আমি তো ঠিক অভিযাত্রী নই। যাত্রী। মানে যেতে ভালোবাসি কিন্তু অভি (ভয়হীন) হয়ে অভিযানে যাবার জোর নেই। স্বাভাবিক ভাবেই দশ মাস জনজোয়ারে থাকতে হয়। তাই ছুটিতে নির্জনতা ভালো লাগে। আর নির্জন রাস্তায় যাত্রার সেরা উপায় পায়ে হাঁটা। আমি ততটুকুই ট্রেকিং করি। প্রথম হাঁটার মজা পেয়েছিলাম সান্দাকফুর পথে। তবে এখন সে রাস্তায় গিজগিজে ভীড়।
তাই সন্দীপদা বলল, চল তবে চিন্তাফু যাই।
সে কোথায়?
সান্দাকফুর উল্টোদিকে। ওরই ছোট বোন। ৩৩ মিটার মাত্র ছোট।
ভাবলাম নির্ঘাৎ মজা করছে। পরে দেখলাম না; নেপালের প্রত্যন্তে প্রায় সাড়ে এগারো হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত বন্যপ্রাণীদের আপনঘর বলা যায় চিন্তাফুকে। গুগল বলে এখানে লাল পান্ডা আর আদিজীব ডাইনোসর গোষ্ঠীর স্যালামেণ্ডার দেখতে পাওয়া যায়। আর এখানে প্রায় ২০০ রকম পাখিও আছে।কিন্তু এ পাহাড়িয়া পথে হাঁটতে এতই ভাল লাগে ক্যামেরাও স্তব্ধ হয়ে যায়। আর এমন শান্ত গভীর পথ, যে পথে ক্যামেরার খিচিক শব্দও বড্ড বাচালতা মনে হয়। এই আদর্শ স্তব্ধতার গান শোনার স্থান।
নেপালের ইলাম থেকে মাইপোখরি হয়ে আমাদের গন্তব্য ছিল নেপালের প্রায় সীমান্ত গ্রাম গোরেওলেগঞ্জ। বানান আর উচ্চারনে সে নামের এতো বৈচিত্র্য। ততটাই বিচিত্র তার ফুল আর অনন্য তার যাপনচিত্র।
এখান থেকে ডাইনে গেলে সান্দাকফু, বামে চিন্তাফু। যত পাহাড়ি গ্রাম দেখেছি; তোমার তুলনা আমি খুঁজি না কখনো। রোমান্টিক বাঙালি মনের মতো সে সব সময়েই মেঘাবরনে আধচেনা দূতী। দূর থেকে বোঝাই যায় না তাকে গ্রাম বলে। কাছে গিয়েও জিজ্ঞেস করতে হয়,তুমিই কি সেই? তুমিই কি সেই মেঘবালিকা?
খান দশেক এলোমেলো ফুটকির মতো বাড়ি। দুই ঢালের মাঝে জলের পথের ধারে ধারে। যেন স্রোতের মুখে আটকে যাওয়া খড়কুটো। বাসিন্দা বলতে বড়জোর ৩০/৩৫ জন মানুষ, গোটা কুড়ি মোরগ মুরগী ও ছানাদল, খান সাতেক পাহাড়ী কুকুর আর কিছু পোষা শুয়োর। আমাদের মতো পাঁচজনের অতিথি দলও বোধহয় সচরাচর আসে না।
তবে মানব সম্পদ কম বলেই হয়তো প্রকৃতি এতো অপরিমেয়। লাজে রাঙা উনবিংশ শতাব্দীর কনে বউ যেন। শিখায় শিখায় উদ্ধত যত রডোডেনড্রন গুচ্ছ; ঠিক ততটাই চলতে পথে গড়িয়ে আছে গুরাস ফুলের গুচ্ছ। ফুলের আগুন যাকে বলে। মেঘের চাদর সরিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে পৌঁছে গেলাম আমাদের প্রতীক্ষায় থাকা সেই কাঠের বাড়িতে।
হুড়কোবিহীন ঘরে রাত কাটানো আর মাঝরাতে তুমুল বৃষ্টিতে দরজা খুলে জলের সেই ভয়ংকর ঝাপটা আমায় হড়কা বান এর স্মৃতি উস্কে দিয়েছিল। অথচ পরদিন সকাল হতেই ঝলমলে আকাশ।
এভারেস্ট দেখার প্রবল ইচ্ছে নিয়ে হাঁটা শুরু করেছিলাম বটে ,কিন্তু বাধ সাধল আবহাওয়া। রোদ্দুর উঠলেও কুয়াশার ঘনঘটা রয়েই গেল। যদিও আমাদের হতাশ মনকে চাঙা করে দিয়েছিল নানা জানা-অজানা ফুলে ভরা পথ।যত এগোচ্ছি তত নতুন নতুন ভাবে সামনে আসছিল তারা। শ্যাওলা পড়া গাছের গায়ে রোদ্দুর পড়ে এক অদ্ভুত মায়াবি করে তুলেছিল পথটাকে। অনেকটা হাঁটার পর পেলাম একটা বুগিয়াল। সে যে কী অপূর্ব সবুজ বলে বোঝানো কঠিন। বুগিয়ালের ঢালে গড়াগড়ি, বিশ্রাম হলে আবার পথ চলা শুরু। যত এগোচ্ছি তত পথ সরু হচ্ছিল। রডোড্রেনড্রন ফুলের সাথে প্রবল হয়ে উঠল বেশ বড় সাদা একধরনের ফুল, দেখতে অনেকটা রুদ্রপলাশের মত। সমগ্র উপত্যকায় যেন রঙিন আবির গুলালের মহোৎসব। এভারেস্ট সেদিন দেখা দেয়নি আমাদের। কিন্তু তার জায়গা পূরণ করেছে পথ ও ফুল। সেই প্রথম বুঝেছিলাম আমি চিরপথিক। পথ শেষের গন্তব্য খুব বড় কথা নয়। আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ।
ক্রমাগত লক্ষ্যে পৌঁছাতে যায় যে নাগরিক জীবন, নানা ভাবে সাফল্যের শীর্ষকে ছুঁতে চায় যে দর্শন সেই সব অগ্রগতির ভাবনায় এমন বেড়ানো ক্ষ্যাপামো। কিন্তু নিত্য নিয়মিত যান্ত্রিক জীবনে এই অকারন ক্ষ্যাপামিকে বাঁচিয়ে রাখাতেই আনন্দ। আর কে না জানে আনন্দই সকল মোক্ষের সার।
এ পথে সবান্ধবে/সদলবলে যেতে গেলে যোগাযোগ করতে পারেন সুমন্ত জানাকে ৮২৫০২২০৩৭৩
Have an account?
Login with your personal info to keep reading premium contents
You don't have an account?
Enter your personal details and start your reading journey with us
Design & Developed by: WikiIND
Maintained by: Ekhon Dooars Team