নিলে তো বরং প্রমাণ হয়ে যেত, দুটো খুনে তার কোনও ভূমিকাই ছিল না।
ইয়ান কেলি-র কথাটা বেকারির অন্যান্য কর্মীর মনেও সন্দেহ জাগাল। তাঁদের এক জন পুলিশে গিয়ে অ্যালানের চোখে ধুলো দেওয়ার ব্যাপারটা বললেন। পুলিশ সেই রাতেই ইয়ান কেলি আর অ্যালান পিচফর্ককে তুলে নিল। পুলিশ নামের তালিকা ঘেঁটে দেখল, তিনটি গ্রামের দু’ হাজার বাসিন্দার মধ্যে অ্যালান পিচফর্ক ছাড়া আর এক জন ডিএনএ টেস্টে অংশ নেননি। আর এক জন যিনি অংশ নেননি, তাঁর ক্ষেত্রে কাজ করেছিল শারীরিক কারণ।
পুলিশ অ্যালান পিচফর্কের রক্ত আর চুলের স্যাম্পেল নিল। দুই কিশোরীর লাশে মেলা ডিএনএ-র সঙ্গে অ্যালান পিচফর্কের নমুনা মিলে গেল। পিচফর্ক ভেঙে পড়ল।
দুটো কিশোরী মেয়েকে ধর্ষণ করার পর খুন করে অ্যালান পিচফর্ক নিপুণ ভাবে যাবতীয় প্রমাণ লোপাট করেছিল। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষায় সে আর রক্ষা পেল না।
এক বছর বাদে লিসেস্টার ক্রাউন কোর্টে অ্যালান পিচফর্কের দুই দফায় যাবজ্জীবন হল। এছাড়াও, মহিলাদের উপর চড়াও হওয়ার জন্য আরও কয়েক দফার কারাদণ্ড। সেইসঙ্গে ন্যায়বিচার এড়াতে ষড়যন্ত্রের দণ্ড।
বিচারপতি ওটন বিশেষ ভাবে ডাঃ জেফ্রিসের প্রশংসা করলেন। রায় দেওয়ার সময় বললেন, প্রফেসরের আবিষ্কারের ফলে “প্রকৃত অপরাধী যে শুধু শাস্তি পেল তা নয়, নির্দোষও মুক্তি পেল। জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিং না-থাকলে অ্যালান পিচফর্ক এখনও বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াত। আর তার ফলে আরও কত ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারত, ভাবা যায় না।”
বিচারে ইয়ান কেলি-র ১৮ মাস জেল হল। যেহেতু সে ন্যায়বিচারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে শামিল হয়েছিল। দু’ বছর চাকরি থেকে সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করা হল তাকে।
পুলিশকে অ্যালান বলেছিল, মেয়ে দুটোকে সে খুন করতে চায়নি। ফাঁকা রাস্তায় একা পেয়ে, নিজেকে তাদের সামনে মেলে ধরে যৌন শিহরণ পেতে চেয়েছিল। কিন্তু তার পরেই সব কেমন ওলট পালট হয়ে গেল। সে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। প্রথমে ধর্ষণ করল। পাছে তারা ধরিয়ে দেয়, তার জন্য খুন করল। দুটো ক্ষেত্রেই খুনের পর নিখুঁতভাবে সব ক্লু মুছে ফেলল, পুলিশ যাতে কোনও চিহ্ন না-পায়। ডিএনএ-র ব্যাপারটা তার জানা ছিল না।
অ্যালান পিচফর্কের সাজা হওয়ার পর জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিংয়ের উপর ভিত্তি করে পুলিশ অপরাধ মোকাবিলায় আরও শক্তিশালী হল। মলিকিউলার জেনেটিকসের অগ্রগতির ফলে অকুস্থলে রক্ত, বীর্য, এমনকী থুতুর সামান্য দাগ থেকে অপরাধীর সন্ধান মেলা সোজা হয়ে গেল। কিছু দিন আগে পর্যন্ত ডিএনএ টেস্টে নমুনাটা কত বছর বয়সের লোকের হতে পারে, বোঝা যেত না। ঘাতক কোনও কিশোর, না ৫০ বছরের মাঝবয়সী— জানা সম্ভব ছিল না। এখন তাও বোঝা যায়। পুলিশের হাতে এখন কম্পিউটারে লোড করা জেনেটিক ‘ফটোফিট’। তা থেকে আততায়ীর লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়। সে কোন জাতির লোক, তার চুল-চোখের মণি কোন রংয়ের, তাও বোঝা যায়।
কিন্তু তাতেও কি আততায়ী সব সময় ধরা পড়ে? প্রফেসর জেফ্রিস নিজেই এ ব্যাপারে আসল সমস্যার কথা বলেছিলেন। প্রচলিত পদ্ধতিতে ডিএনএ বিশ্লেষণ করে অপরাধীর লিঙ্গ নির্ধারণ করা গেল। কিন্তু সেই ব্যক্তি কে? কোনও সন্দেহভাজনের ডিএনএ রিপোর্ট যদি পুলিশের রেকর্ডে না-থাকে, তাহলে রক্তের নমুনা সে কার ফাইলের সঙ্গে মেলাবে? বিজ্ঞানীরা এখনও একটা বড় সমস্যার সম্মুখীন হন অপরাধীর হাইটের ব্যাপারে। কোন ব্যক্তি কতটা লম্বা হতে পারে, জেনেটিক মেক-আপের উপরেও তা যেমন অংশত নির্ভর করে। আবার, পরিবেশের উপরেও নির্ভর করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জার্মান দার্শনিক ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস যেমন ব্রিটেনে শ্রমিক শ্রেণির দুরবস্থার রিপোর্ট লিখতে গিয়ে দেখেছিলেন-- কলকারখানার মারাত্মক দূষণে, কয়লার ধোঁয়ায় যত প্রজাপতি জন্মাচ্ছে সবই কালো। মানুষের হাইটের ক্ষেত্রেও তেমন পরিবেশের একটা বড় প্রভাব থাকে। একইভাবে ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিং থেকে বোঝার উপায় নেই কার নাক কতখানি লম্বা। সুতরাং, আগে থেকে যাদের রেকর্ড পুলিশের কাছে আছে, তাদের থেকে রক্ত নিয়ে ডিএনএ মেলানো সম্ভব। এ ছাড়া ধরা যাক, কাউকে অপহরণ করে অপরাধী মুক্তিপণ দাবি করে চিঠি লিখল। চিঠি খামে পুরে খামের মুখ বন্ধ করল থুতু দিয়ে। সেই থুতুর দাগ থেকেও ডিএনএ বিশ্লেষণ করে অপরাধী ধরা যায়। তবে সেক্ষেত্রেও অপরাধীর ডিএনএ প্রোফাইলের ডেটাবেস পুলিশের কাছে থাকতে হবে। না হলে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হবে।
পরবর্তী কালে ব্রিটেনের হোম অফিস আর আমেরিকার এফবিআই মিলে এই ডিএনএ ফিঙ্গারপ্রিন্টিংয়ের উপর ভিত্তি করে নিজস্ব ডেটাবেস তৈরি করেছে। যৌন অপরাধীদের ধরতে পরস্পর তথ্য বিনিময়ও করেছে। কোনও যৌন অপরাধী জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবার কোনও অপরাধ করলে ওই ডেটাবেসের সাহায্যে তাকে গ্রেফতার করতে অসুবিধা হয় না।
অপরাধ দমনে প্রফেসর জেফ্রিসের আবিষ্কার কাজে লাগানো নিয়ে গোড়ায় নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত আন্দোলনকারীদের আপত্তি ছিল। এতে নাকি নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে না। তাদের আশঙ্কা যে অমূলক সেটা কিছু দিনের মধ্যেই বোঝা গেল। জেনেটিক কোড থেকে কোনও ব্যক্তির পরিচয় জানা যায় না। সন্দেহভাজনের নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা তাতে নেই।
জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিং যদি আগে আবিষ্কৃত হত, তাহলে ‘ইয়র্কশায়ার রিপার’ পিটার সাটক্লিফ বা তার মতো আরও ধর্ষক-খুনি খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়ত। তাদের অপকীর্তির জায়গায় অনেক বায়োলজিক্যাল এভিডেন্স ছিল। কিন্তু ধাওয়া করার মতো কোনও সন্দেহভাজন ছিল না।
৫
কুখ্যাত ধর্ষণকারী খুনিদের মধ্যে পিটার সাটক্লিফের নাম পুলিশের খাতায় রয়ে গিয়েছে। ‘জ্যাক দা রিপারে’র মতো ‘ইয়র্কশায়ার রিপারে’র নামও কেউ ভোলেনি। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। কেউ ভাবতেও পারেনি পিটার সাটক্লিফ এক সাংঘাতিক সাইকোপ্যাথ।
সাটক্লিফের প্রথম খুন ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে। লিডসে এক খেলার মাঠে ২৮ বছরের পতিতা উইলমা ম্যাকানের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। মাথায় হাতুড়ির আঘাতের চিহ্ন। শরীরের বিভিন্ন অংশে স্ক্রু ড্রাইভারের ক্ষত।
ওই ঘটনার পর আরও তিনটি খুন। তারাও লিডস-ব্র্যাডফোর্ড এলাকার পতিতা। তাদেরও খুন করা হয়েছে একই প্যাটার্নে।
পুলিশ হন্যে হয়ে সিরিয়াল কিলারকে খুঁজতে লাগল। কিন্তু আততায়ী যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে।
হঠাৎ করে খুনের প্যাটার্নটা বদলে গেল ১৯৭৭ সালের জুন মাসে। এবার সাটক্লিফ ১৬ বছরের এক কিশোরীকে খুন করল। পতিতা নয়। এর পর থেকে পতিতা নয় এমন মেয়েদেরই মারতে থাকল সাটক্লিফ। গোটা পশ্চিম ইয়র্কশায়ারে মেয়েদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।
সংবাদ মাধ্যমে পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ নিয়ে যখন তোলপাড়, এমন একটা সময়ে আকস্মিক ভাবে সাটক্লিফ ধরা পড়ে গেল। ১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে শেফিল্ড পুলিশ সাটক্লিফের রোভার আটকাল। গাড়িতে এক জন পতিতা ছিল। নাম আভা রিভার্স। গাড়িতে পাওয়া গেল একাধিক ফলস নাম্বার প্লেট। একটা গলায় পরানোর আংটা, একটা হাতুড়ি আর একটা সূচালো স্ক্রু ড্রাইভার।
পুলিশ হস্তক্ষেপ করায় আভা রিভার্স বেঁচে গেল।
পরে, পিটার সাটক্লিফের পরিচয় মেলায় পুলিশ হতভম্ব। শেফিল্ড পুলিশ ধরার আগে অন্তত ন’ বার বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ তাকে ধরেছে। বেশির ভাগ সময়েই লাইসেন্স চেক করার জন্য। সিরিয়াল কিলার হিসাবে সন্দেহজনক কাউকে সে দেখেছে কি না কিংবা রাস্তায় উলটো দিক থেকে তেমন কেউ তাকে পাস করেছে কি না, কেউ ওভারটেক করেছে কি না, সে প্রশ্নও করেছে। কিন্তু কোনও বারই তাদের সন্দেহ জাগেনি, পিটার সাটক্লিফই খুনি। পুলিশের মুখোমুখি হয়েও ‘ইয়র্কশায়ার রিপার’ ঘাবড়ায়নি। তার মুখোশ খসেনি।
১৯৮১ সালের মে মাসে ১৩টি খুন আর সাতটি খুনের চেষ্টার অপরাধে পিটার সাটক্লিফ দোষী সাব্যস্ত হয়। বিচারে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
অ্যালান পিচফর্ক ধরা পড়ার পর ডাঃ জেফ্রিস থেকে অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসার সকলেই বলেছিলেন, জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিং আগে আবিষ্কৃত হলে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচত। ‘ইয়র্কশায়ার রিপার’-কে অনেক আগে ধরে ফেলা যেত। সন্দেহভাজনদের তালিকায় না থাকলেও, রাস্তায় টহলদার পুলিশ একাধিক বার তার লাইসেন্স চেক করেছিল। খুনের জায়গায় ছিল বায়োলজিক্যাল প্রমাণ। জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিংয়ে পিটার সাটক্লিফের হাতে খুব তাড়াতাড়ি হাতকড়া পড়ত।
‘স্যার’ অ্যালেক জেফ্রিসের জেনেটিক ফিঙ্গারপ্রিন্টিং মেথড অপরাধ মোকাবিলায় যুগান্ত ঘটিয়ে দিল।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team