এদেশে রেলপথের আবির্ভাব হয় ব্রিটিশদের হাত ধরে। সাম্রাজ্য বিস্তার তথা সাম্রাজ্য রক্ষা এবং ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য ব্রিটিশরা এদেশের রেলপথ চালু করলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তা ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার অংশ হয়ে ওঠে। ভারতের পরিবহন ব্যবস্থায় বিপ্লব নিয়ে আসে রেলপথ। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের ফলে যে যান্ত্রিক সভ্যতার উন্মেষ ঘটে তার প্রথম সার্বিক প্রভাব ভারতে আসে রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে। অচিরেই ভারতে জালের মতো রেলপথ নির্মাণ হয়। রেলপথের প্রতিটি সেকশনে লুকিয়ে রয়েছে অজস্র ইতিহাস, চিত্তাকর্ষক কাহিনি। ভাবতে অবাক লাগে, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্যের পীঠস্থান বাংলা হলেও বাংলা ভাষায় রেলের ইতিহাস ও কাহিনি নিয়ে বইয়ের সংখ্যা খুব একটা বেশি নেই। লেখক এই অভাবটিকে চিহ্নিত করে নিজের মেধা অধ্যবসায়কে কাজে লাগিয়ে অসাধারণ এই বইটি লিখেছেন। এই বইটি পড়লেই বোঝা যায়, ওই সময় রেলপথ স্থাপন জনমানসে কতটা উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল।
শুধু রেল নয়, এই বইটি পড়লে উত্তরবঙ্গের বৈচিত্র্যময় লোকসংস্কৃতির একটা সুন্দর ধারণা পাওয়া যায়। পলাশীর যুদ্ধকে ভারতের ইতিহাসে আধুনিক যুগের সূচনা মনে করা হলেও, জল-জঙ্গল-চা বাগান ঘেরা উত্তরবঙ্গ প্রকৃত অর্থেই রেলপথের মাধ্যমে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছিল। প্রকৃতি, পরিবেশ, লোকসংস্কৃতির মতোই উত্তরবঙ্গের রেলওয়ে ছিল বৈচিত্র্যে ভরা। মিটারগেজ, ব্রডগেজ, ন্যারোগেজ তিন ধরনের গেজের সমাহার ছিল উত্তরবঙ্গে। বর্তমানে কালিম্পং জেলা বাদে উত্তরের সব জেলাতেই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে এবং কালিম্পংও খুব শীঘ্রই রেল মানচিত্রের স্থান পেতে চলেছে। ভারতে রেলপথ স্থাপন হওয়ার পর বিভিন্ন জায়গায় রেল কেন্দ্রিক শহর গড়ে উঠেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আদ্রা, খড়গপুর, লামডিং, মুঘলসরাই ইত্যাদি। অনুরূপভাবে উত্তরবঙ্গেও এরকম কয়েকটি জনপদ করে উঠেছিল। যেমন দোমোহানি, নিউ জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার জংশন ইত্যাদি। জনপদগুলি গড়ে ওঠার কথা এই বইতে আছে।
তবে উত্তরবঙ্গে রেলপথ কেন্দ্রিক যে বিরাট বিরাট আন্দোলন হয়েছিল সেটাকে আরেকটু বেশি ছুঁয়ে যেতে পারলে ভালো হতো বলেই মনে হয়। যেমন একলাখী বালুরঘাট প্রকল্প নিয়ে কী বিরাট আন্দোলন হয়েছিল। বর্তমানে বালুরঘাট-হিলি রেলপথ স্থাপনের জন্য আন্দোলন চলছে। এমনিতেই আমরা জানি দেশের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোর তালিকায় উত্তরবঙ্গ ওপরের দিকেই থাকবে। সেই অঞ্চলে রেল ব্যবস্থা নিয়ে এরকম সুন্দর প্রাঞ্জল ভাষায় বই আরো আছে বলে আমার জানা নেই। সময় সময় আমরা পেয়েছি বিভিন্ন নদনদীর কথা, জঙ্গলের কথা, বন্যপ্রাণের কথা, বিপন্ন প্রাণীর কথা, চা বাগানের কথা, আদিবাসীদের কথা, পাহাড়ের কথা ইত্যাদি। আমরা এই বইতেই পেয়েছি কীভাবে প্রতিদিন ট্রেনের আগমন জনপদগুলোতে প্রাণের সঞ্চার করত। আমরা এই বইতেই পেয়েছি উত্তরবঙ্গে বর্তমানে রেল কেন্দ্রিক বিভিন্ন দাবিদাওয়ার কথা। খুবই দুর্ভাগ্য যে বাংলার একটা বিরাট অংশের মানুষ 'উত্তরবঙ্গ' বলতে শুধুই বোঝেন দার্জিলিং, শিলিগুড়ি, ফজলি আম এবং কিছুটা কোচবিহার রাজবাড়ি। অথচ এর বাইরে যে উত্তরবঙ্গের বিরাট আখ্যান রয়েছে, সেটা আমরা অনেকেই বুঝতে চেষ্টা করি না। আশার কথা সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলকে চেনাজানার চেষ্টা শুরু হয়েছে। সেইসব অনুসন্ধিৎসু মানুষের কাছে দরকারি বই হতে পারে এটি।
যদিও এটি বাংলার উত্তরাঞ্চলের রেল ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে। কিন্তু বইটি পাঠ করলে বোঝা যায় উত্তরাংশ ছাড়াও বাংলার বিভিন্ন অংশের রেলের ইতিহাসকে ক্ষণে ক্ষণে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে। ভ্রমণপ্রিয়, ইতিহাসপ্রেমী, রেলপ্রেমী, লোকসংস্কৃতির অন্বেষণকারী ইত্যাদি সকল শ্রেণীর মানুষকে আকর্ষণ করার পর্যাপ্ত রসদ রয়েছে এই বইটিতে।
পরিশেষে বলতে পারি, প্রকাশক অনেক যত্ন করে বইটিকে বাজারে এনেছেন। যেমন প্রচ্ছদ তেমনই সুন্দর ছাপা। কাগজও যথেষ্ট উন্নত। প্রকাশক 'এখন ডুয়ার্স' উত্তরবঙ্গের অন্যতম অগ্রণী প্রকাশক হিসেবে উঠে এসেছেন এবং তারা সম্প্রতি বেশ কিছু ভালো বইও প্রকাশ করেছেন। সেই ভালো বইয়ের লিস্টে অবশ্যই আলোচিত বইটির স্থান প্রথম দিকেই হওয়া উচিত বলে মনে করি। আমি বিশ্বাস করি, উত্তরবঙ্গের প্রতি আগ্রহী প্রত্যেক মানুষের এই বইটি পড়া উচিত। সব মিলিয়ে এমন একটি সুন্দর বইয়ের উপস্থাপনা আগামী প্রজন্মের জন্য একটি দলিল হয়ে থাকবে।
উত্তরবঙ্গের রেল ইতিবৃত্ত
অভিজিৎ দাশ
প্রকাশক এখন ডুয়ার্স
দাম ৩৯০টাকা
https://dooarsbooks.com/uttarbanger-rail-itibritta/
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team