শহরের অলিতে গলিতে এখন ঝকঝকে চায়ের আড্ডাখানা, বেশিরভাগই চলছে রমরমিয়ে। প্রচলিত চা দোকানগুলির পাশাপাশি ছোট ছোট ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠেছে আধুনিক চা গুমটি, এছাড়াও নানা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে বেশ কিছু জনপ্রিয় আধুনিক ব্র্যান্ড-এর চা-বার। কফির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন প্রজন্মের সান্ধ্য অবসরে ভাল জায়গা দখল করেছে এই চা বারগুলি। সেসব নিয়ে লিখতে গেলে আলাদা এক আখ্যান। এক কথায় সুস্থ স্বনির্ভরতার পথ দেখাচ্ছে চা পানের জনপ্রিয়তা। অথচ অন্যদিকে উত্তরবঙ্গ ও উত্তরপূর্ব ভারতের চা শিল্পে নেমে আসছে অনিশ্চয়তার অন্ধকার, জলবায়ুর পরিবর্তন বা আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনাকে যার জন্য সিংহভাগ দায়ী করা যায়।
আমরা সবাই কমবেশি জানি, চা পাতা উৎপাদনের মান ও পরিমাণ দুইই আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল। বছর কয়েক ধরেই উত্তরবঙ্গ ও উত্তরপূর্ব ভারতের আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা ও চরমভাবাপন্নতা এতটাই বেড়েছে যে তার প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়ছে চা উৎপাদনের উপর। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে চা বাগান কর্তৃপক্ষ এবং চা ব্যবসায়ীরা রীতিমত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে টি অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ার বিবৃতি, এই কঠিন পরিস্থিতিতে চা বাগান-ফ্যাক্টরি কর্তৃপক্ষ, চা শিল্পে অগ্রণী সংস্থা, খুচরো বিক্রেতা, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা, চা-বিশেষজ্ঞ গবেষক সবাইকে এগিয়ে আসবার আহবান জানিয়েছেন তাঁরা। এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলায়, চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখবার লক্ষ্যে এই মুহূর্তে প্রয়োজন উদ্ভাবনী কৌশল ও উপায়। এই উপায় নির্ধারণে সবাই অংশগ্রহণ না করলে হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা এই চা শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা আগামী দিনে সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।
দেশের মোট চা উৎপাদনের ২০-২৫ শতাংশ আসে উত্তরবঙ্গের চা বাগানগুলি থেকে। অথচ আবহাওয়ার কারণেই সেই উৎপাদন এবার কমছে প্রায় এক তৃতীয়াংশ। স্বভাবতই চা কারবারিদের মাথায় হাত। গত কয়েক বছর ধরেই চায়ের মরসুমে অর্থাৎ এপ্রিল-মে মাসে তরাই-ডুয়ার্সে তাপমাত্রার পরিমাণ বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা। এই দুইয়ে মিলে ফার্স্ট ফ্লাশ এবং সেকেন্ড ফ্লাশ চা পাতা উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই উষ্ণতা এবার এতটাই বেড়েছে যে এতদিনের পুরনো রীতি ভেঙ্গে এই সময়ে চা বাগানে জলসেচের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কিন্তু সেখানেও বাধা, বাগান সংলগ্ন নদীগুলিতে জলস্তর এতটা নেমে গিয়েছে যে সেখান থেকে সেচের জল মিলছে না।
একদিকে অস্বাভাবিক উষ্ণতা, অন্যদিকে দিন ও রাতের তাপমাত্রার বিশাল ফারাক। কখনও রাতের দিকে বৃষ্টি, কখনও দিনের বেলা আকাশ মেঘলা থাকছে। ফলত চায়ের পাতায় নানান পোকার আক্রমণ বেড়েছে, নিয়ন্ত্রিত পেস্টিসাইড স্প্রে করে যা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। অতিরিক্ত জীবানুনাশকের ব্যবহার আবার চা পাতার গুণমানের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায়। আবার টানা কিছুদিন বৃষ্টি না হওয়ার ফলে চায়ের পাতা হলুদ হয়ে খসে পড়ছে। খবরে প্রকাশ, সেকেন্ড ফ্লাশ চায়ের দাম এবার গত পাঁচ বছরের মধ্যে ছিল সর্বনিম্ন, গতবারের দামের তুলনায় অর্ধেক কিংবা তার চেয়েও কম।
আবহাওয়ার একইরকম বিরূপ চিত্র দেখা গিয়েছে প্রতিবেশি আসামের চা বাগানেও। এই মরসুমে চা বাগানে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয় তার অর্ধেকও এবার হয়নি। তার উপর সূর্যের প্রখর তাপে চায়ের পাতাগুলি বাড়বার সুযোগ পায়নি। একেই স্থবির হয়ে থাকা মার্কেট, উচ্চ উৎপাদন ব্যয় ইত্যাদি সমস্যায় ভুগছে আসামের চা, তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসেবে জলবায়ুর প্রতিকূলতা আসামের চা উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে সন্দেহ নেই। একই ছবি ত্রিপুরার চা উৎপাদনেও। স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে উৎপাদন বাঁচাতে বাধ্য হয়ে অসময়ে ব্যয়বহুল জলসেচের বন্দোবস্ত করতে হয়েছে বাগান কর্তৃপক্ষকে। বাগানে জলসেচ ও সার প্রয়োগের ক্ষেত্রে আরও প্রযুক্তিনির্ভরতার উপরে জোর দিচ্ছেন আসাম-ত্রিপুরার চা-বাগানীরা। এ নিয়ে নর্থ ইস্ট টি অ্যাসোসিয়েশন-এর পক্ষ থেকে কর্মশালারও আয়োজন করা হয়েছে।
এমনিতেই দেশের ৮০ শতাংশ চা উৎপাদনকারী উত্তরবঙ্গ ও উত্তরপূর্ব ভারতের চা শিল্প আজ নানান সংকটে জেরবার। গত মে মাসেই আচমকা তালা পড়েছে ডুয়ার্সের এক চা বাগানে, গত জানুয়ারিতে বন্ধ হয়ে গিয়েছে ত্রিপুরার সবচেয়ে বড় চা বাগান। কিছুদিন আগেই দৈনিক কাগজে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, দার্জিলিং-এর অর্ধেক চা বাগানের মালিকই নাকি বাগান বিক্রি করে দিতে ইচ্ছুক। কারণ ইওরোপের বাজারে মন্দা। পাহাড়ে দীর্ঘদিনের অশান্তি এবং তারপরে কোভিডের ফলে রপ্তানি ব্যাহত হওয়ার ফলে জাপানও আর দার্জিলিং চা কিনছে না। পাহাড়ী নান্দনিক সেই সব বাগানের উপর নজর পড়েছে রিয়াল এস্টেট কারবারিদের। আগামী দিনে চা বাগানগুলির মধ্যে এক সে বড়কর এক কোটি কোটি টাকার বিলাস আবাসন গড়ে উঠবে। যা চা শিল্প তো বটেই, উত্তরের পরিবেশের জন্যও এক অশনি সংকেত।
রপ্তানিতে ঝাড় খাচ্ছে তরাই-ডুয়ার্স-আসামের চা-ও। মিডল ইস্ট তথা আরব দুনিয়া নাকি এখন ভারতীয় চা ছেড়ে শ্রীলংকা-কিনিয়ার চা বেশি কিনছে, ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো দাম পাচ্ছে না উত্তরবঙ্গের এবং উত্তরপূর্বের চা। এর উপর আছে শ্রমিক সমস্যা, বন্যা-ভূমিক্ষয়ের মত প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এসবের উপর, যুগ যুগ ধরে চলে আসা জলবায়ুতে অভ্যস্ত চা চাষ আজ প্রকৃতির খামখেয়ালি আচরণে বিধ্বস্ত, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নিতে অপারগ। কেবল তাই নয়, অনভ্যস্ত চড়া রোদে পাতা তুলতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে চা-শ্রমিকরাও, যার ফলে যথেষ্ট ব্যাহত হয়েছে উৎপাদন। চা উৎপাদক-গবেষক-বিজ্ঞানীদের সামনে খাড়া করে দিয়েছে এক নতুন চ্যালেঞ্জ, তাঁদের আজ খুঁজে বার করতেই হবে স্থানীয় জলবায়ুর নতুন এই আচরণের সঙ্গে উপযুক্ত প্রজাতির চা পাতা। আর ব্যবসায়ীদের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ ভারতীয় চায়ের নতুন বাজার তৈরি করবার।
চা অ্যাসোসিয়েশন চাইছেন এই সংকটের সময়ে সরকার এগিয়ে আসুক, খানিকটা আর্থিক সাহায্য দিয়ে রক্ষা করুক সাময়িক বিপর্যয়কে। যেমন কোভিডের সময় আসামের সরকার রাজ্যের ৩৭০টি চা বাগানকে আর্থিক সাহায্য দিয়েছিলেন ৬৪ কোটি টাকা। আসাম চায়ের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সে রাজ্যে সরকার সেখানে সিটিসি চায়ের বদলে অর্থোডক্স চা উৎপাদনের উপর জোর দিয়েছেন এবং অর্থোডক্স উৎপাদন ইউনিট তৈরির জন্য লোনের উপর ২৫% সাবসিডির কথাও ঘোষণা করেছেন। কারণ অর্থোডক্স চায়ের বাজার দাম, বাজার এবং চাহিদা তুলনায় অনেকটা বেশি। আসামে চায়ের উচ্চ উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে যুঝতে এটিকে একটি বড় সরকারি পদক্ষেপ বলা যায়। উত্তরবঙ্গ এবং উত্তরপূর্ব মিলিয়ে পনের লক্ষ বা তারও বেশি শ্রমিকের পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে চা শিল্প থেকে। নানা প্রতিকূলতায় জর্জরিত এই শিল্পকে আগামী প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখবার দায় কার? বিঘ্নিত পরিবেশ কিন্তু আজ সেই প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে।
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team